নভেল করোনা-র কারণে লকডাউন, সুপার সাইক্লোন আমফান এবং কালবৈশাখী ঝড়বৃষ্টির প্রভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্তহয়েছেন বাংলার এবং বিশেষত উত্তর ও দক্ষিন ২৪ পরগনার কৃষকবন্ধুরা। করোনার হাত ধরে আমফানের ঘূর্নীঝড় তার সর্বগ্রাসী কালো ধ্বজা উড়িয়ে অবাধ ধ্বংসলীলা চালালো শহর থেকে গ্রামে।কৃষকসমাজের আর্থিক স্থিতিই টলোমলো হয়ে উঠলো । উন্নতদেশগুলি অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হওয়ায় এরকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থা তলানিতে এসে ঠেকেনা ।কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) কৃষক সেই অর্থনৈতিক বুনিয়াদের ওপর দাঁড়িয়ে নেই । আমাদের কৃষি উৎপাদনের কর্মকান্ডের সঙ্গে যে মানবসম্পদ জড়িয়ে তার সিংহভাগই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী এবং তাঁরাই হলেন আমাদের খাদ্য সয়ম্ভরতার নেপথ্য কারিগর।বড়দের তুলনায় উৎপাদনশীলতায় ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি প্রনয়নে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরাই এগিয়ে আসেন । আজকের করোনাও আমফানের যৌথ হানায় এনারা সকলেই সামাজিক ও আর্থিকভাবে পর্যুদস্ত । ঘরে সীমিত রসদে আগামী মরসুম পর্যন্ত যোঝবার ক্ষমতা নেই। এই ক্ষতিকর পরিস্থিতি আমাদের দৈনন্দিন সবজী বাজারেও প্রভাব ফেলেছে। শাকসবজী চারগুন দামে কিনতে হচ্ছে যার কোনো সুফল কিন্তু এই কৃষকরা পাচ্ছেন না, সবটাই যাচ্ছে এক শ্রেনীর দালাল ও মহাজনদের কবলে।বর্তমানে গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষের সময় এবং খরিফ মরসুমের ধান চাষও আসন্ন । খাদ্য ভান্ডারকে সুনিশ্চিত করতে খুব শীঘ্র আমাদের কৃষকদের মাথা তুলে দাঁড়াতেই হবে ।
এহেন প্রতিকুল পরিস্থিতিতে আমাদের বিকল্প কৃষি ও নতুন উদ্ভাবনী পন্থার কথা ভাবতে হবে।
সর্বপ্রথম ভাবতে হবে ব্যক্তিগত চাষাবাদের তুলনায় সমবায় ভিত্তিক চাষাবাদের অবকাশ অনেক প্রশস্ত –
এই সমবেত প্রয়াস সমগ্র কৃষি সমাজকে বহুলাংশে বলীয়ান করবে।
ক) সমবায় ভিত্তিক চাষ কখনোই আবশ্যিক নয় কিন্তু সেচ্ছার এই উদ্দ্যোগ আমাদের রাজ্যে ব্যতিক্রমী এক নতুন আশার রূপালী রেখার সুচনা করবে।
খ) সমবায় ভিত্তিক চাষে কৃষকের জমির উপর কৃষকের অধিকার সুনিশ্চিত থাকে।
গ) সমগ্র খামারটি একটি মাত্র একক হিসাবে বিবেচিত হয় এবং সম্যক ব্যবস্থাপনায় থাকেন অংশগ্রহণকারী সকল কৃষকগনের নির্বাচিত সদস্যরা।
ঘ) সকল যোগদানকারী কৃষকই নিজের নিবেদিত জমির ও শ্রমের অনুপাতে উৎপাদিত পন্যের প্রাপ্ত আয়ের ভাগ পাবেন ।
এছাড়াও এরকম সমবেত প্রয়াসের অনেক সুবিধাজনক দিক আছে। সমবায় ভিত্তিক চাষ ক্ষুদ্র ও অলাভজনক জমির সকল সমস্যার সুরাহা করে।সকল ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক জমিগুলিকে একত্রিত করে সমবায় ভিত্তিক চাষের সদস্যরা এক বৃহদায়তন খামারের সকল সুবিধা ও সুযোগ উপভোগ করতে পারেন – যেমন অনেক কম ও সুবিধাজনক দামে ও শর্তে বিপুল পরিমানে বীজ, সার ওঅন্য কৃষি উপকরন ক্রয় করার যায় । বড় যন্ত্রপাতি যেমন ট্রাকটর, হারভেস্টিং মেশিন, পাওয়ারটিলার ইত্যাদিও ক্রয় ওপরিশোধও সহজসাধ্য হয়ে যায় এবং কৃষিকাজও বিজ্ঞানসম্মত ও আধুনিক হয়ে ওঠে ।
সমবায়ভিত্তিক কৃষি কাজ শুরুর আগে নিজ নিজ গ্রামে কৃষক গোষ্ঠি গঠন করে গ্রামের উপযোগী লাভজনক ফসল যোজনাপ্রস্তুত করে এগিয়ে আসতে হবে। কিছু প্রশাসনিক অনুমোদনের দিকও আছে। আজকের দিনে ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগের চলারপথে অনেক প্রতিবন্ধকতা আসবে ধরে নিয়েই এগোতে হবে। বহুক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক নানা বিধি ও আনুষ্ঠানিকতা মানতে হবে এবং সর্বপরি কৃষি বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নিতে হবে।KVK এবং বিভিন্ন কৃষি সম্প্রসারণ কেন্দ্র থেকে নিতে হবে প্রশিক্ষণ।
১)গতানুগতিক পদ্ধতিতে প্রচলিত ফসল আলু, লঙ্কা, কপি, বেগুন, চাষ করা ছাড়াও অন্যান্য অপ্রচলিত সবজি যেমন, ক্যাপসিকাম, ব্রকোলি, লাল বাঁধাকপি, চেরি টমেটো, সামার স্কোয়াশ ইত্যাদির চাষ ভালো লাভের সন্ধান দিতে পারে।
২)অর্থনৈতিক স্বাধীনতার লক্ষে গ্রামের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের ক্যাম্পবেল হাঁস, মুরগী, ছাগল, মৌমাছি পালন ইত্যাদিতে উদ্বুদ্ধ করতে পারা যায়।
৩) মাছের পোনা তৈরী করা, পুকুর কেন্দ্রিক খামার চাষ, লবনাক্ত জলে ভেনামি চিংড়ির চাষ নতুন দিশা দেখাতে পারে ।
৪) মাশরুম ও মৌমাছি পালন, পেয়ারা, লেবু বাগান তৈরী,সুপারি ও ফল বাগানভিত্তিক মিশ্র চাষ, তৈল বীজ এবং ডালের চাষও কৃষকের আর্থসামাজিক স্থিতি সুদৃঢ় করতে পারে। সকলে আন্তরিকভাবে এগিয়ে এলে অচিরেই গড়ে উঠতে পারে একআধুনিক,বিজ্ঞানমনস্ক ও ভ্রাতৃত্ববোধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও সংঘবদ্ধ এক কৃষক সমাজ ।
সৌমিত্র সেন (Soumitra Sen)