নিজেদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্য জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও সেখ আব্দুল্লা। জম্মু-কাশ্মীরের মানুষকে গণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত রেখে জওহরলাল নেহেরু সর্বত্র ক্ষমতা কায়েক করতে চেয়েছেন। জম্মু-কাশ্মীর সমস্যা তৈরি করে দেশবাসীর নজর আড়াল করেছেন তিনি। মামুলি প্রাদেশিক সমস্যাকে জাতীয় আঙ্গীনায় টেনে এনে কাশ্মীর সমস্যাকে চিরস্থায়ী করে গিয়েছেন। সমস্যা সমাধানের নামে সেখ আবদুল্লাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়ালের পিঠে ভাগ করেছেন তিনি।মুষলমান তুষ্টিকরণের মাধ্যমে তাঁরা জম্মু-কাশ্মীরের সংখ্যালঘু হিন্দুদের বঞ্চিত রেখেছেন দীর্ঘকাল। জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রতিষ্ঠাতা অর্থাত জম্মু-কাশ্মীর প্রিন্সলে স্টেটের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী ও জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী সেখ আবদুল্লা প্রাদেশিক নেতা হয়েও জাতীয় রাজনীতিতের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিলেন। ১৯৬৭ সালের আগে সমগ্র ভারতবর্ষে তিনবার সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশটিতে কোনও লোকসভা নির্বাচন করার প্রয়োজন বোধ করেনি জওহরলাল নেহেরু ও সেখ আব্দুল্লা। দেশের সমস্ত রাজ্যে ১৬তম লোকসভা নির্বাচন প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরবাসী এই নিয়ে ১২বার লোকসভা ভোটে অংশ নিচ্ছেন। জওহরলাল নেহেরু ও সেখ আব্দুল্লার বদান্যতায় তারা প্রথম তিনটি লোকসভা নির্বাচনে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
কেবল জাতীয় স্তরের নির্বাচন নয়, রাজ্য বিধানসভা ও স্থানীয় ভোট প্রক্রিয়া থেকেও জম্মু-কাশ্মীরবাসীকে বঞ্চিত কেরছেন নেহেরু-আব্দুল্লা জুটি।
১১১ আসন বিশিষ্ট জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় ৮৭টি আসনে নির্বাচন সংগঠিত হয়ে আসছে।বাকি আসনের ক্ষেত্রগুলি পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের অংশ হওয়ায় সেই সমস্ত বিধানসভা ক্ষেত্রের মানুষ গণতান্ত্রিক ভোট ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত রয়েছন। পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের এক তৃতীয়াংশ মানুষ, ভারতের জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের আশ্রয়ে ফিরে এসেছেন। কিন্তু তাদের জন্য নতুন কোনও বিধানসভা ক্ষেত্রের কথা ভাবেননি জহরলাল নেহেরু ও সেখ আব্দুল্লা। জম্মু-কাশ্মীরে এযাবত ১১বার বিধানসভা ও ৪বার পুরসভা নির্বাচন সংগঠিত হয়েছে।এর ফলে স্থানীয় কার্যকারী প্রশাসন গড়ে ওঠেনি জম্মু-কাশ্মীরে। কংগ্রেস ও জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কন্ফারেন্স রাজ্যের রাজনীতিতে একছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে।ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ফলে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মাথা চাড়া দিয়েছে। যারা পরবর্তী সময়ে ভারত বিরোধী শক্তিতে পরিনত হয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালাচ্ছে।
দেশের অন্যান্য প্রান্তে যখন ভোটাভুটির মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হচ্ছেন সেই সময় অর্থাত ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত জম্মু-কাশ্মীর থেকে মনোনীত প্রার্থী সংসদে পাঠানো হচ্ছে! কার স্বার্থে?
স্বাধীন ভারতবর্ষে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫১ সালে ২৫ অক্টোবর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সাল, এই সময়কাল ধরে।২১ বছর বযসী সকল বৈধ ভারতীয় নাগরিক এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্য ছিলেন। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ ভারতীয় অক্ষর জ্ঞনশূণ্য । এত্দসত্ত্বেও চরম উদ্দীপনার সঙ্গে ভারতবাসী দেশের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরের মানুষকে সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে ছিলেন জওহরলাল নেহেরু ও সেখ আব্দুল্লা। ১৯৬৭ সালের আগে পর্যন্ত জম্মু-কাশ্মীরবাসীর রায় না নিয়ে অর্থাত ভোটের মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচিত না করে শাসকদল অর্থাত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস ও জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কন্ফারেন্সের ঠিক করে দেওয়া মনোনীত সদস্যরা সংসদে যেতে!এর ফলে জম্মু-কাশ্মীরবাসীর আশা-আকাক্ষা অপূর্ণ থেকে গেছে।বারবার ভূ-লুন্ঠিত হয়েছে নাগরিক অধিকার।
রাজ্য ওয়াড়ি লোকসভা নির্বাচনের তালিকায় জম্মু-কাশ্মীরের নাম নেই।
১৯৬৭ সাল থেকে জম্মু-কাশ্মীরে সরাসরি নির্বাচন। অর্থাত জনগণের ভোটে লাকসভার সদস্য নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু
১৯৫১ সাল থেকে সরাসরি নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার দৃঢ়করণের কাজ শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরবাসী প্রথম সরাসরি ভোটদানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ পান ১৯৬৭ সাল থেকে।
১৯৬৭ সালে জম্মু-কাশ্মীর লাকসভা নির্বাচনের কিছু গুরুত্ত্বপূর্ণ তথ্য
জম্মু-কাশ্মীরকে ৬টি লোকসভা কেন্দ্রে ভাগ করে ততকালীন কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু একটিও আসন সংখ্যালঘু হিন্দু বা তপশিলি জাতি ও উপজাতির জন্য সংরক্ষিত করেনি। যে নিয়ম এখনও চলে আসছে। এর ফলে দেশের মূল গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্রোত থেকে রাজ্যের সংখ্যালঘু হিন্দুরা বঞ্চিত থেকেই যাচ্ছেন। ৬টি আসনের মথ্যে জাতীয় কংগ্রেস ৫টি ও ১টি আসেনে জয়লাভ করে সেখ আব্দুল্লার জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কন্ফারেন্স। যে সাংসদরা ভোটে জিতেছিলেন তাদের নাম হল ১) এস এ আঘা (বারামুলা) ২)এস এল কুরেশি (অনন্তনাগ) ৩) কে বাকুলা (লাদাখ) ৪) জি এস ব্রিগেডিয়ার (উধমপুর) ৫) আই জে মালহোত্রা (জম্মু)এবং জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কন্ফারেন্সের বি জি মহম্মদ (শ্রীনগর)
৩৭০ ধারার অপব্যাবহার করে জম্মু-কাশ্মীরবাসীর সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস ও জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কন্ফারেন্সের প্রবঞ্চনা
সংবিধানের ৮১ ধারা অনুযায়ী জনগণ সরাসরি ভোট দানের মাধ্যামে লোকসভার সদস্য নির্বাচন করবেন এবং এটাই দেশের সাধারণ নির্বচন প্রক্রিয়ায় দস্তুর। কিন্তু ১৯৫৪ সালে দেশের রাষ্ট্রপতি একটি নির্দেশনামা জারি করে জম্মু-কাশ্মীরের জন্যে ধারাটিকে খণ্ডন করে দিলেন!বিশেষ সাংবিধানিক আইন, ৩৭০ ধারার আড়ে, জম্মু-কাশ্মীরবাসীর কাছ থেকে সরাসরি ভোট প্রয়োগের দ্বারা লোকসভা সদস্য নির্বাচনের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিলেন তিনি। এই নির্দেশ অনুযায়ী রাজ্য বিধানসভার সদস্যদের অনুমতিক্রমে রাষ্ট্রপতি লোকসভার সদস্য মনোনীত করতে পারবেন। এই একতরফা আইনের মাধ্যমে জওহরলাল নেহেরু ও সেখ আব্দুল্লা লোকসভার সদস্য নির্বাচনে বরাবর ছড়ি ঘুরিয়ে গেছেন। পচ্ছন্দের প্রার্থী অর্থাত উঠেতে বললে উঠবে এবং বসতে বললে বসবে, এরকম প্রতিনিধিদের জম্মু-কাশ্মীর থেকে লোকসভায় পাঠিয়েছেন তাঁরা। এই রাজ্য থেকে যে কজন প্রতিনিধি সংসদে যেতেন তাঁরা সকলেই কংগ্রেস ও ন্যাশনাল কন্ফারেন্সের তাঁবেদার হয়েই কাজ করতেন। এর ফলে রাজ্যটির চিরস্থায়ী সমস্যা সমাধানের দিকে কেউই নজর দেয়নি। গড্ডালিকাপ্রবাহে গা ভাষিয়ে জম্মু-কাশ্মীর সমস্যাকে আরও জটিলতর করেছেন। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া,পচ্ছন্দ- অপচ্ছন্দ কখনও গুরুত্ত্ব পায়নি।
১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতির জারি করা একতরফা নির্দেশনামা ১৯৬১ সালে প্রথম চ্যালেঞ্জের মুখমুখি হয়।
রাষ্ট্রপতির ১৯৫৪ সালের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন পুরনলাল লক্ষণপাল নালে এক ব্যক্তি। ১৯৬১ সালে বহু চর্চিত মামলাটি জাতীয় রাজনীতিতে উত্তাল পরিস্থিত তৈরি করেছিল। সর্বোচ্চ আদালতে আবেদনকারী দাবি করেন, ৩৭০ নম্বর ধারায় এরকম কোনও সাংবিধানিক রক্ষাকবজ নেই যে সরাসরি ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়ার বদলে জম্মু-কাশ্মীরে পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি লাগু করা যায়। সংবিধানের ৮১ নম্বর ধারায় সংশোধনীর মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীরের লাকসভা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও হঠকারী সিদ্ধান্ত।
সমগ্র দেশবাসীকে হতাশ করে সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রপতির নির্দেশনামা বহাল রাখে এবং আবেদন খারিজ করে দেয় সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়।
সুপ্রিম কোর্ট পুরনলাল লক্ষণপালের আবেদন খারিজ করে দেয়। ফলসরূপ দীর্ঘদিন যাবত জম্মু-কাশ্মীরবাসী প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত থেকেছেন।স্বাধীন হওয়ার পর দেশ যে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক পথচলা শুরু করেছিল তা জম্মু-কাশ্মীরে হোঁচট খায়।রাষ্ট্রপতিকে দেশের সর্বশক্তিমান হিসেবে তুলে ধরে সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে জানিয়ে দেয়, রাষ্ট্রপতি তিনি তাঁর ক্ষমতাবলে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার উপরে উঠে নির্নয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি তিনি তাঁর বিশেষ ক্ষমতাবলে সংবিধানের ৮১ নম্বর ধারার পরিবর্তনও করতে পারেন।
জম্মু-কাশ্মীরের নির্বাচন ব্যবস্থাপনায়, লোকসভা ও রাজ্যসভা নির্বাচনের মধ্যে কার্যত কোনও ভেদ থাকে না। জম্মু-কাশ্মীরের সাধারণ নাগরিক দেশের গণতান্ত্রিক ভোট প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এই পরিস্থিতি তৈরির জন্য জওহরলাল নেহেরুর সম্পূর্ণ সমর্থন ও সপযোগিতা ছিল। যাঁর হাতে নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত থাকার কথা তাঁর হাতেই দেশের গণতন্ত্রের হত্যা হয়ে গেল।দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশবাসীর প্রতি যে দায়িত্ব ও কর্তব্য দেখানোর প্রয়োজন ছিল তা না করে তিনি কেবলই জনপ্রিয় ভোট রজনীতি করে গেছেন।