করোনার কারণে সারা বিশ্বের সাথে ভারতের অর্থনীতির গতিও কিছু ধীর লয়ে চলেছে।দীর্ঘদিন ব্যাপী লকডাউন থাকায় শিল্প-কারখানায় উৎপাদন বন্ধ।রপ্তানি বাণিজ্যও বন্ধ।বন্ধ আরও অনেক কিছুই।এরই সমষ্টিগত ফল স্বরূপ অর্থনীতির এই ধীর গতি।যা বর্তমানে ৬ শতাংশের নিচে রয়েছে।চলতি ত্রৈমাসিকে বিষয়টি আরও পরিস্কার ভাবে ফুটে উঠেছে।ভারতীয় অর্থনীতিতে যে সংস্কার ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষ থেকে শুরু হয়েছিল,তা লকডাউনের কারণে ধাক্কা খেল।কোভিডের ক্রান্তিকালে,অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উত্তরণের জন্য চূড়ান্ত “যুদ্ধ” ঘোষণা করেছে ভারত!

দেশের এই মন্দা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী গত ১২ মে কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার এক আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেন।যা দেশের “জিডিপি”-র ১০ শতাংশ।তারপরই দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ এই বিপুল অঙ্কের টাকা বরাদ্দের বিস্তারিত জানান।সংবাদ সম্মেলনে শ্রীমতি সীতারামণ উপকৃতবর্গের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পেশ করেন। করোনার কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতি ধুঁকছে।অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনীতির পট-পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে।এই প্রেক্ষিতকে কাজে লাগিয়ে ভারত নতুন ভাবে জেগে ওঠার সংকল্প গ্রহণ করেছে।দুঃসময়কে সুসময়ে রূপান্তরিত করতে চাইছে।দেশের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার এই সুযোগ ভারত হেলায় হারাবে না।নিপোলিয়ন হিলের একটি বিখ্যাত উক্তি এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়।তিনি বলেছেন,”দুঃসময়ের ছদ্মবেশে সৌভাগ্য আসে”। করোনা অতিমারী দেশে ক্রমবর্ধমান জীবনহানি ঘটাচ্ছে।দাবানল,ঘুর্ণি ঝড়,তেলের খনিতে আগুন লাগা বিপুল ক্ষতি সাধন করেছে।এরই মধ্যে দেশের মধ্যেকার দেশবিরোধীরা করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দেবার সর্ব প্রকার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।প্রতিবেশী দেশ লাগাতর ভাবে ভারতে জঙ্গি অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে।আরেক প্রতিবেশী ভারতের ভূমি দখল করতে এসে কুড়ি জন সেনার প্রাণ নিয়েছে।তাঁরা শহীদ হয়ে বিশ্বে দেশপ্রেমের এক অতুল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।এই সকল কিছুকে পাশ কাটিয়ে ভারত এগিয়ে চলেছে…

বিশ্ব অর্থনীতি-রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা হবে কান্ডারীর।শত্রু-মিত্র সবাইকে পথ দেখাচ্ছে ভারত।দিক-নির্দেশিকা দিচ্ছে করোনা মুক্তির।এবং করোনা-পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর

অনেক অর্থনীতিবিদগণ বলছেন যে,বিপুল অঙ্কের আর্থিক প্যাকেজে “চাহিদা“-র বিষয়ে নজর দেওয়া হয় নি।নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের “সরবরাহ” থাকলেও হাতে নগদ অর্থ না-থাকায় দেশবাসী ক্রয় করতে সমর্থ হবেন কীভাবে।

নোবেল-জয়ী অর্থনীতিক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhijit Banerjee) বা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন বলেছেন প্রান্তীক মানুষদের ব্যাঙ্ক অ‌্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা পাঠানোর কথা।যাঁদের “জনধন” অ‌্যাকাউন্ট আছে,তাঁদের এই ভাবে টাকা দেবার বিষয়ে অভিজিৎবাবুরা মত ব্যক্ত করেছেন।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে যে,”ট্যাক্স রিলিফস‌্” ও “রাজকোষ” সংস্কারের বিষয়ে কী হবে।খরচে সাহায্য করার ব্যাপারেই-বা কী হবে।এ-বিষয়ে একজন অর্থনীতিবিদ বলছেন,” প্রবৃত্তি-ই তাকে গ্রাস করবে”।”একজন প্রান্তীক মানুষকে তাঁর প্রবৃত্তি-ই নিজেকে সঞ্চয় করার প্রেরণা দেবে“–এটা অর্থনীতির প্রাথমিক পাঠেই উল্লেখ আছে।একটাকা ব্যয় করার ইচ্ছা তাকে আরেক টাকা আয় করার জন্য উৎসাহ দেবে।

ভারতে মাত্র ১ কোটি ৪৬ লক্ষ মানুষ কর দেন।দেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের কাছাকাছি।যাঁরা কর দেন,তাঁদের বার্ষিক আয় কমপক্ষে ৫ লক্ষ টাকা হতে হয়।সুতরাং কর ছাড়ের বিষয়টা সঠিক পন্থা নয়।ভয়টা এখানেই যে,গুরু সংখ্যক ভারতবাসীকেই নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাতে হয়।চাহিদা বাড়লেও,ক্রয় ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাওয়া দরকার। এই প্রসঙ্গেই আরেকটি মনে আসা স্বাভাবিক যে,সরবরাহ-শৃঙ্খলের পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পাবে।তাতে অর্থনীতিতে “হোয়াইট মানি” বা কর দাতার সংখ্যা বাড়বে। এই ক্রান্তিকালে একটি শব্দ ধ্বনিত হয়।সেটা হল “রাজকোষের দায়িত্ব”।এই শব্দটাই অর্থনীতিতে “মোদী শাসন প্রণালি” হিসেবে চরিত্রায়িত হয়েছে।কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী চেষ্টা করছেন রাজকোষের ঘাটতি যাতে মোট জিডিপি-র ৩ শতাংশ বা তার নিচেয় রাখতে।”বাজেট ম্যানেজমেন্ট অ‌্যাক্ট-২০০৩” অনুসারে সরকার সেই চেষ্টাই করছে।

উল্লেখ্য যে,রাজকোষের ঘাটতি কমানোর জন্য সরকার ব্যয় সংকোচ করতে পারে।সরাসরি দুর্গতদের অ‌্যাকাউন্টে অর্থ পাঠালে সেটা সরকারের ব্যয়ের খাতায় বিপুল অঙ্কের হবে।এবং রাজকোষে তার প্রভাব তীব্রতর হবে।রাজকোষে বৃহৎ আকারের ঘাটতি পড়া মানেই সার্বভৌমিকতার হিসেবে ভারত অনেক নিচেয় নেমে যাবে।ফলে শিল্পপতিরা ভারতে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না।তাঁদের কাছে এখানে অর্থ বিনিয়োগ মানে আবর্জনায় অর্থ ঢালার সমান।বিনিয়োগ না-এলে সরকারকে উচ্চ সুদের হারে ঋণ নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত : দুর্গতদের অ‌্যাকাউন্টে সরাসরি অর্থ পাঠালে তাঁরা প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয়ে আগ্রহী হবেন।দ্রব্যের চাহিদাও বাড়বে।কিন্তু এটাই চূড়ান্ত সমাধান নয়।তাঁদের নিজস্ব আয়ের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।না হলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
তৃতীয়ত : করোনা-পূর্ব ও করোনা-পরবর্তী সময়কাল বিশ্ব জুড়েই অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেছে।বৈশ্বিক ব্যাপস্থাপনা থেকে সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।যেন এক “অ-বৈশ্বিক” অবস্থা তৈরি হয়েছে।জোগান-শৃঙ্খলটা হঠাৎই নাটকীয় ভাবে পরিবর্তীত হয়ে গিয়েছে।ভারতের অর্থনীতিতে উত্থান-পতন ঘটেছে।সরবরাহ-শৃঙ্খলের সাথেই চাহিদার বৃদ্ধি ঘটাতে হবে।এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সংস্কার নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

: উত্তরণের চারটি স্তম্ভ :

১) মূলধনের জোগান :-
সরকার আগেই এ-ব্যাপারে মোটা অঙ্কের অর্থ অর্থাৎ কুড়ি লক্ষ কোটি টাকা,(যা মোট জিডিপি-র ১০%) ঘোষণা করেছে।এটা কর্মসংস্থান তৈরি করবে।দেশে বেকারত্ব কমাবে।স্থানীয় চাহিদা মেটাবে।অর্থনীতিতে “আত্মনির্ভর” ভারত গঠনে সহায়তা করবে।বিশ্ব-ব্যাতীরেকে,ভারতীয় অর্থনীতি গড়ে তুলবে।

২) দেশীয় উৎপাদন বাড়াবে।ব্যাঙ্কগুলি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে দু লক্ষ কোটি টাকা পর্যন্ত ফান্ড সংগ্রহ করতে পারবে।যা দিয়ে দেশীয় ছোট-মাঝারি শিল্প,ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে ঋণ দিতে পারবে

৩) “আত্মনির্ভর উৎপাদন ও বিশ্বব্যাপী রপ্তানী” :-
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ঘোষণায় এই কথায় বলেছেন।বিদেশের পণ্যের উপর নির্ভরতা কমিয়ে,দেশীয় জিনিস ব্যবহারের অভ্যাস করা।সেই দেশে উৎপাদিত পণ্য বিশ্বজুড়ে রপ্তানী করা।করোনার কারণে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এ-এক দৃঢ় পদক্ষেপ।স্বাধীনতা পরবর্তী কালে এটা একটা ঐতিহাসিক জয়যাত্রা সূচিত হল।চীনের সাথে অনেক দেশই বাণিজ্যিক সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যেই।কেউ কেউ চুকিয়ে দেবার পথে।বিশেষত আমেরিকা-চীন বাণিজ্যিক সখ্যতা তলানিতে।এই সুযোগে ভারতকে বিশ্ব বাজারে ভারতীয় পণ্য বিক্রির সুবর্ণ সুযোগ এসেছে।পাশাপাশি দেশীয় বাজারেও দেশী পণ্যে ভরে তুলতে হবে।

৪) সুসংহত গণবন্টন ব্যাবস্থার মাধ্যমে উপভোক্তাকে খাদ্য শস্য প্রদান ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে।উজ্জ্বলা গ্যাস যোজনার ভর্তুকি,নারীদের আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বীর কথার জন্য সহায়তা দান,কিষাণ ক্রেডিট অ‌্যাকাউন্টে বীমাকৃত ফসলের ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রামীণ মানুষদের প্রভূত সাহায্য করছে।

করোনা বিশ্বকে তছনছ করে দিলেও,ভারত তারই মধ্যে ফিনিক্স পাখির উড়ান শুরু করেছে।দুর্যোগ-দুঃসময়কে সুযোগে পরিবর্তন করে উঠে দাঁড়াচ্ছে।

https://www.hindupost.in/economy/post-covid-19-recovery-a-rare-opportunity-for-bharat/

সুজিত চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.