পর্ব ৫

সেই কোন প্রাচীন কাল হতে বর্তমান কাল পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন ভাবে এক সত্য প্রবহমান – 

রামঃ সৎপুরুষো লোকে সত্যঃ সত্যপরায়ণঃ।

সাক্ষাদ্ রামাদ্ বিনিবৃর্ত্তো ধর্মশ্চাপি শ্রিয়া সহ।।

রামায়ণের মর্যাদার মূল ও প্রধান কারণ রামচন্দ্রের চরিত্র। আদিকবির কলমে মর্যাদা পুরুষোত্তম হয়েও দুঃখ , যন্ত্রণা ,ত্যাগ, বিরহে সাধারণ বনবাসী মানব হয়ে উঠেছেন। 

সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি
লভিলে শুধু বঞ্চনা
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।

তাই জন্যই তিনি হয়ে উঠেছেন মানুষের দেবতা। সেই দেবতা আজও আচন্ডালে আমাদের গৃহে গৃহে পূজিত হন। রামায়ণ কথার একদিকে কর্তব্যের দুরহ কাঠিন্য অপরদিকে ভাবের অপরিসীম মাধুর্য দুই একত্র সম্মিলিত হয়েছে। তাতে প্রকৃতিপ্রেম, জীবপ্রেম, মানবপ্রেম, দাম্পত্য, ভ্রাতৃপ্রেম, পিতৃভক্তি, প্রজাবাৎসল্য, প্রভৃতি যত প্রকার হৃদয়বন্ধন আছে তার শ্রেষ্ঠ আদর্শ ফুটে উঠেছে। 

তদিদং বর্ত্তয়িষ্যাবঃ সর্বং নিখিলমাদিতঃ।

ধর্মকামার্থসহিতং শ্রোতব্যমনসৃয়তা।।

এই কারণেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে , ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন , ” খ্রিস্টের জন্মের অন্ততঃ হাজার হাজার বছর পূর্ব হতে আরম্ভ করিয়া আজ খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দুই হাজার বৎসর ধরে রামচরিত কথা ভারতবাসীর জীবন ও সাধনাকে যেভাবে ধারণ করিয়া আছে, তাতে কোনো নৈস্বর্গিক বা আত্মিক উপপ্লব না ঘটিলে ভারতবাসীর সহিত রামায়ণ কাহিনীর সম্পর্ক চিরকাল অচ্ছেদ্য থাকিবে। “

পূজয়ংনশ্চ পঠংশ্চৈনমিতিহাসং পুরাতনম্।

সর্বপাপৈঃ প্রমুচ্যেত দীর্ঘমায়ুর বাপ্নুয়াৎ।।

ধর্মের জয় এবং  অধর্মের পরাজয় এই হল রামায়ণের বাণী। অধর্মের দ্বারা মানুষ যত ঐশ্বর্য লাভ করুক না কেন পরিণাম তার বিনাশ হয়। ধর্ম থাকে প্রেম, ভালোবাসা, ত্যাগ , ষড়রিপু জয়ের মধ্যে ….প্রাচীনতার মধ্যে, অতীত ঐতিহ্যকে সম্মানের মধ্যে। ধর্মের জয়ের অন্যতম পথ হল প্রকৃতি, আরণ্যক, জীব ও মানবপ্রেম, যা সকল রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতির ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। 

সেই জন্যই আদি কবি রামায়ণে উদাত্ত কন্ঠে বলতে পেরেছেন –

রাত্রিঃ শশাঙ্কোদিতসৌম্য বকত্রা 

তারাগণোন্মীলিত চারুনেত্রা ।

জ্যোৎস্নাংশুক প্রাবরণা বিভাতি

নারীব শুক্লাংশুকসংবৃতাঙ্গী।

অরণ্যের মধ্যে ঘটে যাওয়া এক ইতিহাস, ইক্ষাক্বু বংশের এক পুরুষোত্তমের ভ্রাতা ও স্ত্রী সহ অরণ্যচারী হবার এক ইতিহাস, অরণ্যের আরণ্যক ইতিহাস আমাদের নিকট অমৃত সমান হয়েছে। এই অরণ্যের আরণ্যক এক ইতিহাস রামায়ণে যে প্রধান তিনটি ইকোসিস্টেমের উল্লেখ আছে, তাদেরই একটি হল (২) হিমালয় সন্নিহিত অঞ্চলের আলপাইন সদৃশ অরণ্য। বাল্মীকির বর্ণনায় ওই অঞ্চলের গিরিশৃঙ্গগুলি ও সেখানকার অত্যাবশ্যক ও দুষ্প্রাপ্য ঔষধি বৃক্ষলতাদি যেখানে জন্মায় , সেই স্থানগুলির বিবরণ আছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বনের জীববৈচিত্র্য , জলধারবৈচিত্র্য ইত্যাদির কথা বিশেষ নেই। তবে কোন গিরিতে কি প্রকার খনিজ সঞ্চিত আছে তার উল্লেখ আছে।

শত্রোর্জয়ে সমুৎসাহে জনবাদে বিগর্হিতে

লংকাকাণ্ডং পঠেত্ কিং বা শ্রৃণুয়াৎ  সুখী ভবেৎ

অরণ্যসবুজ যে দুটি পর্বতের মধ্যবর্তীস্থানে ঔষধি বা ভেষজ বৃক্ষলতা পাওয়া যায় বলে নির্দেশ করা হয়েছে তা হল কৈলাস ও ঋষভ পর্বত ও তাদের সানুদেশ প্রায় একশত যোজন বিস্তৃত বলা হয়েছে।  ( এক যোজন = প্রায় আট মাইল)…. ওষধি পর্বত যাকে ,মহোদয় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে তা হল কৈলাস ও ঋষভ পর্বতের মধ্যবর্তী একটি স্বতন্ত্র গিরি অঞ্চল। এই ওষধিপর্বত বা গন্ধমাদন পর্বত থেকেই হনুমান লক্ষ্মণের নিমিত্ত বিশল্যকরণী আনয়ন করেছিলেন।

কৈলাস ও ঋষভ পর্বতের মধ্যবর্তী এক সুবিস্তৃত অঞ্চলের দক্ষিণভাগে অবস্থিত শৃঙ্গ বিশেষভাবে চারটি শক্তিশালী ও কার্যকর ওষধি বৃক্ষলতার উৎপত্তি ভূমি বলে বিবৃত হয়েছে। এইগুলি হল মৃত্সঞ্জীবনী বা সঞ্জীবকরণী – অর্থাৎ যা মৃতপ্রায়কে পুনর্জীবন দান করতে পারে। বিশল্যকরণী -যা শরীর হতে সকল কালিমা, ক্লেদ , অধিবিষ বা Toxin দূর করতে সাহায্য করে। সুবর্ণকরণী  -যা দেহকে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ও লাবণ্যময় করতে পারে  এবং সন্ধানকরণী বা সন্ধানী -যা ভগ্ন অস্থিকে সংযুক্ত করতে পারে। এই সকল ওষধি এবং ভেষজ বৃক্ষের বাহ্যিক লক্ষণ হিসাবে বলা হয়েছে এরা প্রচন্ড সুগন্ধযুক্ত বা তীব্র কটু গন্ধযুক্ত এবং দীপ্যমান হত। এই সব উদ্ভিদ থেকে নির্গত গন্ধে সকল অঞ্চল গন্ধময় হয়ে থাকত। সেই কারণেই ওষধিপর্বতকে গন্ধমাদন বলা হত। ভেষজ উদ্ভিদ জন্মাবার জন্য যে ধরনের পার্বত্য ও শীতল বাস্তুতন্ত্রের প্রয়োজন , তা এখানকার পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র সেই প্রকারের ছিল।

ওই সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ কাঞ্চনময় দেশ !

ওই চন্দন যার অঙ্গের বাস, তাম্বল-বন কেশ ।

যার উত্তাল তাল-কুঞ্জের বায়—মন্থর নিশ্বাস !

আর উজ্জল যার অম্বর, আর উচ্ছল যার হাস !”

লঙ্কাপুরী  হচ্ছে রাবণ রাজার সোনার লঙ্কার  রাজধানী ।আগের পর্বেই আলোচনা করেছি, লঙ্কাপুরার সীতা কোঠুয়া বলে জায়গাটি নাকি ছিল মন্দোদরির প্রাসাদ। সীতার কুঠির থেকে  নাম হয়েছে সীতা কোঠুয়া। সীতা কোঠুয়তে গেলে দেখতে পাবেন ঘন জঙ্গলের মধ্যে এক বিশাল রাজপ্রাসাদ ভিত অবধি বেঁচে আছে। ভিত অংশটি কিন্তু ভালো ভাবেই রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সীতা কোঠুয়ার  বর্তমান অবস্থান হাসালাকা নামক স্থানে।এরপরে রাবণের রথ সীতাকে নিয়ে যায় অশোক বনে বা বাটিকায়।পাহাড়ের উপরে নাকি রথের চাকার মতন দুটি সমান্তরাল দাগ এখনও চোখে পরে। এই পথের ধারেই রয়েছে ক্রন্দনরত সীতার চোখের জলে সৃষ্ট অশ্রুকুন্ড।

রাবণের নামে রয়েছে রাবণ গুহা ও ঝর্ণা।বর্তমান ভারতবর্ষে ভারতীয় মহাকাব্যগুলি নিয়ে অনেক তথাকথিত শিক্ষিত লোক, বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেন। রামচন্দ্র নাকি উত্তর ভারতীয় কনসেপ্ট- আজকের আধুনিক বঙ্গ সমাজের নব্য যুগের প্রতিনিধিরা কি কখনও ভেবে দেখেছেন, রাম ও রামায়ণের প্রভাব বাংলাদেশে কতদূর গেঁথে আছে। রামনগর, রামপুর, রামবাটি, রামরাজাতলা রামপুরহাট, সমগ্র বঙ্গে একসময় কতদূর রামের প্রভাবে আচ্ছন্ন ছিল। অনেকের বাড়ির কুলদেবতা ছিলেন রাম। প্রতিষ্ঠা হয়েছিল  রাম মন্দির। যুগ যুগ ধরে বাঙালি হিন্দুদের নামের সঙ্গে রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন  নাম জড়িয়ে থাকত। বাংলার মন্দির টেরাকোটার ভাস্কর্যে রাজা রামের রাজসভা প্রায়ই প্রবেশ পথের খিলানের উপর শোভা বর্ধন করতো।

অথচ আশ্চর্য লাগে  শ্রী লঙ্কার প্রায় প্রতিটি হিন্দু তামিল, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সিংহলি,  রামায়ণ সম্মন্ধে সম্যক অবহিত, একটা মানবিক মূল্যবোধের জীবন দর্শন।

এহেন লঙ্কা জুড়ে রয়েছে সবুজ গহীন অরণ্য। ক্রান্তীয় পর্ণমোচী অরণ্য এবং (৩) লঙ্কার সবুজ বৃক্ষের বন এরমধ্যে প্রকৃতিগত বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। তবে লঙ্কার একটি বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে চিরহরিৎ অরণ্যে। কারণ এটি ভৌগলিক ভাবে নিরক্ষীয় বৃষ্টি অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। বর্তমান শ্রীলঙ্কার গড় তাপমাত্রা ১৬ সে. যা গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ ৩৩ সে.পর্যন্ত হতে পারে । দিন রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য ৪ থেকে ৭ সে.। সাধারণত দক্ষিণাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় আর্দ্রতা সবচেয়ে বেশি থাকে, কলম্বোর মত জায়গায় সারা বছর প্রায় ৭০% আর্দ্রতা থাকে, জুন মাসের দিকে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে তা সর্বোচ্চ ৯০% পর্যন্ত হয়।

পর্ণমোচী বৃক্ষ সাধারণত শীত বা শুষ্ক ঋতুর অভিযোজন হিসেবে পাতা ঝরিয়ে থাকে। চিরহরিৎ বৃক্ষ পাতা ঝরালেও পর্ণমোচীর মতোন একসাথে সব ঝরিয়ে ফেলে না। বিভিন্ন বৃক্ষ বিভিন্ন সময়ে তাদের পাতা ঝরায় যার ফলে বনকে মোটামুটি সবুজই দেখায়। অধিকাংশ ক্রান্তীয় বৃষ্টিবনের বৃক্ষরা চিরহরিৎ বলে পরিচিত যারা পাতার বয়স বাড়া এবং ঝরার সাথে সাথে সারা বছর ধরে নতুন পাতা প্রতিস্থাপন করে। অন্যদিকে ঋতুগতভাবে শুষ্ক জলবায়ুর প্রজাতিগুলো হয় চিরহরিৎ অথবা পর্ণমোচী। উষ্ণ শীতপ্রধান জলবায়ুর অধিকাংশ উদ্ভিদ প্রজাতিও চিরহরিৎ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। এধরনের জলবায়ু অঞ্চলে শিশু, গর্জন, রোজউড, মেহগিনি, চাপলাস, বোগানোমা, নাহার, লোহাকাঠ ইত্যাদি প্রধান বৃক্ষ ছাড়া মাঝে মাঝে রবার, বাঁশ ও আবলুস বৃক্ষও দেখা যায় । এসব কাঠ খুবই শক্ত ও ভারি । এগুলি গৃহনির্মাণ ও আসবাবপত্রের জন্য ব্যবহৃত হয় । 

 রামায়ণ আলোচনা করলে দেখা যায় স্বাভাবিক উদ্ভিদ ও স্বাভাবিকীকৃত উদ্ভিদ নিয়ে গড়ে উঠেছিল লঙ্কার বন , অরণ্য।  

স্বাভাবিকভাবে অরণ্যগুলি চরিত্রে মূলত ঘন জঙ্গল বা বন। স্বাভাবিক বনের মতোই এখানে শিলা , পাহাড়ি গাছ , পর্যাপ্ত জলসম্পদ  ও  জীববৈচিত্র্য বর্তমান। বাল্মীকির রামায়ণে লঙ্কার ঘন সবুজ বনের বর্ণনায় যে সমস্ত উল্লেখ করেছেন তারা হলো  – সরল, কর্নিকা, খর্জুর, পিয়াল, প্রিয়াঙ্গু, মুচুলিন্দ, কূটজ, কেতকী, নীপ, সপ্তচ্ছদা, আসন, কোবিদার । 

 জীব প্রসঙ্গে কবি জলচর পাখিদের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গত চিত্রকূট বর্ণনায় গজ , হস্তী, মহিষ , ব্যাঘ্র ইত্যাদির উল্লেখ করলেও লঙ্কায় এধরনের বৃহৎ পশুর কথা উল্লেখ করেন নি। সেখানে নয়ন চপল মৃগের কথা বলা হয়েছে। 

 স্বাভাবিকীকৃত বন হলো যে বনের  উদ্ভিদ,  তরুলতা স্বভূমিজ নয়। অন্যস্থান থেকে সেখানে রোপন করে, পরিচর্যা করে বৃদ্ধি হয়েছে বৃদ্ধি করা হয়েছে অর্থাৎ একটি সৃজিত বন।  এই ধরনের বনের বিস্তৃত এবং অনুপঙ্খ  বিবরণ আদি কবির বর্ণনায় রয়েছে । যেমন – অশোকবন। লঙ্কার সুবিশাল চিরহরিৎ অরণ্যের পাশাপাশি অশোক বনেও স্বাভাবিক অরণ্যের ইকোসিস্টেমের বৈশিষ্ট্যগুলিও অব্যাহত ছিল। যদিও রাবণের অশোক বন ছিল একটি স্বভাবিকীকৃত বন। এক হিসাবে কৃত্রিম।  এসকল স্বাভাবিকৃত বনের মধ্যে বিস্তীর্ণ মুক্তভূমি রাখা হত।  ইকোলজিক্যাল সংহতি অব্যাহত ছিল বনসৃজন জলসম্পদের বৈচিত্র্যের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক নির্ঝর ও নদী ছাড়াও কৃত্রিম পুষ্করিণী, হ্রদ সৃষ্টি করে,  এমনকি পার্বত্য নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করানো হত।   বিভিন্ন পর্বত ও গিরিকন্দরে ভেষজ বৃক্ষলতার বনসৃজন কৈলাস ও গন্ধমাদনের মতো এই অঞ্চলে পার্বত্য বাস্তুতন্ত্রের  সংগে এই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের সদৃশ্যতা মনে করিয়ে দেয় ।

উদ্ভিদ , বৃক্ষলতা ইত্যাদির বিস্তারণ ও স্বভাবিকীকৃত  ফলে যে বন সৃজিত হয়েছিল এবং তার ফলে যে মুখ্য জীববৈচিত্র গুলি আমরা জানতে পারি, তার মধ্যে প্রধান হলো :

ক) বিভিন্ন প্রকার ও রঙের অশোক পুষ্প – সোনালী, টকটকে লাল অন্যন্য গাঢ় বর্ণের….আর ছিল পবিত্র নিম এবং বকুল। 

খ) চম্পক , চন্দন , নাগকেশর , শাল , উদ্দালক। এছাড়াও ঋতু অনুযায়ী বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ। 

গ) কল্পবৃক্ষ বা সন্তানক – সুগন্ধময় ও মদস্রাবী অগণিত বৃততী, প্রতানবতী ও অলসলা। 

ঘ) জলক্ষেত্র জুড়ে ব্যাপক শালুক ও কমলবন এবং জলজপুষ্প।

ঙ ) জনপ্রিয় পাখিদের মধ্যে হংস , সারস , চকোর ; গীতপটু পাখিদের মধ্যে কোকিল ও অন্য পাখিদের মধ্যে  ময়ূর এবং বন্যপ্রাণীদের মধ্যে মৃগের দল। 

রামায়ণে তিনটি প্রধান বাস্তুতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও ক্রান্তীয় পর্ণমোচী অরণ্যের ইকোলজি সর্বত্র অবিকল এক নয়। বিশেষত বাল্মীকি যেখানে ভাব ও রসের কলা র কথা উল্লেখ করেছেন।  যেই সব অরণ্যের পূত পবিত্র অনুষঙ্গ ও  আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। এর কারণ , হয়তো  এই অরণ্যগুলির কায়িক বৈশিষ্ট্যের কিছু কিছু তফাৎ আছে। হিমালয় সন্নিহিত অল্পাইনীয় বৈশিষ্ট্যের অরণ্যে ইকোলজি অন্য দুটি থেকে  অবশ্যই পৃথক। লঙ্কার চিরহরিৎ অরণ্যে ব্যতীত অশোক কানন যেহেতু উদ্যান বা সৃজিত বন , তাই সেখানে যে বন্য বৈচিত্র থাকা দরকার তা অনুপস্থিত। 

দেবতার স্তবগীতে দেবেরে মানব করি আনে,

তুলিব দেবতা করি মানুষেরে মোর ছন্দে গানে।

ভগবন্‌, ত্রিভুবন তোমাদের প্রত্যক্ষে বিরাজে–

কহ মোরে কার নাম অমর বীণার ছন্দে বাজে।

কহ মোরে বীর্য কার ক্ষমারে করে না অতিক্রম,

কাহার চরিত্র ঘেরি সুকঠিন ধর্মের নিয়ম

ধরেছে সুন্দর কান্তি মাণিক্যের অঙ্গদের মতো,

মহৈশ্বর্যে আছে নম্র, মহাদৈন্যে কে হয় নি নত,

সম্পদে কে থাকে ভয়ে, বিপদে কে একান্ত নির্ভীক,

কে পেয়েছে সব চেয়ে, কে দিয়েছে তাহার অধিক,

কে লয়েছে নিজশিরে রাজভালে মুকুটের সম

সবিনয়ে সগৌরবে ধরামাঝে দুঃখ মহত্তম–

কহ মোরে, সর্বদর্শী হে দেবর্ষি, তাঁর পুণ্য নাম।”

নারদ কহিলা ধীরে, “অযোধ্যায় রঘুপতি রাম।”

ভগবান যুগে যুগে মানব শরীর ধারণ করে এই ধরাধামে আসেন জীবের কল্যাণের নিমিত্ত। সমাজে ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজে লোক শিক্ষা দান করেন। সমাজকে বার বার কেবল মানব নয় তার সঙ্গে এই প্রকৃতি মাতাকে ভালোবাসতে শেখান নানান ভাবে। নারদের মুখে রঘুপতির কথা বর্ণিত হয়। বাল্মীকি তাঁর কলমের আঁচড়ে সেই রঘুপতির চরিত্র , দেহ, হৃদয়, বিবেক সাকার রূপ পেল। সেই রঘুপতি এক তেজস্বী পুরুষ, তিনি সুন্দর ও দৃপ্ত। তিনি বজ্রের ন্যায় কঠিন ও কুসুমের ন্যায় কমল । বাহুবল এবং বুদ্ধিরবলের সঙ্গে তাঁর হৃদয়ের এক সংযোগ স্থল ছিল। 

কালাগ্নি সদৃশঃ ক্রোধ ক্ষময়া পৃথিবী সমঃ।

আবার তিনি যে অপরাধের কোনো প্রায়শ্চিত্ত নেই সেই হীনতম শ্রেষ্ঠ দন্ড দিয়েছেন ক্ষমা।

ভারতীয় সংস্কৃতি রাম, সীতা ও লক্ষ্মণকে নরনারী হিসাবে গ্রহণ করেন নি , কোনো দিন করবেনও না। তাঁদের ত্যাগ, তাঁদের মহত্ব , তাঁদের আদর্শ, তাঁদের বীরত্ব তাঁদের দেবত্ব প্রদান করেছে। ভারতীয় সংস্কৃতি করুণরসকে প্রধান মনে করে , কারণ মানব মনে শাশ্বত বেদনা বোধ থেকেই যায়।  সেই কোন প্রাচীন কাল হতে মানুষ চিরসুন্দরের সঙ্গে, অসীমের সঙ্গে , অনন্তের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। অতীতের কোনো এক বিস্মৃত লগ্নে সে সুন্দরের নিকট হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।  তাই তো, বিরহ বেদনা মানব মনে সদা অপরাহ্নেরর ম্লান ছায়া বিস্তার করে চলেছে। রামায়ণ সেই শাশ্বত অনুভূতকেই রূপ দিয়েছে। তাই তো, ক্রৌঞ্চঙ্গনার বিলাপ থেকে উদ্ভূত করুনরস রামায়ণে বারবার আত্মপ্রকাশ করেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অরণ্যের সুন্দর শৃঙ্গার রস। এই করুন ও সুন্দরের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে শ্রেষ্ঠ রস ভক্তি রস, প্রেম রস। সব মিলে একাকার হয়ে গেছে অরণ্যের রামায়ণ বা রামায়ণের অরণ্যের মধ্যে, প্রকৃতির মধ্যে, প্রেমে ও অপ্রেমে….

আমাদেরি কুটির-কাননে
    ফুটে পুষ্প , কেহ দেয় দেবতা-চরণে ,
    কেহ রাখে প্রিয়জন-তরে — তাহে তাঁর
    নাহি অসন্তোষ । এই প্রেমগীতি হার
    গাঁথা হয় নরনারী-মিলনমেলায় ,
    কেহ দেয় তাঁরে , কেহ বঁধুর গলায় ।
    দেবতারে যাহা দিতে পারি , দিই তাই
    প্রিয়জনে — প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই ,
    তাই দিই দেবতারে ; আর পাব কোথা!
    দেবতারে প্রিয় করি , প্রিয়েরে দেবতা ।

করুণ, প্রেম, ভক্তি সকল রসের ধারায় আরণ্যক রামায়ণ হয়েছে অনন্য সাধারণ , চিরনবীন।

কখন আমি ঘুমিয়ে যেতেম

     দুপুরবেলার তাতে–

লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার

     থাকত সাথে সাথে।

সন্ধেবেলায় কুড়িয়ে আনি

     শুকোনো ডালপালা,

বনের ধারে বসে থাকি

     আগুন হলে জ্বালা।

পাখিরা সব বাসায় ফেরে,

     দূরে শেয়াল ডাকে,

সন্ধেতারা দেখা যে যায়

     ডালের ফাঁকে ফাঁকে।

মায়ের কথা মনে করি

     বসে আঁধার রাতে —

লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার

     থাকত সাথে সাথে।

ঠাকুরদাদার মতো বনে

     আছেন ঋষি মুনি,

তাঁদের পায়ে প্রণাম করে

     গল্প অনেক শুনি।

রাক্ষসেরে ভয় করি নে,

     আছে গুহক মিতা —

রাবণ আমার কী করবে মা,

     নেই তো আমার সীতা।

হনুমানকে যত্ন করে

     খাওয়াই দুধে-ভাতে–

লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার

     থাকত সাথে সাথে।

মা গো, আমায় দে-না কেন

     একটি ছোটো ভাই–

দুইজনেতে মিলে আমরা

     বনে চলে যাই।

আমাকে মা, শিখিয়ে দিবি

     রাম-যাত্রার গান,

মাথায় বেঁধে দিবি চুড়ো,

     হাতে ধনুক-বাণ।

চিত্রকূটের পাহাড়ে যাই

     এম্‌নি বরষাতে–

লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার

থাকত সাথে সাথে।

সমাপ্ত

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ১. শ্রীমদ বাল্মীকি রামায়ণ 

২. বাল্মীকি রামায়ণ : উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

৩. প্রাচীন ভারতের পরিবেশ চিন্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.