করোনা ভাইরাস আক্রান্ত বিশ্বে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে, লাগাতার লকডাউনে আতঙ্কিত বিশ্ব অর্থনীতি গভীরমন্দারমুখোমুখি। বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) একমত যে, করোনা সংক্রমণ কমলেও এর জুতসই প্রতিষেধক যতদিন না আসছে ততদিন করোনার সঙ্গে লড়াই করেই মানুষকে বাঁচতে হবে। অতএব রাষ্ট্রনায়করা একমত যে, লাকডাউন পর্যায়ক্রমে তুলে দিয়ে আর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও চালিয়ে যেতে হবে। তা না হলে অর্থনীতির মুখ থুবরে পড়বে। মন্দাক্রান্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশ ইতিমধ্যেই আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। জাপান সে দেশের
1791-7 (Gross Demestic Product) ২১%, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ১৩%, ভারতবর্ষ ১০% এবং চীনের রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্ক Peoples Bank of China সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির মাধ্যমে US $ 115 billion ঋণের জোগান দেওয়ার। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১২ মে ২০ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজের কথা ঘোষণা করেছেন ভারতের অর্থনীতিকে মজবুত ভিতের উপর দাঁড়। করাতে, যা উন্নয়নশীল দেশসমূহের মধ্যে সর্বাধিক। ভারতের অর্থমন্ত্রী শ্রীমতী নির্মলা সিতারমন এই আর্থিক প্যাকেজের যে রূপরেখা বিবৃত করেছেন তা নিম্নরূপ
(১) প্যাকেজের মোট আর্থিক সংস্থান। দাঁড়াবে ২০,৯৭,০৫৩ কোটি।
(২) ক্ষুদ্র ছোট ও মাঝারি শিল্পে ঋণ দিতে ৩ লক্ষ কোটি টাকার তহবিল গঠন।
(৩) চাষিদের ঋণ দিতে ২ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা।
(৪) হকারদের ঋণ দিতে ৫ হাজার কোটি টাকা।
(৫) কৃষি পরিকাঠামো তৈরীতে ১ লক্ষ কোটি টাকা খরচ।
(৬) ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে প্রায় ৮ লক্ষ কোটি টাকার ঋণের যোগান।
(9) P.D.S (Public Distribution System) এর মাধ্যমে ৭৫ কোটি মানুষকে ৬ মাস ধরে বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রি বণ্টন। মাথাপিছু ৫ কোজি চাল এবং ১ কেজি ডাল একবারেই তোলা যাবে।।
(৮) ৮০০ হেক্টর জমিতে ঔষধি ভেষজ চাষের ব্যবস্থা।
(৯) ১ লক্ষ হেক্টর জমিতে হারবাল উদ্ভিদ চাষে ১ হাজার কোটি টাকা।
(১০) দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদনে ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ।।
(১১) প্রধানমন্ত্রী মৎস্য সমবায় যোজনায় ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ।
(১২) ক্ষুদ্র খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা।
(১৩) লকডাউনের জন্য কৃষিপণ্যে সহায়ক মূল্য দিতে ৭৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ।
(১৪) প্রধানমন্ত্রী কিষান প্রকল্পে আর্থিক সাহায্যের জন্য ১৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
(১৫) বাজেট বরাদ্দ ৬১৫০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত ৪০ হাজার কোটি টাকা মঞ্জুর, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ১০০ দিনের কাজে শামিল।
(১৬) কৃষির উন্নয়নে ১ লক্ষ কোটি টাকার পরিকাঠামো তহবিল।
(১৭) ২০২০-২১ অর্থবর্ষে শর্তাধীনে বাজেট ঘাটতি ৩% থেকে ৫% করার অধিকার রাজ্যের। এতে রাজ্যগুলির হাতে অতিরিক্ত ৪.২৮ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১.০৭ লক্ষ কোটি টাকা বিনাশর্তে।
(১৮) মহিলাদের জনধন প্রকল্পে মাসিক ৫০০ টাকা এবং উজ্জলা প্রকল্পে ৩টি বিনা পয়সায় গ্যাস সিলিন্ডার বরাদ্দ। উপভোক্তাদের মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদেরও অনেকে আছেন।
এই ত্রাণ প্যাকেজকে আত্মনির্ভর ভারত গঠনের প্রকল্প হিসেবে দেখার কথা বলছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে। তাঁর মতে এই প্যাকেজ স্বল্পকালীন আর্থিক সংকটের বাইরে, ভবিষ্যতে বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থায় ভারতকে শক্ত ভিতের উ পর দাঁড় করাবে। এই প্যাকেজের সমালোচকদের মতে ২০ লক্ষ কোটি টাকার যে কথা বলা হচ্ছে তার মধ্যে মাত্র ২,১৭,০৯৫ কোটি টাকা আসবে সরকারি তহবিল থেকে। বাকি টাকা অতীতে ঘোষিত বাজেট বরাদ্দ। শিল্পে ঘোষিত নানা ধরনের কর ছাড় এবং এনবিএফসি-তে অর্থ জোগান সহ, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ যোগানের মাধ্যমে আসবে। যা এই মুহূর্তে সংকটাপন্ন মানুষের কাজে আসবে না। পরিয়াযায়ী শ্রমিক এবং কাজ হারানো মানুষকে হাতে নগদ দিয়ে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে অর্থনীতিকে সচল করতে হবে। এই মতের সমর্থক অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও অনুৎপাদক ক্ষেত্রে অর্থ বিলানোর জন্য যদি মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় তবুও।সরকারি তহবিলের টাকা আর ব্যাঙ্কের টাকা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন,টাকাটা কোথা থেকে এসেছে। এ প্রশ্ন না তুলে দেখুন টাকাটা কোথায় যাচ্ছে। অর্থাৎ এযেন বিড়ালের রং নিয়ে প্রশ্ন তোলার মত। মূল ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত সেক্টরগুলিকে চিহ্নিত করে তাদের অর্থযোগানের ব্যবস্থা করা। নগদ পাইয়ে দেওয়া নয়, কারণ এভাবে অর্থনীতির পুনর্গঠন সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রকল্পে যেমন মানুষ যাতে পুনরায় কাজে ফিরতে পারেন তার জন্য পরিকাঠামো তৈরির ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে আগ্রহীদের উৎসাহিত করার প্যাকেজ রয়েছে। আবার দীর্ঘদিন লকডাউনে কাজ হারানোদের রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে অন্নের ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে উপকৃত হচ্ছেন ৭৫ কোটি মানুষ। তবে ছোট-মাঝিরি শিল্পোদ্যোগ ছাড়াও ছোটো-ছোটো দোকানদার যাদের সংখ্যাও সারা দেশে কোটি কোটি, তাদের কিন্তু এই প্যাকেজে পাওয়ার কিছু নেই। যেমন নেই পরিযায়ী শ্রমিকদের ভবিষ্যতে কাজে যোগ দেওয়ার গ্যারান্টি। এই প্রতিবেদকের মতে, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজ-নিজ রাজ্যে না ফিরিয়ে কর্মস্থলে রেশনের ব্যবস্থা করে, স্থানান্তরের সুযোগ না দেওয়া। এর ফলে করোনা সংক্রমণের সম্ভবনা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি করোনামুক্ত পরিস্থিতিতে কৃষি এবং শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিকের অভাবে উন্নয়ন এবং উৎপাদন মার খাবে। রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে পরিযায়ীদের স্ব-স্ব স্থানে রেখে তাদের খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে কেন্দ্র এত সমালোচনার মুখে পড়ত না।
কেন্দ্র কেন করোনামুখী নগদ বিলির পরিবর্তে এই সংকটকালে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তার শামিল তার উত্তর খুঁজতে বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদদের অনেকের অভিমত স্মতব্য। তাদের মতে সংস্কার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এইটাই উপযুক্ত সময়। এমনকী, জাতিসঙ্ঘের অর্থ বিষয়ক সংস্থা WESP (World Economic Situation Prospect)-এর তরফে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই বিশাল আর্থিক প্যাকেজ ভারতের অর্থনীতিকে মজবুত করবে। তবে তারাও কেউ কেউ মনে করেন, মানুষের হাতে টাকা না এলে এবং ভোগ্যপণ্যে খরচ না বাড়লে দ্রব্যের চাহিদা বাড়বে না, তাতে যদি Demand Pull inflation হয় তোক। অর্থাৎ Keynesion অর্থনীতির মতবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি উৎপাদন না বাড়ে, তা হলে তো মুদ্রাস্ফীতি সহ্যসীমার বাইরে গিয়ে stagflation বা অতিমুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি করবে। যতক্ষন পর্যন্ত মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের সামঞ্জস্য থাকে এবং বেতন বৃদ্ধির ফলে ক্রয়ক্ষমতা সঙ্কুচিত না হয় ততক্ষণ মুদ্রাস্ফীতি অর্থনীতির পক্ষে লাভজনক। কিন্তু staflation এর মতো পরিস্থিতিতে ক্রয়ক্ষমতা কমে মন্দাজনিত সমস্যা দেখা দেবে। ফিরে আসবে অর্থনীতিতে Recession-এর প্রভাব। ফলে হ্রাস পাবে রপ্তানি। টাকার মূল্য কমে যাবে, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি বাড়বে, ভারতের বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিশ্ব-রেটিং নিম্নগামী হবে বিশ্বের দরবারে মর্যাদা হারাবে ভারত।
আর এখানেই প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক প্যাকেজের বিশেষত্ব। কৃষি থেকে শুরু করে উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করে সংস্কারের অঙ্গীভূত করে অর্থযোগানের প্রস্তাব রয়েছে এই প্যাকেজে। ছোট, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পদ্যোগ, NBFC-তে অর্থজোগান, আবাসন ক্ষেত্র, বিদ্যুৎ ক্ষেত্র সংস্কার ও দায়বদ্ধতা, কর্মসংস্থানের ভাবনা, পরিকাঠামো উন্নয়ন, নতুন কৃষিপণ্য আইন, বিমান ও কয়লাক্ষেত্রে সংস্কার এবং বিলগ্নীকরণ সহ বহু সংস্কারের প্রস্তাব রয়েছে। এই প্যাকেজে, যার সফল রূপায়ণ হলে ভারতের অর্থনীতি শুধু ঘুরে দাঁড়াবে তাই নয়, সমগ্র বিশ্বে ভারত আর্থিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে। তাই বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বাণিজ্যসংস্থা এই প্যাকেজকে স্বাগত জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর প্যাকেজে উৎপাদনের ৪টি মূল উপাদান, যেমন—জমি, শ্রম, অর্থ এবং আইনে সংস্কারের প্রস্তাব রয়েছে। সরকার মনে করে ব্যবসা করবেন ব্যাবসায়ীরা, সরকার তার উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করে শুধুমাত্র কল্যাণমূলক ও উন্নয়ন কর্মসূচিতে আত্মনিয়োগ করবে। তাই করোনা সংকটের মধ্যে এই বিপর্যয়কে ভবিষ্যতের সযোগে পরিণত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সরকার। করোনা পরিস্থিতিতে চীনের ওপর আস্থা হারানো বিনিয়োগকারীরাও যাতে ভারতকে ব্যবসার গন্তব্যস্থল মনে করে, তারজন্য সংস্কারকে অঙ্গীভূত করে এই বিশাল আর্থিক প্যাকেজ। সুতরাং ভারতের পুনর্গঠনে এবং আত্মনির্ভর ভারত গঠনে এই প্যাকেজ সময়োপযোগী ও সঠিক। অবশ্য কেন্দ্রীয় সাহায্যের End use (খরচের হিসাব) সার্টিফিকেট চাইলে যাঁরা কেন্দ্রের দাদাগিরির অভিযোগ তোলেন নগদ না পেলে তাদের হতাশা তো থাকবেই।
কে. এন. মণ্ডল
(লেখক ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য প্রবন্ধক)