২০০২ সাল, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে অনুষ্ঠিত সপ্তাহব্যাপী একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছি। লোকসংস্কৃতির একজন অধ্যাপক ক্লাস নিচ্ছেন; বিষয়ে প্রবেশ করার আগে অধ্যাপক সভার কাছে জানতে চাইছেন বাঙ্গলার সর্বাপ্রেক্ষা অধিক পূজিত ও মান্য পুরুষ-দেবতার নাম কি এবং নারী-দেবতার নামই বা কী?
বললাম, আপতত উত্তরটুকু হচ্ছে পুরুষ-দেবতা শিব এবং নারী দেবতা-মনসা। অধ্যাপক সঠিক বলে মেনে নিলেন। তারপরই বলে ফেললাম এক অপ্রিয় তেতো সত্য — আগামী পঞ্চশ বছরে শ্রীরাম হতে চলেছেন বাঙ্গলার সর্বাধিক মান্য পুরুষ দেবতা। সভায় সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন শুরু হল, ছিঃ ছিৎকার; পরে লাঞ্চের সময় ‘সাম্প্রদায়িক-বর্বর’ আখ্যায়িত হতে বাকী রইলো না। শুধু বললাম, “পশ্চাতে রাখিছো যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।” শ্রীরাম বাঙ্গলার হিন্দুস্থানী দেব-সংস্করণ এবং রামের নামে সাম্প্রদায়িক বিভাজন বলে যতই প্রোপাগাণ্ডা করুন না কেন, রামকে বাঁধা দিলে তিনি বহুগুণ তীব্রবেগে রথ নিয়ে বঙ্গদেশে ঢুকবেন।
তখন বাম না রাম — এইভাবে প্রগতিশীল ও অসভ্য-বর্বর বিবেচনা করা হত! বাম-জামানায় কেউ যদি ‘জয় শ্রীরাম’ বলতেন; দ্বিধাহীনভাবে বলতেন ‘আমি হিন্দু’; হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য কীর্তন করতেন; বাংলাদেশে, পূর্ব-পাকিস্তানের সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরোধিতা করতেন; কাশ্মীরী-ব্রাহ্মণদের স্বভূমি থেকে উৎখাত বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ করতেন — তাকে বা তাদেরকে আরএসএস-বিজেপি বলে দেগে দেওয়া হত। ফলে আরএসএস বা বিজেপির সঙ্গে সেই বেচারি বাঙ্গালি হিন্দুর যোগ থাকুক চাই না থাকুক, তিনি ‘চোদ্দো-আনা আরএসএস’ হয়ে যেতেন। বামেদের ক্রমাগত কোনঠাসা করার প্রক্রিয়ায় তাদের ষোলো-আনা আরএসএস হতে সময় লাগে নি, অন্তত মনোভূমে। বাম পতনের শব্দ হয়!
যাইহোক, ২০০২ সাল থেকে হয়ে গেলাম ‘বে-সেকুলারি এক অসভ্যতম জীব’। তার শাস্তি হিসাবে জুটলো গণ্ডায় গণ্ডায়, অবিচার আর অসভ্যতামি, হাটে-ঘাটে-বাটের পর কর্মক্ষেত্রের মাঠেও।
ইতোমধ্যেই বামাবলীর ঢাকনি থেকে ইশারা করা চোপা আঙ্গুল দেখেছিলাম তার দু বছর আগে। ২০০০ সাল, একটি স্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকের দায়িত্ব নিলাম। তাতে পরতে পরতে বামাবলীর চাদরে ঢাকা উন্নয়নের নানান দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হতে লাগলো; যেমন স্থানীয় মিউনিসিপালিটির টেণ্ডার কেলেঙ্কারি, স্থানীয় সিপিএমের ভাঙ্গনের উৎস সন্ধানে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সঙ্গে গোল বাধালো রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে ১৯৪৫ সালে ড. শ্যামাপ্রসাদের আগমন বিষয়ক এক ঐতিহাসিক প্রবন্ধ প্রকাশ; প্রবন্ধটি লিখেছিলেন রহড়া বালকাশ্রমের স্বনামধন্য বিধু মাস্টারমশাই, যিনি মনেপ্রাণে একজন জাতীয়তাবাদী, গৈরিক-দেশপ্রেমী ছিলেন (বর্তমানে প্রয়াত)। কাজেই পত্রিকার প্রবন্ধ নির্বাচনে রামনামের গন্ধটা বোধহয় আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন স্থানীয় ও কর্মক্ষেত্রের বামকূল-তিলকেরা।
যাইহোক এখন বাঙ্গলায় রামনবমী পালিত হচ্ছে প্রবল উৎসাহে। এটা হবারই ছিল। জোর-জুলুমি বাম-নাম যে রাম-নামকে আটকাতে পারে না, সেই অজ্ঞতার মাশুল দিতে সিপিএম-কে আগামীদিনে রামায়ণী-বৈঠক করতেই হবে, রামযাত্রার আয়োজনও করতে হতে পারে, রামনবমী উৎসবকে কেন্দ্র করে তারা আগামীদিনে বাম-সাহিত্য বেচার টিমটিমে স্টলও দিতে পারেন।
বর্তমানে রামনবমী বাঙ্গলার এক জনপ্রিয় উৎসবে পরিগণিত হয়েছে। গৈরিক-জাতীয়তাবাদী মানুষ তো বটেই তাতে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ সাধারণত মানুষের পথ পরিক্রমা। আমজনতা হাজির হচ্ছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কোথাও ক্ষত্রিয় দেবতা রামের সঙ্গে সাজুয্য বজায় রেখে অস্ত্র পূজনও হচ্ছে, হচ্ছে সশস্ত্র মিছিল, যেন পুরোপুরি সনতনী হিন্দু বাঙ্গালীর চিন্তন-ঘরে ফেরা। “আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম সাজে” বাঙ্গালির যে যোদ্ধৃত্ব রূপ ফিরে এসেছে তার অন্তেবাসী প্রান্তবাসী মানুষের মূলস্রোতে নামা। বিগত কয়েক বছরে যে হারে বাঙ্গালী হিন্দু-সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ রামনামে মোহিত হয়েছেন, রাম-আরাধনাকে প্রতিবাদের এক অপূর্ব মঞ্চ করে তুলেছেন তা এককথায় অভূতপূর্ব। যারা বলেন রামের দেশ বাঙ্গলা ছিল না, রাম নিতান্তই হিন্দিভাষীদের খোট্টাভাষীদের দেবতা, তাদের বোধোদয় ঘটার দিন শুরু করবে আজকের রামনবমী। বাঙ্গালি অনেকদিন ধরেই ইষ্টনাম জপেছে, “হরে রাম হরে রাম/রাম রাম হরে হরে/হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ/কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।” বাঙালি ভুলে গেছে বাল্মিকীর পর হিন্দিভাষারও পূর্বে রামের ভক্তিরসে জারিত হয়েছিল বাঙ্গালি কবি কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঞ্চালী’-তে। বাঙ্গালি ভুলে গেছে শ্রীরামকৃষ্ণের, রানি রাসমণির কুলদেবতা রঘুবীর। বাঙ্গালি মনে রাখেনি শ্রীরামকৃষ্ণ সহ বাঙ্গালি মনীষার পূর্ব পুরুষের নামের মধ্যে স্বতঃই এসেছে ‘রাম’ কথাটি। বাঙ্গালিকে মনে করানো হয়নি বাঙ্গলার লোকসংস্কৃতিতে, লোকসংগীত ও লোকনৃত্যে বারে বারে রামায়ণের কাহিনি ও চরিত্র ফুটে উঠছে। বাঙ্গলার লোক-কবিরা তাদের ছড়া, প্রবাদ, প্রচলকথা ও লোককথায় রামনাম এনেছেন বারংবার। বাঙ্গলায় বসবাসকারী বনবাসী কৌমসমাজের লোককথায় রামায়ণ এসেছে এক লোক-ব্যাপন প্রক্রিয়ায়। অথচ বঙ্গদেশের লোকসংস্কৃতিবিদ পণ্ডিতেরা রামনামের ইতিবৃত্ত বিস্মরণীয় করে তোলার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল, ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।
পরিশেষে বলি, আগামী পঞ্চাশ বছরে বঙ্গদেশে সর্বাধিক মান্য নারী-দেবতা হতে চলেছেন মা কালী। পুরুষোত্তম শ্রীরামের তীর-ধনুক আর মহাকালের বার্তাবহ মা কালীর খাঁড়া বাঙ্গালি জীবনে শক্তির অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটাবে, সঙ্গে বেরিয়ে আসবে মধ্যযুগীয়-প্রেমাস্পদ বংশীধারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যোদ্ধা রূপ। শক্তির সমন্বয় সাধনই আগামীদিনের বাঙ্গালির একমাত্র কাজ; আর দ্বিতীয় কাজ হল আসমুদ্রহিমাচলের সনাতনী চেতনার সঙ্গে তার যুগপৎ পথ চলা।