আজ ( ২৮ শে জুন ) অধ্যাপক হরিপদ ভারতীর জন্মদিন। তিনি ভারতীয় জনতা পার্টির, পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের প্রথম সভাপতি ছিলেন৷ ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (Dr. Shyamaprasad Mukherjee) প্রতিষ্ঠিত ‘ভারতীয় জনসঙ্ঘ’-এ যোগদান করেছিলেন, তাই পরবর্তীকালে ‘ভারতীয় জনতা পার্টি‘ হল। তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাচ্ছি তাঁরই লেখনি থেকে।

শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, শিরোনাম ‘ শ্যামাপ্রসাদের জীবন দর্শন ‘। অধ্যাপক ভারতী নিজে ছিলেন দর্শনের অধ্যাপক । সেই সুবাদে বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি মানুষেরই একটি মূল জীবন দর্শন থাকে, সকল মানুষ আপন জীবন-দর্শনের আলোয় ব্যাষ্টি ও সমষ্টি জীবনের সকল সমস্যাকে লক্ষ্য করেন। এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সমাধানের প্রয়াস পান। যাঁরা সাধারণ্যের বাইরে অসাধারণত্বে পৌঁছান, তাদের জীবনদর্শনের স্বীকৃতি ইতিহাসে সাক্ষ্য দেয়। তাঁর লেখায় শ্যামাপ্রসাদের দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঝলক পাওয়া যাবে, এই উদ্দেশ্য নিয়েই প্রস্তুত-পোস্ট।

সত্যের জন্য এক আপোষহীন সংগ্রামী হিসাবে শ্যামাপ্রসাদকে তুলে ধরেছেন অধ্যাপক ভারতী। সাক্ষী-বিহীন পথে তাঁর একলা চলা-র প্রেরণা, সূচীভেদ্য অন্ধকারে বুকের পাঁজর জ্বালানো -র দৃষ্টান্ত সকল দেশের সকল কালের দেশপ্রেমিকের কাছে একদিন বরণীয় হবে, তাদেরও যাত্রাপথ আলোকিত করবে এই ছিল ভারতীর মত। তিনি যা যা বলেছেন বিন্দু আকারে তার নির্যাস এমনতর। (KC)

১. শ্যামাপ্রসাদের ব্যক্তিমানস নির্মাণে, তাঁর জীবনদর্শনে উত্তরাধিকার ও পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব অনন্য । তারমধ্যে অবশ্যই আসবে বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখার্জীর মত এক কালজয়ী মহাপুরুষের কথা। পরাধীন দেশের শিক্ষাকাশের যাবতীয় ঝড়ঝাপটা আপন বক্ষে নেবার সাধনা পুত্রের মধ্যেও খানিকটা প্রবাহিত করে দিয়েছেন তিনি। কোমলে কঠোরে, পরোপকারের প্রবৃত্তি পুত্রের মধ্যে বর্তেছে। বর্ষিত হয়েছে পিতার অজস্র আশীর্বাদ। পিতার দৃষ্টিভঙ্গীর অনুসরণ করে শিক্ষা ও সংস্কৃতি-জগতের পরিপুষ্টির ধারাবাহিকতা এলো সেই সূত্রেই। পিতার কার্যসূচীকে বিস্তারিত করলেন পুত্র, মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দিলেন।
২. দেশপ্রেমিকের মাধুর্যের মধ্যে মাতৃভাষার প্রতি মর্যাদাবোধ তাঁর জীবনাদর্শের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দেশপ্রেমের লক্ষণগুলির মধ্যে এক দুর্লভ উদ্ধার। হরিপদ ভারতী লিখছেন, “বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে তাঁর বাংলা ভাষায় ভাষণ প্রদান — উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদকে এক ঐতিহাসিক অসাধারণত্বের অধিকারী করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এ ঘটনা সেই প্রথম, — এবং আজ পর্যন্ত সেই শেষ। ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় শ্যামাপ্রসাদ যা পেরেছিলেন….আজ পর্যন্ত ভারত-শাসিত পশ্চিমবাংলা রাজ্যে কেউ তা পারলেন না। ভাগ্যবিধাতার এত বড় বিদ্রূপের দৃষ্টান্ত আর বোধকরি খুব বেশি মিলবে না।”
৩. শিক্ষা জগতের ইতিহাসে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর বৈশিষ্ট্য আধুনিক তত্ত্বের মর্যাদা পেতে পারে। তত্ত্বটি এইরকম — শিক্ষা পরিচালনা কেবলমাত্র একটি নিয়মতন্ত্র নয়, একটি অনমনীয় শাসনব্যবস্থা নয়, একটি হৃদয়হীন কাঠামো মাত্র নয়, একটি বিবিধমুখী পাঠ্যতালিকার সমারোহ নয়। তার মধ্যে মানুষের স্থান সর্বাগ্রে। সকলের দিকে সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টি না দিলে শিক্ষা-ব্যবস্থা সার্থক হয়ে ওঠে না। আপাত গম্ভীরতার মধ্যে এক মাতৃ-হৃদয়ের স্নেহনির্ঝর প্রবাহ তাঁকে এই সত্যে পৌঁছে দিয়েছিল। ছাত্রদরদ, ‘বজ্রাদপি কঠোরানি’, পুলিশের বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে ছাত্রদের আড়াল করা, ছাত্রদের নিয়ে দল না বাঁধানো, তাদের সুকুমার হৃদয়কে নিয়ে রাজনীতি না করার মতো বৈশিষ্ট্য তাঁকে সার্বজনীন শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে।
৪. তাঁর অজস্র নীরব জনসেবা নীরবে তাঁকে প্রণাম করেছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে মানুষের প্রতি তাঁর স্বতস্ফুর্ত ভালোবাসার মধ্যে। দলীয় মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গী যে অতিক্রম করে যাওয়া যায়; মাটি ও মানুষের সেবার জন্য মন্ত্রিত্ব গ্রহণ এবং ত্যাগ করা যায়, এই পক্ষের এক বিরলতম দৃষ্টান্ত তিনি। অকৃপণ সাহায্যের দক্ষিণ হাত যখন প্রসারিত করেন, তখন হিন্দু-মুসলমান দেখতে পান না।
৫. তবুও তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলা হয়। যারা এই অভিধায় তাঁর মতো ব্যক্তিত্বকে ভূষিত করেন, তারা কেবল রাজনীতিই করেন, দেশকে ভালোবাসেন না, মাটি ও মানুষের সেবা করেন না, এদের জাতীয়তা পাশ্চাত্যের ন্যাশনালিজমের বিকৃত অনুকরণ, খাঁটি দেশপ্রেম নয়। শ্যামাপ্রসাদের মত ব্যক্তির জীবনদর্শন উপলব্ধি করা সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের দ্বারা সম্ভব নয়।

আলোচনার শেষে ড. ভারতীয় শ্যামাপ্রসাদের জীবনদর্শন -কে উদার জাতীয়তাবাদ নামে অভিহিত করেছেন। আন্তর্জাতিকতার অনন্ত নভোচারী রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেন নি , প্রধানত দেশের কথাই ভাবতেন এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তা নিয়ে কোনো সঙ্কোচ-বোধ ছিল না; দেশসেবায় আত্মনিয়োগ করতেন; অথচ অন্য দেশ সম্বন্ধে উদাসীন ছিলেন না, বৈরীও ছিলেন না। বাংলা ও বাঙালির প্রতি তাঁর দরদ অপরিসীম ।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী। (Dr. Kalyan Chakraborty)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.