জওহরলাল নেহরু এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নন। চীনকে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার— শুধু ভারতে নয়, গোটা পৃথিবীতেই তোমাদের প্রেমিকরা প্রায় নিশ্চিহ্ন। এ ভারত অন্য ভারত। এ ভারত নয়া ভারত। এ ভারতে পা রাখলে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি রক্ত ঝরবে তোমাদের।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় জমিদার গরিব প্রজা উপেনের জমি ‘মিথ্যা দেনার দায়ে ডিক্রি জারি করে কেড়ে নিয়েছিলেন। সেটা ছিল সেকালের বাস্তব পটভূমির সাহিত্যচিত্র।
অনেক পরে ভূমিসংস্কারের নামে যুক্তফ্রন্টের আমলে জমিদারদের জমি কেড়ে নেওয়া শুরু হয়েছিল। অনেক জমিদার জোতদারের মুণ্ডু কাটা গিয়েছিল নকশাল আমলেও।
আরও পরে বামফ্রন্টের মধ্যগগণে এই পশ্চিমবঙ্গেই শুরু হয়েছিল সিন্ডিকেট রাজ। জমি আপনার। আপনার কেনা জমিতে আপনাকেই দখল দেবেন নেতারা। পয়সার বিনিময়ে। তারপর যখন আপনি সেই জমিতেই মাথা গোঁজার ঠাই গড়তে চাইবেন, তখনও সিন্ডিকেট বলে দেবে ইট, বালি, পাথর, সিমেন্ট গুণগতমানে কম, দামে বেশি হলেও তাদের কাছ থেকেই নিতে হবে।
তৃণমূল আমলে সেই সিন্ডিকেট রাজ চলে গেল শিল্পের পর্যায়ে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে কোতল করার অস্ত্রটা তো বহাল রইলই। এবার কোটা শুরু হলো বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের নয়া উদ্যোগে। কারণ সেখানে সিন্ডিকেট কামাতে পারছে এক লপ্তে মোটা দাও। ফলে বহু শিল্পপতিই পাততাড়ি গোটালেন এই রাজ্য থেকে। এসবই ওই দুই বিঘা জমি’-রই আধুনিক সংস্করণ। উপেনের রাজাও ছিলেন জমিচোর। এ যুগের রাজনীতিবিদরাও জমিচোর এবং তা ঘটে চলেছে অবাধে, প্রকাশ্য দিবালোকে।
পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে জমি চোরদের এইসব ক্ষুদ্র সংস্করণেরই বৃহত্তর। সংস্করণ চীন। যুক্তফ্রন্ট, বামফ্রন্ট, তৃণমূলিদের কারবার দু-চার বিঘা নিয়ে। আর ১৬০ কোটি পীতবাসীর দেশ চীন হলো সেরার সেরা জমিচোর। ভারতের বিস্তীর্ণ চীন সীমান্তে তারা সেই ১৯৫০-৫১ সাল থেকেই চুরি করে চলেছে। লক্ষ লক্ষ একর জমি এবং সিংহভাগই ভারতের। কিছুটা নেপাল বা ভুটানেরও। এবং সবটাই গায়ের জোরে। বহু আগেই ১৯৫০ সালে চীন
গায়ের জোরে, রাজনৈতিক কৌশলে এবং নির্মম অত্যাচারের নজির রেখে দখল করে নিয়েছিল গোটা তিব্বতকেই। আর এখন নজর নেপাল, ভুটান ও ভারত। তাই ভারত স্বাধীন হবার পর থেকেই তাদের পাখির চোখ ভারত, যে ভারত কেতারা চীনা উপনিবেশ বানাতে চায়। মূল লক্ষ্য গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জমিদারির পত্তন করা এবং ভারতের মতো ভূমিখণ্ডের বিশাল মানবশক্তিকে অমানবিক পাশবিকতার শিকার করে তুলে ভারতবর্ষের যে বিশাল খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ তা দখল করে বিশ্ববাজারের মালিক হয়ে বসা।
এ পরিকল্পনা নতুন কিছু নয়। ১৯৪৬ সাল থেকে চীনা কমিউনিস্ট রেভেলিউশনের নামে গৃহযুদ্ধের বীভৎসতার মাধ্যমে ১৯৫০ সালে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না প্রতিষ্ঠার পর থেকে চীনের শ্যেনচক্ষু পড়েছিল ভারতবর্ষের ওপর যার পরিণতি ১৯৬২ সালের চীনের অতর্কিত ভারত আক্রমণ এবং আকসাই চীন-সহ লাদাখের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাকিস্তানের কাছ থেকে উপটৌকন হিসেবে দখল করে নেওয়া। যা আদতে পাকিস্তানও দখল করেছিল গায়ের জোরেই। কাশ্মীর থেকে নির্বাসিত ইউনাইটেড কাশ্মীর পিপলস ন্যাশনাল পার্টির নেতা সর্দার সৌকত আলি কাশ্মীরিইউরোপে বসে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন– “…The current standoff and escalating tension between Indian and chinese troops in Eastern Ladak at the line of Actual Control is very sencitive and dangerous to peace and security in the region.”
আজ সেটাই হচ্ছে। সিকিম, অরুণাচল, কাশ্মীর, উত্তরাখণ্ড এমনকী নেপাল এবং ভুটানের বহু চীন লাগোয়া সীমান্ত অঞ্চল জুড়ে আন্তর্জাতিকমানের সন্ত্রাস চালাচ্ছে চীন। ভারত ও চীনের ৪০৫৬ কিলোমিটার সীমান্ত অঞ্চলকে চীন তাদের অধিকারে বলে দাবি তুলেছিল। ১৯৬২-র যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক স্তরের সমঝোতার মাধ্যমে তা ২০০০ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। কিন্তু আগ্রাসন বন্ধ হয়নি।
প্রশ্ন উঠেছে, যদি ১৯৫০ সাল থেকেই চীনা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে থাকে এবং মাইলের পর মাইল ভারতীয় জমি চীন চুরি করে নেয় তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রতিরক্ষা দপ্তর। কী করছিল? সঠিক প্রশ্ন। উত্তর হিসেবে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল, কেন্দ্রে তখন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার। পূর্ব লাদাখ সীমান্তে চীনা অনুপ্রবেশ চলছে ঘন ঘন। মাইলের পর মাইল দখল হয়ে যাচ্ছে। চার বছরেই দখল ৬৪০ বর্গ কিলোমিটার। নজরেই ছিল না কারও। ২০১৩ সালে ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব এবং তৎকালীন ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসরি বোর্ডের চেয়ারম্যান শ্যামসরণ বিষয়টি জানতে পেরে কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা দপ্তরের নজরে আনেন। তখনই। খোঁজখবর শুরু হয়ে যায়। জানা যায়, ওই সময়ের মধ্যে চীন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ৬০০ বার অনুপ্রবেশ করেছে। সংঘাত হয়েছে কিনা বা কত সেনার মৃত্যু হয়েছে তা কোনোদিনই 21PICY OTICA I (Ref. Kashmir Observer May, 28, 2020)
প্রশ্নটা এখানেই—জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে মনমোহন সিংহ, সোনিয়া গান্ধী, রাহুল। গান্ধীরা অবাধে চীনকে ভারতীয় ভূখণ্ড উপটৌকন দিয়ে চলেছেন। আকসাই চীন থেকে পূর্ব লাদাখের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। শুধু লাদাখ নয়, সিকিমের ডোকোলাম, লে-র দেসোচোক, সুমার, হিমাচল প্রদেশের কিন্নৌর অঞ্চলের কাউরিক, শিপকিলা, নেলাং, জুলম সুন্দা, উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীর জাদং ও লাপথাল, যামোলির বারাহাতি, অরুণাচলের তাওয়াং, সিয়াচেনের বিভিন্ন অঞ্চল, (নেপালের কালাপানি ও সুস্থা) সর্বত্রই চীনা আগ্রাসনের প্রমাণ রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এমনকী সবসময় আক্রমণ না করলেও ভারতে অনুপ্রবেশ করে ভারতীয়দের অসম্মান করে যায়। গাছের ফলপাকুড়নষ্ট করে যায়। কিন্তু কংগ্রেসি জমানায় এসব আটকানোর কোনো প্রচেষ্টাই করা হয়নি। কংগ্রেস বরবাবর বলে এসেছে, পঞ্চশীল চুক্তি অনুযায়ী ভারত চীনকে আক্রমণ করতে পারে । অথচ একবারও কংগ্রেসকে বলতে শোনা যায়নি, পঞ্চশীল চুক্তি মেনে চলার দায় ছিল চীনেরও। তারা সেই চুক্তি ভেঙেই ১৯৬২-তে ভারত আক্রমণ করেছে। চুক্তি ভেঙেই তারা বারবার ভারতে অনুপ্রবেশ করছে।
ভারতের মাটিতে একটা আ-স্বাধীনতা সমস্যা আছে। তা হলো, ভারত-চীন সংঘাত প্রসঙ্গে ভারতের মাটিতে চীনের গুপ্ত এবং ব্যাপ্ত চরের রমরমা। তাই কেন্দ্রে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী শাসিত এনডিএ সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই গুপ্ত এবং ব্যাপ্ত চরেরা চীনের অনুপ্রবেশের প্রসঙ্গ উঠলেই রে রে করে ওঠেন। কারণ বিজেপি পরিচালিত সরকার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরই চীনকে আটকে রাখার চেষ্টা শুরু হয়েছে তাঁদের নিজেদের সীমার মধ্যে। বাজপেয়ী সরকার পাক-অনুপ্রবেশ রুখতে গিয়েই কার্গিল সীমান্তে যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছিল। এবারও চীনকে রুখতে গিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে লাদাখ সীমান্তে। চীনের প্রতি দরদি মানুষগুলোর এতে কী লাভ? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর— এই চীনপ্রেমীরা তাদের দেশমাতার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে প্রস্তুত, কিন্তু চীনের সঙ্গে নয়। কারণ সেখানে দেওয়া-নেওয়া সম্পর্ক আছে। একেবারে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সৃষ্টি হওয়ার সময় থেকেই। পরে সিপিআই ভেঙে সিপিআইএমের জন্মের পিছনেও আছে সেই দেওয়া-নেওয়ার ইতিহাস। তাই তো ২০১৫ সালের ২০ অক্টোবর বেজিং-এ ভারতীয় সিপিআই(এম) নেতা, (বর্তমান দলীয় সাধারণ সম্পাদক) সীতারাম ইয়েচুরি চীনে গিয়ে দেখা করেছিলেন চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এবং উপরাষ্ট্রপতি লিইউয়ানচাও-এর সঙ্গে। হাসিমুখে করমর্দন করেছিলেন। তখন চীনা রাষ্ট্রপতি সীতারাম ইয়েচুরিকে বলেছিলেন- “Communist Party of China (CPC) highly valued its relations with the CPI(M). CPI(M) is a strong votary for driving the relationship between China and India, including people-to-people ties.” opefte sallata স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন ভারতের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যম সিপিআই(এম)। আর সেই বাধ্যবাধকতার কথা মনে রেখেই বোধহয় সীতারাম ইয়েচুরি এবার গত ১৯ জুন মন্তব্য করেছেন, “ভারতের উচিত পঞ্চশীল চুক্তি মেনে চলা।” কিন্তু একবারের জন্যও বলেননি, চীন ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত পঞ্চশীল চুক্তি অবিরামভাবে ভেঙে চলেছে চীনই। ১৯৬২সালে অতর্কিত ভারত আক্রমণ তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। তারা চান না, মোদী চীনকে আটকান। কারণ তাতে তাদের ক্ষতি। আর্থিক এবং রাজনৈতিক দুদিক থেকেই।
আর এই চীনপ্রেমীরাই চিৎকার করে গগন। ফাটাচ্ছেন মোদীকে টার্গেট করে। মোদী নাকি ভারতীয় সৈন্যদের আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিচ্ছেন। কতদূর সত্যি এই অভিযোগ?
বালখিল্য এই অভিযোগের জবাব দেওয়াটা আর এক দফা বালখিল্যতা। কিন্তু না দিয়ে উপায় নেই। চীনপ্রেমীরা চাইতেন পারেন—ভারত হয়ে উঠুক চীনা উপনিবেশ। কিন্তু আপামর ভারতবাসী দেশপ্রেমে বিশ্বাসী। জাতীয়তাবাদ বিশ্বাসী। এক দেশ এক নিশান এক নেতায় বিশ্বাসী। চীনাপ্রেমীরা যত বেশি মোদীজীকে দেশের শত্রু বানাতে চাইবে—মানুষ তত বেশি করেই তার চীন বিরোধী পদক্ষেপকে স্বাগত জানাবে। কারণ চীনাপ্রেমীদের মতো কোনও ভারতীয়ই এমনকী সেনাবাহিনীর যেসব অকুতোভয় যুবক সেনারা চীন সীমান্তে লড়াই করে দেশরক্ষা করেছেন তারাও চাইবেন না, ভারতের মাটিতে পা রাখুক চীন। পা রাখলে সংঘাত হবে। সংঘাতে কখনও কখনও দু’ পক্ষেরই প্রাণ যাবে। যুদ্ধের, সংঘাতের নিয়মই তাই। চীনপ্রেমীরা যদি মনে করেন, চীনাদের। আদর করে ডেকে আনবেন ভারতবাসী তাহলে ভুল করবেন। বরং তাদেরই ভাবতে হবে, চীন তাদের আশ্রয় দেবে কিনা। কারণ গুপ্তচর এবং ব্যাপ্তচরদের বেশিদিন ভারতের মাটিতে রাখা যাবেনা। স্বাধীনতার আগে থেকেই ভারতবাসীর একাংশই ভারতের সর্বনাশ করে এসেছে। আজও সেই চেষ্টা অব্যাহত।
এই মুহূর্তে বহু ভারতবাসী আবেগের বশে চীনাদ্রব্য বয়কটের ডাক দিচ্ছেন। উদ্যোগকে স্বাগত। কিন্তু মনে রাখতে হবে— গোটা পৃথিবীই ঢেকে গেছে চীনা উৎপাদনে। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় এমন অনেক জিনিসের জন্যই অন্যান্য দেশের মতোই ভারতের মানুষও চীনের ওপর নির্ভরশীল।বিশ্বায়নের যুগে কোনো দেশই কোনো দেশকে বয়কট করে চলতে পারে না। যতদিন না ভারতবর্ষ স্বনির্ভর হয়ে উঠছে। সর্বাংশে, ততদিন বয়কটের প্রশ্নটা তুলে রাখাই ভালো। তবে যেসব জিনিস বয়কট করা সম্ভব যেমন খেলনা, জামা-কাপড়, জুতো, ছোটোখাটো দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস— সেগুলো বয়কট করাটাই কাম্য । কারণ সেগুলোর বিকল্পের অভাব নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন—একটা ভালো মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে হলে আপনি কী চীনকে বয়কট করে চলতে পারবেন ? কারণ ‘অ্যান্ড্রয়েড টেকনোলজিটাই চীনের। আর তাছাড়া ভারতে চীনের অনুপ্রবেশ একটা রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত বিষয়। সেটার ওপরেই জোর দিয়ে চীনকে উদ্দেশ্য করে আমাদের সংগঠিত হওয়া দরকার। চীনকে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার— এটা ১৯৬২ সাল নয়।
চীনকে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, জওহরলাল নেহরু এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নন। চীনকে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার শুধু ভারতে নয়, গোটা পৃথিবীতেই তোমাদের প্রেমিকরা প্রায় নিশ্চিহ্ন। এ ভারত অন্য ভারত। এ ভারত নয়া ভারত। এ ভারতে পা রাখলে আমাদের চেয়ে hঅনেক বেশি রক্ত ঝরবে তোমাদের।
সুজিত রায়