পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির পতনের ইতিহাস : কিভাবে একটা রাজ্যের জিডিপি শেয়ার দেশের 40% থেকে 3% এ নেমে এলো – সপ্তম পর্ব 

মমতা ব্যানার্জী (Mamata Banerjee) 2009 তে রেলমন্ত্রী হন l প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করলেন, ভোটের আগে যেন এমন কোন সংস্কারমূলক বিল না আনা হয়, যার বিরুপ প্রভাব 2011 র পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) বিধানসভা নির্বাচনে পড়ে l কারণ মার্ক্সিয় অর্থনীতির আফিং সেবন করা বাংলার ভোটার গত চার দশকে একটি সংস্কারবিমুখ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে, যারা নতুনকে গ্রহণ করতেই ভুলে গেছে l নরসিমা রাও ও অটল বিহারী বাজপেয়ীর ইতিহাস থেকে উনি সাবধান হয়েছেন l.পরের দুই বছর বীমা, ব্যাঙ্কিং, খুচরো ব্যবসাসহ সব ক্ষেত্রেই মনমোহন সরকার সংস্কার বন্ধ রাখলেন l অন্যদিকে, মমতা তাঁর রেল বাজেটে পশ্চিমবঙ্গের জন্য ঘোষণা করলেন একের পর এক রেল প্রকল্প l কলকাতা ও শহরতলির যোগাযোগ উন্নত করতে, বেশ কটি মেট্রো প্রকল্প ঘোষণা করলেন রেল বাজেটে

2011 তে তৃণমূল-কংগ্রেস-SUCI এর জোট রাজ্যে ক্ষমতায় এল l কিন্তু তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তাহারে করা কিছু  প্রতিশ্রুতি রাজ্যের শিল্পোন্নয়নের হাত চেপে ধরল, ঠিক যেমন ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা হস্তিনাপুরের রাজনৈতিক স্থিতি আনার বদলে তা বাড়িয়েছিল l যদিও, মমতা কিছু ইতিবাচক মৌলিক পরিবর্তন ও প্রশাসনিক সংস্কার আনলেন রাজ্যে l যেগুলি হল :

  1. পঞ্চায়েত প্রধানদের হাত থেকে চেক সাক্ষর করার ক্ষমতা কেড়ে সরকারি আধিকারিকদের দিলেন l সুব্রত মুখার্জীকে পঞ্চায়েত মন্ত্রী করলেন l আগামী কয়েক বছরে সুব্রতবাবু গ্রামের চেহারা ও সমাজ পাল্টে দিলেন বিভিন্ন প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়নে l গ্রামবাংলা এক কথায় স্বাধীনতা পেল সিপিএম ক্যাডারদের থেকে l
  2. কোঅর্ডিনেশন কমিটিকে সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন করে দিলেন মমতা, যা গত সাড়ে তিন দশক ভাবাই যেত না l  পশ্চিমবঙ্গ এমন এক রাজ্য যেখান থেকে বহু বাঘা আইএএস/আইপিএস অফিসারও এই কোঅর্ডিনেশন কমিটির অত্যাচারে রাজ্য ছেড়ে দিল্লি যেতে বাধ্য হত l সচিবালয়কে মহাকরণ থেকে  নবান্নতে বদলি করে কোঅর্ডিনেশন কমিটিকে একপ্রকার সাইনবোর্ড বানিয়েদিলেন মমতা l 
  3. রাজ্যে ধর্মঘট, রাস্তা অবরোধ, কর্মবিরতি,  হরতাল,  বন্ধ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করলেন l যা এই প্রজন্মের বাঙালী ভাবতেই পারতো না l
  4. বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সামাজিক প্রকল্প অতন্ত্য দক্ষতার সঙ্গে চালু করলেন l 100 দিনের কাজ, বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, কন্যাশ্রী, সবুজসাথী  ইত্যাদি বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে অর্থ পাওয়া শুরু করল গরিবরা l সরাসরি ব্যাংকে l 
  5. রেশন ব্যাবস্থায় একটা স্বচ্ছতা আনলেন ও পরিষেবা বাড়ালেন l প্রায় এক কোটির রেশন কার্ড বাজেয়াপ্ত করলেন l বহু মানুষ 2 টাকা কিলো চাল পেল l
  6. সব রকম আর্থিক লেনদেনে ক্যাশ ট্রানসাকশান নিষিদ্ধ করে ব্যাংক NEFT চালু করলেন অমিত মিত্র l সরকারি কর্মীদের বেতন, কৃষি ও সারের ভর্তুকি, ফসলের দাম, বিভিন্ন সামাজিক ভাতা এবং সবরকম অপ্রত্যক্ষ কর এর আওতায় পড়লো l 
  7. কয়েক লক্ষ শিক্ষিত বেকারকে বিভিন্ন পুরসভা, পঞ্চায়েত, সিভিক পুলিশ ও সরকারি দপ্তরে অস্থায়ী ভাবে নিয়োগ করে তাঁদের ডাল ভাতের একটা সাময়িক ব্যাবস্থা করলেন l এরা অধিকাংশই আশি ও নব্বইয়ের দশকের জ্যোতি বসুর লার্নিং ইংলিশ পড়ে ইংরেজি শেখা অভাগা যাদের জন্য TCS, CTS বা IBM এর দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ
  8. জঙ্গলমহলের জীবন আমূল পরিবর্তন করে দিলেন মমতা l অতিবামপন্থী রাজনীতিকে কয়েকমাসে ধুলিস্বাৎ করে উন্নয়নের ঝড় আনলেন এই অঞ্চলে l পরিকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যে ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রচুর বিনিয়োগ হল l

9.  1982 র পর প্রথম বাংলার কোন মুখ্যমন্ত্রী দার্জিলিং গেলেন l বাংলার এই জেলায় জ্যোতিবাবু কিংবা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পা রাখার সাহস হয়নি গত 29 বছর l সেখানে উনি হুট্ খোলা জিপে ঘুরে বেড়াতে কোন দ্বিধা করেন না l উনি ক্ষমতায় আসার পর দার্জিলিংএর পর্যটক সংখ্যা 20 গুন বেড়ে যায় l বাড়ে দার্জিলিংবাসীদের আয়

  1. বিশ্ববাংলার ব্যানারে গ্রামের কুটির শিল্পের বাজার খুলে দেন এয়ারপোর্ট থেকে শপিং মলে l গ্রাম বাংলার কুটির শিল্প সাড়ে তিন দশক পর অক্সিজেন পায় l
  2. জলধরো জলভারো‘ প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের টাকায় বহু পুকুর ও চেক ড্যাম বানিয়ে পশ্চিমের চারটি জেলার বহু জমিকে দুই কিংবা তিন ফসলি করে দেয়া হল l 

সাড়ে তিন দশক পরিষেবা না পাওয়া একটা জাতি এতটাই খুশি হল যে 2013 পঞ্চায়েতের ঠিক আগে ফাঁস হাওয়া সারদা কেলেঙ্কারি কিংবা 2016 বিধানসভা ভোটের আগে ফাঁস হওয়া নারদ ভিডিও তৃণমূলের বিজয়রথ  আটকাতে পারল না l 2013 পঞ্চায়েত, 2014 লোকসভা ও 2016 বিধানসভায় বিরোধীদের ধুয়েমুছে সাফ করে দেন মমতা

কিন্তু, পাঁচ বছরের পর  মানুষ কিছু দীর্ঘ্যমেয়াদী প্রতিষেধক আশা করা শুরু করল, যা খুব স্বাভাবিক l যে কোন সরকারের কাছে সাধারণ মানুষ কিছু স্বল্প মেয়াদী ও কিছু দীর্ঘমেয়াদী আশা রাখে l স্বল্প মেয়াদী আশা মমতা পূরণ করেছেন বলেই প্রথম পাঁচ বছর তিনি অপ্রতিদ্বন্দী ছিলেন l কিন্তু এবার মানুষ দীর্ঘমেয়াদী ফল চাইছে, যা দেবার জন্য সরকারকে  প্রথম দিন থেকেই আরও প্রস্তুত হাওয়া উচিৎ ছিল l সেটা হল স্থায়ী সরকারি ও ভাল বেসরকারি ‘কর্মসংস্থান’ l প্রতি বছর এগারো লক্ষ ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক পাশ করছে l কিন্তু নতুন কর্মসংস্থান কথায়?

আগেই বলেছি, তৃণমূল সরকারের  শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে সাফল্যের মূল সমস্যা হল তাঁদের  2011 র নির্বাচনী ইস্তেহারের কিছু প্রতিশ্রুতি, যা তারা নিশ্চিন্তে অবজ্ঞা করলে আজ রাজ্যের শিল্প মানচিত্র অন্যরকম হত l কিন্তু তিনি সেই প্রতিশ্রুতি ভাঙলেন না l এই প্রতিশ্রুতিগুলি মধ্যে উল্লেখযোগ্য :

  1. সরকার অনিচ্ছুক জমি মালিকের কাছ থেকে জমি নেবে না l
  2. সরকার SEZ মানবে না l
  3. বেশ কিছু ক্ষেত্রে FDI ও সংস্কার সংক্রান্ত বিরোধীতা l

একটু বিস্তারে আলোচনা করা যাক যে এই তিন প্রতিশ্রুতির জন্য বাংলা কি হারালো :

 1. জমি : প্রথমেই জমির জন্য থমকে গেল মমতা ব্যানার্জীর ঘোষিত সবকটি রেল প্রকল্পের গতি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য 

i জিয়াগঞ্জ আজিমগঞ্জ রেলব্রিজ 

Ii তারকেশ্বর আরামবাগ রেল 

iii গড়িয়া এয়ারপোর্ট মেট্রো 

iv বি বি ডি বাগ -জোকা মেট্রো 

v  দমদম -দক্ষিনেশ্বর মেট্রো 

vi এয়ারপোর্ট বারাসাত মেট্রো 

vii দমদম ব্যারাকপুর মেট্রো l

এর সঙ্গে বন্ধ হল পূর্বতন সরকারের শুরু করা একগুচ্ছ শিল্পপ্রকল্প যা আগের পর্বে উল্লেখ করেছি l বন্ধ হল কেন্দ্র সরকারের ঘোষিত কিছু প্রকল্প যা শুধু বহু লোককে জীবিকাই দিত না, রাজ্যের স্থায়ী উন্নয়নে একটা বড় ভূমিকা নিত l সেগুলি হল :

i সাগরের গভীর সমুদ্র বন্দর

ii. কলকাতা-দিল্লি ডেডিকেটেড ফ্রেইট করিডোর

iii. অমৃতসর-কলকাতা শিল্প করিডোর 

iv দমদম বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ 

v চারটি স্মার্ট সিটি প্রকল্প 

vi বিয়াল্লিশটি স্মার্ট ভিলেজ প্রকল্প 

vii. বারাসাত রায়চক সড়ক 

viii  আইলা প্রকল্প 

ix তিস্তা সেচ প্রকল্প 

x. শিলিগুড়ি-কলকাতা জাতীয় সড়ক 

x মোরগ্রাম-মেছোগ্রাম বন্দর সংযোগকারী রাস্তা ( ADB ফান্ডেড )

শুধু জমিনীতির জন্য, পশ্চিমবঙ্গ যে বিনিয়োগ হারাল, তার মোট পরিমান প্রায় তিন লক্ষ কোটি টাকা l এর ফলে, কত কর্মসংস্থান আমরা হারালাম তার একটা ধারণা নেয়া যাক l একটা দুকাঠা জমিতে চারতলা বাড়ি বানাতে কতজন  দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কত দিনের জন্য কর্মসংস্থান পায় সেই ধারণা মোটামুটি সকলেরই  আছে l এক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমান মোটামুটি এক কোটি টাকা l  তাহলে তিন লক্ষ কোটি বিনিয়োগে কত মানুষ কাজ হারালো? এই বিনিয়োগ রাজ্যে এলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কত মানুষ কাজ পেত?  হয়ত কোন শ্রমিককে রাজ্যের বাইরেই পরিযায়ী হয়ে যেতেই হত না l তাছাড়া পরিকাঠামো ভাল হলে শিল্প, ব্যবসার স্থায়ী ভাবে উন্নতি হত ও কর্মসংস্থান  বাড়তো l কিন্তু এক জমিনীতি উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াল l

  1. এবার আসি SEZ নীতির ফল: রপ্তানি মূলক শিল্প কখনই বিনা SEZ এ কেউ খুলবে না l বিশেষ করে ইনফরমেশন টেকনোলজি ( IT) l ফলে নতুন কোন IT কোম্পানি কলকাতায় এল না l 2013,  2014,  2016 এবং 2019 ভোটের আগে আনন্দবাজারে আমরা ইনফোসিস,  উইপ্রো আসার খবর পেয়েছি l কিন্তু ভোটের পরে আর সেই খবর দেখা যায় না l বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট কলেজগুলো ছাত্রদের কর্মসংস্থান কমে গেল l কলকাতা ও শহরতলির ক্রয় ক্ষমতা কমে গেল l সঙ্গে পরিবহন ও আবাসন শিল্প মার খেতে থাকল l IT শিল্পের মন্দা রাজ্যের অর্থনীতি, শিল্প, বাণিজ্য ও জীবিকার ক্ষেত্রে এটা বড় ধাক্কা l
  2. আর FDI ও সংস্কার বিরোধী তার অতীত, ধাক্কা দিল রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তিতে l 2013 তে FDI তে বিনিয়োগ বিষয়ক একটি বিলের বিরোধিতা করে তৃণমূল কেন্দ্রের সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসে l এরপর কোন বিদেশী সংস্থা বিনিয়োগ করতে সাহস পাবে এই রাজ্যে? ডঃ অমিত মিত্রর মত অর্থমন্ত্রী থাকার পরেও, চার চারটি বড় বিসনেস সামিটে কোন ফল পাওয়া গেল না l 

এছাড়াও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন নীতির ফলে আরও কিছু নতুন সমস্যা শুরু হল যেমন, 

i. চাষীরা ফসলের দাম পেলনা ফোঁড়েদের দরাদরির জন্য l বহু চাষী জমি ফেলে রাজ্যের বাইরে শ্রমিক হয়ে চলে যাওয়াটা শ্রেয় বলে l এমনকি জল ধরো জল ভরোতে সেচের জল পাওয়া চাষীরাও চাষ করতে চাইল না এই কারণে  l 

ii. স্থায়ী সরকারি চাকরির সংখ্যা কমে যাওয়ায় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমতে থাকল l সরকার মহার্ঘ্যভাতা না দেয়াতে বাজারের অর্থের যোগান কমল l এর প্রভাব পড়লো সব শিল্প ও বাণিজ্যে l 

iii. বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সামাজিক প্রকল্পকে নিতে রাজ্যের অস্বীকার l যার ফলে রাজ্যের বাজারে অর্থের যোগান কমলো l 

2016 তে রাজ্যে বিজেপি ঝড় আনলেন রাজনীতিতে একেবারে নতুন বিজেপির সভাপতি তথা খড়্গপুরের বিধায়ক দিলীপ ঘোষ l তিন বছরের মধ্যে, 2019 এ রাজ্যের প্রায় অর্ধেক আসন হাত ছাড়া হয়ে গেল তৃণমূলের l মোট 42 এর মধ্যে বিজেপি 18 ও কংগ্রেস 2 l 

আজ করোনার সঙ্কটে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল যে, একটা রাজ্য, দশকের পর দশক,  উচ্চশিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত সবাইকে পরিযায়ী বানিয়ে বেচে থাকতে পারে না l পরিযায়ী মানুষদের একটা ছোট অংশ এই ঘোরতর বিপদে যখন তার আপনজনদের কাছে ফিরতে চায়, তখন সরকারের তাদের গ্রহণ করতে না পারার অসহায়তা প্রমান করে, গত 54 বছরে এই রাজ্যের কি ভয়ঙ্কর সর্বনাশ হয়ে গেছে l এখনই বড় রকমের আর্থিক, প্রশাসনিক ও আইনগত সংস্কার শুরু করে প্রকৃত উন্নয়নের পথে না হাঁটলে, পশ্চিমবঙ্গ অচিরেই একটা গুরুত্বহীন রাজ্যের পরিণত হবে l আগামী দিনে করোনার চেয়ে বড় বিপদ আসতেই পারে l আজকের পশ্চিমবঙ্গ কিভাবে করবে তাঁর মোকাবিলা? কিন্তু কি সেই সংস্কার যা এখনই প্রয়োজন পশ্চিমবঙ্গের ?  এর উপর একটি SWOT বিশ্লেষণ ও সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা হবে শেষ পর্বে l

লেখক : সুদীপ্ত গুহ (Sudipta Guha)

(লেখক বহুজাতিক পরামর্শদাতা সংস্থা URS কনসাল্টিং ইন্ডিয়ার ভূতপূর্ব চিফ জেনারেল ম্যানেজার)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.