বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্যকে কেন হঠাৎ 2001 বিধানসভা ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রী করা হল এটা জানতে তার আগের পাঁচ বছরের বাংলার রাজনীতির কথা একটু আলোচনা করা যাক l সোমেন-মমতা লড়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস জেগে উঠল এবং 1977 এর পর, 1996 নির্বাচনে প্রথমবার তাদের দলের আসন 42 থেকে দ্বিগুন হয়ে 84 হয়ে গেল l কিন্তু 1996 এ নরসিমা রাও হেরে যাবার পর দিল্লিতে যে খিচুড়ি সরকার আসে তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন সিপিআই এর ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত এবং মমতা সোমেন সেই সরকারকে সমর্থন করতে বাধ্য হলেন l এর আগে 1993 তে, নরসিমা রাও এবং টি এন সেশনের চাপে ত্রিপুরায় সমীর বর্মনকে হারিয়ে সিপিএম ক্ষমতায় আসেন l মমতা নিশ্চিত হলেন, এই কংগ্রেস CPM এর ‘বি টিম ‘ এবং প্রকাশ্যে তা বলা শুরু করলেন l মমতা নিজের দল তৈরি করেন 1998 এ এবং NDA তে যোগ দেন l 1998 ও 1999 এ আশাতীত ভালো ফল করে তৃণমূল ও বিজেপির জোট এবং দুবারই প্রধানমন্ত্রী হন অটলজি l 1999 এ মমতা হলেন রেল বিষয়ক কেবিনেট মন্ত্রী l সবার মত অনিল বিশ্বাসও বুঝলেন, জ্যোতি বসুকে সামনে রেখে ভোট করলে হার নিশ্চিত l বুদ্ধদেবকে ভোটের একবছর আগেই মুখমন্ত্রী করে মাস্টারস্ট্রোক দিলেন অনিল l 2001 এ ষষ্ঠবার ক্ষমতায় এল বুদ্ধদেবের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট l
মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য ও তার শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন মার্কিন পরামর্শদাতা সংস্থা ম্যাকান্সিকে নিয়োগ করলেন একটা মাস্টার প্ল্যান বানানোর জন্য l উনি মূলতঃ MSME, IT, রফতানিমূলক কারখানা ইত্যাদির উপর জোর দিলেন l বুদ্ধবাবুর শিল্প এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগের একটা ছোট তালিকা এখানে দেয়া যাক l
- তৎকালীন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর প্রস্তাব মেনে টালিগঞ্জ-গড়িয়া মেট্রো রেল প্রকল্পে 33% খরচ দিতে রাজি হলেন, যাতে কলকাতাকে কিছুটা বিকেন্দ্রীকরণ করা যায় l
- হাওড়া-শিয়ালদা-সল্টলেক সংযোগকারী মেট্রো তৈরির জন্য KMRCL তৈরি করে 50% শেয়ার রাজ্য সরকার নিল l এই প্রকল্প সেক্টর 5, শিয়ালদাহ, মেট্রো এবং হাওড়া স্টেশনকে যুক্ত করবে, যা কলকাতার পরিবহনের একটা বড় সমস্যা সমাধান করবে l কিন্তু বিভিন্ন কারণে উনি চলে যাবার পর এই প্রকল্পের অগ্রগতি কমে যায় এবং আজও শেষ হয় নি l
- সাগরে গভীর সমুদ্র বন্দর বানানোর জন্য দুবাই পোর্টের সঙ্গে কথা শুরু করলেন l এই প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারত l কিন্তু উনি চলে যাবার পর আজও তা হয়নি এই জীবনদ্বায়ী প্রকল্প l পরবর্তীকালে, 2016 তে কেন্দ্রীয় সরকার 40000 কোটি টাকা বরাদ্দ করে এই প্রকল্পে l কিন্তু রাজ্য কোন এক অজ্ঞাত কারণে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় l
- উত্তরবঙ্গ থেকে মোড়গ্রাম (মুর্শিদাবাদ জেলা ) হয়ে হলদিয়া এবং NH34 হয়ে কলকাতায় রাস্তা চওড়া করে বানানোর জন্য কেন্দ্রের সঙ্গে কথা শুনলেন l এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে কথাও বললেন l যদিও উনি চলে যাবার পর জমিজটে এই প্রকল্পও আটকে গেল l
- বহু SEZ বানালেন এবং IT তে জোর দিলেন l নবদিগন্তের বাইরে নিউটউনএ CTS, TCS, IBM, TCG, PWC, KMPG, DELLOITE কে দিয়ে বড়রকম বিনিয়োগ করালেন l কয়েক লক্ষ শিক্ষিত বেকার চাকরি পেল l একটা আধুনিক কলকাতা উপহার দেবার চেষ্টা করলেন বুদ্ধবাবু l
- বহু MSME ক্লাস্টার বানালেন, যার মধ্যে কিছু রফতানিমূলক SEZ l মানিকাঞ্চন, বেলেঘাটা বস্ত্রপার্ক, সল্টলেকের শিল্পাঙ্গন, হাওড়ায় NH 6 ও NH 2 এর পাশে বহু MSME ক্লাস্টার, কসবা MSME ক্লাস্টার ও বানতলা চর্মনগরী এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য l এছাড়া জঙ্গিপুর ও শিলিগুড়ি ফুডপার্ক সহ আরও কিছু শিল্প পরিকল্পনা করেছিলেন ও জমি অধিগ্রহণ করেছেন, যার পরে আর বাস্তবায়ন হয়নি l নবান্নও বানানো হয়েছিল গার্মেন্টস পার্ক MSME ক্লাস্টার হিসেবেই l বহু দক্ষ শ্রমিকের এখানে কর্মসংস্থান হত l কিন্তু তা আজ রাজ্যের সচিবালয় l
- অন্ডালে বিমাননগরী বানানোর জন্য টাটা এবং সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমান বন্দরের সঙ্গে হাত মেলালেন l তৈরিও হল l কিন্তু উনি চলে যাবার পর আর সফল হয় নি তার এই স্বপ্নের প্রকল্প l এই প্রকল্প চারটে জেলার জীবন পরিবর্তন করে দিতে পারত l
- জিন্দালদের ডাকলেন বিশ্বের বৃহত্তম ইস্পাত কারখানা বানানোর জন্য l কিন্তু চীনের কম দামের ইস্পাত সরবরাহ বাজার খারাপ করে দেয় l সেই প্রকল্প থেকে জিন্দাল হাত গুটিয়ে নেয় l
- রঘুনাথপুর, পানাগড় ও খড়গপুরে শিল্প বানানোর জন্য পরিকাঠামো তথা বিদ্যুৎ, জল, আবাসন, সড়ক এমনকি রেল যোগাযোগ বানালেন l অন্ডাল বিমাননগরীকে রঘুনাথপুর, দুগাপুর, আসানসোল ও পানাগড়ের কথা ভেবেই বানিয়েছিলেন l কিন্তু কোনটাই তিনি চলে যাবার পর আর এগোয় নি রাজ্যের জমি নীতির জন্য l
- বহু বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গড়ে উঠল l তাদের অনেকেই চাকরি পেল l
- তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করার জন্য কেন্দ্রের থেকে 1700 কোটি টাকা আনলেন যা উত্তরবঙ্গকে ইসরায়েল বা গুজরাট বানিয়ে দিতে পারত l কিন্তু তিনি চলে যাবার পর, এই প্রকল্পও জমি জটে বন্ধ হয়ে যায় l
- সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের স্বপ্নের সেচ প্রকল্প সিদ্ধেশ্বরী-নুনবিল, দ্বারকেশ্বর-গন্ধেশ্বরী, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান শুরু করলেন বুদ্ধদেব l কিন্তু ভবিষ্যতে এগুলিও একটুও এগোয়নি জমি জটে l
- বারাসাত-রায়চক আট লেন সড়ক l এটিও তিনি চলে যাবার পর আর হয় নি জমি জটে l
- ফিনান্সিয়াল হাব : রাজারহাটে উনি ফিনান্সিয়াল হাব বানানো পরিকল্পনা, পরিকাঠামো সেরে ফেলেছিলেন l ওনার উত্তরসূরিরা বেশ কয়েকবার টেন্ডার করেও কোন ব্যাংক, নন ব্যাঙ্কিং ফিনান্স কোম্পানি, স্টক ব্রেকিং কোম্পানি বা কোন মিউচুয়াল ফান্ড কোম্পানি পাননি l
- চলচিত্র শিল্পে একটা নতুন যুগ এল l সাধারণত কলেজর ছাত্রছাত্রী, অবিবাহিত যুবক যুবতী ও নতুন দম্পতিরা এই শিল্পের মূল ক্রেতা, যাঁরা 1966 থেকেই মোটামুটি বহির্মুখী l এদের ধরে রাখতে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব সফল হলেন l আগের সংখ্যার শেষের দিকে লিখেছিলাম, বাংলার সংস্কৃতি 2000 এ প্রায় মৃত্যু মুখে পতিত হচ্ছিল l তথ্য ও সংস্কতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব যে অধঃপতন আটকাতে পারেন নি, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব তা কিছুটা করে দেখালেন l রাজ্যের মানুষের হাতে জীবিকা ও অর্থ দিয়ে l তাঁর পিতৃব্যের লেখা কবিতার সেই লাইনটাকে জ্যোতিবাবুর মত তিনিও সত্য প্রমান করলেন l ” ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় l পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি ” l ক্ষুধা কমতেই রাজ্য আবার সিনেমা হল /মাল্টিপ্লেক্সমুখী হল l
2004 ও 2006 তে বুদ্ধবাবু বিপুল ভোটে জিতে এলেন বিরোধীদের প্রায় ধুলিস্বাৎ করে l 2004 থেকে কেন্দ্রে কংগ্রেস তথা UPA সরকারকে CPM সমর্থন করছিল এবং রোজই কোন না কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে সর্বসমক্ষে সরকারকে হেয় করছিল বামনেতারা l বিজেপি ও অন্য বিরোধী নেতারা সংসদে ও বাইরে এই ব্যাপারে মজা নিচ্ছিলেন l সোনিয়া, মনমোহন, প্রণব এদের প্রতি ভিতরে ভিতরে বেশ অসন্তুষ্ট ছিলেন, কিন্তু সহ্য করছিলেন l
এই সময় CPM এ দুটি বড় পরিবর্তন হয়, যা আগামী দিনের পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথা পার্টি হজম করতে পারল না l হরকিষেন সিং সুরজিতের জায়গার পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন প্রকাশ কারাট 2005 এ l সুরজিৎ যেভাবে কংগ্রেসকে ম্যানেজ করতেন, তা অহংকারী প্রকাশ কারাতের পক্ষে সম্ভব হল না l প্রতিদিনই সম্পর্কের অবনতি হতে থাকল l এরপর, 2006 ভোটের আগে কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীকে একটা পুরোনো মামলার সূত্র ধরে গ্রেফতার করে রাজ্য সরকার l জেলে যাবার আগে অধীর চৌধুরী etv bangla news এর সামনে প্রকাশ্যে হুমকি দেন তিনি বেরিয়ে এসে অনিল বিশ্বাসের সুইস ব্যাংকের একাউন্টের নম্বর বলে দেবেন l উনি জামিন পাবার আগেই অনিল বিশ্বাসের হঠাৎ মৃত্যু হয় l রাজ্য সম্পাদক হন বিমান বোস l
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অশ্বমেধের ঘোড়া আটকে গেল 2006 তে, অনিল বিশ্বাসের মৃত্যুর ঠিক পরেই l মিঠুন চক্রবর্তীর ফাটাকেষ্ট সিরিজের দুটি ছবি রিলিজ হবার পর গ্রাম বাংলায় রেশন লুট শুরু হয় এবং সেটা সামলাতে ব্যর্থ হন বুদ্ধদেব l আগুনের মত এই রোগ গ্রামের পর গ্রাম ছড়াতে থাকে l এর মধ্যে মুরগির বার্ড ফ্লু শুরু হয় l সরকার মুরগি বধ করা শুরু করে, কিন্তু ক্ষতিপূরণ দেয় না l ক্ষতিপূরণ শব্দটা ‘কোঅর্ডিনেশন’ বাবুরা বহুদিন আগেই ভুলে গেছেন l ফলে সংখ্যালঘু সমর্থন কমতে থাকে পার্টির l এর মধ্যে আসে সাচার কমিটির সেই রিপোর্ট, যেখানে সংখ্যালঘু মুসলিমদের এই রাজ্যে কোন উন্নতি হয় নি বলে উল্লেখ করা হয় l মমতা ব্যানার্জী আস্তে আস্তে NDA থেকে UPA র দিকে যেতে থাকলেন l সোনিয়া-প্রণবরা দেখলেন মমতা ব্যানার্জী যদি রাজ্য সরকারকে আন্দোলনে ব্যস্ত রাখেন, CPM হয়তো দিল্লিতে মনমোহন সরকারের সঙ্গে ঝামেলায় যাবে না l কিন্তু অনিলহীন CPM এ প্রকাশ কারাটকে আটকায় কে? এরপর সিঙ্গুর / নন্দীগ্রাম আন্দোলনে মমতার সঙ্গে যোগ দিলেন কংগ্রেস, বিজেপি, অমর সিং চৌধুরী, জর্জ ফার্নান্ডেজ থেকে বিক্ষুব্ধ CPM, SUCI, নক্সাল সবাই l
অনিল-সুরজিৎ-জ্যোতিবাবুদের অভাবে, বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য কয়েকটি ভুল করেছিলেন এই সংকটে l
- সিঙ্গুররের জমিটাকে কারখানার জন্য বেছে নেয়া প্রথম ভুল বুদ্ধদেবের l এখানে বুদ্ধবাবুর স্টালিনিস্ট ইগো তাঁকে বিপথে চালিয়েছিল l 2006 বিধানসভা ভোটে সিঙ্গুরে হারার জন্য উনি সিঙ্গুরবাসীকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন তাদের জমি কেড়ে নিয়ে l
- সংকটে CPM এর শেষ জননেতা সুভাষ চক্রবর্তীকে না ডাকা l এই মুহূর্তে ঠান্ডা মাথার এই লোকটিকে গুরুত্ব না দেয়া একটা বিরাট ভুল ছিল l অনিল বিশ্বাসের বিকল্প সাদাসিধে বিমান বোস বা চূড়ান্ত নিষ্ঠুর নিরুপম সেন কখনোই নয় l
- এরপর পার্থ চ্যাটার্জী ও নিরুপম সেনের মধ্যে রাজ্যপালের উপস্থিতিতে চুক্তি সাক্ষর করলেন, সিঙ্গুরের জমিহারাদের পুনর্বাসনের উপর l কিন্তু অবিলম্বে ভুল বুঝতে পেরে তা অগ্রাহ্যও করলেন l
রতন টাটা চলে গেলেন l কিন্তু মানুষের সহানুভূতি পেলেন না বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য l 2009 সাধারণ নির্বাচনে মাত্র তিন বছরের ব্যাবধানে TMC-কংগ্রেস-SUCI জোট ও বিজেপির কাছে 42 টার মধ্যে 27 আসন হারাল CPM l টাটা রাজ্য ছাড়ায় বুদ্ধদেব ভেবেছিলেন মানুষ তাঁর প্রতি সহানুভূতি জানাবে l কিন্তু তা হল না l বুদ্ধদেববাবুর সহানুভূতি না পাবার কারণগুলি হল :
- সাধারণ মানুষ টাটার কারখানার কাছে চাকরি বা ব্যবসার কোন আশাই করেনি l কারণ সাধারণ মানুষ বুঝতেন এখানেও হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালের মত চাকরি, ঠিকাদারী, পরিবহন ব্যবসা ইত্যাদি পাবে শুধুই পার্টি ক্যাডাররাই l
- হলদিয়ার পতন হয়েছিল অত্যাধিক ও প্রশাসনিক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে l এমনকি পূর্ণেন্দু চ্যাটার্জী একসময় হলদিয়াতে আসা বন্ধ করে দেন l মানুষ ধরে নিয়েছিল, টাটারও পরিণতি পূর্ণেন্দু চ্যাটার্জীর মত হতে পারে ভবিষ্যতে l ফলে টাটার কারখানা যে আগামী দিনে রাজ্যে সুদিন আনতে পারে এই বিশ্বাসই অধিকাংশ মানুষের ছিল না l
3. বুদ্ধদেববাবু শিল্প নিয়ে আগের কয়েক বছর কাজ করলেও, 9 কোটির রাজ্যের জন্য তা ছিল অপ্রতুল l তাছাড়া বুদ্ধবাবু নিজেও তাঁর এই শিল্পোদ্যোগ নিয়ে কোন দিন বিস্তারে প্রচার করেন নি l আমি নিশ্চিত, এই প্রতিবেদন যদি কোন চূড়ান্ত বাম সমর্থকও পড়েন, তিনিও আমার লেখা উপরের ষোলোটির উদ্যোগের সবকটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত হবেন না l কারণ এটা জানানো হত না একটি বিশেষ দলীয় কায়েমী স্বার্থের জন্য l তা হল ‘পূর্ণ স্বজনপোষণ’ l শুধুমাত্র পার্টির কর্মীরাই যাতে লাভের গুড় খেতে পারে, তাই এই গোপনীয়তা l 2004, 2006, 2009 এমনকি 2011 ভোটে কেউ শুনেছেন কোন ছোট বা বড় বামনেতা এতগুলো উদ্যোগ বা সাফল্য দাবী করে ভোট চেয়েছেন?
- শিল্প নিয়ে কিছু কাজ করলেও, উনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্যোতিবাবুর সময়ের চেয়ে ভালো কিছু করতে পারেন নি l ধর্মঘট, ইউনিয়নবাজি, কোঅর্ডিনেশন কমিটির অত্যাচার, প্রশাসনিক অবহেলা/অদক্ষকতা ও সিন্ডিকেট অত্যাচার চরমে উঠলেও, তা রোখার কোন চেষ্টাই তিনি এগারোটা বছরে করেন নি l 100 দিনের কাজে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল পশ্চিমবঙ্গ, কারণ পার্টির লোক ছাড়া কাউকে কিছু দেবার উদারতা কমিউনিস্টদের কোন দিনই ছিল না l
5. 2010 এ বিধানসভায় বুদ্ধবাবুর দেয়া এক বিবৃতি অনুযায়ী, 1996 এ তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হবার পর রাজনৈতিক হত্যা আরও বেড়ে গেছে l
- নন্দীগ্রামে গুলিচালনা ও তাপসী মালিকের হত্যা মানুষকে তাঁর থেকে দূরে নিয়ে গিয়েছিলো l
যাবার সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য তাঁর মোক্ষম তাসটা খেললেন, অষ্টম বামফ্রন্ট ফেরানোর লক্ষ্যে l যার ফলে, বাংলার বেকার যুবকদের চরম সর্বনাশের রাস্তা খুলে গেল l সেটা হল সাম্প্রদায়িকতার তাস l ধর্মের ভিত্তিতে শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য 10% সংরক্ষন শুরু চালু করলেন তিনি 2010 এ l যে কমিউনিস্টদের বাংলায় রাজনীতির হাতেখড়ি পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের নিয়ে রাজনীতি থেকে এবং যে উদ্বাস্তুরা তাদের টানা ছয় দশক সমর্থন করে গেছেন, ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তাদের সঙ্গে এতবড় প্রবঞ্চনা করে, উনি বুঝিয়ে গেলেন, তিনি দৈত্য কূলে প্রহ্লাদ হবার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত হতে পারলেন না l উনি নিজেই সাংবাদিকদের সামনে ঘোষণা করলেন, ‘আজ থেকে মহাকরণে 10% লোক আসবে মুসলমান সমাজ থেকে ” l আগামী কয়েক বছর সরকারি চাকরিতে এই 10% আসনের সাম্য আনতে প্রতিটি সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপনে অধিকাংশ আসন ভর্তি করতে হল মুসলমান চাকুরী প্রার্থীদের দিয়ে l যে সংস্কৃতি, যে ধর্মনিরেপেক্ষতার বড়াই উনি সারা জীবন করে এসেছেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য তার সঙ্গে চূড়ান্ত আপোষ করে তসলিমা নাসরিনকে বাংলা থেকে চিরতরে বিদায় করলেন অবলীলাক্রমে l শুধুমাত্র 28% ভোট বাক্স সুরক্ষিত করতে l এতবড় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, থেকে মন্দাক্রান্তা সেন, তিলোত্তমা মজুমদার কেউ প্রতিবাদ করলেন না l কিন্তু শেষ রক্ষা হল না l
2009 সাধারণ নির্বাচনে পরাজয়ের পর, CPM এর ক্যাডাররা ভয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান l 2011 তে 34 বছর পর প্রথমবার রিগিংহীন ভোট দেখল পশ্চিমবঙ্গ l ভোটের আগেই রিগিংমাস্টাররা দিল্লি, আগরতলা বা পাটনায় আশ্রয় নিল l CPM বিদায় নিল l
তবে, একটা জিনিস মানতেই হবে 1966 থেকে 2000 সাল পর্যন্ত রাজ্যে যে শিল্প বাণিজ্যের খরা চলছিল, বুদ্ধবাবু একজন CEO র মত সেই প্রবণতার পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছেন l তার আর্থিক সততাও প্রশ্নাতীত l কিন্তু বুদ্ধবাবুর শিল্পের স্বপ্ন পরের নয় বছরে বাস্তবে পরিণত হল না l তার উত্তরসূরি মমতা ব্যানার্জী পরিষেবা ও সামাজিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে যে গুরুত্ব দিলেন, তার ছিটেফোঁটা রাজ্যের শিল্প, বাণিজ্য ও পরিকাঠামোর ব্যাপারে দিলেন না l শিল্প, বাণিজ্যে আবার মন্দার দিন ফিরে এল l মমতা ব্যানার্জীর 2011 র নির্বাচনী ইস্তেহার রাজ্যের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াল l আলোচনা হবে সপ্তম পর্বে l
সুদীপ্ত গুহ (Sudipta Guha)
( লেখক বহুজাতিক পরামশর্দাতা সংস্থা URS কনসাল্টিং ইন্ডিয়ার ভূতপূর্ব চিফ জেনারেল ম্যানেজার )