পাকিস্তানের নির্ভরযোগ্য বন্ধু বলে বর্ণিত চীনের কৌশলগত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে গৃহীত ৬২ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে (সিপিইসি) একটি অস্বচ্ছতার প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে। খোদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খনের দ্বারা গঠিত একটি কমিটি পাকিস্তানে চীনা বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যেখানে দেখা গেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎসরবরাহ করছে।
প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে যে, হুয়ানেঙ শ্যানডং রুইই (পাক) এনার্জি (এইচ এস আর) এবং পোর্ট কাশিম ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (পিকি উইপিসি এল), চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে তাদের স্থাপনা ব্যয় বাড়িয়েছে। এসব তথ্য জানিয়েছেন হাডসন ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার পরিচালক হুসেন হাক্কানি। তিনি ২০০৮ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
পাকিস্তানের জনগণ, যাদের কাছে বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু হিসেবে চিহ্নিত চীন, অবাক হয়ে দেখছে, আজ চীনের নির্দয়ভাবে অযৌক্তিক ব্যবসা। পাকিস্তানে সাত দশকের ইতিহাসে গণতন্ত্রের মুখোশ পরে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় এসেছে, তারা সবাই ভারতের বিরুদ্ধে তাদের প্রধান সমর্থনকারী হিসেবে চীনকে দেখিয়ে আসছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে চীন পাকিস্তানকে সাহায্য করার নামে যা করছে তা পাকিস্তানি জনগণের মধ্যে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
কমিটি ফর পাওয়ার সেক্টর অডিট, সার্কুলার ডেট রিজারভেশন এন্ড ফিউচার রোডম্যাপ-এ ২৭৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নিজস্ব বিদ্যুৎ সেক্টরে চীনা কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত ১০০ বিলিয়ন তৃতীয়াংশ চীনা প্রকল্পের সাথে সম্পর্কিত।
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) এবং পাকিস্তান সামরিক শক্তির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এবং তার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল অসিম সালিম বাজওয়াকে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি)-এর সভাপতি বানানো হয়েছিল। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্মাণকালীন সুদ বা ইন্টারেস্ট ডিউরিং কন্সট্রাকশন (আইডিসি) সম্পর্কিত তৎক্ষণাৎ বিবেচনা না করার কারণে কয়লাভিত্তিক দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অতিরিক্ত স্থাপনা ব্যয়ের জন্য ৩২.৪৬ বিলিয়ন পাকিস্তানি রুপির (আনুমানিক ২০৪ মিলিয়ন ডলার) অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ৪৮ মাসের জন্য এই সুদের ছাড় প্রদান করা হয় এবং এই সমস্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আসলে প্রায় ২৭-২৯ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা হয় যা সাহিওয়াল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ক্ষেত্রে ৩০ বছরে চিরকালের জন্য বার্ষিক ২৭.৪ মিলিয়ন ডলারের ইকুইটি (রো)-এর একটি বাড়তি রিটার্ন ধার্য করে। ডলারের তুলনায়। বার্ষিক রুপির শতাংশের অবমূল্যায়নকে। মাথায় রেখে আনুমানিক অতিরিক্ত পরিশোধের পরিমাণ ২৯১.০৪ বিলিয়ন রুপি (প্রায় ১.৮ বিলিয়ন ডলার) দাঁড়িয়েছে।
হুয়ানেং শ্যানডং রুইই (পাক) এনার্জি (এইচ এস আর) দাবি করে নির্মাণকালীন সুদ বা ইন্টারেস্ট ডিউরিও কন্সট্রাকশন (আই ডি সি) একটি দীর্ঘমেয়াদী ঋণের উপর ভিত্তি করে (লিবর + ৪.৫ শতাংশ) হারে নির্মাণকালের হিসাবে করা হয়েছে, যদিও পাকিস্তান সরকার। দীর্ঘমেয়াদি কোনো ঋণ নেয়নি। চীনা সংস্থাগুলির লাভের বিশালতা ছিল ধারণাতীত। পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞদের কমিটি যে দুটি প্রকল্প পরীক্ষা করেছিল, তাদের সূচনার সময় মূল্য ধার্য ছিল ৩.৮ বিলিয়ন ডলার। কমিটি ৪৮৩.৬৪ বিলিয়ন রুপির অতিরিক্ত খরচ পেয়েছে, যা বর্তমান বিনিময় হারে ৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে হুয়ানেং শ্যানডং রুইই (পাক) এনার্জি (এইচ এস আর)-কে ৩৭৬.৭১ বিলিয়ন রুপি (আনুমানিক ২.৩ বিলিয়ন ডলার) এবং পোর্ট কাশিম ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (পিকি ইউ পিসি এল)-কে ৩০ বছরের বেশি অতিরিক্ত স্থাপনা ব্যয়ের কারণে অতিরিক্ত রিনার্ট এবং ভুল হিসেবের কারণে অতিরিক্ত রিটার্নের পরিমাণে ১০৬.৯৩। বিলিয়ন রুপি (আনুমানিক ৬৭২ মিলিয়ন ডলার) অভ্যন্তরীণ হারের রিটার্নে (ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন) অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে।
কমিটি তার প্রতিবেদনে সুপারিশ করে যে পোর্ট কাশিম ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (পি কি ইউ পি সি এল) এবং হুয়ানেং শ্যানডং রুইই (পাক) এনার্জি (এইচ এস আর) এর প্রকল্প ব্যয় থেকে ৩২.৪৬ বিলিয়ন রুপি (আনুমানিক ২০৪ মিলিয়ন ডলার) কেটে নেওয়া হবে এবং রিটার্ন পেমেন্ট ফর্মুলাটি প্রকৃত নির্মাণের সময় পুনরায় প্রকাশ করার জন্য সংশোধন করা হবে এবং পোর্ট কাশিম ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (পি কি ইউ পি সি এল) এবং হুয়ানেং শ্যানডং রুইই (পাক) এনার্জি (এইচ এস আর)-এর ট্যারিফ অনুসারে সামঞ্জস্য বিধান করা হবে।
বর্তমান সূত্রের অধীনে, পরিচালনার দুই বছরের মধ্যে হাইপোটনিক শক রেসপন্স (এইচ এস আর) ইতিমধ্যে বিনিয়োগকৃত তার মূল ইকুইটির ৭১.১৮ শতাংশ পুনরুদ্ধার করেছে, যেখানে পোর্ট কাশিম ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (পি কি ইউপি সি এল) পরিচালনার প্রথম বছরে তার মূল ইকুইটির ৩২.৪৬ শতাংশ পুনরুদ্ধার করেছে। এখানেই লাভের অঙ্ক শেষ এবং তার উপরে। কৌশল ছাড়া সংস্থাগুলি তৈরি হতো। ৬২ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সি পিইসি) প্রকল্পে চীনারা যে আয় করবে তা কল্পনা করাও কষ্টকর।
শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যেতে পারে পাকিস্তান সরকার ও তাদের নেতাদের কারণে কীভাবে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হয়েছে। পাকিস্তানের অর্থনীতি কিছু সময়ের মধ্যে দেউলিয়া হওয়ার কিনারায় গিয়ে পৌঁছেছে এবং কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটছে। তা সত্ত্বেও উগ্র ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের লালন-পালন এবং ভারতের বিরুদ্ধে হামলায় তাদের মদত দেওয়া পাকিস্তান বন্ধ করেনি।
তাদের দেশের নীতি সংস্কার করার পরিবর্তে পাকিস্তানের নেতারা আবার মহামারীর জন্য ঋণ পুনর্গঠন ও ঋণ মকুবের সুবিধা চেয়েছে, ঠিক যেমনটা তারা আগে সন্ত্রাস দমনে পুরস্কার হিসেবে আন্তর্জাতিক সহায়তা চেয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক মহল আশা করে যে একের পর এক অর্থনৈতিক সংকট থেকে পাকিস্তানকে বারবার মুক্তি দেওয়া অবাস্তব। প্রচুর সামরিক ব্যয়, গভীর দুনীতি এবং দায়বদ্ধতার অভাব পাকিস্তানের একটি স্বভাবে পরিণত হয়েছে এবং রাজস্ব ও ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান দিন দিন গভীর হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে, চীনা বিনিয়োগগুলি তাদের কাছে একটি নতুন দায়বদ্ধতায় পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আই এফ এফ) পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের কর ও শুল্ক বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। আসলে পাকিস্তানের জনগণকে চীনের হিংস্র আচরণের জন্য বিরাট মূল্য দেবার ফাঁদে পড়তে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরেছে, পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের তাদের নিজস্ব ও চীনের লুটপাটে আর সাহায্য করছেনা। পাকিস্তানের জনগণ এখন ভালো কিছু দেখতে চাইছে। তাদের কাছে তথাকথিত ‘পরম বন্ধু’ চীনের স্বরূপ প্রকাশ হয়ে পড়েছে।
বাসুদেব ধর