সমকালীন সময়ে জ্ঞান ও শ্রমভিত্তিক অর্থনীতির কারিগর হল দক্ষ মানবসম্পদ। উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক অপরিহার্য উপাদান। সেই মানবসম্পদ তৈরির ভিত্তিভূমি উন্নত ও প্রগতিশীল শিক্ষাব্যবস্থা। কোন দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় অবক্ষয় দেখা দিলে মানবসম্পদ বিপন্ন হয়, সমাজব্যবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। ফলে আর্থ-সামাজিক বিকাশ ব্যাহত হয়। সে এক সময় ছিল যখন রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, অরবিন্দ তথা শরৎচন্দ্রের মত নক্ষত্রদের লেখনী দেশে বিদেশে শিক্ষা ও সংস্কৃতির আঙিনায় সম্ভ্রমের সঙ্গে বিরাজ করত। আমরা আজও সেই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দীপ্তিমান স্মৃতি চিহ্নের গর্বিত উত্তরসূরী। পরিতাপের বিষয় বাংলায় এই সময়ে শিক্ষা ও সংস্কৃতি কলুষিত, অপকৃষ্টির আগ্রাসনে ক্লিষ্ট। দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও প্রগতিশীল শিক্ষাব্যবস্থার অনুপস্থিত। এ রাজ্যের শিক্ষাপ্রাঙ্গণগুলো দলীয় রাজনীতির সুতিকাঘরে রুপান্তরিত হয়েছে। দুর্নীতি আর অনিয়মের কশাঘাতে জর্জরিত সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা। চারিপাশে তাকালেই দেখা যায় দলীয় পরিচিতি, নেতাদের লেজুড়বৃত্তি এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে শিক্ষক, অধ্যাপক, অধ্যক্ষ মায় কি উপাচার্য নিয়োগ হয়ে চলেছে। সেকারণে যোগ্য, দক্ষ ও দায়িত্বশীল শিক্ষক আজ বিরল। সুবিচার থেকে প্রতারিত হচ্ছে যোগ্য মেধাবী অথচ আর্থিকভাবে দুর্বল চাকুরিপ্রার্থীরা। হতাশার তিমিরে চিরতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের ভবিষ্যতের সম্ভবনা। সুদীর্ঘ সময়ের মানসিক পরিশ্রম ও আর্থিক দায়ভার রাজনীতির যাঁতাকলে পড়ে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে সুশিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বৃহত্তর ছাত্রসমাজ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সার্বিক শিক্ষাব্যাবস্থা। ফলস্বরুপ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার দোলাচালে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ বেকারত্বের সমস্যা। যার স্বাভাবিক উপসর্গ সামাজিক অবক্ষয়। নির্বাচনের আগে কথা ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দলীয় রাজনীতিকে নির্বাসিত করে বাস্তবমুখী প্রগতিশীল শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার। কথা ছিল অর্থের পরিবর্তে মেধার ভিত্তিতে যোগ্যতা নিরূপণ করার। কথা ছিল যুবসমাজকে ভবিষ্যতের দিশার সন্ধান দেওয়া। স্বভাবতই যুবসমাজ আশা করেছিল দেশের অন্যান্য প্রান্তের মত তারাও সুশিক্ষার আলোকে আলোকিত হবে। নির্বাচনের পরে সেসব প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাস রাজনীতির অন্ধগলিতে পথ হারিয়েছে। এটাই হয়ত রাজনীতির ধারাপাতে স্বাভাবিক নিয়ম! কিন্তু যুবসমাজ ভ্রান্ত আশ্বাসে আস্থা রেখেছিল, তাই আজ তারা হতাশার কৃষ্ণ গহ্বরে আবর্তিত হয়ে চলেছে। আক্ষেপের বিষয় এ রাজ্যে মদ বিক্রির জন্য সরকারের তরফে যে তৎপরতা দেখা যায়, শিক্ষার বিকাশের জন্য ততটা আন্তরিকতা চোখে পড়ে না। সেজন্য এখানে ইতিবাচক মূল্যবোধের শিক্ষা চালু করা হয়নি। পাঠ্যসূচীর বিষয়বস্তুতে ভুরি ভুরি ইচ্ছাকৃত তথ্যবিকৃতির সমাবেশ। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব বিদ্যমান। যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকার অপ্রতুলতা। শিক্ষার নন্দিত নরকে শিহরিত শিক্ষামহল! যেহেতু শিক্ষা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, সংস্কৃতির প্রকৃতি নিরূপিত হয় শিক্ষার মাধ্যমে। স্বাভাবিক কারণেই বর্তমান সময়ে শিক্ষার সার্বিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান হয় সংস্কৃতির জগতেও। তাই সচরাচর দেখা যায় অপসংস্কৃতি আর অপকৃষ্টির লাগামহীন গতিবিধি। গ্রাম থেকে শহর, গলি থেকে রাজপথ, সর্বত্র মার্জিত চিন্তা চেতনা ও পরিশীলিত মন মানসের বিপরীত আচার-আচরণের ঘৃণিত প্রতিবিম্ব বিদ্যমান। অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে প্রানান্তকর পরিস্থিতির মুখোমুখি বাংলার সংস্কৃতি। আমরা কি ভুলে যাব মানবজাতি মানুষের আসল পরিচয়ই তার সংস্কৃতি! যা জীবজগতে অন্য জীবদের থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করে। মানুষ সভ্য হয়েছে সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে। আবার সংস্কৃতির অগ্রগতি সভ্যতার হাত ধরে। তবুও চিরকাল সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিপরীতে একটা অশুভ শক্তি ক্রিয়াশীল রয়েছে। ভারতের সংস্কৃতি নৈতিক শিক্ষার কথা বলে, জীবনবোধের কথা বলে। তবুও দীর্ঘসময় ধরে সংস্কৃতির ছত্রছায়ায় এখানে সঙ্গীত ও সাহিত্যের জগতে নৈরাজ্যের বিষবৃক্ষ রোপন করা হয়েছে। অরুচিকর অপকর্ম মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। যার ফলস্বরূপ রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তীতে মমতাসঙ্গীত শুনতে পাই। বসন্ত উৎসবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা রোদ্দুরসঙ্গীত পরিবেশন করে। রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে নবীনবরণের মঞ্চ সরগরম হয় চটুল নৃত্যের দুর্বোধ্য মুদ্রায়। এরই ধারাবাহিকতায় এখন পাগলু ড্যান্স মাতিয়ে রাখে শহীদ দিবসের মঞ্চ। রসাতলে বাংলার সংস্কৃতি, অবক্ষয়ের রাহুগ্রাসে নিমগ্ন আমাদের জীবনমানস। যুবসমাজ তথা বৃহত্তর মানবসমাজকে অপসংস্কৃতির বিভীষিকা থেকে মুক্ত করার এবং সামাজিক পরিসরে সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে জাগ্রত করার এটাই উপযুক্ত সময়। বিরাজমান অপসংস্কৃতির ছায়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মাননীয় রাজ্যপালের প্রতি কলকাতা এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অসৌজন্যতা প্রদর্শন দেশের কাছে রাজ্যবাসীর মাথা নত করে দিয়েছে। তাঁকে হেনস্থা করা হয়েছে অর্বাচীন একদল অধ্যাপক শ্রেণীর সক্রিয় সহযোগীতায়। এইসব উপাচার্য এবং অধ্যাপকদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় চাকুরিতে নিয়োগ পেয়েছেন। তাই এদের কাছে শিক্ষা নয়, সৌজন্য নয়, সংস্কৃতি নয় কেবলমাত্র দলীয় রাজনীতির কর্মসূচী বাস্তবায়িত করাই মুখ্য বিষয়। অনভিপ্রেত হলেও বাস্তব যে বর্তমান সময়ে শিক্ষিত সমাজেই প্রতিনিয়ত নানাধরনের অপরাধের হার ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এর অন্যতম কারণ প্রচলিত শিক্ষাক্রম ভারতীয় সংস্কৃতির দ্বারা সম্পৃক্ত নয়। রাজনৈতিক শঠতার কারণে ঘটে চলেছে অপসংস্কৃতির বেসাতি। তাই নীতিনির্ধারকরাও কখনো শিক্ষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন তৈরির চেষ্টা করেননি। বরং শিক্ষাকে সংস্কৃতি থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলার পথ সুগম করেছেন। এরই পরিনতিতে কথাবার্তার শালীনতা, জনপরিসরে ভদ্রতা, সুস্থ আচরণ, সর্বোপরি সহনাগরিকের প্রতি সহিষ্ণুতা ও সহমর্মিতার অভাব পলে অনুপলে অনুভূত হচ্ছে। এই অবস্থায় সাহিত্যিকরা বলে থাকেন- ‘আমি ব্যাথিত হই না মানুষের মৃত্যুতে, ব্যাথিত হই মনুষ্যত্বের মরণ দেখে‘। এই অধঃপতিত মানবতার কারণ সার্বিক শিক্ষাব্যাবস্থায় ভারতীয় সংস্কৃতিকে উপেক্ষিত করে রাখা। আমরা ছিন্ন বস্ত্র কিংবা জীর্ণ আসবাবপত্রের জন্য লজ্জাবোধ করি, কিন্তু পঙ্গু দর্শণচিন্তা আর বিকৃত রুচিবোধের জন্য কখনো সংকোচ করি না। অভিজ্ঞতার আধারে দেখতে পাই সংস্কৃতিহীন শিক্ষার পরিনাম কি বিষময় হতে পারে। শিক্ষা নামক সুদৃশ্য পর্দার অন্তরালে জমে উঠছে ডিগ্রিধারী আত্মকেন্দ্রিকতায় আত্মমগ্ন, অসংবেদনশীল মানুষের স্তূপ। পাশাপাশি বেড়ে চলেছে অসহিষ্ণু, উদ্ধত, দাম্ভিক মানুষের অসামাজিক কর্মকান্ড। এরা মানুষের জন্য আপদ, সমাজের জন্য হুমকি এবং দেশের জন্য ভাইরাস। আমরা কি ভাবতে পারি না, সমুন্নত শিক্ষার আলোকে শিক্ষার্থীদের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলো জাগরিত হবে, সৃজনশীল ভাবনায় প্রাণিত হবে। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে সহিষ্ণু, রুচিশীল সুনাগরিক তৈরি হবে। জনগণ কিন্তু সেই দিনের স্বপ্ন দেখে যখন এই তমসাচ্ছন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশ কলুষমুক্ত হবে। বিলীয়মান গৌরবময় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নতুন ভোরের সোনালি রশ্মিচ্ছটায় আবার উদ্ভাষিত হয়ে উঠবে। জন্ম নেবে সভ্যতার কিশলয় মানবতার মরুভূমিতে।
নিশীথ কুমার দাশ, বিজ্ঞানী, পারমানবিক শক্তি বিভাগ