বীর সাভারকরের জন্মতিথিতে তাঁর সম্বন্ধে ঐতিহাসিক তথ্যঋদ্ধ প্রবন্ধ রচনা করার উদ্দেশ্যে এ লেখা নয়। এ রচনার বিষয়বস্তু ব্যক্তিগত কিছু পর্যবেক্ষন ও প্রতিপ্রশ্ন যেগুলিকে তুলে ধরতে চাই সাধারণ পাঠকের, বিশেষতঃ তরুণ প্রজন্মের সামনে।
স্বাধীনতা উত্তরকালে ভারতীয় ঐতিহাসিকবৃন্দ তাঁদের রচনায় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত নানা মনীষীর ভাবমূর্তি নির্মাণ করেছেন নিজেদের পর্যবেক্ষণের নিরিখে। ভারতীয় অ্যাকাডেমিয়া বা অধ্যয়ন জগত যেহেতু ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ইচ্ছায় বামপন্থী-অধ্যুষিত, ফলে এইসব ঐতিহাসিকদের মধ্যেও আমরা পেয়েছি বামপন্থী মনন। তাঁদের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছি আমরা সকলেই। বর্তমান ভারতবর্ষে যাঁরা বর্তমান প্রজন্ম, তাঁদের সকলেরই জন্ম ও শিক্ষা স্বাধীনতা উত্তরকালে। ফলে তাঁদের অধীত ইতিহাস-চেতনাও বামপন্থী প্রভাবযুক্ত হবে, তা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি যেহেতু ইতিহাসের ছাত্রী নই এবং দশম শ্রেণীর পর আর ইতিহাস চর্চা বিশেষ করি নি, তাই এ বিষয়ে পক্ষপাতহীন কিছু পর্যবেক্ষণ ও যৌক্তিক প্রতিপ্রশ্ন পাঠকদের সামনে রাখতে চাই।
গত বেশ কিছু বছর যাবৎ দেখে আসছি যে, বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে বামপন্থীরা বড় গালিগালাজ করেন যা আমার স্কুলজীবনে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সাভারকরের ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন শুরু হয় নব্বইয়ের দশক থেকে যখন আমার স্কুল জীবন আমি সদ্য অতিক্রম করেছি মাত্র। আজ এত বছর পর সাভারকরের ওপর বামপন্থীদের অবিশ্রান্ত নিন্দাবাদ এ প্রশ্নের জন্ম অবশ্যই দেয় যে বিনায়ক দামোদর সাভারকর কি এমন করেছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর ৫৪ বছর পরেও বামপন্থীরা সাভারকর-বিরোধী নিন্দাবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন?
উত্তর যা পেয়েছি তা হল এই যে, বামপন্থীদের মতে সাভারকর সেলুলার জেল থেকে ‘মুচলেকা’ দিয়ে মুক্তি পেয়েছিলেন। তিনি বহুবার বৃটিশ সরকারের কাছে বহু চিঠি লেখেন, এমনকি নিজের স্ত্রীকে দিয়েও চিঠি লিখিয়ে বৃটিশের মার্জনা ভিক্ষা করে সেলুলার জেল থেকে মুক্তি প্রার্থনা করেন। অতএব তিনি ভীরু, কাপুরুষ এবং বৃটিশের পা চাটা ছিলেন। এই হল বামপন্থীদের সাভারকর-নিন্দার মূল বিষয়বস্তু। প্রথমেই বলেছি যে ইতিহাস আলোচনা এ লেখার প্রতিপাদ্য নয়। ঐতিহাসিক সত্য যা-ই হোক, তা নিয়ে আলোচনা করবেন ইতিহাস-বিশেষজ্ঞরা। এখানকার আলোচনা চলবে বামপন্থীদের সাভারকর-নিন্দাকে তর্কের খাতিরে সত্যি বলে ধরে নিয়েই। নিম্নলিখিত প্রতিপ্রশ্নগুলি তারই পরিপ্রেক্ষিতে।
*প্রতিপ্রশ্ন ১:* যদি ধরে নিই সাভারকর ভীরু, কাপুরুষ ও বৃটিশের পা-চাটা ছিলেন, তাহলে, বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে ‘বীর’ সাভারকর বলা হত কেন? আমরা যারা আশির দশকে স্কুলে পড়েছি, তারা জানি যে বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে ‘বীর’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল তাঁর সমসাময়িককালেই। ইতিহাসের তৎকালীন পাঠ্যবইগুলিতে তেমনই উল্লিখিত ছিল। প্রশ্ন হল, যে ব্যক্তি কাপুরুষ, তাঁকে তাঁর সমসাময়িক কাল “বীর” আখ্যা দিল কেন? এর উত্তরে বর্তমানে অনেকে বলেন যে বিনায়ক দামোদর সাভারকর নাকি নিজেই নিজেকে ‘বীর’ আখ্যা দিয়েছিলেন। আগেই বলেছি, এ রচনার উদ্দেশ্য তথ্যপ্রদান নয়, বরং প্রশ্ন তোলা এবং তথ্যের নিরিখে নয়, বরং যুক্তির নিরিখে তার উত্তরের অনুসন্ধান। বিপ্লবী রাসবিহারী বসু একান্তই ছিলেন সাভারকরের সমসাময়িক। সেই রাসবিহারী বসুও তাঁকে উল্লেখ করেছিলেন বীর সাভারকর বলে। সে নাম যদি নিতান্ত অকারণে নিজেই নিজেকে গৌরবান্বিত করে আত্মশ্লাঘা অনুভব করার জন্য সাভারকর দিয়ে থাকেন, তবে রাসবিহারী বসুর মত অনন্যসাধারণ বিপ্লবীও কি সে নামকে স্বীকৃতি দিতেন? তা কি স্বাভাবিক? এমনকি সাভারকরের রাজনৈতিক মতাদর্শের নিতান্ত বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধী তাঁর চিঠিতে সাভারকরকে ‘বীর সাভারকর’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তা-ই বা কেন? সাভারকরের সেই নামকে স্বীকৃতি দেওয়ার কি প্রয়োজন ইন্দিরা গান্ধীর থাকতে পারে? সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরও সাভারকরের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করে টুইট করেছিলেন ‘বীর সাভারকর’ বলে উল্লেখ করেই। এ নাম যদি তাঁর নিজের নিজেকে দেওয়া নাম হয়, তবে তা বহুজনস্বীকৃত হত কিনা, সে প্রশ্ন রয়েই যায়।
*প্রতিপ্রশ্ন ২:* একজন ভীরু, কাপুরুষকে বামপন্থীরা যে আজও ভুলতে পারছেন না, তার যুক্তিসঙ্গত কারণ কি হতে পারে? একজন তথাকথিত ‘কাপুরুষ’ কি এমন অবিশ্রান্ত নেতিবাচক প্রচার পেতে পারেন? এতখানি মনোযোগ কি তাঁর প্রাপ্য হয়? কি এমন বৈশিষ্ট্য বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ছিল যার জন্য মৃত্যুর ৫৪ বছর পরেও বামপন্থীদের নিশানায় তিনিই? তবে কি সাভারকর এমন কিছু করেছিলেন যা কোনো না কোনো ভাবে সরাসরি বামপন্থীদের স্বার্থ বিরোধী? এ প্রশ্নের জবাবে অনেকে হয়ত বলবেন যে সাভারকরের অনুগামীরাই আজ ভারতবর্ষ শাসন করছে এবং তাঁকে নিয়ে মাতামাতি করছে বলেই পুরোনো তিক্ততার বিষয়গুলিকে লোকসম্মুখে নতুন করে তুলে ধরার প্রয়োজন হচ্ছে। এমত উত্তর কতখানি যুক্তিসঙ্গত তা আলোচনা করা প্রয়োজন এবং যে প্রতিপ্রশ্ন আমার মনে এসেছে সেগুলির যথার্থ উত্তরও খুঁজে পাওয়া দরকার বর্তমান প্রজন্মের স্বার্থে। একই সঙ্গে একজন ব্যক্তি ‘বীর’ ও ‘কাপুরুষ’ দুই-ই হতে পারেন না। যাঁকে তাঁর সমসাময়িককালের বিশিষ্টজনেরা ‘বীর’ বলছেন, যাঁকে তাঁর বিরুদ্ধ মতাবলম্বীরাও ‘বীর’ বলছেন, তাঁকেই যদি তাঁর বহু পরবর্তী প্রজন্ম ‘কাপুরুষ’ বলে চিহ্নিত করে, তবে কোন্ মতটি অধিকতর গ্রাহ্য হওয়া উচিত? সমসাময়িক কালের মতামত? নাকি তাঁর মৃত্যুর প্রায় পঁচিশ বছর পর থেকে যে প্রচার শুরু হয়, সেই প্রচারটিই?
যে চিঠিকে বামপন্থীরা ‘মুচলেকা’ বলছেন, সে আদতে ক্লেমেন্সি পিটিশন। সে সময় বহু জেলবন্দী বিপ্লবীই বৃটিশ সরকারের কাছে ক্লেমেন্সি পিটিশন দাখিল করে মুক্তি প্রার্থনা করেছিলেন এবং মুক্তি পেয়েছিলেন। পরাধীন দেশে জেলমুক্তির জন্য সাম্রাজ্যবাদী শাসকের কাছে ক্লেমেন্সি পিটিশন লেখা একটি অতি সাধারণ, প্রচলিত পদক্ষেপ ছিল কারণ বন্দীজীবন থেকে মুক্তি পেতে চাওয়া জেলবন্দী কয়েদীর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এস এ ডাঙ্গে বা পি সি যোশীর মত কম্যুনিস্ট নেতাও মুচলেকা অর্থাৎ ক্লেমেন্সি পিটিশন দিয়ে ছাড়া পেয়েছিলেন। কিন্তু বদলে কিছু ‘দিতে হয়েছিল’ তাঁদেরকে। বৃটিশকে কথা দিতে হয়েছিল যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশের পক্ষে দাঁড়াবেন তাঁরা। শপথ করতে হয়েছিল, “ভারত ছাড়ো” আন্দোলনের বিরোধিতা করবেন তাঁরা। অর্থাৎ আদতে বৃটিশ stooge হতে হয়েছিল কম্যুনিস্টদেরই। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার বদলে বৃটিশের পক্ষে কাজ করার শপথ নিতে হয়েছিল তাঁদেরকে। এ কাজ গৌরবের নয়, বরং গ্লানির। আপন স্বার্থে তা করতে রাজী হলেও মনের গভীরে নিশ্চয়ই চরম অপরাধবোধে ভুগতেন তাঁরা।
অপরপক্ষে, বার বার নানা পদ্ধতিতে ক্লেমেন্সি পিটিশন লেখা সত্ত্বেও বীর সাভারকরকে মুক্তি দেয় নি বৃটিশ সরকার। সবাই ছাড়া পেলেন, ছাড়া পেলেন না শুধু তিনি। বৃটিশ তাঁকে জেলবন্দী করেছিল দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের জন্য। অর্থাৎ সরকার চেয়েছিল গোটা জীবন জেলবন্দী হয়েই কাটিয়ে দিন বিনায়ক দামোদর সাভারকর। কিন্তু কেন? কতখানি বিপদ অনুভব করেছিল সরকার যাতে ঐ একটি মানুষকে ছোট্ট কুঠুরিতে আটকে রাখতে চেয়েছিল গোটা জীবন? তাঁর সমসাময়িক প্রায় সকলের ক্লেমেন্সি পিটিশন মঞ্জুর করেছিল তারা, নামঞ্জুর হয়েছিল শুধু সাভারকরের পিটিশন। তাও বার বার। অর্থাৎ সাভারকরকে মুক্তি দেওয়ার সাহস বৃটিশের ছিল না। তাঁকে দিয়ে কোনো শপথ করিয়ে নিয়ে তাঁকে ছেড়ে দিলেও সাভারকর যে সেই শপথ রক্ষা করবেন এমন বিশ্বাস নিশ্চিতভাবেই বৃটিশের ছিল না, যে কারণে বার বার তিনি ক্লেমেন্সি পিটিশন করা সত্ত্বেও খারিজ হয়েছিল সেগুলি। শেষ পর্যন্ত টানা পঁচিশ বছর জেলবন্দী থাকার পর জীবনে সব রকম রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিত্যাগ করবেন এমন শপথ নেওয়ার প্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকার মুক্তি দেয় তাঁকে। অর্থাৎ কম্যুনিস্ট নেতারা যেমন সরাসরি দেশের স্বাধীনতা-বিরোধী কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাড়া পেয়েছিলেন, বীর সাভারকরের কাছ থেকে তেমন কোন প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পারে নি বৃটিশ সরকার। তাই রাজনীতিই ছেড়ে দেবেন এই শর্তেই অবশেষে তাঁকে মুক্তি দিতে রাজী হয়েছিল তারা।
বিনায়ক দামোদর সাভারকরই সেই ব্যক্তি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে দীর্ঘতম সময় যাঁকে কাটাতে হয়েছিল বৃটিশ সরকারের জেলবন্দী হয়ে। সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর। আজকের যুক্তিবাদী তরুণ প্রজন্মের জন্য এই তথ্যও আশা করি তাঁর ‘বীর’ত্বের একটি পরোক্ষ প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হবে।
আদতে বীর সাভারকরের প্রতি বামপন্থীদের নিন্দাবাদ বোধ করি পরাজয়ের এক গভীর হতাশা ও গ্লানি থেকে উৎপন্ন। তাঁদের এমত নিন্দাবাদকেও হয়ত বিচার করা উচিত মমত্বের সঙ্গে, তাঁদেরকেও সেই গ্লানি থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করা কি নতুন ভারতের কর্তব্য নয়? কিন্তু কিসের পরাজয় আর কোন্ গ্লানি? এর উত্তরটি মনস্তাত্ত্বিক।
বামপন্থীরা গর্বের সঙ্গে বলে থাকেন যে সেলুলার জেলে যেসব বিপ্লবীর নাম আছে, তাঁদের একটি বড় অংশ পরবর্তীতে কম্যুনিস্ট মতাদর্শ গ্রহন করেছিলেন। এ কথা অসত্য নয়, কিন্তু বোধ করি গৌরবেরও নয় এবং কম্যুনিস্টরাও মনের গভীরে তা জানেন। সেলুলার জেলে কম্যুনিজমের আদর্শে দীক্ষা দেওয়া হয়েছিল জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের। কম্যুনিস্ট মতাদর্শের পত্রপত্রিকা ও চিঠিচাপাটির অবাধ জোগান ছিল সেখানে। উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের স্বার্থে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের মধ্যে হিন্দু জাতীয়তাবাদের আগুন নিভিয়ে কম্যুনিজম নামক একটি অলভ্য লক্ষ্যের দিকে তাঁদের নিশানা ঘুরিয়ে দেওয়া। এ ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের এক ধুরন্ধর, সুপরিকল্পিত ছক। আগ্নেয় বিপ্লবীদের মধ্যেকার ভারতীয়ত্বের স্পিরিটকে চিরতরে ভোঁতা করে, ভারতীয়দের আত্মমর্যাদাবোধ ও আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেওয়ার জন্য কম্যুনিজমের আদর্শকে বৃটিশ ব্যবহার করেছিল এক অমোঘ মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র হিসেবে, যা মানুষের মস্তিষ্ককে প্রোগ্রাম করে দেয় এক বিশেষ ফর্ম্যাটে, যাতে মানুষ তার স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। চোখের ঠুলির মত, এ হল অনেকটা মগজে ঠুলি পরানো।
এর ফলে সেলুলার জেলে ঢোকার সময় যাঁরা জাতীয়তাবাদের আগুন বুকে নিয়ে ঢুকেছিলেন, বেরোনোর সময় তাঁদের অনেকেই বেরিয়েছিলেন কম্যুনিস্ট মতাদর্শ নিয়ে। কিন্তু এ যে আদতে বৃটিশের কাছে তাঁদের পরাজয়, সে কথা বুদ্ধি দিয়ে বুঝলেও, অন্তর দিয়ে মানতে হয়ত কষ্ট হয় তাঁদের অনেকেরই। এই সেই পরাজয়ের গ্লানি, যে গ্লানি থেকে মুক্ত হতে কম্যুনিজমের আদর্শ প্রচারের পাশাপাশি সাভারকরকে ছোট করার প্রয়োজনীয়তাও হয়ত তাঁরা অনুভব করেন। যাঁরা সেলুলার জেলে থাকাকালীন কম্যুনিস্ট হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের অন্তরাত্মা জানে যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মনস্তাত্ত্বিক আক্রমণকে প্রতিহত করতে তাঁরা পারেন নি। তাঁদের সচেতন মনে হয়ত বা সেই পরাজয়ের বোধ নেই, বরং আছে কম্যুনিজমের আদর্শ সম্বন্ধে প্রকট গর্ববোধ। কিন্তু সচেতনমনের সেই গর্ববোধের আড়ালে তাঁদের অবচেতনের গভীরে নিশ্চিতভাবেই লুকিয়ে আছে হেরে যাওয়ার যন্ত্রণা। সে হয়ত তাঁরা নিজেরাও সম্যক জানেন না। কিংবা হয়ত জানেন! সেই পরাজয়ের গ্লানি থেকে মুক্তি পেতেই হয়ত শুষ্ক, প্রেক্ষিতহীন (এবং সেই কারণেই অর্থহীন) কিছু তথ্যের ভিত্তিতে সেই মানুষটিকে ছোট করতে চান তাঁরা, যিনি সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর জেলবন্দী থেকেও প্রবল মনস্তাত্ত্বিক সেই আক্রমণকে প্রতিহত করে হিন্দু জাতীয়তাবাদের আগুনকে বুকের মধ্যে ধরে রাখতে পেরেছিলেন।
বীর সাভারকরকে কম্যুনিজমের আদর্শে বিশ্বাসী করে তুলতে বৃটিশ পারে নি। এমন আন্দাজ করা কি অযৌক্তিক হবে যে কম্যুনিজমের মন্ত্রে তাঁকে দীক্ষিত করে তুলতে পারলেই হয়ত বৃটিশ সরকার মুক্তি দিত তাঁকে? কিন্তু দীর্ঘ পঁচিশ বছরের প্রয়াসেও তারা যেহেতু তা পারে নি, সেই কারণেই হয়ত তাঁর ক্লেমেন্সি পিটিশন নামঞ্জুর হয়েছে বার বার! কম্যুনিজমের ব্রেইনওয়াশ সম্পন্ন হলেই হয়ত অন্যদের মত সাভারকরও মুক্তি পেতেন আরও আগেই। কিন্তু তা হয় নি। সেই ব্রেইনওয়াশ, সেই ভয়াবহ মনস্তাত্ত্বিক ফর্ম্যাটিং পঁচিশ বছর যাবৎ রোধ করে কৌশলে তাদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর। তাঁর ‘বীর’ত্বের এ-ও কি আর এক পরোক্ষ প্রমাণ নয়?
তাই প্রশ্ন জাগে, সাভারকরের ওপর কম্যুনিস্টদের রাগের অন্যতম কারণ কি এই যে, যে আক্রমণ প্রতিহত করতে কম্যুনিস্টরা পারেন নি, সে আক্রমণকে ব্যর্থ করেছিলেন সাভারকর? তবে কি তাঁদের এ ক্ষোভ আদতে সাভারকরের প্রতি নয়, বরং নিজেদের প্রতি? এ কি তাঁদের নিজেদের পরাজয়ের, মনস্তাত্ত্বিকভাবে নিজেদের আত্মসমর্পণের গ্লানি? নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই কি সাভারকরের সাফল্যকে ছোট করে দেখানোর নিরন্তর বৌদ্ধিক অপচেষ্টায় রত থাকতে হয় তাঁদেরকে?
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কার্যকলাপে নিজেকে আর না জড়ালেও পরোক্ষভাবে নিজের চিন্তাভাবনা ও লেখার মাধ্যমে নিজের জীবনদর্শন ও প্রকৃত হিন্দু জাতীয়তাবাদ ক্রমাগত অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করে গিয়েছেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর। সেইজন্যই কি কম্যুনিস্টরা নিজেরা বৃটিশ stooge হওয়ার আত্মগ্লানি ঝেড়ে ফেলার উদ্দেশ্যে সাভারকরকে ছোটো করতে চেয়েছেন? অনেকটা— “পেঁচা রাষ্ট্র করি দেয় পেলে কোনো ছুতা, জানো না মোর সাথে সূর্যের শত্রুতা”—ধরণের মানসিকতা নিয়ে? নতুন ভারতের উচিত বিনায়ক দামোদর সাভারকরের আদর্শকে সামনে রেখে আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকা কম্যুনিস্টদেরও গ্লানিমুক্তির পথের সন্ধান দেওয়া। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেদিনের সে পরাজয় ভুলে নতুন ভারত গঠনের পথে এগোতে হবে সকলকে।
দেবযানী ভট্টাচার্য্য (Debjani Bhattacharyya)