১৯৭৫ সালের ২৫ শে জুন ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত দিন । এদিন ভারতবর্ষের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সারাদেশব্যাপী জরুরী অবস্থা জারি করেছিলেন যা ২৫ শে জুন ১৯৭৫ থেকে ২১ শে মার্চ ১৯৭৭ পর্যন্ত প্রায় ২১ মাস পর্যন্ত ছিল এক গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে অগণতান্ত্রিক রাজত্বের সময় কাল। ভারতবর্ষের এই অন্ধকারময় অধ্যায়ে ৪২ তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘Secular শব্দ যুক্ত করে ভারতাত্মার উপর সব থেকে সুদূরপ্রসারী ও গভীর আঘাত হানা হয়

জরুরী অবস্থা ও সংবিধান সংশোধন

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর শরণার্থীদের অতিরিক্ত চাপ ও বেকারত্বের ফলে ভারতবর্ষের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির অবনমন হচ্ছিল। ১৯৭৪ সালে গুজরাটে ও পরে বিহারে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চড়া দাম ও কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের দুর্নীতির প্রতিবাদে তৈরি হওয়া ছাত্র আন্দোলন জয়প্রকাশ নারায়ণ এর নেতৃত্বে এক জাতীয় আন্দোলনের রূপ পায়।

১৯৭৪ সালের ১২ ই জুন এলাহাবাদের হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহন লাল সিনহা, ১৯৭১ সালের সংসদীয় নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সরকারী ব্যবস্থার অপপ্রয়োগে অসদুপায় অবলম্বনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন এবং তার নির্বাচনকে বাতিল করে পরবর্তী ছয় বছর তার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন
এ রায়ের বিরুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধী সুপ্রিম কোর্টে গেলে ; ২৪ শে জুন সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টের রায় আংশিক স্থগিতাদেশ দিয়ে লোকসভার কোনো কার্যক্রমে ইন্দিরা গান্ধির অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
জয়প্রকাশ নারায়ণ ১৯৭৫ সালের ২৫ শে জুন দিল্লির রামলীলা ময়দানে র বিশাল রাজনৈতিক সমাবেশে নেতৃত্ব দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর পদত্যাগের জন্য দেশব্যাপী সত্যাগ্রহ ঘোষণা করেন। রেলওয়ের কর্মীরাও জর্জ ফার্নান্দেসের নেতৃত্বে দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন।

                         দেশের 'অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা'র অজুহাতে ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ ১৯৭৫ সালের ২৫ শে জুন মধ্যরাতে 'অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা' ঘোষণা করেন।
   মধ্যরাতের পর, সমস্ত বড় সংবাদপত্রের অফিসগুলিতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।
 ভারতের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণার সাথে সাথে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্র সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়।  সরকার এই সময়কালে বিশাল ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করে।

সমস্ত রকমের ধরনা, ঘেরাও ,সত্যাগ্রহ ‘Maintenance of internal security act‘ (MISA) প্রয়োগে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সেই সময় ভারতবর্ষের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ইন্দিরা গান্ধীর অন্যতম সমালোচক সুব্রক্ষ্মণ্যম স্বামী শিখের ছদ্মবেশ ধারণ করে গ্রেফতারি এড়াতে সফল হন।
প্রেসকে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল। সমস্ত সংবাদপত্রের নিবন্ধগুলি প্রকাশের জন্য সরকারের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের কন্ঠরোধ করা হলো।
কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
জয় প্রকাশ নারায়ণ ,মোরারজি দেশাই ,লাল কৃষ্ণ আদ্ভানি, অটল বিহারি বাজপেয়ি সহ বেশিরভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। রাজমাতা বিজয়ারাজে সিন্ধিয়া ও মহারানী গায়ত্রী দেবীও বাদ যান নি।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ের পটভূমিতে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচন আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না বলে ঘোষণা করে একটি সংশোধনী আনা হয়েছিল। সঞ্জয় গান্ধী সেই সময়ে কোনও সরকারী পদে অধিষ্ঠিত না থাকা সত্ত্বেও হাতে বিপুল প্রশাসনিক ক্ষমতা পেয়ে যান এবং পরিবার পরিকল্পনার নামে জোরপূর্বক নির্বিজকরণের প্রক্রিয়া চালান।

সংবিধানে সেই সময় স্বৈরতান্ত্রিক ভাবে বিভিন্ন সংশোধন করা হয়েছিল যার মধ্যে অন্যতম ৪২ তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘Secular’ শব্দটি যুক্ত করা ।

ইউরোপে ‘সেক্যুলারিজম (Secularism) এর উদ্ভব’

সেক্যুলারিজম এর অর্থ ‘not connected with religious matter‘ । এখন এই প্রসঙ্গে ‘রিলিজিয়ন’ খ্রীস্টান রিলিজিয়নকে বোঝায় যারা মনে করে তারাই প্রকাশিত সত্যের (Revealed Truth) একমাত্র রক্ষক এবং God নিজেই তা গীর্জার কাছে প্রকাশ করেছেন।

এবং এই প্রকাশিত সত্য কি? মানবজাতি এডাম ও ইভের একটি পাপের ফলস্বরূপ জন্মগ্রহণ করে। তবে সৌভাগ্যক্রমে, প্রায় ২০০০ বছর আগে, God মানবতার প্রতি দয়া করেছিলেন এবং তাঁর একমাত্র পুত্র যীশু খ্রীস্টকে ক্রুশে আমাদের পাপের জন্য প্রাণ দিয়ে আমাদের মুক্ত করার জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন, তারপরে তিনি মৃত থেকে জীবিত হয়ে স্বর্গে তাঁর পিতার কাছে ফিরে এসেছিলেন। তবে, যীশুর ত্যাগের সুবিধালাভে সক্ষম হতে একজনকে অবশ্যই ব্যাপ্তিস্ম (Baptism) করতে হবে এবং চার্চের সদস্য হতে হবে, অন্যথায় বিচারের দিনে তাকে চিরস্থায়ী নরকের জন্য বেছে নেওয়া হবে।

যাদের যুক্তিবাদী মস্তিষ্ক এই ধরনের দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল , বহু শতাব্দী ধরে হয় তাদের চুপ করে থাকতে হয়েছিল অথবা প্রতিবাদ করে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছিল।

এর কারণ দীর্ঘকাল ধরে চার্চ রাষ্ট্রের সাথে জড়িত ছিল, এবং চার্চের অনুকূলে তৈরি হওয়া কঠোর আইনগুলি তথাকথিত ‘প্রকাশিত সত্যকে’ প্রশ্নবিদ্ধ করতে দিতো না। গ্যালিলিওকে বাইবেলের তত্ত্বের বিরুদ্ধে বলার জন্য চার্চের শাস্তির মুখে পড়তে হয়।এমনকি ভারতবর্ষে গোয়াতে, ফ্রান্সিস জেভিয়ার এর নেতৃত্বে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে অবর্ণনীয় বর্বরতার ইতিহাস আছে । আজ অবধি বহু মুসলিম দেশেও ইসলাম ত্যাগ করা মৃত্যুদন্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ।

তাৎপর্যপূর্ণভাবে, কয়েক শতাব্দী ব্যাপি চার্চ ও রাষ্ট্রের এই যুগলবন্দীর সময় যখন পাদ্রিরা একচ্ছত্র ক্ষমতালাভ করেছিল তা ইতিহাসে ‘অন্ধকার যুগ’ নামে পরিচিত। এবং প্রায় ৩৫০ বছর আগে থেকে যে সময় রাষ্ট্রপরিচালনায় চার্চের আধিপত্য কমতে শুরু করে, তাকে ‘আলোকিতকরণের যুগ’ বলা হয়। ভারতবর্ষের জ্ঞান ঔপ্যনিবেশিকদের হাত ধরে ইউরোপে পৌঁছে চার্চের প্রভাব রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
ধীরে ধীরে অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তিবাদী চিন্তন ইউরোপে বিস্তারলাভ করতে শুরু করে এবং এটি স্টেট ও চার্চকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে সহায়ক হয়। এ জাতীয় বিচ্ছেদকেই ‘Secularism‘ বলা হয়।
বর্তমানে, বেশিরভাগ পশ্চিমী গণতন্ত্র হচ্ছে ‘সেক্যুলার’, অর্থাৎ চার্চ রাষ্ট্রীয় শক্তির মাধ্যমে তার উদ্দ্যেশ্যপূরণ করতে পারে না।যদিও বেশিরভাগ দেশ এখনও খ্রীস্টধর্মকে অগ্রাধিকার দেয়। উদাহরণস্বরূপ জার্মানিতে, খ্রীস্টীয় মতবাদ সরকারি স্কুলগুলিতে পড়ানোর সাংবিধানিক বৈধতা আছে।

ভারতের ‘ধর্ম‘ ও ইউরোপের ‘রিলিজিয়ন(Religion) সমার্থক নয়

ভারতের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একেবারে অন্যরকম ছিল। এখানে, ভারতীয় জনগণের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের এমন কোনো শক্তিকেন্দ্র কখনওই ছিল না যা অযৌক্তিক মতবাদকে প্রাধান্য দিতো এবং রাষ্ট্র তাকে সমর্থন করতে বাধ্য ছিল। ভারতবর্ষীয় সমাজ,রাষ্ট্র, এমনকি ব্যক্তিগত জীবন যে সমস্ত নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হতো , তাকেই ‘ধর্ম’ বলা হতো।
মনুসংহিতায় বলা হয়েছে ,
“ধৃতিঃ ক্ষমা দমোস্তেয়ং শৌচমিন্দ্রিয়নিগ্রহঃ।
ধীর্বিদ‍্যা সত‍্যমক্রোধো দশকং ধর্ম লক্ষণম্।।”

অর্থাৎ ; ধৈর্য, ক্ষমা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, চুরি না করা, পবিত্রতা, ইন্দ্রিয় সংযম, ধী(জ্ঞানেরও অধিক), বিদ‍্যা(পরা ও অপরা), সত‍্য এবং অক্রোধ এই দশটি ধর্মের লক্ষণ।
আবার ,
যতোহভ্যুদয়নিঃশ্রেয়সসিদ্ধিঃ স ধর্মঃ

অর্থাৎ ,যে ব্যবস্থা আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলির লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম করে তোলে ,উৎসাহ যোগায় ,চরম ভোগের মধ্যে জীবনযাপন করলেও যে ব্যবস্থা মানুষের মধ্যে সেই স্বর্গীয় আনন্দ বা পরম সত্যকে উপলব্ধির যোগ্যতা এনে দেয় তারই নাম ‘ধর্ম’।
ধর্মের সঙ্গে যুক্ত সামাজিক দিকটি হলো—
ধারণাৎ ধর্মমিত্যাহুঃ ধর্ম ধারায়তি প্রজাঃ
অর্থাৎ, যে শক্তি ব্যক্তিসমূহ কে একত্রে আনে এবং সমাজ রূপে তাদের ধরে রাখে তারই নাম ধর্ম।
এই দুই সংজ্ঞাকে জুড়লে দেখা যায় ধর্ম স্থাপন এর অর্থ হলো এমন একটা সংঘবদ্ধ সামাজিক জীবন গড়ে তোলা যেখানে প্রত্যেকেই এই সমাজের অপরাপরের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করবে, অন্যের পার্থিব জীবনকে অধিকতর সমৃদ্ধ ও সুখী করে তোলার জন্য ত্যাগের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হবে এবং সেই আধ্যাত্মিক জীবনকে বিকশিত করবে যা পরম সত্যের উপলব্ধির অভিমুখী হয়।

ইউরোপের রিলিজিয়ান এবং ভারতবর্ষের ‘ধর্ম’ এর মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রবন্ধে বলেছেন……..

“গীতায় জ্ঞান প্রেম ও কর্মের মধ্যে যে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য-স্থাপনের চেষ্টা দেখি তাহা বিশেষরূপে ভারতবর্ষের। য়ুরোপে রিলিজন বলিয়া যে শব্দ আছে ভারতবর্ষীয় ভাষায় তাহার অনুবাদ অসম্ভব; কারণ, ভারতবর্ষ ধর্মের মধ্যে মানসিক বিচ্ছেদ ঘটিতে বাধা দিয়াছে–আমাদের বুদ্ধি-বিশ্বাস-আচরণ, আমাদের ইহকাল-পরকাল, সমস্ত জড়াইয়াই ধর্ম। ভারতবর্ষ তাহাকে খন্ডিত করিয়া কোনোটাকে পোশাকি এবং কোনোটাকে আটপৌরে করিয়া রাখে নাই। হাতের জীবন, পায়ের জীবন, মাথার জীবন, উদরের জীবন যেমন আলাদা নয়–বিশ্বাসের ধর্ম, আচরণের ধর্ম, রবিবারের ধর্ম, অপর ছয়দিনের ধর্ম, গির্জার ধর্ম, এবং গৃহের ধর্মে ভারতবর্ষ ভেদ ঘটাইয়া দেয় নাই। ভারতবর্ষের ধর্ম সমস্ত সমাজেরই ধর্ম, তাহার মূল মাটির ভিতরে এবং মাথা আকাশের মধ্যে; তাহার মূলকে স্বতন্ত্র ও মাথাকে স্বতন্ত্র করিয়া ভারতবর্ষ দেখে নাই–ধর্মকে ভারতবর্ষ দ্যুলোকভূলোকব্যাপী মানবের-সমস্ত-জীবন-ব্যাপী একটি বৃহৎ বনস্পতিরূপে দেখিয়াছে।”

ভারতবর্ষের ধর্মে আঘাত ও সংবিধান পরিবর্তন

যাইহোক, ভারতবর্ষের ধর্মের এই উন্মুক্ত পরিবেশটি পরিবর্তিত হয়েছিল যখন ইসলাম এবং খ্রীস্টান ধর্ম ভারতে প্রবেশ করে। ভারতীয়রা, যারা ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’ অর্থাৎ পুরো বিশ্বকে একটি পরিবার হিসাবে বিবেচনা করেছিল, তারা কেবল মূর্তি পূজাকারী ‘হিন্দু’ বলেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য, উপহাস ও এমনকি বিপুল গণহত্যার শিকার হয়েছিল। ভারতীয়রা বুঝতে পারেনি যে নির্দিষ্ট মতবাদের সম্প্রদায়গুলি তাদের নিজস্ব প্রাচীন ধর্ম থেকে খুব আলাদা ছিল। প্রথমবারের মতো তারা ঈশ্বরের নামে নির্মম হত্যার মুখোমুখি হয়েছিল।
ইউরোপের চার্চের বিরুদ্ধে লড়াই করা ভলতেয়ার বলেছিলেন ” Those who can make you believe absurdities,can make you commit atrocities“।

মুসলিম শাসনকালে হিন্দুদের তাদের জীবনের ভয়ে হীন অবস্থায় থাকতে হয়েছিল ও ব্রিটিশ শাসনকালে তার ধর্মকে মিশনারিদের উপহাস সহ্য করতে হয়েছিল। ইংরেজরা ‘শিক্ষা’ নীতি পরিবর্তনের দ্বারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। স্বভাবতই, এটি ভারতীয়দের আত্মমর্যাদাবোধের ক্ষতি করেছে। প্রকৃতপক্ষে, আজ অবধি, মেকলীয় শিক্ষাব্যবস্থার ফলস্বরূপ ‘ইংরেজী শিক্ষিত‘ শ্রেণীর অনেকের মধ্যেই ভারতীয় ‘ধর্ম‘ সম্পর্কে এক অবজ্ঞার মনোভাব বদ্ধমূল হয়ে আছে।

হিন্দুদের স্বধর্মের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ-স্বামী বিবেকানন্দের প্রচেষ্টা হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানে সহায়ক হয়।

এত আঘাত সত্ত্বেও বহু শতাব্দী ধরে হিন্দু ধর্মের বেঁচে থাকা সাফল্যের দাবি রাখে, যেখানে পশ্চিম-বিশ্ব পুরোপুরি খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী হয়ে যায় এবং অল্প সময়ের মধ্যেই ৫০ টিরও বেশি দেশ ইসলামের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

যদিও হিন্দু ‘ধর্ম’ বেঁচে গিয়েছিল কিন্তু প্রায় ৮০০ বছর ধরে বৈদেশিক শাসনের ফলে , এই কয়েকহাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ক্রিড়াক্ষেত্র ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে থাকে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হলেও , তা নিজের অখন্ড রূপ পেলো না আর স্বাধীন ভারতবর্ষের ক্ষমতা এমন একটি পরিবারের কুক্ষিগত হলো যারা এই সুপ্রাচীন মহান ঐতিহ্যের উত্তরসূরি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করতেন।

সংবিধানের খসড়া কমিটির প্রধান ডঃ বি.আর.আম্বেদকর ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সেক্যুলার’ শব্দটি যুক্ত করার বিরোধিতা করেছিলেন এবং ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচয় বহনকারী ‘রামায়ণ ও মহাভারত’ এর বিভিন্ন ঘটনাবলীর চিত্র সম্বলিত মূল সংবিধান টি আত্মপ্রকাশ করে।

তারপর ১৯৭৬ সালে জরুরি অবস্থার সময়কালে গণতন্ত্রের শ্বাসরোধ করে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘Secular’ শব্দটি যুক্ত হলো

বর্তমান বিশ্বে ‘সেক্যুলারিজম‘ এর অবস্থা

এখন দেখে নেওয়া যাক, ইউরোপ থেকে চার্চ ও রাষ্ট্র কে বিচ্ছিন্ন করতে উদ্ভূত যে সেক্যুলারবাদ কে আমরা আপন করে নিলাম , বর্তমানে ইউরোপে তার অবস্থা কি?
ইউ কে(UK) এর ‘হাউস অফ লর্ডস’ এ ইংল্যান্ডের বিশপদের জন্য ২৬ টি আসন সংরক্ষিত আছে।এমনকি ২০০১ এ ইংল্যান্ড সরকার আরো একধাপ এগিয়ে চার্চ-রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নকরণ কে দুর্বল করতে হাউস অফ কমনস্’ এ চার্চের প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে House of Commons (Removal of clergy disqualification)Act পাশ করে।

সেক্যুলারিজম এর নামে দ্বিচারিতা

আর অন্যদিকে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি ভারতবর্ষে সেক্যুলারিজমের এক অন্য অর্থ প্রতিষ্ঠা করেছে। এর অপপ্রয়োগে সংখ্যাগুরুদের বঞ্চিত করে সংখ্যালঘুদের তোষণ করতে অনেকক্ষেত্রেই নিরপেক্ষতাকে বর্জন করা হয়েছে।সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দ্বারা পরিচালিত সংস্থাগুলি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পেলেও হিন্দুরা নিজেদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ অধিকার থেকে আজও বঞ্চিত। মন্দিরের সম্পত্তি ,এতদিন সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকলেও ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি সরকারের আওতার বাইরে। সংবিধানের ২৮ নং ধারা অনুসারে সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ে সংখ্যাগুরু হিন্দু ধর্মের গ্রন্থ গুলি পড়ানোর আইনি স্বীকৃতি না থাকলেও , সাংবিধানিকভাবে আর্টিকেল ৩০ অনুসারে সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের উপাসনা-পদ্ধতির পঠন,পাঠন ও প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে । হাল আমলে নরেন্দ্র মোদি সরকার ট্রিপল তালাক বাতিল করে মুসলিম মহিলাদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ব্যক্তিগত বিবাদ(বিবাহ,বিবাহ-বিচ্ছেদ,সন্তান দত্তক নেওয়া, ভরণ-পোষণ, উত্তরাধিকার)নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সম্প্রদায় ভিত্তিক আইনের পরিবর্তে সব নাগরিকের জন্য এক আইন ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড (UCC)’ চালু না হওয়া সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র নির্মাণে ‘সেক্যুলারিজম‘ এর অসাড়তা প্রমাণ করে।

সমাধান কোন পথে

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন ” আমাদের এই পবিত্র মাতৃভূমির মূলভিত্তি , মেরুদন্ড বা জীবনকেন্দ্র—-একমাত্র ধর্ম”।

ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি, বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ তাঁর ‘Vivekananda and young India, Vivekananda, the great spiritual Teacher, a compilation(P. 37) বই তে লিখেছেন….
“যাই তোমার সমাজ সংস্কারের পরিকল্পনা হোক, রাজনীতি বা অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে বিপ্লবের প্রচেষ্টাই তোমার হোক ,কোনো কিছুই সফল হবে না যদি না তার পিছনে ধর্মের প্রেরণা থাকে।’
ভারতবর্ষের মূলভিত্তি ধর্ম অথচ ‘secularism‘ কালক্রমে এক ভ্রান্ত অর্থ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ পরিগ্ৰহ করেছে।

আমরা দেখলাম গণতন্ত্রের এক দুর্বল সময়ে পাশ্চাত্যের পরাণুকরণের এক অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে গৃহীত ‘সেক্যুলারিজম’ সংখ্যাগুরু হিন্দুদের বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার এক অস্ত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আজ যদি স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষের রাজনীতি, অর্থনীতি ,সমাজনীতি ‘ধর্ম’ কে আশ্রয় করে পরিচালিত হতো, ৭৩ বছর পার করে আমরা এক ‘পরমবৈভবশালী’ ভারতবর্ষ পেতাম
তাই ভারতবর্ষের উচিত , নিজের ঐতিহ্যশালী সংস্কৃতি কে উপলব্ধি করে এক নিরপেক্ষ ‘ধর্মাশ্রয়ী’ রাষ্ট্রের পথে পা বাড়ানো।

পিন্টু সান্যাল (Pintu Sanyal)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.