প্রাক স্বাধীন ভারতে এক হার না মানা বীরাঙ্গনার কেমন করে মরনপণ লড়াই চালিয়েছিলেন তার কথা এই বীরগাথায় লেখার চেষ্টা করছি
ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন তিনি।১৮৫৭ সালের বৃটিশ শাষনের নাগপাশ থেকে দেশবাসীর মুক্তির জন্য, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক হয়ে তিনি আজও উজ্জল, আজও অবিনশ্বর।
নাম ছিল তার মণিকর্ণিকা (Manikarnika) (মনি) ১৮৩৫ সালের ১৯ শে নভেম্বর বারাণসীতে তাঁর এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম। পিতা মারোপান্ত তাম্বে ও মাতা ভাগীরথি বাই তাম্বে।তাঁর মাত্র চার বছর বয়সেই মাতৃবিয়োগ ঘটে। লক্ষীবাই খুব মিশুকে এবং সুন্দরী ছিলেন।শিক্ষা দীক্ষা বাড়ীতেই হয়েছিল তাঁর। ঘনিষ্ঠজনেরা তাঁকে চামেলী নামেও ডাকতেন।
পিতা তাঁকে পারদর্শিতার সঙ্গে অস্ত্র শিক্ষা গ্রহন করান। অস্ত্র চালনা, ঘোড়ায় চড়া সব কিছুতেই তিনি পারদর্শিনী হয়ে ওঠেন।
পিতা মারোপান্ত তাম্বে প্রথমে বিথুরের পেশোয়া দরবারে চাকরি করতেন এবং পরে তিনি ঝাঁসির মহারাজার দরবারে যোগ দেন।সেই ঝাঁসিই হয়ে উঠলো লক্ষীবাইয়ের কর্মভূমি। ঝাঁসির রাজা বাল গঙ্গাধর রাও নিম্বলকারের সঙ্গে লক্ষীবাইয়ের বিবাহ হয় ১৮৪২ সালে। লক্ষীবাই সেই পুত্রহীন রাজার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন। সদ্য কিশোরী রানী লক্ষীবাই এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন ১৮৫১ সালে কিন্তু সেই সন্তান মাত্র চার মাস বেঁচেছিল । এরপর ১৮৫৩ সালে গঙ্গাধর রাও গুরুতর অসুস্থ হবার পরে দামোদর করাও বলে এক দুর সম্পর্কের আত্মীয়কে পুত্র হিসাবে দত্তক নেন এবং সেই বছরেই গঙ্গাধর রাও মারা যান। তাই লক্ষীবাইকে রাজকার্য্য সামলাতে হয়।দত্তক শিশু পুত্রের ব্যাপারে বৃটিশরা লর্ড ডালহৌসির মাধ্যমে আইনি বৈধতা নিয়ে আপত্তি তোলেন এবং ঝাঁসি বৃটিশ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রাধীন বলে দাবী করেন। লক্ষীবাইকে ষাট হাজার টাকা পেনশন দিয়ে ঝাঁসির দুর্গ ছেড়ে চলে যেতে বলেন।কিন্তু লক্ষীবাই তা সম্পূর্নরুপে অস্বীকার করেরন। লক্ষ্মী বলেছিলেন, ‘আমি দিব না! আমি আমার ঝাঁসি ছেড়ে দিব না! কেউ আমার ঝাঁসি কেড়ে নিতে পারবে না; যার সাহস আছে সে চেষ্টা করতে পারে!’
১৮৫৭ সালে মীরাটে ঘটে সিপাহী বিদ্রোহ, সেই সময়ই লক্ষীবাই ঝাঁসি নিজ শাষনে রাখতে মরনপণ সংগ্রাম শুরু করেন এবং দত্তক নাবালক পুত্রের হয়ে রাজ্য শাষন শুরু করেন। ঝাঁসির দুঃসাহসী রানী বৃটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন। ইংরেজদের বিতাড়িত করে ঝাঁসির রানী শুরু করেছিলেন তার রাজ্য শাসন।খুব দ্রুততার সঙ্গে তাঁর সেনা বাহিনী তৈরী করে বুন্দেলখন্ডেরও দায়ীত্ব গ্রহন করেন।প্রতিবেশী সকল বিদ্রোহীরা ঝাঁসিতে এসে লক্ষীবাইকে সমর্থন জানান। রানী লক্ষ্মীবাই ঝাঁসির সুরক্ষা জোরদার করতে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও গঠন করেছিলেন। মহিলাদেরও এই সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হয়েছিল এবং যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
সিপাহী বিদ্রোহে অনেক বৃটিশদেরকে হত্যা করে বিদ্রোহীরা। বৃটিশ বিরোধী বিদ্রোহ চুড়ান্ত আকার ধারন করে এ সারা ভারতে দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।রানী লক্ষীবাই তাতে অংশগ্রহন করেন।
১৮৫৮ সালে বৃটিশরা ঝাঁসি আক্রমন করেনরানী লক্ষীবাই এক বীরাঙ্গনার মতোই সম্মুখ সমরে অবতীর্ন হন। তাঁকে সাহায্যর জন্য তাতিয়া টোপে কুড়ি হাজার সৈন্য নিয়ে যোগদান করেন।কিন্তু অনেক কম সৈন্য নিয়েও বৃটিশরা দমন করে ঝাঁসির দুর্গ দখল করে নেয়। নিজেকে ব্রিটিশদের দ্বারা বেষ্টিত দেখে লক্ষ্মী বাই তার দত্তক পুত্র দামোদর রাওকে নিজের পিঠে বেঁধে সাদা ঘোড়ায় বসে দুর্গের ১০০ ফুট উঁচু প্রাচীর থেকে লাফিয়ে পড়েছিলেন। রানী দামোদর রাওকে নিয়ে ব্রিটিশদের বন্দি হওয়া থেকে পালাতে সফল হন। রানী ঝাঁসি থেকে পালিয়ে কালপি পৌঁছে গিয়ে তাঁতিয়া টোপের সাথে দেখা করেছিলেন। তাঁতিয়া ও রানির সম্মিলিত সেনাবাহিনী গোয়ালিয়র থেকে বিদ্রোহী সৈন্যদের সহায়তায় গোয়ালিয়রের একটি দুর্গ অধিকার করেছিল। ১৮৫৮ সালের ১৭ জুন গোয়ালিয়রের নিকটে কোটার আশ্রয়স্থানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করার সময় রানী লক্ষ্মীবাই (Rani Lakshmibai) মৃত্যু বরণ করেন

তিনি অধিকাংশ সময়েই নীল রঙের জামা, পায়জামা ও মাথায় সুন্দর পাগড়ির মতো টুপি পরতেন। কোমরে জড়ানো দোপাট্টা, তাতে ঢোকানো থাকতো রত্নখচিত তলোয়ার।তিনি কখনও পুরুষবেশে, কখনও নারীবেশে দরবারে উপস্থিত হতেন।

প্রখর বুদ্ধিমতী ছিলেন তিনি। নিজেই আইন প্রণয়ন করতেন। আইন প্রয়োগের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন এবং আইনের অধিকার ও অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে বিচক্ষনতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন।তাঁর মহিমা বর্ণনাতীত।

সামরিক সঙ্গীত পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতার জাতীয় পতাকা তার সামনে সামনে বহন করা হতো।
দেশপ্রেমের আগুন সব সময় তার মনে জ্বলজ্বল করতো। আর তিনি যুদ্ধে তার দেশের সম্মান এবং শ্রেষ্ঠতার জন্য গর্ব বোধ করতেন।

একটি দেশের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় এমন এক বীরাঙ্গনা বিদুষিনী নারীকে পাওয়া
সৌমিত্র সেন। (Soumitra Sen)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.