করোনা সংকটের পাশাপাশিই আমফান ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহ তাণ্ডব। এই জোড়া। আক্রমণে পশ্চিমবঙ্গের জনজীবন এখন সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত। করোনার থাবা থেকে যখন পরিত্রাণের কোনো রাস্তাই দেখছেন না রাজ্যের মানুষ, তখন তারই পাশাপাশি আমফানের আক্রমণ সবাইকে আরো দিশাহারা করে দিয়েছে। আমফান ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বিস্তৃত অঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাওড়া ও হুগলিরও এক বিরাট অংশ।রাজধানী কলকাতাও এই ঝড়ের আঘাত থেকে রক্ষা পায়নি। রাজ্যের আবহবিদরা বলছেন, ১৭৭৩ সালের পর এমন বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় এইরাজ্যে প্রত্যক্ষ করোনি। এমনকী, ২০০৯-এর আয়লার তাণ্ডবকেও ছাপিয়ে গিয়েছে এই ঝড়। এই ঝড়ে যে এখন পর্যন্ত কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার এখনো করে উঠতে পারেনি। সুন্দরবন অঞ্চলে। নদীবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা জলপ্লাবিত হয়েছে। কয়েক হাজার মৎস্যজীবী চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
বিস্তীর্ণ এলাকায় কৃষিজমি জলমগ্ন হয়ে। কৃষিকাজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বহু কাচা ও পাকা বাড়ি এইঝড়ে ভেঙে পড়েছে। কয়েক লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রাথমিক অনুমান এই বিধ্বংসী ঝড়ে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই ঝড়ের চব্বিশ ঘণ্টা পরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাজ্যে এসে মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ঝাবিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে ১০০০ কোটি টাকার সাহায্যও দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে।এই ঘূর্ণিঝড়ে মৃত ব্যক্তিদের পরিবার পিছু দু’লক্ষ টাকা এবং আহতদের পরিবারপিছু পঞ্চাশ হাজার টাকার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন। প্রধামন্ত্রী। প্রধামন্ত্রী বলেছেন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যৌথভাবে সমীক্ষা চালিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ হিসাব করার পর প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য করা হবে। আমফান দুর্গত এলাকাগুলিতে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠন ত্রাণ ও উদ্ধারের কাজে নেমেছে। সেনাবাহিনীও বিপর্যয় মোকাবিলায় নেমে পড়েছে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অবস্থা সামাল দেওয়া যাবে এই আশা করাই যায়।
কিন্তু করোনা ও আমফান একটি বিষয় আমাদের সামনে পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে। তা হলো, এই রাজ্যের বাসর্বস্ব সরকারের অপদার্থতা। করোনা সংকটে যখন সমগ্র ভারতের সঙ্গে এই রাজ্যও আক্রান্ত, তখন প্রথমে আমরা দেখেছি রাজ্য সরকারের, প্রধানতমুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই সংকটকে লঘু করে দেখানোর প্রয়াস। পরে, সংকট যখন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থেকেছে তখন মুখ্যমন্ত্রী রাস্তায় নেমে চকখড়ির দাগ কেটে প্রচারের আলোয় থাকার প্রচেষ্টা করেছেন। কিন্তু করোনার মোকাবিলায় রাজ্যে সর্বত্র সফল লকডাউন করার প্রচেষ্টা করেননি। উপরন্তু তথ্য চাপা দেওয়ার নির্লজ্জ প্রয়াস করছেন। ফলত রাজ্যে করোনা সংকট আরও বাড়তে থেকেছে। ব্যর্থ মুখ্যমন্ত্রীও আসর ছেড়ে শেষ পর্যন্ত পালানোর রাস্তা খুঁজছেন। আমফানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনার । পুনরাবৃত্তি দেখা গেল। দেখা গেল, ভাষণ সর্বস্ব মুখ্যমন্ত্রী কার্যক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আমফান নামক ঘূর্ণিঝরটি যে বিধ্বংসী রূপে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চলে আছড়ে পড়তে চলেছে—সে সতর্কবার্তা আবহাওয়া দপ্তর দু’সপ্তাহ ধরে দিয়ে আসছিল। কাজেই প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পাওয়া যায়নি—একথা রাজ্য সরকার বলতে পারবে না। আবহাওয়া দফতর আরও বলেছিল, এই ঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ১৬৫-১৭৫ কিলোমিটারের ভিতর থাকবে। কলকাতায় এই গতিবেগ হতে পারে ১৩০-১৫০ কিলোমিটার। এই গতিবেগে কোনো ঝড় যদি আছড়ে পড়ে তাহলে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে তা একটি শিশুও বোঝে। এই ভয়াবহাতা আঁচ করেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঝড় আসার আগেই মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। কী ধরনের সহায়তা প্রয়োজন তা জানতে চেয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তার স্বভাবসিদ্ধ ঔদ্ধত্যে তা প্রত্যাখ্যান করেন। মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে বসে বারে বারে বলেছিলেন, আমরা সবরকমভাবে প্রস্তুত আছি। এর পর ঝড় যখন এল, কলকাতা-সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে তছনছ করে দিয়ে চলে গেল, তখন বোঝা গেল মুখ্যমন্ত্রী এবং তার প্রশাসন এই বিপর্যয় মোকাবিলায় মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। কলকাতা শহরই ৫০০০ এরই বেশি গাছ ভেঙে পড়ল। বেশ। কিছু এলাকা জলমগ্ন হলো। কলকাতাশহরের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ টানা তিন চারদিন বিদ্যুৎ ও পানীয় জল বিহীন অবস্থায় রইলেন। পুরসভা ও প্রশাসনের কোনো তৎপরতাই দেখা গেল না। টালা থেকে গড়িয়া মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখালো। সেই বিক্ষোভের সামনে শাসক দলের কাউন্সিলাররা কার্যত গা ঢাকা দিলেন। আর মুখ্যমন্ত্রী আসরে নামলেন বলির পাঠা খুঁজে বের করতে। করোনা সংকটেও এরকম বলির পাঁঠা তিনি খুঁজে বের করেছিলেন। বদলি করেছিলেন খাদ্য সচিব ও স্বাস্থ্য সচিবকে। এবার প্রথমেই বদলি করলেন কলকাতা। পুরসভার কমিশনার খালিল আহমেদকে। কিন্তু রাজ্যের পুরমন্ত্রী তথা কলকাতা পুরসভার প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম আড়ালে রয়ে গেলেন। আড়ালে রয়ে গেলেন দমকল এবং বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের মন্ত্রী সুজিত বসু ও জাবেদ খান। এরপর নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে সিই এসসি-র ওপর দায় চাপিয়ে দিলেন। বললেন, কলকাতার বিদ্যুৎ বিপর্যয় সিইএসসি-র কারণে। একবারও বললেন না, ভেঙে পড়া গাছ না সরালে বিদ্যুৎ সংযোগ ফেরানো সম্ভব নয়। আর গাছ সরানোর কাজটা পুরসভার। মুখ্যমন্ত্রীর আর একটি স্বভাব আছে। প্রয়োজন মিটলে তিনি কাছের মানুষকেও আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে পারেন।
সিইএসসি-র চেয়ারম্যান শিল্পপতি সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সঙ্গে তিনি এবার সে কাজটিই করলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এমন ভান করলেন, যেন সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সঙ্গে তার সম্পর্কই নেই। সঞ্জীববাবু যেন শুধুমাত্র যেন সিপি এমেরই কৃপাভোগী। অথচ এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই সঞ্জীব গোয়াঙ্কাকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশ সফর করেছেন। বিদেশ সফরে গিয়ে সঞ্জীববাবু মমতাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। তার আঁকা ছবি এক কোটি টাকায়। কিনেছেন সিইএসসি-র কর্ণধার। মমতা তাকে বঙ্গবিভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। মমতার ৯ বছরের শাসনকালে সিইএসসি এখানে বিদ্যুতের মাশুল ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। মমতা কোনো আপত্তি করেননি।
প্রশাসন যে পুরোপুরি ব্যর্থ এবার সে আওয়াজ উঠতে শুরু করেছে মমতার মন্ত্রীসভার অন্দর থেকেই। মমতার দুই প্রবীণ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং সাধন পাণ্ডে অভিযোগ করেছেন, আগে থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। গ্রহণ যে করা হয়নি সে রাজ্যবাসী বিপর্যয়ের পর পরই বুঝেছেন। তিনদিন সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে রাখার পর সেনাবাহিনীকে তলব করা হয়েছে। অথচ পরিকল্পনা থাকলে আগেই সেনা নামিয়ে পরিস্থিতি সামলে দেওয়া যেত।
আসলে সরকারের সমস্যাটি অন্যত্র। এই সরকারের সে অর্থে কোনো অগ্রাধিকার তালিকা নেই। অনুৎপাদক খাতে এই রাজ্যসরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে। মেলা-খেলা-অমুকশ্রী- তমুকশ্রীর পিছনে কোটি কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে রাজ্য সরকারের। কিন্তু সুন্দরবনের নদীবাঁধগুলি পাকাপাকি করে গড়ে তোলার যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার দরকার ছিল তা নেওয়া হয়নি। বিপর্যয় মোকাবিলায় যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা দরকার ছিল তা হয়নি। হাসপাতালগুলিতে শুধু নীল সাদা রং করে সুপার স্পেশালিটি বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সুপার স্পেশালিটি করার জন্য যে পরিকাঠামো গড়ে তোলা দরকার তা করা হয়নি। চালাকির দ্বারা যে মহৎ কার্য সিদ্ধ হয় না তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে এবার বুঝবেন রাজ্যের মানুষ।
রন্তিদেব সেনগুপ্ত