অমর প্রেমের ভীলসার ইতিহাসের আনাচে কানাচে – পর্ব ২

পর্ব_২

এই তীর্থ-দেবতার ধরণীর মন্দির-প্রাঙ্গণে

যে পূজার পুষ্পাঞ্জলি সাজাইনু সযত্ন চয়নে

সায়াহ্নের শেষ আয়োজন; যে পূর্ণ প্রণামখানি

মোর সারা জীবনের অন্তরের অনির্বাণ বাণী

জ্বালায়ে রাখিয়া গেনু আরতির সন্ধ্যাদীপ-মুখে

সে আমার নিবেদন তোমাদের সবার সম্মুখে

“ঋক্-রচয়িতা ঋষি ছন্দে মন্ত্ররচনা করিয়া গিয়াছেন, এই মন্দিরও পাথরের মন্ত্র; হৃদয়ের কথা দৃষ্টিগোচর হইয়া আকাশ জুড়িয়া দাঁড়াইয়াছে।

মানুষের হৃদয় এখানে কী কথা গাঁথিয়াছে? ভক্তি কী রহস্য প্রকাশ করিয়াছে? মানুষ অনন্তের মধ্য হইতে আপন অন্তঃকরণে এমন কী বাণী পাইয়াছিল যাহার প্রকাশের প্রকাণ্ড চেষ্টায় এই শৈলপদমূলে বিস্তীর্ণ প্রান্তর আকীর্ণ হইয়া রহিয়াছে।”

ভীলসা শহরের পাথরের দুর্গের ধ্বংসাবশেষের পার্শ্বে বেতোয়া নদী বয়ে চলেছে। নদীর গর্ভের বাঁধানো পথ ধরে নদী পার হয়ে তিন মাইল মেঠো পথ দিয়ে #উদয়গিরি গুহা গহ্বর। বহু দূর হতে উদয় গিরির দৃশ্য দেখা যায়। গিরিগাত্র খোদিত করে প্রস্তুত ছোট বড় আঠারোটি গুহার চিন্হ এখনও দেখতে পাওয়া যায়। একটি গুহার অভ্যন্তরের প্রাচীর গাত্রে উৎকীর্ণ লিপি হতে গুহাটির নির্মাণ কাল ৮২ গুপ্ত সংবৎ বা ৪০১ – ৪০২ খ্রিস্টাব্দ বলে জানা যায়। সমস্ত গুহার গঠন ও শিল্পধারা হতে গুহাগুলিকে গুপ্তযুগে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। 


সনাতন ধর্ম এবং তাঁর দুই মার্গ বৌদ্ধ ও জৈন – তিনটি সাধনার ফল উদয়গিরির গুহায় নানা মূর্তির মধ্যে #প্রথম গুহাটি পাহাড়ের তলদেশে , ইহা সর্বাপেক্ষা বৃহৎ, সমস্ত ঘরটি পাহাড়ের অভ্যন্তরে অবস্থিত । মেঝেটির আয়তন দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থে  বিশ হাত #সমচতুষ্কোণ। গুহার ছাদ আসল পাহাড় ; পর্বত কেটে সমতল ছাদের তলে খোদিত চতুষ্কোণবিশিষ্ট পাঁচটি প্যানেল ছাদের শোভা বর্ধন করছে। প্রতিটি প্যানেলর মধ্যে একটি করে পদ্মফুল খোদিত রয়েছে। ছাদটি সমস্তই গিরিবপু , তাই তার সংস্কারের প্রয়োজন নেই, ধ্বংস হবার ভয় নেই এবং অভ্যন্তরে জল ইত্যাদি পড়ে নষ্ট হবার আশঙ্কা নেই। গুহার অভ্যন্তরে প্রাচীর গাত্রে দেবনাগরী অক্ষরে কয়েকটি ছত্র উৎকীর্ণ আছে। গুহার দ্বারে সম্মুখে একটি অলিন্দ ছিল।।স্তম্ভের ভগ্নাবশেষ হতে স্তম্ভের কারুকার্যের সূক্ষ্মধারার পরিচয় পাওয়া যায়।

#দ্বিতীয় গুহাটির আয়তন দৈর্ঘ্যে বিশ ফুট ও প্রস্থেও বিশফুট। এটিও সম্পূর্ণ পাহাড়ের অভ্যন্তরে নির্মিত। একটি মাত্র দ্বার ভিতরে প্রবেশের জন্য রয়েছে। 


#তৃতীয় গুহাটি যদিও ক্ষুদ্র , ৮’ X ৬’ ফুট মাত্র। তথাপি এর মধ্যে একটি সুদর্শন চতুর্ভুজ নারায়ণ মূর্তি খোদিত রয়েছে। এই মূর্তিটি দর্শন করলে দর্শকের হৃদয় ভক্তি ও মাধুর্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাহ্য জগতের কোন চিন্তা থাকে না। শিল্পী তাঁর প্রাণের অব্যক্ত ভাবের প্রেরণাকে মূর্ত করে তুলেছেন তাঁরই সাধনার বলে। মনে ভাব ব্যক্ত করতে পারাতেই তো শিল্পী সাহিত্যিকদের কৃতিত্ব। 


#চতুর্থ গুহার প্রবেশ দ্বারের চৌকাঠে অদ্যাপি অটুট আছে। গুহার মধ্যে বেদীর উপর খোদিত ত্রিনয়ন স্বয়ম্ভু শিব লিঙ্গ অবস্থান করছে। দ্বারের বাম বহির্পাশ্বে পর্বতগাত্রে ছয় ফুট উচ্চ গণপতির অপূর্ব মূর্তি বিরাজিত। গজেন্দ্রবদন  লম্বোদর সুন্দর সিদ্ধিদাতার মূর্তিটি পরম রমণীয় , গ্রাম্য নরনারীরা শুভদিনে এখানে এসে সিদ্ধিলাভের আশায় সিদ্ধিদাতার গাত্রকে সিঁদুর চর্চিত করে যান।


#পঞ্চম গুহাটি মহাকালের নিয়মে ধ্বংসোম্মুখ। গুহাটির বহির্গাত্রে এগার ফুট উচ্চ বিরাট বরাহ মূর্তি এখনও অটুট ও অম্লান রয়েছে। শিল্পী তাঁর সকল সত্ত্বা দিয়ে সৃষ্টি কর্তার বিশাল , প্রচন্ড মূর্তির কল্পনা এই বরাহ অবতার মূর্তিতে প্রকাশ করবার প্রয়াস প্রয়াস পেয়েছেন। মুখ গহ্বরে প্রায় প্রবিষ্ট পঞ্চ মূর্তি শ্ৰী ভগবানের অনন্ত মহিমা প্রকাশ করছেন। তাঁর মস্তকোপরি অনন্তনাগ ফণা বিস্তার করে বরাহাবতারত্ব প্রকাশ করছেন। এই গুহা বরাহ গুহা না খ্যাত।


#ষষ্ঠ গুহার প্রবেশদ্বারের উপর বিশাল তরঙ্গে ভেসে শত শত নরনারী যেন অসীম অনন্তের অন্বেষণে যাচ্ছেন। তরঙ্গের উত্তাল নৃত্য তিনটি স্তরে খোদিত রয়েছে। এক একে স্তর যেন এক এক নরনারীর ঢেউ।

  দুইটি  স্তরে কুড়িটি করে এবং নিম্ন স্তরে বত্রিশটি নারী মূর্তি তরঙ্গের ন্যায় বহমান।শিল্পী দ্বারের দুই পাশে পাপীদের হৃদয়ে ভীতি সঞ্চার করার নিমিত্ত যেন , ভয়ঙ্কর দুই দ্বারপালকে খোদিত করে নির্মাণ করেছেন।
#সপ্তম গুহাটি বীর সেনা বা Ministry of war নিৰ্মাণ  করেন। এই কথা পর্বত গাত্রে উৎকীর্ণ হয়েছে।  গুহা অভ্যন্তরে দেবী দশভুজা সকল প্রাণী কুলকে অভয় প্রদান করছেন। গগনচন্দ্রাতপ  তলে খোদিত প্রস্ফুটিত পদ্ম গুহার শোভাবর্ধন করছে।


অষ্টম হাতে দ্বাদশ পর্যন্ত পাঁচটি গুহা আয়তনে অত্যন্ত ছোট। এগুলি সাধকদের বাসের জন্য নির্মিত হয়নি। প্রত্যেকের মধ্যে একটি করে দেব অথবা দেবীমূর্তি বিরাজ করছেন।


উদয়গিরি গুহার মধ্যে #ত্রয়োদশ গুহাটি সর্বাপেক্ষা চিত্তাকর্ষক। এই গুহাটি একটি বৃহৎ গুহার ধ্বংসাবশেষ । তিন দিক ধ্বসে গিয়েছে। একদিকের পর্বতগাত্রে অনন্ত শয্যায় শায়িত রয়েছেন শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম চতুর্ভুজ বিশাল নারায়ণ মূর্তি। মূর্তিটির পূর্ণ ১২ হাত বা ১৮ ফুট লম্বা এবং প্রস্থে পরিমাণ তিনহাত । নাভি হতে মৃণালদল প্রস্ফুটিত হয়েছে। তার উপরে ধ্যানরত চতুর্মুখ ব্রহ্মা অবস্থান করছেন। নভোমন্ডলে নানা দেবতা যুক্ত করে নারায়ণের ল স্তব করছেন। নারায়ণের মস্তকের উপর অনন্তনাগ তাঁর সহস্র ফণা বিস্তার করে বসে আছেন। আর এই নাগের কুণ্ডলীকৃতঅবয়বে শ্রীভগবানের অনন্ত শয্যা রচিত হয়েছে।  কঠিন শিলার উপর আঁচড় দিয়ে দক্ষ শিল্পী ভগবানের অসীম অনন্ত শক্তি ও মহিমার বিকাশ ঘটিয়েছেন। ওই মহিমামণ্ডিত ঐশভাব যুক্ত পরম স্নিগ্ধ নারায়ন মূর্তি শিল্পীর অপূর্ব ভক্তি ও শক্তি দিয়ে পাথরের ফুটিয়ে তুলেছেন।


ভারতীয় শিল্পীগণ বাস্তব আদর্শ সম্মুখে রেখে কখনো খোদন কার্য করতেন না। শিল্পীর চিত্তে যে অবব্যক্ত ভাবের উদয় হতো তাকেই তাঁরা কল্পনা ও সৃষ্টি শক্তির সাহায্যে রূপ প্রদান করতেন। শিল্পী তখন প্রস্তরে জীবন প্রদান করতেন।


নিম্নভাগে দুটি ভক্ত তাদের ভক্তিপূর্ণ অর্ঘ্য করে সেই বিশাল দেবতার চরণে উজাড় করে দিচ্ছেন। আত্মনিবেদনের এমনই ভাব প্রস্তর মূর্তি দুটিতে ফুটে উঠেছে, যে তা দেখলে সেই মঙ্গলময়ের চরণে আত্মনিবেদন করতে সত্বই প্রবৃত্তি হয়। 


একটি প্রকাণ্ড নির্মম কঠিন পাষাণকে  জগদীশ্বরের নামে কত সাধ্য সাধনা করে , কত যত্নে ও কৌশলে তার দেহে আঁচড় দিলে তবে তা এরূপ করুণার আকার ধারণ করে ,এত আনন্দের ছটা ব্যক্ত করে সে কথা চিন্তা করলেও হতবাক হতে হয়। সুদক্ষ শিল্পী তাঁর সংযম ও  একাগ্রতার দ্বারাই অপূর্ব মনোরম পরিকল্পনায় প্রস্তর খণ্ডে তোলে আনন্দের মূর্তি ,পাষণে দেয় প্রাণ। 


চতুর্দশ হতে সপ্তদশ পর্যন্ত চারটি গুহার মাত্র ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান আছে। অষ্টাদশ গুহাটি পর্বতের উপরে অবস্থিত। এক সংকীর্ণ পথে কয়েকটি সোপান দিয়ে নিম্নে অবতরণ করে এই গুহাতে প্রবেশ করতে হয়। গুহার আয়তন দৈর্ঘ্য ১২ ফুট ও প্রস্থে ১৬ ফুট। জল নিষ্কাশনের পথ, স্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ ও তাদের গঠনকৌশলের পরিচয় প্রদান করে, দর্শকের মন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী এই গুহাটি জৈন সাধকের সাধনার স্থল ছিল। পর্বত গাত্রে উৎকীর্ণ লিপি থেকে তার নির্মাণ কাল ও পরিচয় পাওয়া যায়।

উদয়গিরি সংলগ্ন কাজিয়াপুরা পাহাড়ের উপরও একটি কারুকার্যমন্ডিত গুহা বর্তমান। অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের হলেও গুপ্ত যুগের সনাতনী শিল্পীর নৈপুণ্য গুহা গাত্রের ও স্তম্ভের কারুকার্যে ফুটে উঠেছে। আয়তন বৃহৎ , মূল পাহাড় কেটে অভ্যন্তরে নির্মিত ,ছাদের উপর বিশাল গিরিবপু। বহির মন্ডপের ছাদও আসল পাহাড়ের অংশ। তিন দিক উন্মুক্ত। নিচে আরতি চারকোণা সূক্ষ কারুকার্যমন্ডিত স্তম্ভ। গঠনধারা গুপ্ত যুগের শিল্পধারা অনুযায়ী। 


ভীলসা উদয়গিরির গুহাগুলি খুব পরিচিত না হলেও এর কারুকার্য এবং শিল্প সাধনা উচ্চাঙ্গের। সনাতনী শিল্পীদের দক্ষতা গুহা গাত্রে খোদিত মূর্তিগুলিতে ফুটে উঠেছে । সকল শ্রেণীর দর্শক এই গুহা গুলি দেখলে আনন্দ এবং তৃপ্তি পাবেন।


  কানপুর হতে যে রেললাইন ঝাঁসীর মধ্য হতে ভূপাল গিয়েছে , তারই মধ্যে ভীলসা স্টেশনে নেমে এক্কা কি মোটর যোগে বেতুয়া নদী পার হয়ে পশ্চিমে দুই মাইল গমন করলে প্রাচীন বেশনগর বা বিদিশাকে পাওয়া যায়। সেখানেই পূর্ব পর্ব উক্ত  হিলিওডোরাসের স্তম্ভ অবস্থিত। এখান থেকে উদয়গিরি ৮ মাইল দক্ষিণে অবস্থান করছে। 

দেবালয়শ্রেণী তার নিগূঢ়নিহিত নিস্তব্ধ চিত্তশক্তির দ্বারা দর্শকের অন্তঃকরণকে সহসা যে ভাবান্দোলনে উদ্‌বোধিত করে তোলে তাহর আকস্মিকতা, তার সমগ্রতা, তার বিপুলতা, তার অপূর্বতা প্রবন্ধে প্রকাশ করা কঠিন-বিশ্লেষণ করে খণ্ড খণ্ড করিয়া বলবার চেষ্টা করতে হবে।


 মানুষের ভাষা এইখানে পাথরের কাছে হার মানে–পাথরকে পরে পরে বাক্য গাঁথতে হয় না, সে স্পষ্ট কিছু বলে না, কিন্তু যা-কিছু বলে সমস্ত একসঙ্গে বলে–এক পলকেই সে সমস্ত মনকে অধিকার করে–সুতরাং মন যে কী বুঝে ছিল, কী শুনল, কী পেল, তা ভাবে বুঝলেও ভাষায় বুঝতে সময় পায় না–অবশেষে স্থির হয়ে ক্রমে ক্রমে তাহকে নিজের কথায় বুঝে নিতে হয়।


বৃক্ষ ইব স্তব্ধো দিবি তিষ্ঠত্যেকঃ।

হে মোর অতিথি যত। তোমরা এসেছ এ জীবনে

কেহ প্রাতে, কেহ রাতে, বসন্তে, শ্রাবণ-বরিষনে;

কারো হাতে বীণা ছিল, কেহ বা কম্পিত দীপশিখা

এনেছিলে মোর ঘরে; দ্বার খুলে দুরন্ত ঝটিকা

বার বার এনেছ প্রাঙ্গণে। যখন গিয়েছ চলে

দেবতার পদচিহ্ন রেখে গেছ মোর গৃহতলে।

আমার দেবতা নিল তোমাদের সকলের নাম;

রহিল পূজায় মোর তোমাদের সবারে প্রণাম।

সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. ভারতের দেব দেউল
২. . India: The Ancient Past: A History of the Indian Subcontinent from C. 7000 BCE to CE 1200

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.