পশ্চিমবঙ্গ দিবসঃ এক বিস্মৃতির ইতিহাস।

যে জাতি বারো মাসে তেরো পার্বণের আদিখ্যেতায় রসগোল্লা দিবসও পালন করতে ভোলে না, অথচ পশ্চিমবঙ্গ দিবস শুনলে বিষ্ময়ে হতবাক হয়, তাকে আত্মবিস্মৃত জাতি ছাড়া আর কিই বা বলা যায়! ভীষণভাবে অবাক হই যখন দেখি, হতভাগ্য বাঙালি হিন্দু দের “quit Noakhali or die” বলা মানুষটিকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয় আর আরব সাম্রাজ্যবাদের বুক চিরে পশ্চিমবঙ্গ কে ছিনিয়ে এনে হতভাগ্য বাঙালি হিন্দুদের স্বাধীনভাবে শ্বাস নেওয়ার এক নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল দেওয়া মানুষটিকে, কাশ্মীরের জন্য জীবন উৎসর্গ করা মানুষটিকে সাম্প্রদায়িক তকমা লাগানো হয়। দূর্ভাগ্য আমাদের। বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদীদের ধূয়া অনুসরণকারী বিকৃত মতাদর্শের পথিক অধিকাংশ ঐতিহাসিক, রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে, ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায় লোকচক্ষুর গোচরে আনেনি। স্তাবকতা নিরপেক্ষ ভবিষ্যৎ বংশীয়দের দৃঢ় লেখনীর উপর আস্থা জ্ঞাপন করে চলুন ফিরে দেখি একটি ইচ্ছাকৃত বিস্মৃত ইতিহাসের উপখ্যান

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে যে বাঙালি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ইচ্ছাকৃতভাবে সবচেয়ে বেশি অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, বছরের পর বছর যাকে মিথ্যা ন্যারেটিভে সাম্প্রদায়িক বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে, গর্বিত বাংলা মায়ের সেই আপোষহীন সুযোগ্য সন্তান ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের (Dr. Shyamaprasad Mukherjee) বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আরো একঝাঁক কৃতী সন্তান যেমন ডঃ মেঘনাদ সাহা, ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, ডঃ সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, শ্রী নলিনী রঞ্জন সান্যাল, শ্রী প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ, শ্রী নলিনাক্ষ সান্যাল, পন্ডিত লক্ষীকান্ত মৈত্র, স্যার যদুনাথ সরকার, শ্রী নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার, শ্রী যাদবেন্দ্র নাথ পাঁজা, ডঃ মাখনলাল রায়চৌধুরী, ডঃ বিনয় সরকার, ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ একত্রিত হয়ে তাদের দৃঢ় চিত্ত ও শাণিত যুক্তি দিয়ে যে মহতী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তারই সার্থক ফলস্রুতি ১৯৪৭ সালের ২০ ই জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস।

সমগ্র বিশ্ব জুড়ে যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দাপাদাপি, ঠিক সেই সময়ে বাঙালি হিন্দুদের তেজস্বী প্রতিবাদ ও প্রত্যাঘাত হেতু বঙ্গভঙ্গ রোধ ব্রিটিশরাজের কাছে চূড়ান্ত অপমানজনক সিদ্ধ হয়েছিল। ঠিক সেই কারনেই ১৯১১ সাল পরবর্তী সময় গুলিতে ঘনিয়ে আসে বাঙালি হিন্দুর কাল। একের পর এক রচিত হতে থাকল বাঙালি হিন্দু বিনাশের পটভূমি। সমগ্র বাংলায় হিন্দু আধিপত্য ক্রমাগত ক্ষুন্ন করার সাথেসাথে ১৯৩২ সালের communal award, ১৯৩৫ এ ভারত রক্ষা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অবস্থা এতটাই সঙ্কটাপন্ন হল যে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ শ্রী নিরোদ চন্দ্র চৌধুরী স্বীকার করতে বাধ্য হলেন…..“হিন্দুদের দেখার কিছু থাকলো, বলার কিছু থাকলো কিন্তু করার কিছুই থাকলো না।” যেটুকু স্বাভিমান বাকি ছিল, তাও লুপ্ত হল কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক শ্রী পদ্মের বিদায়ের মাধ্যমে। অভিবক্ত বঙ্গের একদা প্রচন্ড শক্তিশালী বাঙালি হিন্দু, পথের কপর্দকহীন ভিক্ষুকে পরিনত হল প্রায়। গোঁদের উপর বিষফোড়া রূপে ১৯৪০ সালে বাংলার মুসলিম লীগ সরকার কর্ত্তৃক আনা হল সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্ট Secondary education bill। এই প্রেক্ষিতে ১৯৪০ সালে ২১ই ডিসেম্বর অ্যালবার্ট হলে অনুষ্ঠিত একটি প্রতিবাদ সভায় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় একে communal and reactionary bill বললেন। ঐ বছরই ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে কলিকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্ক থেকে এই বিলের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আওয়াজ ওঠে এবং পালন করা হয় সারা বাংলা প্রতিবাদ দিবস। আন্দোলনের তীব্রতায় সরকার বিল টিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠিয়ে দিয়ে সাময়িক ভাবে পিছু হটে। কিন্তু সমগ্র বাংলায় ইসলামিক রাজ্য গড়ার উদগ্র প্রয়াসে মরিয়া মুসলিম লীগ ১৯৪৬ এর ১৬ আগস্ট Direct action day ঘোষণা করল, যার নারকীয় আগুনে দগ্ধ হল বাঙালি হিন্দু সমাজ। ঐ বছরেই ১০ই অক্টোবর কোজাগরী লক্ষী পূজোর রাতে নোয়াখালি তে শুরু হল মুসলিম লীগের নোয়াখালি অঞ্চলের নেতা কাশেম আলীর নেতৃত্বে হিন্দু বিনাশ যজ্ঞ। কতজন যে প্রাণ হারালেন, কত হিন্দু নারী হলেন ধর্ষিতা, কতজন পুরুষকে বলপূর্বক সুন্নত করিয়ে হত্যা করা হল, কত হিন্দু নারী একলহমায় গৃহবধূ থেকে বারবণিতায় রূপান্তরিত হলেন তার প্রকৃত হিসাব বিগত ৭৩ বছরেও পাওয়া যায়নি, পাওয়া গেছে কিছু কাল্পনিক সামান্য হিসেব মাত্র। বাঙালি হিন্দুর এই বহুমাত্রিক ধ্বংসযজ্ঞে, নিস্ক্রিয়ভাবে দূরে দাঁড়িয়ে উত্তাপ উপভোগ করে গেছে ব্রিটিশরাজ, বঙ্গভঙ্গ রদের অপমানের জ্বালা মেটাতে।

হিন্দু রক্তস্রোতের মধ্যে দিয়ে আরব সাম্রাজ্যবাদীদের সর্বত্র পতাকা উত্তোলনের এই জিঘাংসাকে সার্থকভাবে রুখে দিতে পেরেছিলেন স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজের পরম প্রিয় ও ভরসার পাত্র, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা ১৯৪৭ সালের ৫ই এপ্রিল ঐতিহাসিক তারকেশ্বর সম্মেলনের সূচনা করে হাজার হাজার হিন্দু মা বোনেদের উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনির মধ্যে দিয়ে। এখানেই সিন্ধান্ত নেওয়া হল পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ গঠনের এবং একই সাথে তার ভারতে অন্তর্ভুক্তির। এই পরিপ্রেক্ষিতেই এল সেই সন্ধিক্ষণ ২০ই জুন, ১৯৪৭। সেদিন অখন্ড বাংলার হিন্দু প্রধান অঞ্চলের আইনসভার সদস্যরা পৃথকভাবে বসলেন। ডঃ মুখার্জির সুদক্ষ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট প্রতিনিধিরা বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ভোট দিলেন। মুসলিম লীগের সর্বাত্মক বিরোধিতা সত্ত্বেও বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ভোট পড়ল ৫৮ – ২১। সেই মাহেন্দ্রক্ষণেই সৃষ্টি হল পশ্চিমবঙ্গের।

বাঙালি হিন্দুর রক্তস্নানের মধ্য দিয়ে আরব সাম্রাজ্যবাদীদের করাল গ্রাস থেকে ছিনিয়ে এনে সৃষ্টি হল পশ্চিমবঙ্গ, ১৯৪৭ এর ২০ জুন। দূর্ভাগ্যবশত বিগত দিন গুলিতে পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের উৎসাহ প্রদর্শন করেন নি কেউ। অথচ আমরা দেখতে পাই, ৩০ ই মার্চ রাজস্থান দিবস, পয়লা মে মহারাষ্ট্র দিবস, পয়লা নভেম্বর কর্ণাটক দিবস সাড়ম্বরে সংশ্লিষ্ট রাজ্য গুলিতে পালিত হয়। তবে আমাদের এখানে এত অনীহা কেন? বাঙালি হিন্দু মনন কে অবদমিত করবার জন্যই কি? না কি নির্লজ্জ তোষণবাদী রাজনৈতিক স্বার্থে? নিরপেক্ষ শক্তিশালী লেখনীই এর উত্তর খুঁজুক।

ডঃ তরুণ মজুমদার (Dr. Tarun Majumdar)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.