ভগবান বুদ্ধের বাণী শান্তিকামী মানুষ আজও সমান ভাবে স্মরণ করে

বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে বৈশাখী পূর্ণিমার পবিত্র তিথিতে গৌতমবুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব ৬২৪ অব্দে নেপালের লুম্বিনীতে জন্মগ্রহণ করেন। ভারতের বিহারে রাজ্যের গয়ার উরুবেলা গ্রামে নিরঞ্জনা নদীর পশ্চিম তীরে অশ্বত্থা বৃক্ষের নীচে বসে ধ্যানের মাধ্যমে বোধিজ্ঞান লাভ করেন এবং বুদ্ধ হন। এই পূর্ণিমা তিথিতে তিনি ৮০ বছর বয়সে ভারতের উত্তর প্রদেশের কুশীনগরে মহানির্বাণ লাভ করেন। গৌতম বুদ্ধের জীবনের এই তিনটি প্রধান ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বলেই এটি বুদ্ধপূর্ণিমা।

বুদ্ধপূর্ণিমা বৌদ্ধদের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। এই দিনে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের আবালবৃদ্ধবণিতা সকালে স্নান শেষে নতুন বস্ত্র পরিধান করে বা পরিচ্ছন্ন পোশাকে বৌদ্ধবিহারে সমবেত হন। বুদ্ধপূজার সামগ্রী, বিভিন্ন দানীয় বস্তু ও ভিক্ষুদের জন্য প্রসাদ তারা অর্পণ করেন। এসময় উপাসক উপাসিকারা বুদ্ধপূজায় অংশ নিয়ে পঞ্চশীল-অষ্টশীল গ্রহণ করে। ভিক্ষুসঙ্ঘ ও গৃহীরা আলোচনায় অংশ নেন।

দিবসের কর্মসূচির মধ্যে বিকেলে বুদ্ধের জীবন ও দর্শন নিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এমনকী মন্ত্রী এমপিরাও অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে আলোচনা সভায় অংশ নেন। বিকেলে অধিকসংখ্যায় বৌদ্ধরা বিহারে সমবেত হন। সন্ধ্যায় থাকে বিশেষ অনুষ্ঠান। বুদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শুভেচ্ছা জাপন করেন এবং তাদের সরকারি বাসভবনে বৌদ্ধদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন।

ভারত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। বৌদ্ধধর্ম সুপ্রাচীন, গৌতমবুদ্ধের জীবদ্দশায় ভারতে এই ধর্ম প্রচারিত হয়। ভারতের অতীত ইতিহাস বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির ইতিহাস। গৌতমবুদ্ধ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ৪৫ বছর ধর্মপ্রচার করেছিলেন। সমগ্র বৌদ্ধ দর্শন চারিয়ার্য সত্য, অষ্টষাঙ্গিক মার্গ ও প্রতিত্যসমুৎপাতনীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে। ভগবান বুদ্ধের বাণী ও উপদেশগুলো ত্রিপিটকে লিপিবদ্ধ আছে। এগুলোর নির্বাস ধম্মপদেও পাওয়া যায়। তার বাণীর প্রধান হলো মৈত্রী।

তিনি বলেছেন, সকল মানুষ সমান, মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নাই। তিনি মানুষের কল্যাণ কামনা করেছেন। কেবল মানুষ নয়, সকল জীবের সুখ ও মঙ্গল চেয়েছেন। তিনি বলেছেন জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক। তিনি আরও বলেছেন, হিংসার দ্বারা হিংসা জয় করা যায় না। তাকে ভালাবাসা বা মৈত্রী দিয়ে জয় করতে হয়। এই মৈত্রী হলো হৃদয় নিঃসৃত। মাতা যেমন রোগশয্যায় তার কাতরসন্তানের রোগমুক্তির জন্য স্বীয় জীবন দান করতেও পিছপা হয় না।

তিনি মৈত্রী ছাড়াও করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষার কথা বলেছেন। করুণা হলো। অপরের দুঃখে তার পাশে দাঁড়ানো, তার দুঃখ অবসানে সহায়তা করা। মুদিতা হলো অপরের গৌরবে গৌরবান্বিত হওয়া, অপরের সাফল্যে অভিনন্দন জানানো। এটা শুদ্ধ মন ছাড়া কখনই সম্ভব নয়। আজমুদিতার চর্চা করাটাই বড়ো বেশি প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ মানুষ সহজেই অপরকে বড়ো করতে চায় না। অথচ এর দ্বারা সে যে নিজেও বড়ো হচ্ছে, তা ভুলে তিনি উপেক্ষার কথা বলেছেন। সেটি হলো লাভ -অলাভ, সত্য-মিথ্যা, যশ-অশ, সুখ-দুঃখ ইত্যাদিতে অবিচল থাকা অর্থাৎ লাভে উচ্ছ্বসিত না হওয়া আবার অলাভ বা ক্ষতিতে ভেঙে না পড়া। এভাবে মনকে যে দৃঢ় করতে পারে সেই হয়। আলোকিত মানুষ, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তিনি বলেছেন, সকল প্রকার পাপকর্ম থেকে বিরত থেকে পুণ্যকর্ম সম্পাদন করতে।

বুদ্ধদেবের মহামূল্যবান আর এক উপদেশ হলো তোমার কাছে তোমার নিজের জীবন যেমন প্রিয়, অন্যের কাছে তার জীবনও তেমন প্রিয়। এই বোধটাকে নিজেদের মধ্যে উপমা হিসাবে নিলে তখন সে অন্যকে আঘাত করতে পারে না, হত্যা করতে পারে না। তিনি বলেছেন, আপনাকে দীপ করে জ্বালো–আত্মদীপো ভব। তোমার নিজের মধ্যে যে বোধিশক্তি আছে তাকে জাগাও। তিনি বলেছেন নিজেরমুক্তি, নিজের উন্নতি, নিজের সুখের জন্য নিজেকেই উদ্যোগী হতে হবে। তাই মনের অন্ধকারে যে সৎকর্ম প্রেম-প্রীতি সুপ্ত আছে তাকে জ্ঞানের আলো দ্বারা জয় করো।

তিনি বিশেষ ভাবে যে উপদেশ দিয়েছেন তা হলো ক্রোধকে অক্রোধ দ্বারা, কৃপণকেও দানের দ্বারা, মিথ্যাকে সত্যের দ্বারা জয় করো। বুদ্ধের বাণীগুলো ত্রিপিটকের ৮৪ হাজার শ্লোকের মধ্যে নিহিত আছে। বুদ্ধ সাম্যের প্রতীক, জ্ঞানের প্রতীক, মহামৈত্রীর প্রতীক। বুদ্ধ মানুষকে সত্যের পথে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। আমরা সমস্ত শান্তিকামী মানুষ আজকের দিনে এই বাণী স্মরণ করছি। তাঁর নির্দেশ বহু জনের হিত ও কল্যাণে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক। তঁর আহ্বান, এসো আমরা বৈরীদের মধ্যে অবৈরী হয়ে যারা দুঃখপ্রাপ্ত, ভয়প্রাপ্ত তাদের মাঝে দুঃখহীন ও শোকহীন হয়ে বসবাস করি।

ডাঃ প্রকাশ মল্লিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.