করােনার আবহে অর্থনৈতিক সংকটে আত্মনির্ভরতাই হতে পারে একমাত্র মন্ত্র

১৫৯ বছরে এ এক অন্য ২৫ শে বৈশাখ, লকডাউনের রবীন্দ্রজয়ন্তী। ২৫ বৈশাখ, কবিগুরুর জন্মদিন। তবে ২০২০-তে সেই চেনা ছবি আর ধরা দিল না। দীর্ঘ ১৫৯ বছরে এ এক অন্য সকাল। নেই কোনও আড়ম্বর, নেই শয়ে শয়ে ভক্তের ভিড়। বন্ধ রাস্তা পথঘাট। যে কবি চার দেওয়ালের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার কথা বলে গিয়েছেন, সেই কবিগুরু স্মরণ এবার কোয়ারেন্টাইনে। জানি না কবি কখনাে আমাদের মতাে এরকম লকডাউনে ছিলেন কিনা। তবে এই চীনা ভাইরাস অতিমারীর আবহে বর্তমান প্রজন্মের মানসিক যন্ত্রণা নিংড়ানাে ভাষা হয়তাে উপনিষদের ঋষির মতাে কবির উপলব্ধিতে ধরা দিয়েছিল। সেই উপলব্ধি থেকেই থেকেই হয়তাে তিনি লিখেছিলেন ‘সভ্যতার প্রতি’ শিরােনামে কয়েকটি পঙক্তি—

‘দাও ফিরে যে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লােষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর । হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী, দাও সেই তপােবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি, গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান, সেই গােচারণ, সেই শান্ত সামগান, নীবারদানের মুষ্টি, বল্লবসন, মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলােচন। মহাতত্ত্বগুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব । নাহি চাহি নিরাপদে রাজভােগ নব— চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার, বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার, পরানে স্পর্শিতে চাই ছিড়িয়া বন্ধন। অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।

শুধু সভ্যতার প্রতি নয় ‘স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে সে সময় বদলে যাওয়া সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলির দিকেও আঙুল তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আধুনিকতার নামে, পরিবর্তনের নামে সে সময় যে দিশায় সামাজিক ও রাজনৈতিক সূচনা হয়েছিল কবিগুর তার কঠোর সমালােচনা করেছিলেন। আজ চীনা ভাইরাস মহামারীর ধাক্কায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আবার একবার পরিবর্তনের প্রয়ােজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হচ্ছে। লকডাইন চলার সময় গত ১২ মে রাত আটটায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদীর ভাষণেও সেই পরিবর্তনের সুরই ধ্বনিত হলাে। প্রধানমন্ত্রী বললেন বিশ্বগুরু হতে হলে ভারতকে আত্মনির্ভর হতে হবে, কিন্তু আত্মকেন্দ্রিক নয়। এখন সমস্ত বিশ্বজুড়ে অর্থকেন্দ্রিক বিশ্বায়ন বনাম মানব কেন্দ্রিক বিশ্বায়নের চর্চা হচ্ছে। ভারতই এই মানব কেন্দ্রিক বিশ্বায়নের প্রবক্তা, যার আত্মা ‘বসুধৈব কুটুম্বক ভাবনার মধ্যে নিহিত। প্রধানমন্ত্রী আরও বললেন, “লােকালের জন্য ভােকাল হতে হবে। অর্থাৎ স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন উন্নত গুণমান সম্পন্ন দ্রব্য গর্বের সঙ্গে শুধু নিজেরাই নয়, অন্যকেও ব্যবহার করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।

করােনা ভাইরাস মহামারী দেখিয়ে দিয়েছে বিশ্বায়নের নামে বিকাশ নয়, বিনাশই হচ্ছে। বিশ্বায়ন হচ্ছে ঔপনিবেশিক শক্তির শােষণ ও শাসনের নতুন হাতিয়ার। এ ছাড়া বিগত বারাে বছরে যে হারে বিশ্ব উষ্ণায়ন হয়েছে, সেই হার যদি বজায় থাকে। তাহলে আগামী কুড়ি বছর পর পৃথিবী আরও বড়াে সংকটের মুখে পড়তে চলেছে। এছাড়াও নানা কারণে বিশ্বায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল অনেকদিন থেকেই। বেক্সিট অর্থাৎ ইউরােপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেড়িয়ে আসা, ভারতীয়দের জন্যও এইচবি ভিসা নিয়ে আমেরিকার কড়াকড়ির মতাে ঘটনা চলমান বিশ্বায়নকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। করােনা ভাইরাস মহামারী চলাকালীন চীন থেকে জাপানি কোম্পানিগুলিকে নিজেদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য জাপান সরকার বাজারে ২২০ বিলিয়ন ইয়েন বরাদ্দ করেছে। কোরিয়ান কোম্পানিগুলি চীন থেকে ভারতে ফিরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। অতি সম্প্রতি এফডিআই-এর ক্ষেত্রে ভারত সরকার কড়াকড়ি শুরু করে দিয়েছে। চীন সহ বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশের এফ ডি আই-এর জন্য সরকারের অগ্রিম অনুমােদন প্রয়ােজন। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ চীন থেকে তাদের বিনয়ােগ ফিরিয়ে নিয়ে আসার চিন্তা করছে।

ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে চলমান ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রী আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর যে আত্মনির্ভরতার কথা বলেছেন তা ভারতের ডিএনএ-তেই রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে চোখ রাখলে ভারতের নিজস্ব সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার আত্মনির্ভরতার বিষয়টি স্পষ্ট করে বােঝা যায়।

ব্রিটিশ শাসকরা ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলি ভেঙ্গে দিয়ে । ব্রিটেনের আদলে রাজনীতি নির্ভর, সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। সমস্যার সূত্রপাত তখন থেকেই। স্বাধীনতা লাভের পর এদেশের নীতি নির্ধারকরা ভারতকে ইংরেজের ছেড়ে যাওয়া জুতােতে পা গলিয়ে রাজনীতি নির্ভর, সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা বহাল রেখে চলতে বাধ্য করল। ভারত স্বাধীন হলাে ঠিকই কিন্তু স্বাতন্ত্র্য লাভ করল না।।

স্বাধীনতার সাত দশক ধরে মানব সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণভারত উন্নয়নশীল গরিব দেশের তকমা বহন করে চললেও চলমান মহামারীর জেরে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থা আরও একবার ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। মানুষ দেখেছে সামান্য দিনমজুরি কাজের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিজের রাজ্য ছেড়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে হচ্ছে। বাড়ি ফেরানাের জন্য ট্রেন, ফ্রি রেশন ইত্যাদির ব্যবস্থা করে এই মানুষগুলির কষ্ট লাঘব করতে কেন্দ্রীয় সরকার আপ্রাণ প্রয়াস। করছে। কিন্তু অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও রাজ্য সরকারের ভূমিকা দেখে মনে হচ্ছে তারা যেন মানুষের এই দুরবস্থাকে আরও বাড়িয়ে তাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ভাগ্য ফেরানাের প্রতিযােগিতায় নেমেছে। ডুবন্ত মানুষকে জল থেকে না তুলে, নিরাপদ দূরত্বে। দাঁড়িয়ে তার ভাগ্য বিপর্যয়ের দায় চাপানাের প্রতিযােগিতা শুরু হয়েছে। সরকারি বেসরকারি সমস্ত ব্যবস্থাগুলি সংবেদনশীলতার সঙ্গে এগিয়ে এলে এই মানুষগুলির কষ্ট নিশ্চিতভাবে অনেকটাই লাঘব হতাে।

পরিযায়ী শ্রমিকের ঢল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে করােনা ভাইরাস বিপর্যয়ের জেরে ভারতে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছে। সরকারি ব্যবস্থার মাধ্যমে কখনই এত মানুষের কর্মসংস্থান করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদী এই সমস্যা মােকাবিলায় আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তােলার লক্ষ্যে ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজের মাধ্যমে যে সমস্ত প্রকল্প ঘােষণা করেছেন তাতে গ্রাম ও শহরে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভবনা রয়েছে। কোনাে জামিন বা গ্যরান্টি ছাড়াই ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্পের জন্য ৩ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ। আর্থিকভাবে দুর্বল সংস্থাগুলিকে ২০ হাজার কোটি টাকা অনুদান। ২০০ কোটি টাকার প্রকল্পে আন্তর্জাতিক দরপত্র নয়। ৮ কোটি পরিযায়ী শ্রমিককে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য, শহরে শ্রমিকদের বাড়িভাড়া, গ্রামে ফিরলে ১০০ দিনের কাজে নিয়ােগ, ৫০ লক্ষ হকারের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ। জনজাতি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান, বৃক্ষরােপণ, পতিত জমি পুনরুদ্ধার সহ বিভিন্ন প্রকল্পে ৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ, ২৫ কোটি কৃষককে কিষান ক্রেডিট কার্ড সমসংখ্যক কৃষকের জন্য ২ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ, প্রান্তিক চাষিদের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ। মৎস্যচাষ ও পশুপালনে ঋণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আত্মনির্ভর করে তােলার প্রয়াস হয়েছে। নেতিবাচক রাজনীতি না করে দেশে একটু ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করলে করােনামুক্ত বিশ্বে ভারত সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। কারণ এই আত্মনির্ভরতা ভারতের ডিএনএ-তেই রয়েছে। এই ভাবনার মূলসূত্রটি ধরতে একবার ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখা যেতে পারে। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ব্রিটিশ গভর্নর স্যার চার্লস মেটকাফ ভারতের গ্রাম্য সমাজকে বর্ণনা করে বলেছেন , “গ্রামগুলি ছােটো ছােটো গণরাজ্য; এদের যা কিছু প্রয়ােজন প্রায় সমস্তই এদের নিজেদের মধ্যে আছে; বাইরের কারাে সঙ্গে সম্পর্ক রাখা এদের প্রায় প্রয়ােজনই হয় না। যেখানে অন্য কিছুই টিকে থাকে না সেখানেও এরা বেশ টিকে রয়েছে। গ্রামগুলির এই জনসমাজ, এদের প্রত্যেকেই এক একটি ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র বিশেষ—সাধারণের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের প্রভূত ব্যবস্থা করে দিচ্ছে এবং তাদের কল্যাণে মানুষ প্রচুর পরিমাণে স্বাধীনতা ও স্বরাজ ক্ষমতা ভােগ করতে পারছে।” এই বর্ণনা থেকে এটা স্পষ্ট যে এদেশের গ্রামগুলি যেন প্রায় কল্পনার স্বর্গলােকের মতাে ছিল। ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র দত্ত বলেছেন, “বয়নশিল্পই তখন আমাদের জাতীয় শিল্প ছিল এবং মেয়েরা ঘরে ঘরে চরকায় সুতাে কাটত”। ভারতীয় বস্ত্র শুধু ইংলন্ডে নয়, ইউরােপের অন্যান্য দেশেও যেত। তাছাড়া চীন, জাপান, ব্রহ্মদেশ, আরব, পারস্য ও আফ্রিকার কোনাে কোনাে দেশেও যেত। ভারতের বস্ত্রশিল্প এতই উন্নত ছিল যে। ইংলন্ডে যন্ত্রে প্রস্তুত বস্ত্র তার সঙ্গে প্রতিযােগিতায় পেরে উঠত না। ইংলন্ডের বয়ন শিল্পকে রক্ষা করার জন্য ভারতীয় বস্ত্র শিল্পের উপর শতকরা আশি টাকা হারে শুল্ক বসানাে হয়েছিল। বিদেশি বাণিজ্যের আক্রমণে ভারতের বস্ত্রশিল্প বিনাশপ্রাপ্ত হলাে। ফলে বহু মানুষ কাজ হারালেন। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতাসীন বড় লাট বলেছিলেন,“দেশময় দুর্দশা দেখা দিয়েছে, জগতের ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার। ভারতে তাঁতিদের হাড়গােড়ে মাঠঘাট ছেয়ে গেছে।”

স্পষ্টতই ইংরেজরা এদেশের মজবুত আর্থ সামাজিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। ইংলন্ডের অনুকরণের রাজনীতি সর্বস্ব, সরকারি ব্যবস্থা নির্ভর ব্যবস্থা কায়েম করেছিল। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন কবিগুরু। স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “সমাজই বিদ্যার ব্যবস্থা করেছে, তৃষিতকে জল দিয়েছে, ক্ষুধিতকে অন্ন, পূজার্থীকে মন্দির, অপরাধীকে দণ্ড, শ্রদ্ধেয়কে শ্রদ্ধা। গ্রামে গ্রামে দেশের চরিত্রকে রক্ষিত এবং তার শেকড় প্রতিষ্ঠিত করেছে। দেশের উপর দিয়ে রাজ্যসাম্রাজ্যের পরিবর্তন হয়ে গেল, স্বদেশী রাজায় রাজায় নিয়তই রাজস্ব নিয়ে হাত-ফেরাফেরি চলল, বিদেশি রাজারা এসে সিংহাসন কাড়াকাড়ি করতে লাগল,লুঠপাঠ অত্যাচারও কম হলাে না, কিন্তু তবু দেশের আত্মরক্ষা হয়েছে; যেহেতু সে আপন কাজ আপনি করেছে, তার অন্ন-বস্ত্র, ধর্ম-কর্ম সমস্তই তার আপনারই হাতে। এমনি করে দেশ ছিল দেশের লােকের; রাজা ছিল তার এক অংশ মাত্র, মাথার উপর যেমন মুকুট থাকে তেমনি। রাষ্ট্রপ্রধান দেশে রাষ্ট্রতন্ত্রের মধ্যেই বিশেষভাবে বদ্ধ থাকে দেশের মর্মস্থান; সমাজপ্রধান দেশে দেশের প্রাণ সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে থাকে। রাষ্ট্রপ্রধান দেশের রাষ্ট্রতন্ত্রের পতনে দেশের অধঃপতন, তাতেই সে মারা যায়। গ্রিস, রােম এমনি করেই মারা গিয়েছে। চীন ও ভারত রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের ভিতর দিয়েই সুদীর্ঘকাল আত্মরক্ষা করেছে, তার কারণ —সর্বব্যাপী সমাজে তার আত্মা প্রসারিত। পাশ্চাত্য রাজার শাসনে এইখানে ভারতবর্ষ আঘাত পেয়েছে। গ্রামে গ্রামে তার যে সামাজিক স্বরাজ পরিব্যাপ্ত ছিল, রাজ শাসন তাকে অধিকার করলাে। যখন থেকে এই অধিকার পাকা হয়ে উঠল তখন থেকে গ্রামে গ্রামে দিঘিতে জল শুকিয়ে, জীর্ণ মন্দিরেশূন্য অতিথিশালায় উঠল অশ্বত্থ গাছ, জাল-জালিয়াতি মিথ্যা-মকদ্দমাকে বাধা দেবার কিছু রইল না, রােগে তাপে অজ্ঞানে অধর্মে সমস্ত দেশ রসাতলে তলিয়ে গেল। সকলের চেয়ে বিপদ হলাে এই যে, দেশ দেশের লােকের কাছে কিছু মর্মকথা চাইলে আর সাড়া পায় না। জলদান, অন্নদান, বিদ্যাদান সমস্তই সরকার বাহাদুরের মুখ তাকিয়ে। এইখানেই দেশ গভীরভাবে আপনাকে হারিয়েছে। ……সমাজে তাই আমি বলেছিলুম ইংরেজ আমাদের রাজা কিংবা আর কেউ আমাদের রাজা এই কথাটা নিয়ে বকবকি করে সময় নষ্ট না করে সেবার দ্বারা, ত্যাগের দ্বারা, নিজেরে দেশকে নিজে সত্যভাবে অধিকার করবার চেষ্টা সর্বাগ্রে করতে হবে। দেশের সমস্ত বুদ্ধিশক্তি ও কর্মশক্তিকে সঙ্ঘবদ্ধ আকারে কেমন করে দেশে বিস্তীর্ণ করা যেতে পারে, স্বদেশী-সমাজে আমি তারই আদর্শ ব্যাখ্যা করেছিলুম।”

“আমি এই কথাই বিশেষ করিয়া বুঝাইবার চেষ্ঠা করিয়াছি যে, বিলাতে যেমনই হােউক, আমাদের দেশে সমাজ একটি ক্ষুদ্র ব্যাপার নহে। যুদ্ধবিগ্রহ, কিয়ৎ পরিমাণে পাহারার কাজ ও কিঞ্চিৎ পরিমাণে বিচারের কাজ ছাড়া দেশের আর সমস্ত মঙ্গল। কার্যই আমাদের সমাজ নিজের হাতে রাখিয়াছিল। ইহাই আমাদের বিশেষত্ব। এই জন্যই এই সমাজব্যবস্থার উপরেই আমাদের মনুষত্ব, আমাদের সভ্যতা স্থাপিত এবং এইজন্য এই সমাজ ব্যবস্থাকে আমরা চিরদিন। সর্বতােভাবে স্বাধীন ও সক্রিয় রাখতে একান্ত সচেষ্ট ছিলাম।”

একটি পরিসংখ্যান বলছে স্বাধীনতার সাতদশক পরেও নাকি ২০ কোটি ভারতবাসী পেটে ক্ষুধা নিয়ে, না খেয়ে ঘুমুতে যায়। কিন্তু লকডাউনের মতাে চরম সংকটে সরকারি সাহায্যের লালফিতের ফাস খােলার অপেক্ষা না করে দেশ জুড়ে সেবা কাজের মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যেভাবে । সক্রিয়তা প্রদর্শন করছে তা এক কথায় অভূতপূর্ব। এতে প্রমাণ হয় সরকার নয়, ‘সমাজ সর্বোপরি’। এই আদর্শ এখনাে ভারতের ডিএনএ-তে সক্রিয়। এই জন্যই বােধ হয় লকডাউনে অনাহারে মৃত্যুর খবর নেই।

গান্ধীজীও ভাবতেন আমাদের দেশ কখনাে না কখনাে ‘স্বরাজ’ অর্জন করবে। সরকারের ওপর ন্যূনতম নির্ভরশীলতা গান্ধীজীর স্বরাজের মূল ভাব। দেশপ্রেম ও রাষ্ট্র সর্বোপরি। গ্রাম স্বরাজের এই ধারণা যে আধুনিক সময়েও সম্ভব তার দৃষ্টান্তও ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। ভারতরত্ন নানাজী। দেশমুখের নেতৃত্বে শুরু হওয়া গ্রাম বিকাশের কাজের ফলে উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের। পাঁচশাের বেশি গ্রাম এখন স্বনির্ভর। আন্না হাজারের নেতৃত্বে শুরু হওয়া খরাপ্রবণ, দুর্ভিক্ষ পীড়িত মহারাষ্ট্রের রালেগাও সিন্ধি এখন সমস্ত বিশ্বের সামনে এক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। রালেগাও সিন্ধি যেখানে এক সময় ৮০ শতাংশ মানুষ না খেয়ে থাকতেন, গ্রাম থেকে আট দশ কিলােমিটার দূরে গ্রামবাসীরা যেতেন পাথর ভেঙে সামান্য আয় করার জন্য, এখন সেই গ্রামে বাইরের মানুষ আসে কাজের সন্ধানে। খরা পীড়িত এই গ্রামে একসময় একবার ফসল ফলানাের মতাে জল পাওয়া যেতােনা এখন সেখানে চেকড্যামের মাধ্যমে বৃষ্টির জল ধরে রেখে কম করে বছরে দু’বার ফসল ফলানাে হয়। দুশাে থেকে ২৫০ ট্রাক পেঁয়াজ এখন ব্যাঙ্গালাের চেন্নাইয়ের মতাে বড়াে বড়াে শহরে সরবরাহ করা হয়। আগে ওই গ্রামে ৪০০ লিটার দুধ কেনার মতাে অবস্থা ছিল না, এখন ওই গ্রাম থেকে ৬০০০ লিটার দুধ প্রতিদিন বাইরে যায়। ফলে প্রতিদিন সােয়াশাে থেকে দেড় লক্ষ টাকা প্রতিদিন গ্রামে ঢুকছে। ওই গ্রামে দুই কক্ষের একটি বাড়িতে দুজন শিক্ষক দিয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত একটি স্কুল চলতাে। এখন ওই গ্রামে ৪০ জন শিক্ষক, বিজ্ঞান বিভাগ সহ দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশােনা হয়। না, কোনাে সরকারি সহায়তা নয়, বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়ােগও নয়, বা কোনাে ধন কু বরের কৃপাদৃষ্টি নয়, সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে এটা সম্ভব হয়েছে। রালেগাও সিন্ধি র মতাে অনুর্বর জমিযুক্ত খরাপ্রবণ গ্রাম যদি লক্ষ্মীর ঝাঁপির স্থায়ী ঠিকানা হতে পারে তাহলে ভারতের অন্য গ্রামগুলি পারবে না কেন? ভারতরত্ন নানাজী দেশমুখ ও আন্না হাজারের গ্রাম স্বরাজের সফল প্রয়ােগ ও ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে কবিগুরুর ভাবনা যে নতুন পরিবর্তনের রােড ম্যাপ হয়ে উঠবে এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই।

সাধনকুমার পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.