ভালোবেসে হাতি পুষলে সে জীবন দিয়ে দেয় মানুষের জন্যেও। বাস্তবেও তার প্রমাণ ভুরিভুরি। কিন্তু মানুষ? মজার ছলে হোক বা প্রতিহিংসায়, হাতির মতো প্রাণীর জীবন কেড়ে নিতে পারে বলে-বলে। বেশি দূরের নয়, এ দেশেরই কেরালায় এক গর্ভবতী হাতিকে এমন হাসতে-হাসতেই নৃশংসভাবে খুন করা হল! 

যে সে খুন নয়, রীতিমতো দাপিয়ে-কষ্টে ভুগিয়ে মারা হল হাতিটিকে। গর্ভবতী হাতিটিকে বাজিভরা আনারস খেতে দেওয়া হয়েছিল। আর সেই বাজি ভরা আনারস ফাটতেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় হাতিটির জিভ এবং মুখ। শুধু কি তাই। সন্তান যাতে বাঁচে, সেই প্রাণ চলে যাওয়া অবস্থাতেও হাতিটি দাঁড়িয়েছিল জলের মধ্যে। যদি সে বাঁচে, আসলে পেটের সন্তানটা যদি বাঁচে!

ঘটনাটি ঘটেছে উত্তর কেরালার মালাপ্পুরম জেলায়। বনকর্মীরা জানিয়েছেন, হাতিটি বন থেকে লোকালয়ে চলে এলেও সে মানুষকে অত্যন্ত বিশ্বাস করত। তাই মানুষের দেওয়া সেই বাজি ভরা আনারস খেয়েও সে লোকালয়ে ছুটে বেড়িয়েছে টানা, কিন্তু কোনও বাড়ি বা মানুষের ছিটেফোঁটাও ক্ষতি করেনি সে।

আসলে বনে খাবারের অভাবে সে ঢুকে পড়েছিল লোকালয়ে। খাবারের খোঁজ করছিল। আর সেই সময়ই তার মুখে তুলে দেওয়া হয় বাজি ভরতি আনারস। নিজের আর পেটের সন্তানের জন্যে সেই আনারসটি খেয়ে নেয় সে। এরপরই হঠাত তার মুখে বিস্ফোরণ হয়। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় মুখ ও জিভ। অসহ্য যন্ত্রণা এবং খিদে নিয়ে সারা গ্রাম হেঁটে বেড়ায় সে। এই অবস্থায় হাতিটি জল খুঁজছিল। যদি কিছু সুরাহা হয়…

নিজের চেষ্টাতেই খুঁজতে-খুঁজতে হাতিটি পৌঁছে যায় ভেলিয়ার নদী পর্যন্ত। জলের খোঁজ পেয়েই সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে নদীর মাঝে। আর সেই দাঁড়িয়ে থেকেই মৃত্যু হয় তার। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হাতিটি নদীর জলে শুঁড় এবং মুখ ডুবিয়ে দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ। যদি মুখ ফেটে যাওয়ার অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে কিছুটা মুক্তি মেলে, যদি পেটের বাচ্চাটা বাঁচে…

বনবিভাগের আধিকারিক মোহন কৃষ্ণন লিখেছেন, ‘মানুষকে বিশ্বাস করাই হাতিটির কাল হল। খাবার খাওয়ার সময় সে হয়ত ভেবেছিল, মানুষ দিচ্ছে যখন নিশ্চয় ভালো হবে। ভাবছিল নিজের আসন্ন সন্তানের কথাও। প্রচন্ড যন্ত্রণা আর কষ্টেও হাতিটি কারও ক্ষতি করেনি। আসলে ওর ভিতরে ভালো ছাড়া আর কিছু ছিল না।’

কৃষ্ণন জানিয়েছেন, অন্য দুটি কুনকি হাতি দিয়ে নদী থেকে এই হাতিটিকে তোলার চেষ্টা হলেও সে কোনও সাড়াশব্দ দেয়নি। কৃষ্ণন বলছেন, ‘আমার মনে হয় ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করছিল। মৃত্যু আসন্ন ভেবেই সে আমাদের কিছু করতে দেয়নি।’ নদীতে দাঁড়িয়েই শেষ নিঃশ্বাস নেয় সে। মৃত্যুর পর তার দেহ ট্রাকে করে জঙ্গলে নিয়ে যান বনবিভাগের কর্মীরা, সেখানেই দাহ করেন তাকে। কৃষ্ণনের কথায়, ‘ডাক্তার ময়নাতদন্ত করে জানান, খুব তাড়াতাড়ি এক সন্তানের জন্ম দিত ও। মরার সময় কী যে কষ্ট হচ্ছিল ওর। মাথা নত করে ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম আমরা।’

এক করোনাভাইরাসের দাপটে ভুগছে গোটা বিশ্ব। বাধ্য হয়ে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশই দীর্ঘদিন লকডাউনের পথে হেঁটেছে। অর্থাৎ গৃহবন্দি হয়েছে মানুষ। আর সেই সুযোগেই গোটা বিশ্ব, এমনকী এদেশেও শহর-গঞ্জের পথেঘাটে ঘুরে বেরিয়েছে বন্য প্রাণীরা। কখনও গুরুগ্রামের রাস্তায় দেখা মিলেছে হরিণের, কখনও বা এই ব্যারাকপুরের রাস্তায় ময়ূরের। সব দেখে অনেকেই বলেছিলেন, ‘প্রকৃতিকে এতদিন ধরে ধ্বংস করেছে মানুষ। আজ তারই ফল ভোগ করছে। মানুষ ঘরে, পশুপাখিরা রাস্তায়।’ করোনায় বিপর্যস্ত মনুষ্য সমাজ আদৌ কি প্রকৃতির যত্ন করবে আবার, কেরালার নৃশংস হাতি-হত্যার ঘটনা সেই প্রশ্নটা আরও বড় করে তুলে দিয়ে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.