এটা আমরা সবাই জানি যে করোনা ভাইরাস তার পরিবর্তিত জিন মিউটেশান অতি দ্রুত সংঘঠিত করতে পারে বলে এর প্রতিষেধক বের করা দুঃসাধ্য। ইতিমধ্যেই পাঁচ রকমের করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে। সুতরাং আমাদের শরীরের antigen-antibody গঠনের প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী ও কার্যকরী করলে তবেই আমরা করোনার মোকাবিলায় শক্ত ইমিউনিটি গড়তে সক্ষম হব।
আমাদের পশ্চিমবঙ্গে পক্ষপাতমূলক প্রশাসনিক পদক্ষেপের ফলে এই রাজ্যে করোনা রোগী সহ পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাই ভেঙে যেতে বসেছে। পরিসংখ্যান বলছে, করোনা পজিটিভ রোগীর সঙ্গে মৃতের শতকরা হিসেব মেলালে আমাদের করোনা যুদ্ধে সাফল্যের পরিমাপ করা যাবে। এই হিসেবে পৃথিবীতে আক্রান্তের ৬.৪৬% মৃত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫.৯৫%, ব্রিটেনে ১৪.২%, স্পেনে ৯.৯৫%, চীনে ৫.১৮% এবং ভারতে ৩.১৫%। এটা প্রমাণ করে ভারত সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে সঠিক সময়ে লকডাউন করে এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় ও মুখ-নাক ঢেকে সাধারণ হাইজিন মেনে যে নিয়মাবলী চালু করেছে তার ফলে মৃত্যুসংখ্যা এমন উচ্চ জনঘনত্বের দেশে অনেক কমানো গেছে। ফলে ভারতীয় নেতৃত্ব বিশ্বের দরবারে যথেষ্ট মান্যতা পেয়েছে।
করোনা আক্রান্ত ও মৃত সবচেয়ে বেশি মহারাষ্ট্রে। আক্রান্ত ও মৃতের শতকরা হার ৩.৬২%, গুজরাটে ৫.৭৯%, এমনকী দিল্লিতে ২.৩৬%। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ৮.৮৯%। অভিজ্ঞতার নিরিখে কারণ ব্যাখ্যা করলে যে বিন্দুগুলি উঠে আসে তা হলো রাজ্যে টেস্টিং প্রক্রিয়াটাই অবৈজ্ঞানিক। ‘rapid kit’ টেস্টের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে পজিটিভ হলে সেটা সঠিক কিন্তু নেগেটিভটা নিশ্চিত নয়। সেটা পজিটিভ হতেও পারে। সেজন্য rtPCR পদ্ধতি সময়সাপেক্ষ ও বেশি খরচের হলেও তা অনেক নির্ভরযোগ্য। রাজ্য এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ঠিকই করেছে। সমস্যা অন্য জায়গায়। এই পদ্ধতিতে স্যাম্পল সংগ্রহ থেকে টেস্ট শুরু করার মধ্যে সময় থাকে মাত্র ২ থেকে ৩ ঘণ্টা। এই জায়গায় প্রথাগত কর্মবিমুখ ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচ ও প্রশাসনিক অপদার্থতার কারণে ও ব্যক্তিবিশেষের প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি করার কারণে এই সময়ের পরে যে নমুনাই পরীক্ষা করা হোক তার ফল নেগেটিভ হয়েছে। কিন্তু সেই রোগীদের মধ্যে অনেকের পরবর্তিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ‘Co-Morbidity’-র মতো হাস্যকর তত্ত্ব চালু করার চেষ্টা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব না মানা এবং প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তায় বা মদতে সামাজিক সংক্রমণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তৃতীয়ত, জামাতি ও পরিযায়ী শ্রমিকেরা ফেরার পর তাদের সঠিক পরীক্ষা, আইসোলেশন।
এমনকী সঠিক তথ্যাদি পরিপূর্ণভাবে প্রশাসনের কাছে না রাখা। চতুর্থত, সুসজ্জিত প্রাইভেট কোভিড হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসকের নতুন প্রোটোকল অনুযায়ী কাজ করতে দেয়ার ব্যাপারে প্রশাসনিক কতৃপক্ষের দীর্ঘসূত্রতা। পঞ্চমত, অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক মানুষদের সঠিকভাবে দেখভাল না করে অযথা দুর্নীতি ও পেশীশক্তি প্রদর্শন। এর ফলে করোনা মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতা তাকে রাজনৈতিকভাবেও দুর্বল করেছে।
প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রতিবাদী ভাবমূর্তি গড়ার তাগিদে হাসপাতাল ভাঙচুর ও চিকিৎসক নিগ্রহের লজ্জার ইতিহাস আমাদের আছে। অভিযোগ আছে যে, এইসব ঘটনায় রাজনৈতিক ও ধর্মীয় রং দেখে soft pedaling করার। এরপর রাজ্য সরকারের সঠিক ও পর্যাপ্ত পরিমাণ পোশাক ও PPE কিট এবং যথার্থ N95 না দেওয়ার কারণে বা স্বাস্থ্যভবন নির্দেশিত পদ্ধতিতে চিকিৎসা চালানোর কারণেই হোক, রাজ্যে করোনা আক্রান্ত চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসাকর্মীর সংখ্যা এত বেশি যে অনেক হাসপাতাল আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজ্যে ৩০ জন চিকিৎসক করোনা আক্রান্ত। এছাড়া ২ জন। চিকিৎসক মারা গেছেন। ৪২ জন নার্স ও ৬৪ জন চিকিৎসাকর্মী যারা খুব কম বেতনে পরিষেবা দেন, তারা করোনায় আক্রান্ত। ফলে এদের অনেকেই আর কাজে আসছেন না। এখনো পর্যন্ত রাজ্য থেকে ৬০২ জন নার্স তাঁদের নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে গেছেন। এর ফলে রাজ্যে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাই ভেঙে যেতে বসেছে। এই ৩০ জনের মধ্যে ১৮ জন চিকিৎসক ও ৪২ জন নার্সের মধ্যে ২৬ জন শুধু শহর কলকাতাতেই আক্রান্ত হয়েছেন।
ভাষণবাজি ও বিভিন্ন করোনা কমিটি গঠন করেই যে রাজ্যের মানুষকে সুরাহা দেওয়া যাবে না তা বোধহয় মুখ্যমন্ত্রীও বুঝতে পারছেন। কিন্তু ঔদ্ধত্যের কারণে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছেন না।
করোনা পরীক্ষার ব্যাপারে সুইডেন যে পদ্ধতি অনুসরণ করে সফল হয়েছে এখানে সেই ‘target vulnerable section formula প্রয়োগ করা যেতে পারে। কারণ অনন্তকাল লকডাউন সম্ভব নয়। এই পদ্ধতিতে ৬৫ বছর ও তার ওপরের বয়সের সকলের পরীক্ষা করা ও পজিটিভ রোগীদের চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন। নেগেটিভদের হোম কোয়ারান্টিনে রাখা এবং সরকারের তরফ থেকে তাদের দেখভালের দায়িত্ব নেওয়া। অন্যদের কাজকর্ম ধীরে ধীরে শুরু করতে দেওয়া ও লক্ষণ দেখা দিলে তবেই টেস্ট করা।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের World Food Programme-এর ডিরেক্টর David Beaslay-র একটি বক্তব্যকে হাতিয়ার করে কমিউনিস্ট ও তাদের তল্পিবাহকরা চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে যে দেশে অবশ্যম্ভাবী দুর্ভিক্ষ এসে গেল। BBC বলেছে, David Beaslay বলেছেন যে এই দুর্ভিক্ষে সাড়ে তেরো থেকে পঁচিশ কোটি লোক প্রভাবিত হবে। কিন্তু আসল রিপেটিটা পড়লে বোঝা যায় যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা যে দশটি দেশের তার নটি দেশই আফ্রিকার ও অন্যটি সিরিয়া। এই দেশগুলিতে খাদ্য সুরক্ষার শক্তিশালী স্কিম নেই। উপরন্তু এই দেশগুলির অধিকাংশই দুর্ভিক্ষপ্রবণ ও তারা খাদ্যের জন্য অন্যদেশের মুখাপেক্ষী ও নির্ভরশীল।
আমাদের দেশে করোনার কারণে খাদ্যশস্যের উৎপাদনে ক্ষতি হয়নি। উপরন্তু এবছর তুলনামূলকভাবে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার লকডাউনে খাদ্যশস্য উৎপাদনে ছাড় দেওয়া ছাড়াও সরকারের খাদ্য সহায়তা প্রকল্পগুলি যথেষ্ট শক্তিশালী ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষদের কাছে উপযোগী। বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে সরকার প্রান্তিক মানুষদের হাতে কিছু নগদের জোগানের ব্যবস্থাও করেছে। লকডাউন পর্ব লঘুকরণের পর্যায়ে প্রান্তিক মানুষরা ধীরে ধীরে তাদের কাজে ফিরে যেতে শুরু করেছেন। ভোগপণ্যের চাহিদা ও উৎপাদনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই।
দেশে রেকর্ড পরিমাণ চাল ও গম উৎপাদন হয়েছে। FCI-এর গুদামগুলিতে ঘাটতি নেই। কিন্তু আমাদের রাজ্যের পরিস্থিতি ভিন্ন। গত বছরের তুলনায় এ বছর আলুর উৎপাদন ১৪% বৃদ্ধি পেলেও দাম বৃদ্ধির কারণ এখানের জটিল বণ্টন ব্যবস্থা।
হিমঘর, সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্মেও শাসকলালিত কাটমানি শিল্পের দৌলতে রাজ্যসরকারের সংগ্রহমূল্য কিলোপ্রতি ৫ টাকা হলেও ৭০% এর উপর। আলু কিলোপ্রতি ৮ টাকার কমে চাষিরা বেচেছেন। আর সেই আলু উপভোক্তারা এখনই কিলোপ্রতি ২০-২৫ টাকা দরে কিনছেন। এটা নিশ্চিতভাবেই শাসকের ব্যর্থতা। আনাজপাতি ও অন্য পণ্যের ক্ষেত্রেও রয়েছে কাটমানি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য।
এরসঙ্গে রেকর্ড অনুযায়ী জানা যায় যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গত বছর চাল সংগ্রহের পরিমাণ ২২% মাত্র। সরকারের স্বীকৃতি অনুযায়ী এই রাজ্যের গণবণ্টন ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত। এক দেশ এক রেশন কার্ড’ ব্যবস্থায় এই দুর্নীতি রুখতে প্রশাসনের ব্যবস্থা থাকলেও রাজ্যসরকারের তাতেও অনীহা। একমাত্র দুর্নীতিমূলক প্রশাসন স্বচ্ছ ও সেবার উদ্দেশ্য নিয়ে চলা সরকারই রাজ্যবাসীকে এই দুরবস্থা থেকে রেহাই দিতে পারে।
ড. নারায়ণ চক্রবর্তী
(লেখক পশ্চিমবঙ্গ বায়োটেক ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের পূর্বর্তন উপদেষ্টা ও নির্দেশক)