সে সেই মহাভারতের কথা। সে অনেক অনেককাল আগের কথা। শ্রীকৃষ্ণ দূত হয়ে শান্তি প্রস্তাব নিয়ে যান। তিনি পাঁচ পান্ডবের জন্য পাঁচটি গ্রাম দান করার অনুরোধ করেন , যেখানে পান্ডবেদের স্বতন্ত্র অধিকার থাকবে। কিন্তু হায়, স্বতন্ত্রতা ! তাও পান্ডবদের ? জ্ঞাতিভাই তো কি ? শত্তুর তো ভেবে এসেছে সেই জন্ম কাল হতে। তাই দুর্যোধন  শান্তি প্রস্তাব অস্বীকার করে বললেন , ”  “বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী”। শ্রীকৃষ্ণকে গোয়ালা বলে অপমান করে বন্দী করতে চাইলেন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন , ” বেশ তোমার যখন বিধ্বংসের চাহিদা তবে বিধ্বংসই হোক।” কিন্তু জ্ঞাতি বিরোধিতা ভালো কথা নয়। ভবিষৎ প্রজন্ম কি শিখবে ? ইতিহাসই বা কি শেখাবে ? বিদুর সেই সভায় তখন জ্ঞাতি বিরোধিতার কুফল দেখিয়ে অনেক গল্প বলে উপদেশ দিয়েছিলেন। বিদুর নীতির মধ্যে সেই উপদেশগুলি আজও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বড় গুরুত্বপূর্ণ।  কি ছিল সেই উপদেশ ? সেই গল্প বলি আজ : 

কোনো এক পক্ষী শিকারী ব্যাধ একবার পক্ষী ধরবার জন্য এক অরণ্যের মাঝে ফাঁদ পেতেছিল। একদিন প্রাতঃকালে হল কি , দুটি শকুন সেই ফাঁদে আটকে গেল। শকুন তো খুব বড় পাখী। ওদের গায়ে জোরও খুব। তারা কি করল তখন? তখন তারা গায়ের জোড়ে এমন টান দিল যে , জাল সুদ্ধ  উপড়ে এল । তারপর , তারপর সেই জাল নিয়েই আকাশে উড়ান দিল। 

এদিকে ব্যাধ এসে দেখলে পাখী উড়েছে তো বটেই , জালও নেই। কিন্তু ব্যাধ বুদ্ধিমান । সে বিলাপ করলে না। মাঠের উপর দিয়ে উড়ন্ত শকুনদের গতি লক্ষ্য করে সঙ্গে সঙ্গে ছুট যেতে লাগল।  সেই ব্যাধ যে পথ দিয়ে ছুটছিল , সেই পথ দিয়ে এক মুনি আসছিলেন স্নান করতে।  তিনি ব্যাধের কান্ড দেখে বললেন , ” ওহে বাপু, তুমি কি মনে করো যে , তুমি ছুটে গিয়ে ওদের ধরতে পারবে ?  তাছাড়া ওরা উড়ে গিয়ে কোনো উচ্চ পাহাড় বা বৃক্ষের ডালে বসবে – তুমি কি করে পাবে ওদের ? “

ব্যাধ কিন্তু নিজেকে বোকা ভাবল না । বরং হাসল…একটুও অপ্রতিভ না হয়ে মুনিকে সে প্রণাম করে বলল , ” আপনি সরল ঋষি, সংসারে কিছুই খবর রাখেন না । তাই এমন কথা বলছেন। ওরা দুজনে মিলে চেষ্টা করে জাল তো সবসুদ্ধ উপড়ে নিয়েছে। ওদের সে সদ্ভাব আর একতা  কতক্ষণ থাকবে ? জীব মাত্রেই একত্র কিছুকাল থাকলে বিবাদ হবেই। ওরাও সেই নিয়মের বাইরে যাবে না। ফলে, নিজেদের ঝগড়া ও যুদ্ধ করে মাটিতে পড়ে যাবে।”

ব্যাধের কথা সত্য হল। শিগগিরই শকুন দুটি ঝগড়া , লড়াই করে ক্লান্ত হয়র মাটিতে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ল। ব্যাধকে তাই তাদের হত্যা করার জন্য বিশেষ কিছু করতে হল না। পাখী ও জাল উভয়ই পেয়ে গেল।

পরিশেষে বিদুর বললেন – 

চত্বারি তে তাত গৃহে বসন্তু শ্রিয়াভিজুষ্টস্য গৃহস্থধর্মে ।

 বৃদ্ধো জ্ঞাতিরবসত্রঃ কুলীনঃ সখা দরিদ্রো ভগিনী চানপত্যা ॥

সংসার হোক বা দল , গোষ্ঠী হোক বা রাষ্ট্র  সর্বত্র সুখ , শান্তি ও ধনসম্পদকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য , শ্রীকে ধরে রাখার জন্য জ্ঞাতি ও বন্ধুবিবাদ করা উচিত নয়। গৃহবিবাদ শত্রুর পথকে প্রশস্ত করে। বয়ঃজ্যেষ্ঠ অভিভাবক, জ্ঞাতি, মিত্র এবং নিজের ভোগীনিকে সম্মান করা ও ভালোবাসা উচিৎ। তাতে কৌম শক্তি বৃদ্ধি পায়।

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ মহাভারত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.