পশ্চিমবঙ্গ এখন শুধুই এক নৈরাজ্য, এক নেই-রাজ্য

২০ মে ২০১১। মহা ধুমধাম করে শহর কলকাতার রাজপথ কাঁপিয়ে মিছিল করে মহাকরণে ঢুকেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক আকাশে ইতিহাস সৃষ্টিকরে ৩৫ বছরের জরঙ্গব বামফ্রন্ট সরকারকে অবিশ্বাস্যভাবে হারিয়ে রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বসেছিলেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের চেয়ারে। তারপর এক মাসের মধ্যেই তিনি জনসমক্ষে প্রকাশ্য সমাবেশে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন—“সব কাজ শেষ করে দিয়েছি। যা যা করার ছিল সব হয়ে গেছে।”

এই লেখাটি যখন লিখছি তখন ক্যালেন্ডারের পাতায় ২৪ মে। টেলিভিশনের পর্দায় সকাল থেকে বারে বারে দেখছি তিনি তার ব্যর্থতা মেনে নিচ্ছেন। পদত্যাগ করছেন না। করবেন না, সেটা জানা। কিন্তু গত ১০ বছরে যে কিছুই হয়নি, তা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিচ্ছেন এই ভাষাতেইঃ“আমরা নিরুপায়। এত বড় দুর্যোগের মোকাবিলা করতে সময় লাগবে। আমায় আপনারা সময় দিন।”

গোটা শহর কলকাতা অবরুদ্ধ। গত দু’মাস ধরে অবরুদ্ধ করোনা ভাইরাস প্রোষিত লাকডাউনের জন্য। তার সঙ্গে এসে মিশেছে। আমফান (অথবা উমপুন) ঝড়ের তাণ্ডব যার গতি ছিল ঘণ্টায় ১৬৫ কিলোমিটার। প্রায় ৬০০০ গাছ উৎপাটিত হয়ে রাস্তায়, বস্তির টালির চালে, ফুটপাতের বাসিন্দাদের ওপর। বিদ্যুৎ নেই, জল নেই, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালে চিকিৎসারত রোগী কেমন আছেন, বেঁচে আছেন না কী মারা গেছেন, তার কোনো খবর নেই। রেশনে চাল নেই, ডাল নেই। গাছ কাটার করাত নেই। কর্মী নেই। হাসপাতালে ডাক্তার নেই, নার্স নেই, ওষুধ নেই। বিদ্যুৎ না থাকার দায় সিএসএসসি-র ঘাড়ে চাপিয়েই খালাস। ওয়েস্টবেঙ্গল স্টেট ইলেকট্রিসিটি ডিস্ট্রিবিউশন কর্পোরেশন লিমিটেড তো সরকারের। তাদের কর্মীরাও ঘরে বসে। জরুরি পরিষেবায় তাদের কাজে নামানোর সরকারি তাগিদ নেই। এত কলকাতাশহরতলির খবর। গ্রামের অবস্থা আরও শোচনীয়। মানুষের মাথায় ছাদ নেই, পেটে দানাপানি নেই। বাঁধ ভেঙেছে শয়ে শয়ে। ক্ষেতে ধান নেই, ফসল নেই, পানীয় জল নেই, পুকুরে মাছ নেই। স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের বইখাতা নেই, গায়ে জামা নেই, প্যান্ট নেই, সব গেছে আমফানে। ঘরে ঘরে কান্না, পাড়ায় পাড়ায় বিক্ষোভ অবরোধ। বস্তিতে বস্তিতে মুখ্যমন্ত্রী আর মেয়রের বাপবাপন্ত। গোটা পরিস্থিতি প্রমাণ করে সরকারটাই নেই। যে সরকার নাকি এক মাসের মধ্যেই সব করে ফেলেছিল।

সরকার যে নেই তা পরিষ্কার একটা দৃশ্যেই – করোনা ভাইরাসের মহামারীর দিনেও পথে মন্ত্রীরা নেই, এমএলএ-রা নেই, এমপি-রা নেই, কাউন্সিলাররা নেই, আশাকর্মীরা নেই, স্বাস্থ্যকর্মীরা নেই, গ্রামাঞ্চলে পঞ্চায়েতের সদস্যরা নেই, প্রধান নেই, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিরা নেই, জেলা পরিষদের সভাধিপতিরা নিশ্চিন্তে ঘরে মুখে মাস্ক বেঁধে ছুটি কাটাচ্ছেন। মূল্যসমেত মাগনার ছুটি কাটাচ্ছেন সব স্তরের সরকারি কর্মীরাও। পুলিশ ছাড়া পথে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। যাঁদের দেখা যাচ্ছে তাদের মুখে স্লোগান, শরীরী ভাষায় বিদ্রোহ। কারও মাথা ফেটেছে, কারও হাত ভেঙেছে, কারও পা ভেঙেছে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে। কোথাও পুলিশের লাঠিতে, কোথাও দিদির ভাইদের সম্মিলিত আক্রমণে। এটা সরকার? নাকি সার্কাস পার্টি ?

আমরা সবাই জানি রাতারাতি এত বড়ো দুর্যোগের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। কোনকালেই কোনও যুগেই কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা তো ‘মহাশক্তিশালী, ‘সর্ববিপদহারিণী’ মমতাদিকে দেখতে, শুনতে অভ্যস্ত। যিনি একমাসেইসব করে দিতে পারেন, তাঁর কাছ থেকে এখন কেন শুনব বড়ো বড়ো কথা কিংবা অসহায় অবস্থার কথা? হ্যা শুনব।

যদি উনি স্বীকার করেন, রাজ্যে পরিকাঠামো গড়ে তোলার প্রচার করেছেন, পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। যদি উনি স্বীকার করেন, উনি রাজ্যের মানুষের সঙ্গে তঞ্চকতা করেছেন, যদি উনি স্বীকার করেন হাসপাতল ভবন হয়েছে, হাসপাতালের পরিকাঠামো গড়া হয়নি। যদি উনি স্বীকার করেন অজস্র স্কুল হয়েছে, কলেজ হয়েছে —শিক্ষক, অধ্যাপক, শিক্ষাকর্মী প্রয়োজনমত নিয়োগ করা হয়নি। যদি উনি স্বীকার করেন, সামাজিক উন্নয়নের জন্য যত টাকা বরাদ্দ হয়েছে তার সিংহভাগই গেছে কাটমানিতে। বাকিটায় যা কাজ হয়েছে তা দীর্ঘমেয়াদি নয়, ক্ষণস্থায়ী। কারণ ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে, পঞ্চায়েতে দিদির পোষ্য ভাইয়েরা, ক্লাবপতিদের পকেট ভরাতে গিয়ে ঠিকাদারদের জলে দুধ মেশাতে হয়েছে। দুধে জল নয়। ফল হয়েছে করোনায় রোগীরা পরিচ্ছন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থা পায়নি। চিকিৎসাকর্মীরা তাদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় মাস্ক পায়নি, পিপিই পায়নি। কোটি কোটি মানুষের করোনা টেস্ট হয়নি। কারণ টেস্টের জন্য কিট মেলেনি। আর উন্নয়ন ? উন্নয়নের নামে যে কসমেটিক চেঞ্জ হয়েছে বলে এতদিন ধরে সমালোচনা হয়েছে বিভিন্ন মহলে, তা প্রমাণিত হয়েছে। গালে পাউডার লাগালে কিংবা সপ্তাহে তিনবার ফেসিয়াল করে ধসে পড়া উন্নয়ন ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনা যায় না। ঝড় বৃষ্টি হলেই ধুয়ে যাবে গলে যাবে মেকআপ—এটাই তো স্বাভাবিক। ফেসিয়াল করে চমক দেওয়া যায়, বয়স লুকোনো যায় না। ফলে কলকাতা লন্ডন হয়নি। দার্জিলিং সুইজারল্যান্ড হয়নি। আমরা এই রাজ্য আর রাজ্যের অধিবাসীরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছি। উন্নয়নে পিছিয়েছি, শিক্ষায় পিছিয়েছি, সংস্কৃতিতে পিছিয়েছি, অর্থনীতিতে পিছিয়েছি। এগিয়েছি কীসে? কাটমানিতে, অপসংস্কৃতিতে, ভোটের রিগিং-এ, মস্তানিতে, লেকচারে, মিথ্যা প্রচারে, গা-জোয়ারিতে ও মানুষকে মানুষ না ভাবাতে।

ট্রাফিক সিগন্যালে রবীন্দ্রসংগীত বাজলে যে সাংস্কৃতিক প্রগতি হয় না, তাতে রোদ্দুর রায়দের মতো গিমিকওয়ালাদেরই সংখ্যা বাড়ে, অবিদ্যা পাড়ার মতো লিপস্টিকে লাইটপোস্টগুলিকে এলইডি আলোয় সাজালেই যেমন কলকাতা লন্ডন হয়ে যায় না, নীল সাদা রঙে সরকারি ভবন, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজকে রং করলেই যেমন সামাজিক উন্নয়ন হয় না, তেমনি মুখ্যমন্ত্রী মুখে রুমাল বেঁধে রাস্তায় রাস্তায় গোল দাগ কাটলে বা মাইক হাতে প্রচারে নামলেই করোনা আটকানো যায় না কিংবা এক সপ্তাহ আগে থেকে আমফানের মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত’ বলে সরকারি বিজ্ঞাপনে মিডিয়া প্রচার করলেই বিপর্যয়কে রোখা যায় না। এর পরেও কি মুখ্যমন্ত্রী বলবেন—আমরা যথাসাধ্য করেছি? এরপরও মুখ্যমন্ত্রী একবারও বলবেন না ভুল করেছি, পাপ করেছি, তার শাস্তি দিন আপনারা?

না, ভুল স্বীকার করার সাহস কিংবা মানসিকতা ওনার নেই। কোনোদিনই ছিল না, তা যদি থাকত তাহলে যোগ্য মন্ত্রীরা গর্তে লুকিয়ে থাকতেন না। যোগ্য অফিসাররা তা তিনি আইএএস কিংবা আইপিএস যাই হোন কেন, ফেউয়ের মতো মুখ্যমন্ত্রীর আঁচল পাহারা দিতেন না। তা যদি হতো, উনি ক্ষমতায় যথাযথ বণ্টন করতেন যেমন করেছে উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ, দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল, বিহারে নীতীশ কুমার। অন্তত শেখার চেষ্টা করতেন। বিপর্যয়ের মোকাবিলা হাতে হাত, কঁাধে কাঁধ মিলিয়ে কীভাবে করতে হয়। তা যদি হতো, সরকারি কাজে সব প্রশংসাটুকু নিজের আঁচলে বেঁধে রাখার চেষ্টা করতেন না। অন্যদেরও ভাগ দিতেন, দেননি। দেবেনও না, তার জন্য ওনার পরিবার লক্ষ কোটির মালিক হবেন। আর পথের ধুলোয় মৃত্যুর সঙ্গে যুঝবে সাধারণ মানুষ। তা যদি হতো, উনি বুঝতেন, প্রধানমন্ত্রীকে কোমরে দড়ি দিয়ে ঘোরাব বলে আজকের মতো ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর’ বলে প্রধানমন্ত্রীর পায়ে ধরতে হতো না।

ভারতবর্ষ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর দেশ। অন্যতম বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ। মা মাটি মানুষকে স্লোগানে আটকে রেখে সস্তার রাজনীতি করলে হবে না। সম্মান দিতে হবে। না, মুখ্যমন্ত্রী সম্মান দেন না। মাটিকে না, মানুষকে না, ভারতমাতাকে না। উনি শুধু ঘুরেমরেন মানুষের মুখে ‘মমতাদি জিন্দাবাদ’ ধ্বনি শোনার জন্য। আর ক্লাবে ক্লাবে কোটি কোটি টাকা বিলিয়ে রিগিং-এর বিল মেটানোর জন্য। আজ রাজ্যের অবস্থা দেখে মনে পড়ে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সেই কালজয়ী ছন্নছাড়া কবিতার লাইনটি—

“…কলেজে সিট নেই কারখানায় কাজ নেই ট্রামে বাসে জায়গা নেই

মেলায় খেলায় টিকিট নেই হাসপাতালে বেড় নেই।

বাড়িতে ঘর নেই

অনুসরণ করবার নেতা নেই

প্রেরণা যোগাবার প্রেম নেই…..”

দুর্ভাগ্য পশ্চিমবঙ্গের, দুর্ভাগা বাঙ্গালি। আজ বাঙ্গালি সত্যিই এক নৈরাজ্য, এক নেই-রাজ্যের বাসিন্দা। তাই তো আমাদের আজ খেত নেই, ভিত নেই, রীতি নেই, নীতি নেই, আইন নেই, কানুন নেই, বিষয় নেই, ভদ্রতা নেই, শ্লীলতা-শালীনতা নেই। আমরা সবাই আজ—

“সেচহীন ক্ষেত মণিহীন চোখ চক্ষুহীন মুখ। একটা স্ফুলিঙ্গহীন ভিজে বারুদের স্তুপ।”

এ রাজ্যের বর্তমানের গতি নেই, নেই কোনোও ভবিষ্যতের ঠিকানা। কারণ আমরা সবাই এক পাপগ্রহের চক্রবর্তে ঘূর্ণায়মান। একজনের অনুপ্রেরণাতেই চলে পশ্চিমবঙ্গ। মা মাটি মানুষ সবই অনুপ্রাণিত একজনের অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক, অশিক্ষা, অপসংস্কৃতির ঘেরাটোপে বন্দি মানসিকতায়। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একদা । রাজনীতিবিদদের প্রশ্ন করেছিলেন—রাজা তোর কাপড় কোথায়?

আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন কী। বলতেন? হয়তো বলতেন—“রানি তুই বে আব্রু। অবগুণ্ঠনে মুড়ে ফেল তোর কালোন্ধকার মুখ। ওই মুখ হয়ে যাক অসূর্যম্পশ্যা।’

সুজিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.