স বিদ্যা পরমা মুক্তের্হেতুভূতা সনাতনী।
সংসারবন্ধহেতুশচ সৈব সর্ব্বশ্বরেশ্বরী ।।
যাঁরা শ্ৰী ভগবানের লীলা নিয়ে তাকে পরকীয়াবাদ প্রভৃতি আখ্যা দিয়ে আলোচনা করেন, সর্বপ্রথম তাঁদের #যোগমায়া তত্ত্বটি জানা একান্ত প্রয়োজন। এতদ্ভিন্ন শৈব এবং শাক্তগণের পক্ষেও এই তত্ত্ব আলোচনার আবশ্যকতা রয়েছে। তথ্যটি মার্কণ্ডেয়পুরাণে এই তত্ত্বটি বিষদরূপে বিবৃত হয়েছে। প্রথমোক্ত শ্লোক সেই কথাই প্রমান করে। উক্ত শ্লোকের অর্থ হল – সেই সনাতনী পরমবিদ্যা রূপে মুক্তির হেতুভূতা। আবার সেই সর্ব্বেশ্বরেশ্বরীই মায়া হয়ে সংসার বন্ধনে সাহায্য করেন।
তন্নাত্র বিস্ময়ঃ কার্যো যোগনিদ্রা জগৎপতেঃ।
মহামায়া হরেশ্চৈতত্তয়া সম্মোহ্যতে জগৎ।।
মহামায়া হলেন স্বয়ং যোগনিদ্রা স্বরূপিণী । সূতরাং , তিনিই আদি শক্তি এবং তিনিই জগৎমোহন হবে না তাতে বিস্ময় নেই। মার্কণ্ডেয়পুরাণ এবং চন্ডীতে বহুবার তিনিই বৈষ্ণবীরূপে কথিতা হয়েছেন। চন্ডীর ত্রয়োদশ অধ্যায় তাঁকে বিষ্ণুমায়া বলে উল্লেখ করেছেন।
বেদের দেবী সূক্ত বা বাক্ সূক্তে উল্লিখিত হয়েছে :
অহং সুবে পিতারমস্য মূর্ধ্বন্মম যোনি রপ্স্বন্তঃ সমুদ্রে।
ততো বিতিষ্ঠে ভুবনানি বিশ্বোতামূন্দ্যাং বর্ষ্মণোপস্পৃশামি।।
অর্থাৎ, এই বিশ্বের উপরিভাগের দ্যুলোককে আমিই প্রসব করে থাকি। দিব্য কারণ বারি রূপ সমুদ্রে, যেখানে সমস্ত প্রাণীর উদয় ও বিলোপ হয়, সেই ব্রহ্মচৈতন্য আমার নিবাসস্থল। সর্বভূতে আমি প্রবিষ্ট এবং বিশ্বকে আমি নিজের মায়া দ্বারা স্পর্শ করে আছি।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় তিনি মায়া এবং যোগমায়া নামে অভিহিত হয়েছেন। সেখানে কৃষ্ণ পার্থকে বলছেন –
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।।
অর্থাৎ , মায়া যখন অবিদ্যা তখন সেই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন। এই মহামায়ার সংসারে জাগতিক চাওয়া পাওয়া , দুঃখ যন্ত্রনা হতে মুক্তি পেয়ে বিদ্যারূপী পরম ব্রহ্মস্বরূপ , যোগ স্বরূপ মায়াকে প্রাপ্ত হবার নিমিত্ত সকল জাগতিক চাহিদা পরিত্যাগ করে আমার স্মরণ নাও। মায়ার সংসারে জীবকুল জাগতিক বিষয় বন্ধনে আবদ্ধ থেকে তাই আমি তাঁদের গোচর হই না। মূঢ় লোকে তাই আমাকে অজ ও অব্যয় বলে জানতে পারেন না।
চন্ডীতে আদি পরাশক্তি মহামায়া এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় তিনিই বিষ্ণুমায়া, যোগমায়া এবং মহামায়া হিসাবে অবস্থান করছেন।
কাত্যায়নি মহামায়ে মহাযোগিন্যধীশ্বররি।
নন্দগোপসুতং দেবি পতিং মে কুরু তে নমঃ।।
নন্দগোপনন্দনকে জীবন সঙ্গী হিসাবে গোপীগণ যাঁর উপাসনা করেছিলেন , মহারাসলীলার প্রারম্ভে শ্ৰীভগবান্ সেই মহামায়ারই মূলস্বরূপকে , সর্ব্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশকে গ্রহণ করেছিলেন।
ভগবানপি তা রাত্রীঃ শারদোৎফুল্লমল্লিকাঃ।
বীক্ষ্য রন্তুং মনশ্চক্রে যোগমায়ামুপাশ্রিতঃ।।
দেবী যোগমায়াকে শ্ৰী কৃষ্ণের সকল লীলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী রূপে প্রণাম জানানো হয়েছে। চন্ডীতে মহাবিদ্যা যোগমায়া এবং অবিদ্যা রূপী জাগতিক মায়ার উল্লেখ পেয়েছি। তাঁকে মায়া , মহামায়া এবং যোগমায়া রূপে অভিহিত করা হয়। অবিদ্যাস্বরূপ মায়া সংসার বন্ধনের হেতু , মহাবিদ্যা স্বরূপ সর্ব্বসম্পদ্ দাত্রী , অভীষ্টদায়িনী, মোহমুক্তির হেতু স্বরূপ। তিনিই যোগ স্বরূপ আনন্দব্রহ্মের অনুভূতি প্রদানের সামর্থে সর্ব্বাধিকা। ইনিই যুগে যুগে আবির্ভুত বিষ্ণুর দশঅবতারের সহকারিণী স্বরূপ।।
নারদপঞ্চরাত্রে শ্রুতিবিদ্যা সংবাদে বলা হয়েছে যে –
জানাত্যেকা পরা কান্তং সৈব দুর্গা তদাত্মিকা।
যা পরা পরমা শক্তির্মহাবিষ্ণুস্বরূপিণী।।
যস্যা বিজ্ঞানমাত্রেণ পরাণাং পরমাত্মনঃ।
মূহুর্ত্তাদেব দেবস্য প্রাপ্তির্ভবতি নান্যথা।।
একেয়ং প্রেম সর্ব্বস্ব স্বভাবা গোকুলেশ্বরী।
অনয়া সুলভো জ্ঞেয় আদিদেবোহখিলেশ্বরঃ।।
ভক্তির্ভজনসম্পত্তির্ভজতে প্রকৃতিঃ প্রিয়ম্।
জ্ঞায়তেহত্যন্তদুঃখেন সেয়ং প্রকৃতিরাত্মনঃ।।
দুর্গেতি গীয়তে সদ্ভিরখণ্ডরসবল্লভা।
অস্যা আবরিকা শক্তিনর্মহামায়াহখিলেশ্বরী।।
যয়া মুগ্ধং জগৎ সর্ব্বং সর্ব্বদেহাভিমানিননঃ।।
শ্ৰীদুর্গা হলেন চিন্ময়ী শক্তি। তাই তিনি #একাংশনা , তিনিই এক। পরমাশক্তি মহাবিষ্ণু স্বরূপিণী শ্রেষ্ঠশক্তি। তিনি প্রেম সর্ব্বস্বভাবা , তিনি গোকুলাধিষ্ঠাত্রী । তাঁকে জানতে পারলেই মহাশূন্য আদিদেবকে সহজেই প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই অখন্ড রসবল্লভা আদি শক্তির আবরিকা শক্তি অখিলেশ্বরী মহামায়া সমস্ত জগৎকে , সকল দেহাভিমানী জীবকে মুক্ত করেন।
চন্ডীতে দেবী নিজ মুখেই বলেছেন –
নন্দগোপগৃহে জাতা – যশোদা – গর্ভ সম্ভবা। আমি নন্দগোপগৃহে যশোদা গর্ভে জন্ম গ্রহণ করব। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় এনাকেই বিষ্ণুর অনুজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এনারই না। একাংশনা। ইনিই যোগমায়া। জগন্নাথ ও বলদেবের মধ্যবর্তীনি দেবী শক্তি সুভদ্রা নামে অবস্থান করছেন। যদিও অনেকেই এর ভ্রমাত্মক উক্তি করেন।
মায়ার কার্য হল #বিমুখমোহন । আর মহামায়া বা বিদ্যার কাজ হল #উম্নুখমোহন। শ্রীভগবানের শক্তিগণকে , তাঁর পরিকরগণকে , এমন কি স্বয়ং ভগবানকে মুগ্ধ করতে একমাত্র সেই আদি শক্তি মহামায়া যোগমায়াই সমর্থা। এই মুগ্ধতাই হল লীলা। এই মুগ্ধতা তিনি স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
শ্বেতাশ্বর উপনিষদে মায়া প্রকৃতি নামে অভিহিতা হয়েছেন।
মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং তু মহেশ্বরম্।
ঈশোপনিষদে অবিদ্যা ও বিদ্যা এই দুই নকমে সেই মায়াকে পাওয়া যায়।
বিদ্যাঞ্চাবিদ্যাঞ্চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহঅবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়ামৃতমশ্নুতে।
বিদ্যা এবং অবিদ্যা উভয়কে যিনি একত্র করে জানেন তিনি অবিদ্যা অর্থাৎ কর্ম্ম-দ্বারা মৃত্যু হতে উত্তীর্ণ হয়ে ব্রহ্মলাভের দ্বারা অমৃত প্রাপ্ত হন।
এইটিই সংসারধর্ম্মের মূলমন্ত্র — কর্ম্ম এবং ব্রহ্ম, জীবনে উভয়ের সামঞ্জস্য-সাধন। কর্ম্মের দ্বারা আমরা ব্রহ্মের অভ্রভেদী মন্দির নির্ম্মাণ করতে থাকবে। তিনি সেই মন্দির পরিপূর্ণ করে বিরাজ করতে থাকবেন। বিদ্যা ও অবিদ্যা উভয়েই যুগপৎ জানতে বলেছেন। অবিদ্যাকে জানলে সংসারবন্ধন ঘটবে না। তার দ্বারা মৃত্যুকে উত্তীর্ণ হয়ে বিদ্যার দ্বারা অমৃতত্ত্ব লাভ করতে হবে। ঈশোপনিষদ্ অবিদ্যা ও বিদ্যা, সম্ভূতি ও অসম্ভূতি পৃথক নয় একত্রে উপাসনার কথা বলেন। উভয়কেই একত্রে জানতে হয় তবে মুক্তি ঘটে।
যোগমায়া আদি পরাশক্তি , ব্রহ্মময়ী ।
যঃ কৃষ্ণঃ সৈব দুর্গা স্যাৎ যা দুর্গা কৃষ্ণ এব সঃ।
অনয়োরন্তরাদর্শী সংসারোন্নো বিমুচ্যতে।।
কৃষ্ণ ও দুর্গার তত্ত্বতঃ কোনো ভেদ নেই। ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে –
মায়য়া রমমাণস্য ন বিয়োগস্তয়া সহ।
আত্মনা রময়া রেমে ত্যক্তকালং সিসৃক্ষয়া।।
মায়ার সংসারে তাঁর বিয়োগ নাই। তাঁর ইচ্ছায় বারবার প্রলয় ও সৃষ্টি। শূন্য ও মায়া একত্রে তা সম্পাদন করছেন প্রতি নিয়ত। শূন্যের সঙ্গে রমা নিয়ত বিহারশীল তাই রমার অপর নাম নিয়তি।
নিয়তিঃ স রমা দেবী তং প্রিয়া তদ্বশং সদা।
ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে –
এবং জ্যোতির্মময়ো দেবঃ সদানন্দঃ পরাৎপরঃ।
আত্মারামস্য তস্যাস্তি প্রকৃত্যা ন সমাগমঃ।।
তিনিই প্রকৃতি , আবার তিনি প্রকৃতি হতে নির্লিপ্ত । তিনি ও প্রকৃতি একই আবার এক হয়েও এক নয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় প্রকৃতির বেশ পরিষ্কার বিশ্লেষণ আছে। শ্ৰীদুর্গাই রূপভেদে প্রকৃতি বা মহামায়া ও যোগমায়া নামে অভিহিতা হন। যোগমায়া রূপই শ্ৰীদুর্গার প্রকৃত স্বরূপ।
কালিকা পুরাণ ষষ্ঠ অধ্যায় বিষ্ণুমায়া ও মহামায়া পৃথক বর্ণনা আছে। উভয়েরই আদি শক্তির অংশ স্বরূপা। যিনি যোগীগণের মন্ত্র মর্ম্মোদঘাটনে তৎপরা , পরমানন্দ স্বরূপা, সত্ত্ব বিদ্যা – তাঁকেই জগন্ময়ী বলা হয়। ইনি বিষ্ণুমায়া নামে বলে অভিহিত হন। আর যিনি জীবকে ওই সংসার বন্ধনে আবদ্ধ রাখেন, মহাকালের চক্রের নিয়মে রেখে পরিচালনা করে সৃষ্টি করে সৃষ্টিকে রক্ষা করেন তিনি মহামায়া।
শ্রীকৃষ্ণ পরিকরগণকে এবং শ্রীকৃষ্ণকে মুগ্ধ করাই যোগমায়ার কার্য। সে কথা পূর্বে বলেছি। মাটি খেয়ে গোপাল যখন যশোদার তিরস্কারে মুখ হাঁ করেছিলেন যশোদা তখন দেখেছিলেন ব্রম্ভান্ডকে….কিন্তু তিনি কি কেবল ঐটুকুই দেখেছিলেন? না , তিনি আরো দেখেছিলেন , স্বয়ং মহামায়া যোগমায়াকে….তাঁর মনে হল তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন না দেব মায়া? নাকি তাঁর বুদ্ধিভ্রম হল ? তিনি সেই ব্রম্ভান্ড স্বরূপ নারায়ণকে প্রণাম করে বললেন , ” আমি যশোদা , গোপ রাজ নন্দ আমার পতি, কৃষ্ণ আমার পুত্র, আমি ব্রজেশ্বর অখিল বিত্তের অধিকারিণী পত্নী , গোধনাদি সহ ব্রজের গোপগোপী আমার অধিকৃত, যাঁর মায়ায় আমার এমন হল, তিনিই এখন আমার আশ্রয়। “
ইথ্থং বিদিততত্ত্বায়াং গোপিকাং স ঈশ্বরঃ ।
বৈষ্ণবীং ব্যতনোন্মায়াং পুত্রস্নেহময়ীং বিভুঃ।।
মহামায়া যোগামায়ার অপার মায়ায় যশোদা বিষ্ণু অবতার দেবকীনন্দনকে নিজ পুত্রজ্ঞান করলেন। সেই মহা বৈষ্ণবী মায়ার মাহাত্ম্য বেদ , শ্রুতি, সাংখ্য , যোগ ও পঞ্চরাত্রাদিতে কীর্তিত হয়। দার্শনিকগন এই মায়াকে অঘটন পটিয়সী বলে উল্লেখ করেছেন। তাই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা আলোচনার জন্য যোগমায়া তত্ত্ব জানা আবশ্যক। এই রহস্য জানতে হলে প্রসন্ন অন্তঃকরণে সাধনা আবশ্যক। পূর্ব্বাচার্যগনের পদাঙ্ক অনুসরণ পূর্বক তাদের বাণী রূপে গ্রহণ আবশ্যক।
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।।
তাই সর্বাগ্রে আমাদের যোগমায়ার উপাসনা করতে হবে।
যন্মর্ত্ত্যলীলৌপয়িকং স্বযোগমায়াবলং দর্শয়তা গৃহীতম্।
বিস্মাপনং স্বস্য চ সৌভগর্দ্ধেঃ পরং পদং ভূষণভূষণাঙ্গম্।।
এই হলেন যোগমায়া। তিনি শ্রীকৃষ্ণ লীলা করেছিলেন। যোগমায়া মায়ার সংসারে তাঁর কীর্তি স্থাপন করেছিলেন। এই যোগমায়ার অপর নাম পৌর্ণমাসী । অঙ্গীরা পত্নী শ্রদ্ধার গর্ভে চার কন্যা জন্মান। সিনীবালী , কুহু, রাকা এবং অনুমতি। এই রাকা রজনীতে রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়। রাকা রজনীর নাম পৌর্ণমাসী । স্বত্বস্বরূপিনী যোগমায়া দেবীই সেই লীলার অধিষ্ঠাত্রী । তিনি লীলার প্রকাশিকা বলেই পৌর্ণমাসী বলে অভিহিতা হন।
এই আদি পরাশক্তিই হলেন মহাশক্তি, মহাবিদ্যা , মহামায়া, মহালক্ষ্মী ।
অহং রুদ্রেভির্ব্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোভা।
সেই মহাপরমা শক্তিকে আমার প্রণাম জানাই।
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ শ্রী দেবী ভাগবত” মার্কণ্ডেয় পুরাণ
বৈদিক দেবীসূক্ত বা আত্মাসূক্ত
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
চন্ডী
কালিকা পুরাণ