বালাকোটে বায়ুসেনার আক্রমণ হানার বহু আগে থেকেই আমি দৃঢ় কণ্ঠে বলে আসছি ২০১৯-এর নির্বাচনে মোদী ২০১৪-এর ফলাফলেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাবেন। জয় সম্পর্কে আমার নিশ্চয়তার কারণ কতকগুলি বিষয়ের মধ্যে আবদ্ধ রয়েছে।
প্রথমটি তো মোদী স্বয়ং, তা আর বলে দিতে হয় না। এ বিষয়ে কিছু দিল্লিকেন্দ্রিক সাংবাদিক বা বুদ্ধিজীবী যাই বলুন না কেন মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে তার জনপ্রিয়তা অটুট। সারা বছর ধরে রেডিয়ো প্রোগ্রাম করা, নিরন্তর সোশ্যাল মিডিয়ায় জুড়ে থাকা, অজস্র অনুষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি বারবার সফলভাবে সাধারণ দেশবাসীকে বোঝাতে পেরেছেন যে তিনি একজন যথার্থ আন্তরিক, কঠিন পরিশ্রমী ও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম প্রধানমন্ত্রী। কিছু কিছু মানুষের তাঁর পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনেকক্ষেত্রে পালিত না হওয়ার কারণে ক্ষোভ নিশ্চয় আছে। কিন্তু কারুরই তার দেশ ও দেশের নাগরিকদের ওপর অটল দায়বদ্ধতা নিয়ে কোনো সন্দেহ আছে বলে মনে হয় না।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো মোদীর মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাওয়ার সহজাত অফুরন্ত ক্ষমতা। সকলেই মানবেন এই বিরল বৈশিষ্ট্যই স্বাধীনোত্তর ভারতে তাঁকে একজন অন্যতম সেরা নির্বাচনী প্রচারবিদ হিসেবে মান্যতা দিয়েছে। যিনি হাতেনাতে ফল দেখাতে পারেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারযুদ্ধে তিনি দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থেকে প্রচার করেছিলেন। কয়েকশো সভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। আজ ৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও তার উদ্যমে কোনো ভাটা পড়েনি। ১৫০টি সভার পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই নির্ধারিত হয়ে গেছে। আরও বহু ভাবনা চিন্তার স্তরে রয়েছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে তিনি আর একবার নির্বাচনী লড়াইটিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মার্কিনি কায়দায় নিয়ে যেতে চান। তৃতীয় যে সুবিধেটা তার দিকে যাচ্ছে সেটা হলো ভারতীয় জনতা পার্টির জোট বজায় রাখার সফল কৌশল। বলতে দ্বিধা নেই ২০০৪ সালে করা ভুল থেকে বিজেপি শিক্ষা নিয়েছে। সেই নির্বাচনের ঠিক আগেই দল কিছু কিছু জোটসঙ্গীকে দুমদাম ছেঁটে ফেলার কিছুটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ডিএমকে-কে ছেড়ে দেওয়ার ফলে দল সংসদে ১৪ জন ডিএমকে সাংসদের সংখ্যা থেকে বঞ্চিত হয়। এবার কিন্তু বিজেপি জোটের গুরুত্ব কোনোভাবেই অস্বীকার করেনি। প্রয়োজনে তারা নিজেদেরকে নমনীয় করেছে অর্থাৎ স্বার্থ ছেড়ে দিয়েও পুরনো জোটসঙ্গীর ইচ্ছে পূরণ করেছে। দরকারে নতুন কিছু ছোটো দলকেও টেনে এনেছে। চতুর্থত, এনডিএ-কে প্রভূত সাহায্য করছে একটি খাপছাড়া ও সম্পূর্ণ নির্বাচনী প্রস্তুতিহীন বিরোধী জোট। কংগ্রেস ও বহুবিধ আঞ্চলিক দলগুলির পরস্পরের মধ্যে এমন কোনো ‘কমন’ বৈশিষ্ট্য নেই শুধুমাত্র অন্ধ মোদী বিরোধিতা ছাড়া যা তাদের একসূত্রে বেঁধে রাখতে পারে। আর আদৌ যদি কিছু থেকে থাকে তা যথেষ্ট নয় কেননা বিএসপি-র মায়াবতী ইতিমধ্যেই রাহুল গান্ধীর মুণ্ডপাত করছেন। তৃণমূলের মাথা মমতা ব্যানার্জিও তার আক্রমণের বাইরে থাকছেন না। বিরোধী দলগুলির মধ্যে একমাত্র কংগ্রেসের একটি জাতীয় উপস্থিতি আছে। মনে পড়ে আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগে ২০১২ সালে আমি ও ড, জগদীশ ভগবতী “The bell tolls on India’s Congress Party’ শিরোনামের এক নিবন্ধে লিখেছিলাম “নেহরু-গান্ধী ব্রান্ডের আবেদন নষ্ট হয়ে গেছে। এর ফলে ২০১৪ সালে কংগ্রেসের নির্বাচনী সাফল্যের সম্ভাবনা অলীক।” আজকেও বলছি গল্পটা আদৌ পাল্টায়নি। নজর করলেই দেখা যাবে বিগত ৫ বছরে কংগ্রেস জনতার মধ্যে তার প্রভাব বাড়াতে কোনো পরিকল্পনাই নেয়নি। জাতীয় দল হিসেবে কোনো জাতীয় এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেনি, যা আদতে একটি প্রয়োজনীয় নির্বাচনী প্রচারের বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারে। এরই প্রত্যক্ষ পরিণতিতে দলে নীচু স্তরে কাজ করার কর্মীর একান্ত অভাব। রাহুল গান্ধীকে তাই জনতার মনযোগ আকর্ষণ করতে তার প্রচার কেবলমাত্র ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগানের ওপরই দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়েছে। হ্যাঁ, বহু বিলম্বে তিনি নির্দিষ্ট দরিদ্র শ্রেণীর জন্য একটি সরকারি রাজস্বের পক্ষে সম্পূর্ণ অবাস্তব এক নগদ টাকা পাঠানোর প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছেন। কিন্তু আমরা জানি কর্মহীন, প্রকল্পহীন অর্থপ্রদান কখনই কোনো নীতিগত পরিকল্পনার বিকল্প হতে পারে না। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে মোদী কায়মনোবাক্যে দেশ থেকে দুর্নীতির ধ্বংস চাইছেন এবং সর্বশক্তি ও দায়বদ্ধতা নিয়ে তিনি এ বিষয়ে পরিকল্পনা থেকে আইন সবই করেছেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ গালি মানুষের মধ্যে রাহুলের প্রতি বিতৃষ্ণার সৃষ্টি করছে। মোদীর এবারের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার এটি পঞ্চম কারণ অনায়াসে হতে পারে। বিগত ৫ বছরের শাসনকালে তার সরকারের ওপর একটিও দুর্নীতির কলঙ্ক যে লাগেনি তা কিন্তু বিশাল আত্মশ্লাঘার বিষয়। এটি নিঃসন্দেহে সরকারের বড়ো কীর্তি।
একথা কেউই বলছে না যে, মোদী দেশ থেকে দুর্নীতিকে আমূল উৎপাটন করে ফেলেছেন। কিন্তু মানুষের মনে তিনি যে একজন দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপোশহীন যোদ্ধা সেই ভাবমূর্তি তিনি নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। স্বাধীনোত্তর ভারত ইতিহাসে এমন ন্যায়পরায়ণ যোদ্ধা ভারত আর পায়নি। তাঁর এই নিরন্তর লড়াইয়ের ফলে সরকারের অনেক কাজেই digitisation ব্যবস্থা চালু হয়ে গিয়েছে। ফলে ছোটোখাটো কাজ পেতে সাধারণ মানুষকে যে ‘হাতগরম’ করার টাকা দিতে হতো তার থেকে তারা বেঁচেছে। অনেক সরকারি অধিকর্তাই এই ভিজিটাইজেশনের ধাক্কায় এমন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছেন।
পঞ্চমত, যে কারণটি মোদীকে নির্বাচনে নির্ণায়ক বিজয় দেবে তা হলো মানুষের নিত্যদিনের প্রয়োজনে আসে এমন প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তাঁর কাজের সাফল্য। মানুষের সমস্যাগুলির সমাধান করা। এই সূত্রে অথনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে বিগত ১৫ বছরে কেউ হাত দেয়নি এমন তিনটি নীতিগত সাহসী সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন। Insolvency & Bankruptcy Code, GST, Direct benefit Transfer তারই অঙ্গ। সাধারণ মানুষের জীবন ছুঁয়ে গেছে জনধন যোজনা, উজ্জ্বলা, স্বচ্ছ ভারত ও আধার। এই বিশাল দেশে এই ধরনের বিপুলাকার সব প্রকল্পের সাফল্য প্রমাণ করে তিনি বড়ো মাপের কাজ করার যোগ্য ও ক্ষমতাধর।
পরিকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁর সরকার অভাবনীয় বৃদ্ধির স্বাক্ষর রেখেছে। এর ফলে ক্ষমতায় আসার প্রথম দিকে তাকে খাটো করার জন্য সেই সমস্ত সমালোচক যারা সর্বদাই ইউপিএ সরকারের থেকে দ্রুতগতিতে কাজের সাফল্যের কথা বলে গলা ফাটাতো তারা যোগ্য জবাব পেয়ে যায়। রাস্তা নির্মাণ, রেলপথের বৃদ্ধি, এয়ারপোর্ট থেকে জলপথে পরিবহণের মতো সকল ক্ষেত্রে লক্ষণীয় উন্নতি দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, আজকের তারিখে অজস্র রেলওয়ে লাইন পাতা থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরির বরাত দেওয়া রয়েছে। এগুলির দ্রুত সম্পাদন পরিকাঠামো ক্ষেত্রের চেহারাই আগামীদিনে বদলে দেবে।
সর্বোপরি, ছোটো ব্যবসায়ী ও শহুরে নাগরিকদের মধ্যে পরম্পরাগত ভাবে বিজেপির যে জনাধার ছিল তাকে অতিক্রম করে মোদী অত্যন্ত নিপুণভাবে গ্রামীণ অঞ্চলে কংগ্রেসের চিরাচরিত ভোটব্যাঙ্কেও থাবা বসিয়েছেন। তার শাসনকালের একেবারে প্রথমদিকেই তিনি তার বক্তব্য কাজের অভিমুখ ও সামগ্রিক পরিকল্পনাগুলির বড়ো অংশ গ্রামীণ চাষি ও গরিবদের উন্নতির জন্য নির্দিষ্ট করেন। কৃষকদের জন্য তিনি ফসল বিমার সূচনা করেন। জমিতে যাতে পর্যাপ্ত সেচের জল যায় তাঁর ব্যবস্থাও নেন। একই সঙ্গে সরকারের তরফ থেকে কৃষকদের জন্য বিভিন্ন খাতে যে অর্থ বা ভরতুকি পাওনা হয় তা সরাসরি ব্যাঙ্ক খাতায় পাঠানো শুরু করেন। তিনি শুধু মাত্র কৃষিপণ্যের যথার্থ বিপণনের জন্য যে e-national agricultural market-এর সুচনা করেন তা ভারতে প্রথম। গ্রামীণ গরিবদের জন্য সামগ্রিকভাবে তিনি ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নয়ন, রাস্তা ঘাট, গ্রামীণ বৈদ্যুতিকরণ, আবাস নির্মাণ, শৌচালয় থেকে গৃহস্থালীতে ধোঁয়াহীন রান্নার গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করে গ্রামীণ জীবনে বাঁচার স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আসেন। Employment Gurantee Scheme-এর রূপায়ণও এরই মধ্যে পড়ে। আমি নিশ্চিত, মানুষের জন্য এত ধরনের কল্যাণকর কাজের ফল হিসেবে একটি বিপুল নির্বাচনী জয় তার জন্য অপেক্ষা করছে।
অরবিন্দ পানাগড়িয়া