১৯৬২ সাল, ভারত-চীন যুদ্ধ (২০ অক্টোবর — ২১ নভেম্বর)-এর কাছাকাছি সময়। ত্রিভুবন নারায়ণ সিং (Narayan Singh) -এর সঙ্গে জহরলাল নেহেরু (Jaharlal Nehru) -র একটি কথোপকথনের কথা বলছেন দত্তপন্থ ঠেংড়ীজী। টি. এন. সিং উত্তর প্রদেশের মানুষ; পরে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী (১৮ ই অক্টোবর, ১৯৭০ — ৪ ঠা এপ্রিল, ১৯৭১) এবং তারও পরে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল (৬ ই নভেম্বর, ১৯৭৯ — ১২ ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮১)। সেসময় পার্লামেন্টের অধিবেশন চলছে; নবরাত্রির আশেপাশে কোনো এক সময়। গৃহে নিয়মিত চণ্ডীপাঠ করতেন শ্রী সিং। পার্লামেন্টের অধিবেশনের আগে প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু বাইরে এসে বসতেন, নানান সদস্যের সঙ্গে আলাপচারিতা চলত, সেদিনও বসেছেন; টি. এন. সিং-এর সঙ্গে তাঁর দেখা হল৷ নানা কথায় তিনি বললেন, আমাদের ধর্মাচারগুলি যারা তৈরি করেছেন, তারা তো এই পৃথিবীর মানুষ নন, তাহলে দেশের মানুষের বাস্তব সমস্যা — ক্ষুধা, তৃষ্ণা, দারিদ্র্য কী করে ধর্মাচার দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? টি. এন. সিং বললেন, তা তো নয়! শ্রীচণ্ডীতে তো এটা লেখা আছে “যা দেবী সর্ব ভূতেষু সুধারূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমাে নমঃ।।…. যা দেবী সৰ্ব্ব ভূতেষু নিদ্রারূপেণ সংস্থিতা।…. ইত্যাদি ইত্যাদি।” এসব অবাস্তব হয় কী করে! ক্ষুধা, সুধা, নিদ্রা, ভ্রান্তি এসবই তো বাস্তবের প্রতিভূ, জীবনচর্যা থেকে আগত বিষয়! তখন নেহেরুজী টি. এন. সিং-এর কাছ থেকে সমস্ত বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে শুনলেন। এরপর থেকেই তাঁর জীবনে ধর্ম নিয়ে নতুন চিন্তা-চেতনার উদয় হল। ১৯৬৪ সালে নেহেরু মৃত্যুর ঠিক ২৪ ঘন্টা আগে শ্রীমন্ত নারায়ণের একটি বইয়ের প্রস্তাবনায় তিনি লেখেন, “মনুষ্যকে মন আচ্ছা হো ধরম্ কে আধার পর।” এটাই তাঁর লিপিবদ্ধ শেষ দার্শনিক উপলব্ধি। তার আগে ধর্ম নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না তাঁর। হিন্দুধর্ম অবিশ্বাসী মানুষকেও প্রভাবিত করতে পারে, যদি তার সঠিক ব্যাখ্যা করা যায়।
২.
ঠেংড়ীজী কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতে চেয়েছেন, মানুষ বলেন, সে ধর্ম মানেন না; কিন্তু তার জীবনাচরণ ধর্মাচারকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। একটি ঘটনার কথা বলছেন। সিপিআই-এর মহারাষ্ট্র শাখার সম্পাদক ছিলেন ক্রান্তিসিন্হ নানা পাটিল (৩ রা আগষ্ট, ১৯০০ — ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭৬; দলের প্রতিনিধি হিসাবে মারাথওয়ারা অঞ্চলের বীড কেন্দ্র থেকে সাংসদ হয়েছিলেন ১৯৬৭ সালে, তার আগে ১৯৫৭ সালে সাঁতারা কেন্দ্র থেকে সাংসদ হন)। তিনি কোনো একবার আরএসএস-এর একজন উচ্চাধিকারীর সঙ্গে একই ট্রেনের কোচে সহযাত্রী হয়ে যাচ্ছিলেন। স্বয়ংসেবকদের ক্ষেত্রে নিয়ম হল, যখন ট্রেনে কোনো উচ্চাধিকারী যান, তখন খাবার সময় সকল স্বয়ংসেবক তাঁর কাছে আসেন ও একসঙ্গে খাওয়া হয়। তাই দুপুরে খাবার সময় সকলেই সেই আধিকারিকের কাছে আসলেন। তিনি পাটিলজীকেও ডাকলেন, আসুন, আমাদের সঙ্গে একসাথে ভোজন করবেন। তখন পাটিলজী একটু দূরে সরে গিয়ে বললেন, না না, আজকে আমার নির্জলা একাদশীর উপবাস। আর স্বয়ংসেবকেরা যা খাচ্ছেন, তা হল, রুটি আর পেঁয়াজের আচার। তাহলে ভাবুন, সিপিআই-এর মানুষটি নিরম্বু উপবাস করছেন, আর হিন্দুত্ববাদী মানুষটি একাদশীর দিন রুটির সঙ্গে পেঁয়াজ খাচ্ছেন!
৩.
দত্তপন্থ ঠেংড়ীজী একবার রসিকতা করে বলছেন, “হিন্দুত্বকা পরিভাষা সমঝনা বহুতি কঠিন হ্যায়।” এরপর একটি ঘটনার কথা বললেন। ১৯৬৮ সালে সংসদীয় দলের সদস্যরূপে তিনি সরকারি যাত্রায় রাশিয়া গিয়েছিলেন। দলের প্রমুখ ছিলেন নীলম সঞ্জীব রেড্ডি। ওই দলে সিপিআই-এর হীরেন মুখার্জীও ছিলেন। মস্কোর ইন্সটিটিউট অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে হীরেন বাবুর বক্তব্য ছিল। সেখানে অনেক রাশিয়ান বিদ্বান মানুষ উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্যের বিষয়: Religion and God, ধর্ম ও ঈশ্বর। মার্ক্সীয় আধরে পুরো ভাষণ, হীরেন বাবু সিদ্ধান্তে এলেন, God is Fraud. ঈশ্বর ধোকা হ্যায়, জালসাজি হ্যায়। অন্য কারো মন্তব্য বা বিতর্কের অবতারণার সুযোগ সেখানে ছিল না। রাশিয়ার বিদ্বানরা প্রচুর হাততালি দিলেন। সভা শেষ হল। হোটেলে দুপুরে হীরেন বাবুর একটা বই ফেরত দিতে তাঁর ঘরে গেছেন ঠেংড়ীজী। দরজা বন্ধ, তবে সামান্য ফাঁক ছিল। হোটেলে বলে দেওয়া হয়েছিল, কারো ঘরে গেলে বেল বাজিয়ে অনুমতি নিয়ে তবে ঢুকতে হবে, কারণ রুমের আবাসিকরা নিজেদের স্বাভাবিক পোষাকে থাকতে পারেন, তাই এই অলিখিত নিয়ম। ঠেংড়ীজী বেল বাজিয়েই যাচ্ছেন, ফেরার তাড়াও ছিল। কিন্তু হীরেন বাবুর দুটি কানে যথেষ্ট বধিরতা; কর্ণযুগলে শ্রবণযন্ত্র ব্যতিরেকে প্রায় কিছুই শুনতে পেতেন না। ঠেংড়ীজীর মনে পড়লো সে কথা। তিনি এবার দরজায় উঁকি মারলেন। দরজার দিক পিঠ দিয়ে সোফায় পদ্মাসনে বসে আছেন হীরেন বাবু, কানের যন্ত্রদুটি পাশে খুলে রাখা, ধ্যানমুদ্রায় উচ্চারণ করে চলেছেন “চিদানন্দরূপঃ শিবোহম শিবোহম”। স্বাভাবিক পোষাকে নেই জেনে ঠেংড়ীজী এবার দরজা ঠেলে ঢুকলেন, হীরেন বাবু তখনও চোখ বন্ধ করে নিবিষ্ট মনে স্তোস্ত্রগীত করে চলেছেন। স্তোত্র শেষ হল, হীরেন বাবু ঠেংড়ীজীকে দেখে চমকে উঠলেন। শ্রবণযন্ত্র পরে নিয়ে বললেন, ” How long you are standing here?” দত্তপন্থজী বললেন, “Two or three minutes.” হীরেন বাবু বলে উঠলেন, “Mind you, I don’t believe in God.” ধ্যান রেখো, আমি ঈশ্বরে অবিশ্বাসী। ঠেংড়ীজী বললেন, “ঠিক আছে”।
৪.
আরও একটি ঘটনা দিয়ে তিনি হিন্দুত্ব ও ধর্মাচরণ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য শেষ করেছেন। ১৯৭০ সাল। রামকৃষ্ণ রেড্ডির সঙ্গে কন্যাকুমারিতে তাঁর একটি মিটিং ঠিক হল মহালয়ার দিন সকাল ন’টায়। কন্যাকুমারীর মানুষ বিশ্বাস করেন, মহালয়ার দিন খুব সকালে স্নান করে দেবীর পূজা করলে পুণ্য হয়। ন’টায় মিটিং বলে যথেষ্ট সকালে উঠে স্নান করে মন্দিরের দিকে ভিজে কাপড়ে যাত্রা শুরু করলেন ঠেংড়ীজী। সঙ্গে ছিলেন ডিএমকে-র কোনো একজন এম.পি.। মন্দিরে ঢোকার আগে তিনি ঠেংড়ীজীকে বললেন, আমি শুধু এখানকার নেতাই নই, সমগ্র তামিলনাড়ুর একজন পরিচিত নেতা, ফলে এই মন্দিরের চারপাশে সবাই আমাকে চেনেন।
ঠেংড়ীজী বললেন, সে তো খুব ভালো কথা।
ভদ্রলোক বললেন, আরে সেটাই তো আমার সমস্যা!
— কেন?
— ১৫ দিন আগে আমার পার্টি ঘোষণা করেছে God does not exist. ভগবানের অস্তিত্ব নেই। এবারও আমাকে রাজ্যসভার টিকিট নিতে হবে। আগামী ২ রা এপ্রিল রাজ্যসভার সমাপ্তি, মাত্র কয়েকমাস বাকী। এখন যদি আমি মন্দিরে ঢুকি আর এই ঘটনা যদি চারপাশে রটে যায়, তাহলে টিকিট পাওয়া সম্ভব হবে না। কারণ কয়েকজন হেবিওয়েট প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন এই টিকিট পাবার লোভে।
— তাহলে আপনি যাবেন না!
— (অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়ে তিনি বললেন) কিন্তু মহালয়ার পুণ্য অর্জন তো আমায় করতেই হবে। আমি একটি উপায় বের করেছি। (মন্দিরের পাশে একটি ছেলের কাছ থেকে কাগজ আর পেনসিল নিয়ে তামিল ভাষায় নিজের নাম, গোত্র, ঠিকানা লিখে চিরকুটটি ঠেংড়ীজীর হাতে দিলেন।) আমার নামে একটি স্পেশাল পূজা আপনাকে দিতে হবে।
ঠেংড়ীজী বললেন, ঠিক আছে। মন্দিরের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। দু’পা এগোতেই তিনি আবার ডাকলেন। তারপর ব্যাগ খুলে অনেকগুলি টাকার নোট দিয়ে বললেন, এটা তার হয়ে স্পেশাল দক্ষিণা পুরোহিতকে পৌঁছে দিতে হবে। ঠেংড়ীজী তা নিলেন এবং এগিয়ে চললেন। আবারও ডাকলেন তিনি। এবার বিরক্তই হলেন ঠেংড়ীজী, কারণ ন’টার সময় নির্ধারিত বৈঠক, হাতে সময় বিশেষ নেই, তাই তাড়াহুড়ো ছিল। কিছুটা বিরক্তির সুরে বললেন, কী ব্যাপার? এবার এম.পি. ভদ্রলোক তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করলেন। ঠেংড়ীজী অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, এ কী করছেন? ভদ্রলোক উত্তরে বললেন, “Kindly transfer this also“.
এই ঘটনাটি বলে ঠেংড়ীজী মুচকি হেসে বললেন, এত বড় বড় লোকেরা ধর্মাচরণ নিয়ে এত বড় বড় কথা ভেবেছেন যে, আপনাদের আর বেশি ভাবার দরকার নেই।
ধর্ম মানুষের মজ্জাগত, আর ‘ইজম‘ (ism) সচেতনভাবে মানুষ শেখে এবং সেটাকে অন্তরের যুক্তিবোধের মধ্যে মান্যতা দেয়। ধর্ম প্রতিদিন বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যের অনুবর্তনে মানুষের ভেতরে প্রবেশ করে। জীবনচর্যা থেকে ধর্মাচারকে আলাদা করা যায় না। ‘ইজম’ সচেতনতার সামগ্রী কিন্তু ধর্মাচরণ মানুষের জীবনচর্যার পরতে পরতে অবচেতন ভাবেই প্রবাহিত হয়। এইভাবে দৃষ্টান্ত দিয়ে দত্তপন্থ ঠেংড়ীজী বুঝিয়ে দিলেন, সামাজিক লাভের জন্য কোনো ইজমে যেতে হয়। কিন্তু অন্তর অন্য কথা বলে, তাই অন্য পুণ্যার্থীকে প্রণাম করে তাকে বলতে হয়, এটাও দেবতার চরণে পৌঁছে দেবেন! একদম খাঁটি সত্যকে তুলে ধরেছেন রাষ্ট্রঋষি।
ছবিদুটি এঁকেছেন শীর্ষ আচার্য এবং ড. গোপী ঘোষ
(রাষ্ট্রঋষি দত্তপন্থ ঠেংড়ীজী জন্মশতবর্ষ চলছে। তিনি ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ, ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ, স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ সহ বহু বিশ্ববিখ্যাত সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, এক পূজনীয় পণ্ডিত ব্যক্তি। রাজনীতি থেকে শুরু করে সমস্ত সংগঠনের কার্যকর্তা নির্মাণে তাঁর বৌদ্ধিক মতামত আজও আমাদের সমৃদ্ধ করে চলেছে। ২০০৪ সালের ১৪ ই অক্টোবর দেহাবসান ঘটে এই প্রবুদ্ধ মানুষটির।)
(দত্তপন্থ ঠেংড়ীজীর বক্তব্য থেকে মণিমাণিক্য উদ্ধার করে এনেছেন ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty)।)