বিশ্ব পরিবেশ দিবস (World Environment Day) প্রতি বছর ৫ই জুন পালিত হয়ে আসছে ৷ কিন্তু বিশ্ব পরিবেশ দিবস – ২০২০ বিভিন্ন প্রশ্ন, বিভিন্ন আশঙ্কায় মোড়া ৷ আমরা সারা বিশ্ববাসী প্রকৃতির রোষে এখন কাটাচ্ছি ভয়াবহ করোনা আতঙ্কে ৷ এর ভেতরে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’য়ের মতো বিধ্বংসী তুফান “আম্ফান” আমাদের রাজ্যের মূলতঃ তিন জেলাকে তছনছ করে দিয়ে গেল ৷ প্রকৃতি তথা পরিবেশকে অস্বীকার তথা অবহেলার চরম মূল্য দিতে হচ্ছে সমগ্র মানব জাতিকে, মানবসভ্যতা আজ ভয়ঙ্কর সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ৷
আমাদের ভুললে চলবে না যে, ছোট্ট একটা পতঙ্গ দ্বারা পরাগ সংযোগ হয় এবং পৃথিবীতে জীবনপ্রবাহ অব্যাহত থাকে ৷ এ সবই প্রকৃতির অবদান ৷ প্রকৃতি-পরিবেশের অন্যতম বিষয় হ’ল জীববৈচিত্র্য ৷ জীবজগতের বিভিন্নতা মিলিয়েই জীববৈচিত্র্য – মানুষ আর নামানুষের সমষ্টি ৷ জীবজগতের এই বৈচিত্র্যের কারণ – তাদের দেহে উপস্থিত নানা জিন এবং তাদের বাসস্থানের অর্থাৎ বাস্তুতন্ত্রের রকমফের ৷ জিনগতভাবে বৈচিত্র্যের ফলে সৃষ্টি হয় নতুন নতুন প্রজাতি, যারা বাস্তুতান্ত্রিক বিভিন্নতার প্রভাবে জীবজগতকে বৈচিত্র্যময় করে তোলে ৷ মানুষও এই জীববৈচিত্র্যেরই অংশ ৷ সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমিয়ে পড়া পর্যন্ত কিংবা জন্ম থেকে মৃত্যু – সবক্ষেত্রেই আমরা নির্ভরশীল জীববৈচিত্র্যের উপর ৷ জীববৈচিত্র্যকে কাজে লাগিয়ে নিজের জীবনকে আরো সুখী করার প্রয়াস চলতেই আছে ৷ কিন্তু আমাদের চাহিদার তো শেষ নেই, নেই লোভের সীমা-পরিসীমা ৷ অতি ব্যবহারে টান পড়েছে জৈবসম্পদের ভান্ডারে ৷ উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবনধারা ও বিবর্তনের ধারা পরিবর্তিত অথবা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে – এমন কি তাদের বেশ কিছু গেছে চিরতরে হারিয়ে ৷ জীববৈচিত্র্যের এই সংকট সামগ্রিক পরিবেশের উপর ফেলেছে কুপ্রভাব – বর্তমানে করোনা সংক্রান্ত এই প্রভাবও মানুষ পারছে না বা হয়ত পারবে না সম্পূর্ণ এড়াতে ৷ কিন্তু মনে থাকে যেন, আমাদের খাওয়া, পরা, বেঁচে থাকা অর্থাৎ জীবনের সবটাই নির্ভর করে এই জীববৈচিত্র্যের উপর ৷
প্রায় তিরিশ হাজার খাদ্য হিসেবে ব্যবহারযোগ্য উদ্ভিদের মধ্যে প্রায় আট হাজার উদ্ভিদকে মানুষ কোন না কোনভাবে খাদ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে ৷ পাশাপাশি অনেক প্রাণী থেকে প্রাণীজ খাদ্য পাওয়া যায় ৷ চা-দুধ-অ্যালকোহল প্রভৃতি পানীয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৈচিত্র্যময় জীবপ্রজাতি থেকেই পাওয়া যায় ৷
অতি মূল্যবান খনিজ জ্বালানী কয়লা ও পেট্রোলের উৎস তো সেই জীব ৷ আবার, সাদা ভ্যারেন্ডা ঘাস সেও কিন্তু জ্বালানী তেল উৎপাদনের অন্যতম উপাদান ৷ ঘর-বাড়ী, আসবাবপত্র বা অন্যান্য নির্মাণকাজে উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রয়োজন ৷ রং, রেজিন, আঠা, রবার, তেল, কাগজ, তুলো, পাট, রেশম, লাক্ষা প্রভৃতির উৎসও উদ্ভিদ বা প্রাণী ৷
আনুমানিক কুড়ি হাজার উদ্ভিদ প্রজাতি ব্যবহার করে নানা ঔষধ তৈরী হয় ৷ আবার অনেক ঔষধের মূল উপাদান প্রাণী সম্পদ ৷ প্রায় সত্তর ভাগ ঔষধ উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্পদ থেকে উৎপাদিত হয় ৷ সাপের বিষ থেকে তৈরী ওষুধ ক্যানসারের ও কিছু কঠিন অসুখ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয় ৷ লক্ষ লক্ষ মানুষকে সুস্থ করেছে কুইনাইন, পেনিসিলিন, মরফিন ইত্যাদি ভেষজ ওষুধ ৷
এমন কি, গানের যে সাতটি সরগম – সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি – তাও কিন্তু সাতটি প্রাণীর আওয়াজ অনুকরণ করেই এসেছে ৷ সুতরাং নান্দনিকতা ও বিনোদনেও জীববৈচিত্র্য আছে ৷
একটা বট গাছে বহু সংখ্যক জীব বাস করে ৷ ঐ গাছ নষ্ট হয়ে গেলে ঐ গাছের অভাবে নির্ভরশীল প্রাণী ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে যায়, বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যতা বিঘ্নিত হয় ৷ মাটি তৈরী, তার স্বাভাবিক উর্বরতা রক্ষা, পরিবেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণ, ক্ষতিকারক জীব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ, ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রতিরোধ, বিষাক্ত কার্বনের পরিমান ও বিশ্ব আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ, মরু অঞ্চল হ্রাস, জলাভূমির প্রাকৃতিক সঞ্চালন, ভূমিক্ষয় রোধ ইত্যাদি প্রাকৃতিক কর্মকান্ড জীবসম্পদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ৷
সুতরাং নিজেদের পরিবেশকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে জীববৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া উপায় নেই ৷ স্থিতিশীল উন্নয়ণের স্বার্থে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের একান্ত প্রয়োজন ৷
প্রকৃতি সংক্রান্ত এই চেতনা সঞ্চারের প্রয়োজন আমাদের, প্রয়োজন সদিচ্ছা ও সমষ্টিস্বার্থের বিষয় খেয়াল রাখার ৷ প্রকৃতিপ্রেমের পরম্পরাকে জাগরুক রাখতে হবে ৷ নদী, মাটি, আকাশ, বাতাস, পশু-পাখি, গাছ প্রভৃতিকে পূজা করার প্রাচীন পরম্পরাকে যত্ন সহকারে বাঁচিয়ে রাখতে হবে ৷ ছোট বেলায় দেখেছি – বাড়ীতে পিঠা হলে প্রথম পিঠাটা পাখিদের জন্য ঘরের চালার উপর ছিটিয়ে দেওয়া হত। প্রকৃতিপ্রেমের কি দারুণ নমুনা যা প্রাচীনকাল থেকে হয়ে আসছিল ৷ স্বার্থবোধের ধারণা প্রকৃতপক্ষে সামাজিক মূল্যবোধ ও অভ্যাস থেকে জন্মায় এবং তার দ্বারাই লালিত হয় ৷ সঙ্কীর্ণ স্বার্থ থেকে বৃহত্তর স্বার্থে উত্তরণের জন্য যথাযথ সামাজিক আদর্শ ও নীতিবোধের অনুশীলন আবশ্যক ৷ “হীরক রাজার দেশে” গল্পে যেমন আহ্বান ছিল যে “এই পৃথিবীতে বারবার চাই উদয়ণ পন্ডিতদের আবির্ভাব, এই বিশ্বে খাদ্যাভাবের থেকেও শিক্ষার অভাব” ৷ সত্যিই তাই ৷ আজ এই কঠিন বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে নাগরিকদের তাদের কর্তব্য সম্পর্কে সঠিক দিশা খুঁজে বের করতে হবে, সমাজকে পথ দেখাতে হবে ৷ কেউ কেউ আবার বলছে, দূষণের জেরে উত্তর মেরুতে বরফ প্রচন্ড গলতে শুরু করেছে ৷ বরফের নীচের বহু শতকের হিমায়িত মৃতদেহ নাকি বেরিয়ে আসছে ৷ আর এই মৃতদেহগুলো থেকে ২৬ ধরনের নতুন ভাইরাস নাকি বেরিয়ে এসে যাচ্ছে সমুদ্রের জলে ৷ সুতরাং শুধু করোনাতেই শেষ নয়, আগামীদিনে এমন আরও অনেক ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে ৷ যন্ত্রসভ্যতার অগ্রগতি, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা প্রভৃতি প্রকৃতির নিয়ম ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছে ৷ উন্নয়ণের নামে প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছে শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ ৷ প্রকৃতি অনেক সহ্য করতে করতে এখন গেছে ক্ষেপে, মানবসভ্যতা এখন প্রকৃতির রোষানলে ৷ সেক্ষেত্রে বর্তমান প্রজন্মকে প্রাচীন কালের সেই প্রকৃতি প্রেমের জ্ঞান গ্রহণে ঋদ্ধ হতে হবে, পুষ্ট করতে হবে সমাজকে ৷ গাছ লাগাতে হবে, তাকে ভালোবাসতে হবে ৷ বাস্তুতন্ত্র রক্ষা তথা স্থিতিশীল উন্নয়ণের জন্য প্রাণীদের সঙ্গেও কেবলই ধ্বংসাত্মক আচরণ করা যাবে না ৷ বায়ুকে শরীরে যথাযথভাবে গ্রহণ করতে হবে, প্রাণায়াম তো খুবই ভালো ৷ সূর্যালোকের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে, শরীরেও ভিটামিন-ডি সংশ্লেষণ হবে ৷ জলসংরক্ষণ করতে হবে, একে দূষিত হতে দেওয়া যাবে না ৷
“মধু ঋত বাতায়তে, মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবা” – মধুময় হোক বাতাস, সমুদ্র থেকে অমৃত মধু ক্ষরিত হোক – আমাদের একান্ত প্রার্থনা ৷ ভালো পরিবেশ সুন্দর মনের জন্ম দেয় ৷
সকলে সাধারণভাবে বাড়ীতে থাকুন, সুরক্ষিত ও সুস্থ থাকুন ৷ পরিবেশও সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর হোক ৷
প্রীতিরঞ্জন মাইতি (Pritiranjan Maiti) (রাজ্য জীববৈচিত্র্য পুরস্কার – ২০১৪ প্রাপ্ত)