ব্রিটিশরা যখন পরাধীন ভারতে ফুটবল নিয়ে আসে, তখন এই খেলাটিকে সবার আগে রপ্ত করে নিয়ে আঁকড়ে ধরে বাঙালিরা। ব্রিটিশ শাসকদের চিন্তায় ছিল, ফুটবল নামক নেশায় বাঙালিদের বুঁদ করে রেখে স্বাধীনতার আন্দোলনকে স্তিমিত করে রাখা। কিন্তু তাদের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।
এই খেলাটিকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে যায় বাঙালির আবেগ, বাঙালির উচ্ছ্বাস, বাঙালির ভালবাসা। বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে ফুটবল। বাঙালির মানসিকতায় দারুণ প্রভাব ফেলে সহজ, রোমাঞ্চকর এই খেলাটি। বাঙালির কারণেই সেই ব্রিটিশ আমলে উপমহাদেশের ‘ফুটবলের রাজধানী’ হিসেবে বিবেচিত হত কলকাতা। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বাঙালির কাছে ফুটবল হয়ে ওঠে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান অস্ত্র। পরাধীন দেশে প্রতি পদে পদে অপমানে গুমরে মরছিল বাঙালি। এই রকম একটা সময়ে খেলার মাঠে ব্রিটিশদের সঙ্গে সমানতালে লড়াই দেবার একটা সুযোগ এসে যায় তাদের সামনে। মাঠের ফুটবলে ব্রিটিশদের যখন দেশীয় ফুটবলাররা নাজেহাল করে দিতেন, তা দেখে খুব আনন্দ পেত তারা। আর স্বজাতির দল জিতলে সেদিন সেলিব্রেট করত কলকাতা। কিছুক্ষণের জন্য হলেও পাওয়া যেত পরাধীনতার গ্লানি থেকে ‘মুক্তি’–র আনন্দ। ফুটবল খেলাকে বাঙালি যত গভীরভাবে ভালোবেসেছে আর তার জন্য যতটা আত্মত্যাগ করেছে, তা তুলনাহীন। এই উপমহাদেশে ফুটবল খেলাকে জনপ্রিয় করে তুলতে বাঙালির ভূমিকা অবিসংবাদিতভাবে স্বীকৃত। একথা আজ সর্বজনবিদিত যে ফুটবল খেলার সঙ্গে বাঙালির রয়েছে গভীর নাড়ীর টান। এই খেলাটি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে তাদের মনে-প্রাণে।
কলকাতার ফুটবলের তিন প্রধান দল মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল আর মহামেডান স্পোর্টিং। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এই তিন দলকে ঘিরেই বাঙালির ফুটবলের বাড়বাড়ন্ত। বিশেষ করে, মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলকে উপলক্ষ করে বাঙাল-ঘটি, ইলিশ-চিংড়ির দ্বন্দ্ব কলকাতার সামাজিক জীবনে দারুণভাবে প্রভাব ফেলে। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর প্রতিফলন দেখা যায়। মূলত কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দাদের কাছে মোহনবাগান এবং পূর্ব বাংলার বাঙালি, যাঁরা কলকাতায় থিতু হয়েছিলেন, তাঁদের হৃদয়ে ইস্টবেঙ্গল স্থায়ী আসন করে নেয়। বহু সামাজিক পরিবর্তন সত্ত্বেও সেই ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা কিন্তু পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি আজও। পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম নির্দশন ফুটবল, তখন থেকে আজও। ফুটবল আজও বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। সময়ের হাত ধরে বদলে গেছে শতাব্দী, রাষ্ট্রের সীমানা, সামাজিক জীবন। শুধু বদয়ালনি বাঙালির ফুটবলপ্রেম।
বাঙালির এই ফুটবলদর্শন থেকেই কলকাতায় জন্ম হয় বারপুজোর। ফুটবলে সাফল্য লাভের প্রত্যাশায় পয়লা বৈশাখ এই পুজো উদযাপন করে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল এবং তাদের মতো আরও অসংখ্য ক্লাব। এই পূজার মূল থিম ছিল যে, প্রথম দিনটি যদি ভালো কাটে তাহলে সারা বছরই ভালো যাবে। যদিও কলকাতার ফুটবলে আগের সেই জৌলুস এখন আর নেই, তবু ফুটবল মাঠে সাফল্যের প্রত্যাশায় বারপুজোয় জমজমাট হয়ে ওঠে ক্লাব প্রাঙ্গণগুলি। পয়লা বৈশাখে ফুটবল বাঙালির সঙ্গে ছিল, আছে, থাকবে। ভ্রমণপিপাসা, রসনাতৃপ্তির মতোই এখনও ফুটবল পাগলামি বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাই আজও সবুজ গালিচার উপর বাইশ জোড়া পায়ের একটি বলকে নিয়ে “খেলা” বাংলার জীবনে হিল্লোল জাগায়।
বাঙালির ফুটবল প্রেম বিশ্বজনীন। ফুটবল বাঙালির প্যাশন। তাই ময়দানি সংস্কৃতির বাইরেও জায়গা করে নিয়েছে ফুটবল। বাঙালির গল্প, সাহিত্য, গান, নাটকেও জায়গা করে নিয়েছে ফুটবল, বাদ পড়েনি সেলুলয়েডও। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি এলেই যা আরও বেশি করে ভাবায়, বারপুজোর আঙ্গিকে। বঙ্গ জীবনের এই ফুটবল দর্শন থেকেই একদিন জন্ম হয়েছিল বারপুজোর। যার জৌলুস কোনও অংশে কম ছিল না দুর্গাপুজোর চেয়ে। শারদীয়া উৎসবের মতই বারপুজো কেন্দ্রিক ফুটবল উৎসবও ছিল বাঙালির এক প্রধান মিলনমেলা। বারপুজোকে ঘিরে ময়দানের ক্লাবগুলিতে ছিল সাজো সাজো রব। বিশেষ করে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের বর্ণময় বারপুজো বাঙালির ফুটবল দর্শনকে আলাদা করে চিহ্নিত করেছিল।
অন্যান্য পুজোর মতোই বারপুজোও সংস্কারাচ্ছন্ন এক বিশ্বাস। সাবেকিয়ানা ছেড়ে বাঙালি যতই আধুনিক হোক, পয়লা বৈশাখের কিছু মিথ এখনও বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত পয়লা বৈশাখের পর শুরু হতো ময়দানের ফুটবল মরশুম। তার আগে হয়ে যেত দলবদলের পর্ব। তাই বাঙলা বছরের প্রথম দিনে সকলকে সাক্ষী রেখে পুজা অর্চনার মধ্য দিয়ে ধুমধাম করে পালিত হয় বারপুজো। কালীঘাট থেকে পুরোহিত এসে রীতিমত করতেন সেই বারপুজো। বারের চারপাশে থাকতো কিছু অতন্দ্র প্রহরী। যারা পুজো শেষ না হাওয়া পর্যন্ত বারটিকে পাহারা দিতেন। পাছে কেউ বার ডিঙিয়ে না যায়! আসলে বার ডিঙোলে নাকি ক্লাবের পক্ষে তা অমঙ্গল! গোটা গ্যালারি ভরে যেত বারপুজো দেখতে।
তখন পুজোর দিনে ফুটবলারদের লাইন পড়ে যেত ক্লাব তাঁবুতে। বারপুজোর দিন মোহনবাগানের স্বনামধন্য কর্মকর্তা ধীরেন দে সকাল সকাল দুধ সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে চলে আসতেন ক্লাবে। সঙ্গে নিয়ে আসতেন এক থলি রুপোর কয়েন। যা নেওয়ার জন্য ফুটবলারদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যেত। খুব রাশভারী, রুচিশীল ও খুঁতখুঁতে মানুষ ছিলেন ধীরেন দে। রুপোর কয়েন পাওয়ার জন্য নূন্যতম যোগ্যতামান বেঁধে দিতেন তিনি। ভাল ফুটবল খেলা নয়, কয়েন পাওয়ার জন্য ফুটবলারদের সুদর্শন হওয়াটা ছিল বেশি জরুরি। তবে এমনটা তিনি করতেন মজা করে। পরে অবশ্য সবাইকেই কয়েন দিতেন। এই একদিন তিনিও রাশভারী ইমেজটা মাঠের বাইরে রেখে আসতেন।
আজও বারপুজো হয়। কর্পোরেট ছোঁয়ায় ষোলো আনা বাঙালিয়ানা থেকে বেরিয়ে এসে বারপুজো এখন অনেকটাই ‘বাংলিশ’। আসলে ভিনদেশি তারাদের ভিড়ে সংস্কৃতিবান বাঙালির ফুটবল সংস্কৃতি এখন অনেকটাই অস্তমিত। ঐতিহ্য আছে, কিন্তু নেই সেই জৌলুস। একটা সময় মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের দল গঠন হতো একঝাঁক বাঙালি ফুটবলার নিয়ে। সে দিন আজ আর নেই। ফুটবলটা এখন আর কাদা মাঠে নয়, স্মার্ট ফোনেই সীমাবদ্ধ। শুধু তাই নয়, ফেডারেশনের দৌলতে যে ক্রীড়াসূচি শেষ কয়েক দশকে তৈরি হচ্ছে, তা বৈশাখের প্রথম দিনটিতে ঘরছাড়া করে রাখে মোহন-ইস্টকে। আর ঘরে থাকলেও ঘরের ছেলেদের অপ্রতুলতায় বারপুজোর আবেগ আর ছুঁয়ে যায় না অবাঙালি ফুটবলারদের।
পয়লা বৈশাখের সকালে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের ক্লাব তাঁবু প্রতিবারের মতোই সাজানো গোছানো থাকে আজও। সমর্থকদের ভিড় প্রিয় ক্লাবে। দুই প্রধানেই বৈঠকী মেজাজ থাকে এদিন। মন্ত্র উচ্চারণ করেন পুরোহিতরা। নতুন মরসুমের অধিনায়ক রীতিনীতি মেনে সংকল্প করেন। কেমন যেন একটা পুজো পুজো ভাব। পুজোপার্বণের দিন যেমন লাগে। বাংলা নববর্ষের দিন ইস্ট-মোহনে পুজো পুজো গন্ধ পাওয়া যায়, এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার, আজও। তবে সর্বভারতীয় স্তরে ইদানীংকালে দুই প্রধানের ব্যর্থতা এই চেনা ছন্দ আর চেনা গন্ধের মধ্যে এনে দেয় অস্বাভাবিকতা, এটাও সত্যি। মহমেডানের অবস্থা তো আরও খারাপ। তবু সমর্থকদের কাছে বারপুজোর ছবিটার কোনও পরিবর্তন হয়নি। হয়ত হবেও না কোনওদিন। নেই নেই-এর স্বর্গরাজ্য! তবু কিসের টানে ওঁরা সব ছুটে আসেন ক্লাবে? সাফল্য নেই, তবুও। ক্লাবের প্রতি কী অপরিসীম ভালবাসা তাদের! সমর্থকদের ভালবাসার কি মূল্য দেন প্লেয়াররা? কর্তারা? মনে তো হয় না। এখন তো মরসুম শুরু হওয়ার আগেই চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় বছরের শেষে কি হবে। বারপুজোর ফল আর পাওয়া যায় না। পিছোতেই থাকি আমরা।
আগে পয়লা বৈশাখ দিয়ে মরশুমের শুরু হতো। ফলে ক্লাবে সই করা নতুন সব ফুটবলারই ওদিন মাঠে হাজির থাকতেন, অধিনায়ক সহ। এরপরেই কলকাতা লিগের টুর্নামেন্ট শুরু হত। ১৯৭৯-তে জেভিয়ার পায়াস মোহনবাগানে আর ১৯৮০-তে মজিদ বাসকর ইস্টবেঙ্গলে সই করেছিলেন। ওদের দেখার জন্য ঐ দুই বছর পয়লা বৈশাখের দিন মাঠ ভেঙে পড়েছিল। আর এখন তো মরশুমের শেষে বারপুজো হয়। ফলে অধিকাংশ খেলোয়াড়কেই এই দিনে পাওয়া যায় না। বারপুজো মানে শুধুই ক্লাবের মঙ্গলকামনা নয়, সমাজেরও। বারপুজোর দিন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনায় শামিল হন ভিন ধর্মের খেলোয়াড়রাও। শুধু ক্লাবের জন্য শুভকামনা নয়, সবার জন্যই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয় এদিন। ফুটবলই আজও পারে সমাজে সর্বধর্ম সমন্বয়ের একটা বার্তা দিতে।