আমাদের বুদ্ধিজীবীরা মাঠে নেমেছেন, গত ১২ এপ্রিল। প্রথমে শােনা যাচ্ছিল, অন্তত সােশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল বাংলা কবিতা সাম্রাজ্যে ‘খােদা’ রূপে খ্যাত মাননীয় শঙ্খ ঘােষ মিছিলে নেতৃত্ব দেবেন। খােদার ওপর খােদকারিটা অতুৎসাহী ‘বুদ্ধিজীবীরা’ করে ফেলেছিলেন। আসল ব্যাপার হলাে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে খােদাবাবুর বিলক্ষণ সমর্থন রয়েছে, তবে মিছিলের সামনে থাকতে তিনি নারাজ। তাই মিছিলের আহ্বায়ক হিসেবে নাম-ফাম তিনি তুলে নিয়েছেন। তা হােক, তবু মিছিল হয়েছে এবং গণতন্ত্র রক্ষার মহান দায়িত্ব, ফ্যাসিবাদ থেকে দেশকে মুক্ত করার দায়িত্ব তারা স্বকন্ধে তুলে নিয়েছেন দেখে যারপরনাই আনন্দিত হওয়া যায়।
ঠিক একই আনন্দ আমরা ১৯৪২ সালে উপভােগ করেছিলাম। মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধী দেশজুড়ে ‘ইংরেজ ভারত ছাড়াে’ ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজ ভারত ছাড়ুক সেটা মােটেও ফ্যাসিবাদ বিরােধীরা চায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে জোটশক্তির পক্ষে ইংরেজরা অক্ষশক্তির দুই মাথা অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি বাহিনী, বেনিটো মুসােলিনীর ফ্যাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। আর ইংরেজদের সহযােগী কে ছিল জোসেফ স্ট্যালিন, রাশিয়া, চিয়াং কাইশেকের চীন এবং বলাই বাহুল্য ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের আমেরিকা।
এসব ইতিহাস সবাই জানেন। লেনিন যুগ তখন অতীত, মাও যুগ সমাগত। এরই মাঝে স্ট্যালিনের রাশিয়া আর কিছুটা কাইশেকের চীনের সঙ্গে একত্মবােধ করা কমিউনিস্ট নামক অতি প্রগতিশীল একটি গােষ্ঠী ইংরেজ ভারত ছাড়াে ডাক শুনে ভারী উত্তেজিত হয়ে পড়ল। ঠিকই তাে, একে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তার ওপর তাদের পিতৃ-মাতৃসম চীনের সংগ্রামী লড়াই ইংরেজ যাতে ভারত না ছাড়ে তার জন্য গান্ধীজী ওই আন্দোলনকে পেছন থেকে ছােরা মারতে বিশেষ দ্বিধা করেনি।
আসলে পুরােনাে কাসুন্দিগুলাে ঘাঁটতে হয় যখন দেখি আজও এরা ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি শােনে। কেমনতর ফ্যাসিবাদ? এই যেমন ধরুন ভারতীয় সংসদে হানাদার ফাঁসির আসামি আফজল গুরুর মহাসমারােহে জন্মদিবস পালনে কেউ বাধা দিলে সেটি অবশ্যই চরম ফ্যাসিবাদী কাজ। তারপর ধরুন গিয়ে উরির হামলার পর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বা পুলওয়ামার পর বালাকোটে এয়ার স্ট্রাইক, নেহাত প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয় ফ্যাসিবাদী না হলে এমন কাজ কেউ করে না। একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক, ১৯৬২ কিংবা ১৯৭১। ‘৬২-তে চীন ভারত আক্রমণ করল। মাও-জে-দঙের সাম্রাজ্যবাদী চীন। ভারতের তাে উচিত ছিল নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করা, বিশেষ করে নেহরুর মতাে ফ্যাসিবাদ বিরােধী প্রধানমন্ত্রী যখন স্বমহিমায় গদিতে আসীন।
চীনের ভারত অধিগ্রহণ না করার দুঃখে ফ্যাসিবাদ-বিরােধীরা কত-শত স্লোগান তুললেন ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’, ‘বাংলা হবে ভিয়েতনাম’ ইত্যাদি। যাক পুরােনাে কাসুন্দি ঘেঁটে আর কী হবে। তবে এই যে আজকে ‘টুকরে টুকরে’ গ্যাঙের আবির্ভাব হয়েছে, যারা ‘কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি, মণিপুর মাঙ্গে আজাদি’ বলে স্লোগান দেয়, যারা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ধর্ষক সাজাতে চায়, মনে রাখবেন এদের সাংস্কৃতিক পূর্বসূরীরাই ৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে খানসেনাদের অমানবিক, পাশবিক অত্যাচারের প্রতিবাদে টুঁ শব্দটি করেনি। অবশ্য সবটাই ফ্যাসিবাদ বিরােধিতার মহান উদ্যোগ।
বাম আমলে প্রতিনিয়ত গণতন্ত্র যখন ভূলুণ্ঠিত হতাে, ফ্যাসিবাদ বিরােধিতার সুমহান তাড়নায় এই ধরনের বুদ্ধিজীবীদের মুখে কুলুপ পড়তাে। বাম-জমানার প্রথম দিকে এরা ‘জ্যোতি’তে উদ্ভাসিত হয়ে শাসকের তাঁবেদারি করত, পরের দিকে এঁরা ‘বুদ্ধি’জীবী হলেন। এখন মমতায় ঢাকা আছে। ‘সুবােধ’ কবি, ‘শ্রীজাত’কবি–“শঙ্খ’ ধ্বনিতে লক্ষ্য করুন, বিষয়টি দিব্যি বুঝে যায়। এঁদের কেউ প্রকাশ্যে দিবালােকে গাে-মাংস খান, কেউ বা ত্রিশূলে কন্ডােম পরান, আবার কেউ তার কন্যারত্নের মাধ্যমে ‘কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদের মনের কথাটি বলিয়ে নেন।
‘ফ্যাসিবাদ’ বিরােধী লড়াইটাও এদের ইস্তাহারে এরা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ‘খােদা’ কবি বলেছেন ফ্যাসিবাদী হইল গিয়ে বিজেপি, একে পরাস্ত করাই এখন একমাত্র লক্ষ্য। দুঃখ হয়, হাসিও পায়। রাজনীতি করা প্রতিটি ভারতীয়ের গণতান্ত্রিক অধিকার, এঁরা করুন না। কিন্তু নিরপেক্ষতার মুখােশ পরে কেন, ‘ফ্যাসিবাদ’-এর ভ্রূকুটি দেখিয়ে কেন? নাকি তথাকথিত ফ্যাসিবাদ বিরােধীদের আসল ফ্যাসিস্ট মুখটিই প্রকাশ হয়ে পড়বে? নাকি এও প্রমাণ হবে সেলিব্রেটি হলেও মুসলমান পরিচয় আর সেকুলারিজম নামক হিন্দুদের দিগ্ভ্রান্ত করার কৌশলের আজও নিরন্তর প্রয়ােগের চেষ্টা হচ্ছে। মােদী হঠাও, দেশের কারাের হিম্মত না থাকলে মাসুদ আজহার তাে আছেই। বুদ্ধিজীবীদের মগজাস্ত্রে শান পড়েছে মাসুদ লাও-মােদী হটাও। চীন ভরসা।
বিশ্বামিত্রের কলম