পয়লা বৈশাখ একটা ঝকঝকে দিন। এদিন রোদ ওঠে ঝলমলে, বাইরে প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়া হাওয়া, পাখিরাও যেন বেশি মিষ্টি সুরে ডাকছে! ভোর ভোর ঘুম ভাঙিয়ে দিতে চাইছে আপনার! চৈত্র সংক্রান্তির পরের দিন, মানে গাজন সন্ন্যাসীদের আত্মপীড়নের পরের সকালে আপনি হঠাৎই অনুভব করছেন— বিষাদজনিত দুনিয়ার ক্লান্তি ভ্যানিশ করে গেছে! যেন ঘুমিয়ে ছিলেন দুঃস্বপ্নে আর জেগে উঠলেন ‘স্বপ্নের দুনিয়ায়’! আপনি জানেন, যে আপনি বুড়ো আংলা নন, রাখাল ছেলে না, কিংবা গুপি-বাঘার মতো ভূতের রাজার বরও জোটেনি কপালে। তবুও, আপনার চোখমুখ হয়ে উঠেছে ‘দেখো রে, নয়ন মেলে, জগতেরই বাহার’ গানটার মতো পবিত্র সুন্দর! অর্থাৎ যা যা সারা বছর ঘটে না, সেই কাণ্ডের দিকে তলে তলে এগোচ্ছে অন্তর—নিজেকে বাঙালি ভাবতে আরাম বোধ হচ্ছে! মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ শুনি। ওই যে, ওই গানটা—‘জগৎ-এ আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ আর অবশ্য অবশ্যই ‘এসো হে বৈশাখ’।
বাস্তববাদীরা বলবেন ঘটনা মুন্নাভাই টাইপ, কেমিকেল লোচা। তাই সই। হয়তো ভাবের ঘরে চুরি! ক্ষতি কী? মাত্র তো দু’দিন। ইংরেজি বছর হয় ৩৬৫ দিনে। বাংলা বছরের দিনের সংখ্যা সেখানে কমতে কমতে ঠেকেছে দুটো দিনে এসে। দুটোই বৈশাখী ডে আউট, ১লা আর ২৫-এ। বাকি ৩৬৩ দিন ঝোলে নির্জন ঠাকুরঘরের দেওয়ালে, বাংলা ক্যালেন্ডার হয়ে। কিংবা ফুল পঞ্জিকায়। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত, বেণীমাধব শীল। বিয়ে, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, শ্রাদ্ধশান্তিতে খোঁজ পড়ে, নচেৎ…! অতএব পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির সবেধন নীলমণি একজোড়া বাংলা দিনের প্রথমটিতে পৈতৃক আবেগ নিয়ে সামান্য বাড়াবাড়ি করব না আমরা? করাই উচিত। আহা, দোকানে দোকানে আজ সাবেকি হালখাতার পার্বণী আহ্লাদ।
পুজো হবে। সিদ্ধিদাতা গণেশ আর মা লক্ষ্মীর। বাঙালি ছোট্টবেলা থেকে লক্ষ করেছে, বাইরে যে যত ‘নাস্তিক’, ভিতরে তত ‘আস্তিক’। ফলে বড় বস্ত্রালয় থেকে শুরু করে টেবিল পাতা পুঁচকে লটারির দোকানে গণেশ আর লক্ষ্মীর অভয়মুদ্রা বিরাজ করছেই। লঙ্কা আর লেবু ঝুলছে বিপনীসম্মুখে—নজর না লগ যায়ে। দোকানি দোকান খুলে আগেভাগে পুজো দেন। ঠাকুরের গলা থেকে পুরোনো মালা খুলে নতুন পরান। ধূপ জ্বালেন, তারপর জল-বাতাসা। সাইকেল যার বাহন, সেই পুরুত মশাই সারা বছর মুহূর্তের মন্ত্র উচ্চারণে পুজো সেরেই ধা! কিন্তু আজ ওভাবে না, পুজো হবে ঘটা করে। মেলানো হবে নগদ-বাকির ভারসাম্য শিট। পুরোনো ময়লা খাতা বন্ধ করে খোলা হবে নতুন লাল আশীর্বাদী খাতা। ঠাকুর মশাই প্রথম পাতায় স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে পবিত্র করবেন, তবে সফল হবে আগামী এক বছরের বাণিজ্যউজান। এবং এদিন সকালে দোকানে ব্যবসা হবে না। কারণ পুজো শুরু হয়ে গেছে। গণেশ আর লক্ষ্মীর সামনে জ্বলছে ধূপ, থরে থরে ফলপ্রসাদের থালি, সমবেত ব্যবসায়ী পরিবার। পবিত্র মন্ত্র আর ঘণ্টার ধ্বনির পাশে নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত দোকানদার। পাশে ঘরণী। দোকানি ততোখানি না যতখানি তাঁর স্ত্রী স্বামীটির ও সন্তান সন্ততির মঙ্গলকামনায় করজোড়ে ঈশ্বরের সামনে। ছোট দোকানের পুজোও ছোট, মানে ‘গরিব’। বড় দোকানের ব্যাপার কিন্তু আলাদা। সফল স্বর্ণ ব্যবসায়ীর আড়ম্বর দেখার মতো। আয়োজন এলাহি। ফল আর মিষ্টির থালায় ঠাকুরের আসনের সামনেটা একেবারে উপচে পড়ছে। বাজারের দামি ধূপ গন্ধ সুন্দরী করে তুলছে বাতাসকে। অধিকাংশ পুরোহিতই এখানে বেশি সময় দেন। দক্ষিণাও যে বেশি। তবে এটুকুতেই শেষ হচ্ছে না বাংলা বছরের প্রথম দিনের আচার, বিচার, সংস্কার। কারণ সকাল থেকে গঙ্গাস্নান শুরু হয়ে গেছে যে। পাপ ধোয়া স্রোতস্বিনী মা গঙ্গার ইষৎ মাটি রঙের জলে ডুব দিলে—আহ, মুক্তি!
কালীঘাটে আর দক্ষিণেশ্বরে বেজায় ভিড়। আজ যাঁরা গঙ্গাস্নানে এসেছেন তাঁরা সকলেই যে ব্যবসায়ী তা না। আসলে এও পরম্পরা—বছরের প্রথম দিন গঙ্গায় ডুব দিলে হয় আত্মশুদ্ধি। এবং সূর্যস্তব, প্রণাম। তারপর পুজো দেওয়া মায়ের পদপাদ্মে। লাইন পড়ে যায় দক্ষিণেশ্বরে। যারা যেতে পারি না, আমরা টিভিতে দেখি মন্দিরে মন্দিরে পয়লা দিনের জনতার ঢল। অন্যের স্নান দেখে নিজের স্নান। কিন্তু আজ যা বাঙালিমাত্র মানেই, মানবেই, মেনে আনন্দ পাবে শিশুর মতো। তা হল নতুন কাপড় পরা। সাধারণত ছেলেরা পাজামা-পাঞ্জাবি, মেয়েরা শাড়ি, বড়রা ফতুয়া। এদিন দুপুরে বাঙালি বাড়িতে, ফ্ল্যাটে গেলে নজরে পড়বেই মাঝবয়সি গৃহকর্তা স্নান সেরে ধবধবে নতুন লুঙ্গি/পাজামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে পাত পেড়ে খেতে বসেছেন। এক্ষেত্রে দু’বাংলার রেওয়াজ এক।
গঙ্গাপাড়ের অধিকাংশ হিন্দু বাঙালি আর পদ্মাপাড়ের অধিকাংশ মুসলমান বাঙালির রেওয়াজের বঙ্গীয়সঙ্গম যে এই পয়লা, মতান্তরে পহেলা বৈশাখ। যেহেতু বাংলা বছরের পত্তনের পেছনে জাত ধর্ম ছিল না, জীবনধর্ম ছিল বড়। আসলে কৃষিকাজ। শোনা যায়, সেই সেকালে জিনিসটা ছিল ঋতুভিত্তিক। মাঠ থেকে ফসল তোলার সময়টাই তো আসল। ইতিহাস বলছে, খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা আনতে সম্রাট আকবর বাংলা বছরের প্রবর্তন করেন। যাক গে, আসল কথা, হালখাতা মূলত হিন্দু বাঙালির হলেও পয়লা বৈশাখ সকলের। ওই যে বলছিলাম, সকল ধর্মাচারই শেষতক লোকাচার। সে কারণেই বছরের প্রথম দিনের সঙ্গে খাওয়া দাওয়ার সম্পর্কটি সবচেয়ে স্পেশাল।
এদিন ভালোমন্দ রান্না হবেই। তবে চিকেন, মাটন পাবেন না সব বাড়িতে। গাঁ গঞ্জের অনেক ঘরে আজ পান্তাভাত আর ইলিশ মাছের রেওয়াজ। আবার পবিত্র দিনে সাত্ত্বিক নিরামিষ ভোজ রাধা হচ্ছে বহু ঘরে। হয়ত পাড়ার এক রান্নাঘরের খিচুড়ির গন্ধ সম্মোহিত করছে লাগোয়া অলিগলিকে। আর মিষ্টি। যখন বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা ‘হু’ বলছে ভারতে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে, তখনও প্রতি এলাকার নাম করা মিষ্টির দোকানে কাক-ভোর থেকে লাইন পড়ে গেছে পয়লায়। সকাল দশটার পর মিষ্টি আনতে গেলে দেখবেন— রসময় শোকেসে গোটা কয় নিখুতি আর ডুমো মাছি মিটিং। এমনকী ছোট ময়রার দোকানেও বেলা বারোটার পর গেলে খালি হাতে ফিরতে হবে বাঙালিকে। অতএব, বুদ্ধিমানে বিষুব সংক্রান্তির দিনেই স্টোর করে পয়লা বৈশাখী মিষ্টি। তাছাড়া বাড়ির ঠাকুরের আসনে ঘরোয়া পুজোও যে আছে। সেই নিমিত্ত ফুল-ফল আগের সন্ধ্যাতে কিনে ফেলাই ঠিক। কারণ বছরের প্রথম দিনের সকালে বাজারে আমের পল্লব বিক্রি হয় ভরিতে, সোনার দামে! তবে কেবলই খাওয়া দাওয়া আর পুজো পার্বণে আটকে থাকত না সাবেকি পয়লা বৈশাখ। ছিল গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা কত।
হত নৌকোবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তি। অবশ্য এসবের সঙ্গে আজকের শহর ও শহরতলির বাঙালির সম্পর্ক নেই মোটে।
হয়তো সম্পর্ক আছে এক মায়াময় সন্ধেবেলার। যে সন্ধ্যায় বাবা মায়ের হাত ধরে সন্তানেরা বের হয় হালখাতায়। ওই যে ওই, স্থানীয় স্টেশন রোডে বড় সোনার দোকানের সামনে ছোট প্যান্ডেল। প্লাস্টিকের চেয়ার। বৈশাখী গরম তাই দু’দুটো স্ট্যান্ড ফ্যান ঘুরছে কাল বৈশাখী গতিতে। দোকানে প্রবেশ মাত্র ক্রেতা-বিক্রেতার বিনম্র নমস্কার বিনিময়। ক্রেতা নগদ মূল্য তুলে দিচ্ছেন বিক্রেতার হাতে। নতুন খাতায় সেই হিসেব যত্ন করে লিপিবদ্ধ হচ্ছে। তারপর বড় ছোট সকলের হাতে প্রধান দোকানির সহকারীরা তুলে দিচ্ছে ঠান্ডা পানীয়। তারপর মিষ্টির প্যাকেট, তারপর ক্যালেন্ডার। ছোটরা বাড়িতে ফিরে গুনবে আনন্দ—কটা ক্যালেন্ডার, কটা মিষ্টির প্যাকেট এবার। এসবই মন ভরে ওঠা কথা। ভালো লাগা। কিন্তু দুঃখ কি নেই?
আছে। বহু সোনার দোকানেই আছে বন্ধকি কারবার। গরিব বাবাটি যে দোকানে বাধ্য হয়ে বাঁধা দেয় আংটিটা, কানের দুলটা। সেই পয়সায় হয়তো সন্তানের কঠিন রোগের চিকিৎসা হয়েছে। হয়তো দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কারাখানার চাকরিটি গেছে স্বামীর। আর অসহায় স্ত্রী সংসার বাঁচাতে মঙ্গলসূত্রটি পর্যন্ত…। কবে ওই গয়না ফেরত আসবে কেউ জানে না! আদৌ আসবে কিনা! অভিজ্ঞ স্বর্ণ ব্যবসায়ী ক্রেতার মুখ দেখলেই বোঝেন, এরা উপায়হীন, চোখে অভাবের শূন্যদৃষ্টি! মাথার উপর শকুন উড়ছে! তবু পয়লা বৈশাখের দিন যে কিছু দিতে হয় দোকানে। বন্ধকি ক্রেতা লজ্জায় মরে গিয়েও যান হালখাতা করতে। যেতে হয় তাঁকে। ফের প্রয়োজন হতে পারে পোড়া কপালের দোষে! অতএব যাওয়া। হয়ত সেই রোগা বাবার আঙুল ধরে সঙ্গ নিয়েছে অবোধ শিশুপুত্র। শিশুর গায়ে চৈত্রসেল থেকে কেনা সস্তার জামা। গরিব বাবা মিথ্যে হেসে শ’খানেক কি শ’দুয়েক টাকা দোকানির হতে তুলে দেন মাথা নিচু করে নিজেক লুকিয়ে। তবে সব ব্যবসায়ীই যে সেন্ট পারসেন্ট মুনাফাখোর হবেন তা-ই বাঁ কোথায় লেখা আছে। অতএব, স্বর্ণ দোকানের মালিকটি সংবেদনশীল হলে বোঝেন, সামনের মানুষটা মানুষ না, হাত পা-ওলা বেদনা। দ্রুত টাকা নিয়ে হিসেব লিখে মিষ্টির প্যাকেট আর ক্যালেন্ডার এগিয়ে দেন তিনি। সহকারীকে বলেন, কোল্ডড্রিঙ্ক দিয়েছিস? গরিব বাবা হয়তো বল্লেন, তাড়া আছে দাদা। থাক কোল্ডড্রিঙ্ক। কারণ তিনি যে তাঁর অক্ষমতা থেকে নিষ্কৃতি চান, পালাতে পারলে বাঁচেন। কিন্তু শিশুপুত্রটি শোনে না। সে মিষ্টি হেসে বলে, আমি কোল্ডড্রিঙ্ক খাব বাবা। কোল্ডড্রিঙ্ক আসে পুঁচকের হাতে। বাবা আর না করতে পারেন না। পাশে বসে ছেলের ঠান্ডা পানীয় পানের তৃপ্তির দিকে তাকিয়ে থাকেন। পেছনে তখন স্ট্যান্ড ফ্যানের সেই ঝড়, সেই কালবৈশাখী।
যে দানব হাওয়ায় গরিব বাবার বুকের ভেতরে ভেঙে পড়ছে বড় বড় গাছ, তার ডালপালা, পুরনো ছায়া। শুধু ঝড় না, সঙ্গে হয়তো বৃষ্টিও। শিশু সন্তানের আনন্দের সামনে সেই বৃষ্টি না লোকালেই নয়। সন্তানকে আড়াল করে রুমাল দিয়ে চোখ থেকে বৃষ্টি মোছেন বাবা।
তার মানে ১লা বৈশাখ কেবল ঝকঝকে দিন না, হতভাগ্যের বৃষ্টি ভেজা বেদনার দিন।