তৃতীয় পর্ব 

গৌড়স্য পশ্চিমভাগে বীরদেশস্য পূর্বতঃ

দামোদরোত্তরে ভাগে  সুহ্মদেশ প্রকীর্ত্তিতঃ।।

মহাভারত  শুরু করে কালিদাসের রঘুবংশ , জৈন ধর্মগ্রন্থ আচারঙ্গসূত্ত প্রভৃতি সহ নানা প্রাচীন গ্রন্থে সুহ্মদেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্রদ্ধেয় গোপালদাস মহাশয় “নানকার মলুটী’তে #দিগ্বিজয়_প্রকাশ নামে একটি সংস্কৃত ভূগোল গ্রন্থ থেকে প্ৰথমোক্ত শ্লোকটি উদ্ধার করেছেন।

আবার গৌরহর মিত্র বীরভূমের ইতিহাস এর প্রথম খন্ডে দিগ্বিজয়_প্রকাশ থেকেই শ্লোকটির একটি অন্য পাঠের উল্লেখ করেছেন । সেটি হল : 

গৌড়স্য পশ্চিমভাগে বীরদেশস্য পূর্বতঃ

দামোদরোত্তরে ভাগে রাঢ়দেশঃ প্রকীর্ত্তিতঃ।।

অবশ্য  দুটির শ্লোকেই সুহ্মদেশ এবং রাঢ়দেশ শব্দ দুটির অদল বদলে শ্লোকের মূল অর্থ একেবারেই বদলে যায় না। মহাভারতের সভা পর্বে আমরা জানতে পেরেছি যে ,সূক্ষ্ম এবং রাঢ়দেশ একই এলাকার দুটি নাম। 

শ্লোকটির অর্থ হল গৌড়ের পশ্চিমে, বীরদেশের পূর্বে দামোদর নদের উত্তরভাগে সুহ্মদেশ ( রাঢ়দেশ)  অবস্থিত।

মুন্ডারি শব্দে #বীর শব্দের অর্থ হলো জঙ্গল । ১৮৯১  খ্রিস্টাব্দে সেনসাস রিপোর্ট অনুযায়ী সাঁওতাল পরগনা ও বীরভূমের পশ্চিমে জঙ্গলময় অঞ্চলকে বীরভূমি অর্থাৎ জঙ্গল ভূমিও বলা হয়েছে। সুতরাং দামোদরের উত্তরে এবং বর্তমান ঝাড়খণ্ডের পূবের অংশকে বলা যেতে পারে সুহ্মদেশ । সেইসঙ্গে একথাও বলা যায় সেটি ছিল মলুটী গ্রাম গড়ে ওঠার সময় কার অবিভক্ত বৃহত্তর বীরভূমের পশ্চিমাঞ্চল। অর্থাৎ মলুটী গাঁয়ের প্রাচীন সুহ্মদেশের অন্তর্ভুক্ত থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট প্রবল। 

তবে কিনা, অতীতেরও অতীত থাকে । মলুটী সুহ্মদেশ , মল্লভূমের অন্তর্গত ছিল অথবা ছিলনা সেসব বিতর্ক থেকে বেরিয়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগে যাই।  জনবসতিহীন গভীর জঙ্গল কেটে মলুটী গাঁ গড়ে ওঠার আগেও যে সে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটা অধ্যায় পেরিয়ে এসেছে তার বেশকিছু প্রমাণ কিন্তু পাওয়া গিয়েছে ।অবশ্য সে সব সময় তার নাম কি ছিল ,আদৌ নাম ছিল কিনা সে হদিস মেলে না। 

মলুটীর পাশে  চিলা নদীর ঘাটটির নাম সদরঘাট । সেখান থেকে চিলার উজানে শিরালী  পর্যন্ত এক – দেড় কিলোমিটার এলাকার মধ্যে অন্তত তিনটি জায়গায় চিলার গর্ভ বা পাশ  থেকে বেশকিছু পাথরের অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি পাওয়া গিয়েছে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ডঃ সুব্রত চক্রবর্তীর অনুসন্ধান থেকে জানতে পারা যায়,  পুরাতন প্রস্তরযুগ ও নতুন প্রস্তরযুগের সন্ধিক্ষণে এই প্রত্নবস্তুগুলো তৈরি হয়েছিল । এগুলো মূলত প্যালিওলিথিক যুগের হলেও মেসোলিথিক যুগের কিছু যন্ত্রপাতিও এখানে দেখতে পাওয়া গিয়েছে।

মলুটী অঞ্চলে প্রস্তরযুগের যে সকল প্রত্নবস্তু পাওয়া গিয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কুড়ুল, Retouchted Blade , পাশে এবং শেষে ধারযুক্ত ঘষবার  যন্ত্র এবং ছিদ্র করার যন্ত্র।  তবে, বড় অস্ত্র বা তীর কিংবা বর্শার ফলার মত কোন কিছু সন্ধান এখনও এখানে পাওয়া যায়নি। অবশ্য এ কথা সত্য যে , এ বিষয়ে ডঃ সুব্রত চক্রবর্তী যতটুকু কাজ করেছেন তার বাইরে সরকারের তরফ থেকে আজও কোন সংগঠিত অনুসন্ধান হয়নি। তাহলে হয়তো কয়েক হাজার হাজার বছর আগের প্রাগৈতিহাসিক মলুটীর কোন অজ্ঞাত অধ্যায় ইতিহাসের কাছে উন্মোচিত হয়ে যেত ।

পূর্ব পর্ব গুলোতে  মলুটীর ১০৮ মন্দিরের কথা , তাদের গঠনবৈচিত্রের কথা উল্লেখ করেছি। তার সঙ্গে বলেছি পোড়ামাটির ইঁট ও ফলক  নির্মাণের পদ্ধতির কথা । এই সমস্ত মন্দিরগুলোর গাঁথনি সাধারণত চুন সুরকি দিয়ে করা হতো। নদীর কাছাকাছি অঞ্চলে হলে চুন বালির ব্যবহারও চালু ছিল। 

গাঁথনিকে মজবুত করার জন্য এর সঙ্গে পরিমাণমতো গুড় কিংবা গুড় তৈরীর সময় পাওয়া গুড়ের গাদ ( যা সাধারণভাবে ফেলে দেওয়া হয় অথবা মদ তৈরির কাজে লাগে)  এবং হর্তুকি , খয়ের,  মেথির বীজ ভেজানো জল মেশানো হতো । 

চুনের আবার তিনটি ধরন ছিল । বাংলার বহু জায়গায়, বিশেষত রাঢ় অঞ্চলে চুনাপাথরের ছোট বড় ঢেলা পাওয়া যায় । যার  স্থানীয় নাম হল #ঘুটিং। এই ঘুটিং পুড়িয়ে যে চুন পাওয়া যেত তা শুধু গাঁথনির কাজে ব্যবহার হতো।  এছাড়া #জোংড়া নামে গাজরের মতো আকারের নোনা জলের শামুকের খোলা পুড়িয়ে জোংড়া চুন পাওয়া যেত। আবার পুকুরের শামুক , গেঁলা ,গুগলি পোড়ানো চুুুনকে #বাখারি_চুন বলা হতো ।  জোংড়া ও বাখারি_চুন গাঁথনি ও পলেস্তরা করার জন্য বেশি ভালো ছিল।

 মন্দির তৈরির কারিগরদের বলা হত সূত্রধর । তাঁদের মধ্যে একজন থাকতেন প্রধান স্থপতি। মন্দিরের বিভিন্ন রকমের নকশা , ধরন,  গঠন ইত্যাদি নির্ণয় বা আঁকার কাজ তিনি করতেন । তারপর দলের অন্যান্যদের মধ্যে কাজের দায়িত্ব ভাগ করে দিতেন।  বিভিন্ন দলের প্রধান স্থপতির ভাবনাচিন্তানুযায়ী মন্দিরের নকশা , অলংকরণ ইত্যাদি অনেকটাই আলাদা হতো । ফলে , মন্দিরগুলিতে নানান বৈচিত্র দেখতে পাওয়া যেত । অলংকরণের সময় কোন ফলক কোথায় বসবে প্রধান স্থপতি তা ঠিক করে দিতেন ।

অলংকরণের ক্ষেত্রে রামায়ণ,  মহাভারত , শ্রীকৃষ্ণের লীলা, দশাবতার ইত্যাদি বিভিন্ন চিত্রের পাশাপাশি দেবী মাহাত্ম্য অর্থাৎ দুর্গা , মহিষমর্দিনী, দশমহাবিদ্যা এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বিভিন্ন সমসাময়িক ঘটনা ইত্যাদি মন্দিরের ফলক এবং প্যানেলগুলোতে দেখতে পাওয়া যেত।  এই দ্বিতীয়ধরনের ফলকগুলো থেকে তখনকার সমাজ জীবন সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায় ।

 মলুটীর প্রায় সব কটি অলংকৃত মন্দিরের বাঁ পাশের প্যানেলে ছোট ছোট ফলকে রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনা স্থান পেয়েছে । যার মধ্যে আছে বন গমন,  মারীচ সংহার, সীতাহরণ , জটায়ুবধ ইত্যাদি । মারীচ বধের চিত্রে দেখা যায় হরিনের দেহ ফুঁড়ে মারীচ বেরিয়ে এসে রামকে প্রণাম করছে,  হরিণের মুন্ড মাটিতে পড়ে আছে। আবার  কোথাও দাড়িওলা বনবাসী রামকেও দেখতে পাওয়া যায় । 

ডানদিকের পার্শ্ব প্যানেলে আছে কৃষ্ণলীলার বিভিন্ন 

চিত্র , যেমন –  যমলার্জুন উদ্ধার , বকাসুর বধ , রাধা কৃষ্ণের লীলা ইত্যাদি। বাংলার অধিকাংশ মন্দিরেই  কৃষ্ণলীলা দেখতে পাওয়া যায়।

‘নানকার মলুটী’তে শ্ৰীকৃষ্ণের একটি দুর্লভ চিত্র উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণে চিত্রটি হল ষড়ভুজ। গ্রন্থ বর্ণনা অনুযায়ী কৃষ্ণ দুই হাতে বাঁশি বাজাচ্ছেন, দুই হাতে ধনুর্বাণ আর দুই হাতে খড়্গ ও শিঙ্গা ধরে আছেন। শ্রীকৃষ্ণের এই রূপ ভাগবত বা অন্য কোন প্রাচীন গ্রন্থে  পাওয়া যায় না।  এটি কিন্তু বিশ্বরূপ মূর্তি নয়।  এক্ষেত্রে একটি রামপ্রসাদী গান মনে পড়ে – 

ঐ যে কালী কৃষ্ণ শিব রাম – সকলই আমার এলোকেশী।

শিব রূপে ধর শিঙ্গা , কৃষ্ণ রূপে বাজাও বাঁশি।

ও মা, রাম রূপে ধর ধনু , কালী রূপে করে আসি।

আলোচ্য ষড়ভূজ কৃষ্ণ চিত্রটিকে দুর্লভ চিত্র বলার কিছু কারণ আছে । প্রসঙ্গত এটি শ্ৰীকৃষ্ণের না শ্রীচৈতন্যদেবের তা নিয়ে একটি বড় বিতর্ক আছে। মহাপ্রভু  পুরীতে বাসুদেব সার্বভৌম এবং নবদ্বীপে নিত্যানন্দকে তাঁর ষড়রূপ দর্শন করিয়েছিলেন বলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব বিশ্বাস করেন । সেই কিংবদন্তি অনুসরণ করে সতেরো শতক থেকে বিভিন্ন সময়ে তৈরি হওয়া বাংলার অনেক মন্দিরেই শ্রীচৈতন্যদেবের ষড়ভূজ মূর্তি স্থান পেয়েছে।  সেখানে শ্রীচৈতন্যদেব,  রাম ও  কৃষ্ণের সমন্বয় ঘটেছে।  মুর্তিগুলোর মুখাবয়ব এবং নিচের দুটি হাত শ্রীচৈতন্যদেবের , ওপরের দুই হাত রামচন্দ্রের এবং মাঝের দুই হাত কৃষ্ণের। শ্রীচৈতন্য ত্রিভঙ্গ ঠামে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর বাম পাটি সোজা এবং ডান পা বাঁকানো।

 পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের দক্ষিণ দরজার কাছে ষড়ভূজ শ্ৰীচৈতন্যদের বিশাল মূর্তি আছে। গুপ্তিপাড়া( হুগলী) বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরের ফ্রেস্কোয় দুজোড়া অতিরিক্ত হাতের একজোড়ায় রামের জন্য সবুজ,  অন্য জোড়ায় কৃষ্ণের  জন্য নীল রং ব্যবহার করা হয়েছে । এছাড়াও টেরাকোটার চৈতন্যের ষড়ভুজ মূর্তি দেখা যায় – কাটোয়ার গৌড়াঙ্গপাড়া, জয়দেব কেন্দুলি রাধাবিনোদ মন্দির , বাঁশবেড়িয়ার অনন্ত বাসুদেব মন্দির , বীরভূম উচকরণ , বাঁকুড়ার হোদলনারায়নপুর , বীরভূমের মল্লেশ্বর মন্দিরে। ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে রাজা বীরচন্দ্র সিংহের প্রতিষ্ঠা করা বিষ্ণুপুরের তেজপাল মন্দিরে এবং সতেরো শতকের মাঝামাঝি তৈরি বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত শ্যমরায় এবং জোড়বাংলা মন্দির এর পোড়ামাটির অলঙ্করণে এমন ষড়ভুজ চৈতন্য মূর্তি দেখা যায়।

 কিন্তু কৃষ্ণ ষড়ভূজ মূর্তি মলুটী ছাড়া আর কোথাও আছে কিনা জানতে পারা যায় না। আর পূর্বেই বলেছি এটিকে কৃষ্ণমূর্তি বলা হলেও এটি কৃষ্ণের মূর্তি নাকি মহাপ্রভুর মূর্তি তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে।

নানকার মলুটীর  লেখকের বর্ণনায় ষড়ভুজের নিচের একটি হাতে খড়্গের কথা লিখলেও সেই হাতে খাঁজকাটা কাটা মোটা লাঠির মতো যে অস্ত্রটি দেখা যায় তার সঙ্গে খড়্গ নয় বরং গদার মিল অধিক। তাছাড়া খড়্গের মাঝখানটি কেউ ধরে না। অথচ , চিত্রে সেইটা দেখা যাচ্ছে ।

মলুটীর এই মূর্তিটি সঙ্গে বীরভূম জেলার উচকরণের সরখেল পরিবারের চারটি চারচালা শিব মন্দিরের দ্বিতীয় মন্দিরের ( ১৭৬৯ ) দরজা ডানদিকে উললম্ব প্যানেলে ষড়ভূজ চৈতন্য মূর্তিটির আশ্চর্য রকমের মিল পাওয়া যায়।  সেখানে মূর্তির নিচের একটি হাতে গদার মতো একটি আয়ুধ দেখা যায় । কিন্তু মূল তফাৎ হলো

উচকরণের মূর্তির হাতে কমন্ডুল আছে এবং মলুটীর মূর্তির হাতে শিঙ্গা দেখা যায়।

আরো একটি তফাৎ হলো উচকরণে মূর্তির পাশে একই ফলকে বাসুদেব সার্বভৌমকে দেখা যায়। মলুটীর মন্দির একক। অবশ্য এসব খুব বৃহৎ পার্থক্য নয়। 

  মলুটীর মন্দির দুটি কারণে দুর্লভ।  প্রথমত , যদি এটি কৃষ্ণমূর্তি হয় তবে বলা যায় ষড়ভুজ কৃষ্ণমূর্তি একান্তই দুর্লভ । আর দ্বিতীয় কারণটি হলো যদি না হয় তবে চৈতন্যের শিঙ্গাধারী ষড়ভূজ মূর্তি সম্ভবত একটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।

#ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ১) মলুটির টেরাকোটার মন্দির

 ২) মন্দিরময় মলুটী 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.