চীনের (China) উৎপাদন সংস্থা ভারতে এলে তার কত শতাংশ পশ্চিমবঙ্গ পাবে? একবার দেখি শর্তগুলি কতটা আমরা পূরণ করে? এখানে মনে রাখতে হবে বিনিয়োগকারীরা রপ্তানিমুখী বহুজাতিক সংস্থা l এরা মূলত জিনিস বানাবে বিদেশে বিক্রির জন্য l এরা ভারতে বিনিয়োগের পূর্বে কিছু ‘ফ্যাক্টর‘ যাচাই করে একটা তুলনামূলক বিনিয়োগ ম্যাট্রিক্স বানাবে এবং তার উপর ভিত্তি করে SWOT বিশ্লেষণ করবে l সেগুলো মোটামুটি এরকম :
- SEZ বা স্পেশাল ইকোনমিক জোন: SEZ এমন একটা স্থান যেখানে বাণিজ্য বিষয়ক বর্তমান দেশীয় আইন প্রযোজ্য নয় l কিছু নিজস্ব আইন এর জন্য প্রযোজ্য l রপ্তানি বৃদ্ধি করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও বিদেশীমুদ্রার ভান্ডার সমৃদ্ধ করাই এর মূল উদ্যেশ্য I এই জোনে বিনিয়োগকারী জমি, বিদ্যুৎ, কর বিষয়ক বিষয়ে কিছু ছাড় পান, যাতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকে l বাজারে এই চাকুরীরতদের অধিক উপস্থিতি কৃষিজাত ও শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ায় l ঠিক যেমন নয়ের দশকে সফটওয়্যার শিল্পের কর্মীরা বাজারে বাড়ি, গাড়ি, পোশাক কিনলে আবাসন, অটোমোবাইল ও বস্ত্র শিল্পে জোয়ার আসে l অপ্রত্যক্ষ ভাবে আরও চার গুন মানুষ কাজ পায় দেশীয় অন্যান্য শিল্পে l কিন্তু ক্ষমতায় এসে তৃণমূল সরকার প্রথমেই SEZ দেবেন না বলে সেই দরজা বন্ধ করে দিলেন l ফলে, গত নয় বছর কোন বড় সফটওয়্যার কোম্পানি কলকাতায় আসেনি l 2014, 2016 ও 2019 ভোটার আগে বাংলা সংবাদপত্রগুলি Infosys, Wipro আসার গল্প লেখে l ভোটার পর সেই খবর আর কেউ দেখে নি l আর মাইক্রোসফট, ইন্টেল, সিসকো,সান মাইক্রোসিস্টেম, আপেল? এসব নাম তো কলকাতার সংবাদপত্রে ভুলেও লেখে না l ভোটার যত কম জানে, ততো…….
2. জমিনীতি : টাটাকে তাড়িয়ে 2009 ও 2011র নিবার্চনী বিপুল সাফল্যের পর, মমতা ব্যানার্জীর চাপেই মনমোহন সিং 1894 এর জমি আইন পরিবর্তন করেন l 2013 তে নতুন পুনর্বাসন ( R & R ) নীতি প্রাণিত হয় l এই নীতিতে সরকার জমি অধিগ্রহণ করলে শহরে বাজারমূল্যের দ্বিগুন আর গ্রামে চার গুন damদেবার কথা l সেই অনুযায়ী প্রত্যেক রাজ্য তার নিজস্ব R & R নীতি বানায় l কিন্তু আশ্চর্য যে শুধু পশ্চিমবঙ্গই বাদ l এখানে রাজ্য বিনিয়োগকারীকে জমি কিনে নিতে বলছেন l যা একপ্রকার অসম্ভব l গত নয় বছর কোন মেট্রো,জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ , বন্দর, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, সেচ, বিদ্যুৎ প্রকল্প শেষ করা যায় নি এই অসচ্ছ পুনর্বাসন নীতির জন্য l জিয়াগঞ্জ আজিমগঞ্জ সেতু, যা উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের দূরত্ব 2 ঘন্টা কমিয়ে দিতে পারতো,তা গত নয় বছর বিশ বাও জলে, কয়েক কাঠা জমির জন্য l এছাড়া একটিও বড় শিল্প গত নয় বছরে আসেনি, তা দুধের শিশুও জানে l জমিজটে হলদিয়া পেট্রোর সম্প্রসারণ হচ্ছে উড়িষ্যাতে l
3. জমির বর্তমান পরিমান: আনন্দবাজারের খবর অনুযায়ী, মোদীজি 4,50, 000 একর জমি চিহ্নিত করেছেন শিল্পের জন্য l পশ্চিমবঙ্গে একলপ্তে জমি আছে মাত্র 9000 একর l 3000একর করে পানাগড়, খড়্গপুর ও রঘুনাথপুরে lপুরোটাই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে অধিগৃহীত l এই অবস্থায়, পুরো জমিতে যদি শিল্প হয়ও, মোট বিনিয়োগের 2% পাবে পশ্চিমবঙ্গ l যেখানে বাংলার জনসংখ্যা দেশের 10% l
- FDI নীতি ( প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের নীতি ) : 2013 তে মমতা ব্যানার্জী কেন্দ্রের UPAসরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসেন FDI তে রিটেল আসতে দেবেন না বলে l যে দল FDI এর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে এতো বড় সিদ্ধান্ত করতে পারে, সেই দলের মুখ্যমন্ত্রীর উপর ভরসা করে কোন বহুজাতিক সংস্থা আসবে এই রাজ্যে তাদের উৎপাদন কেন্দ্র বানাতে?
5. বন্দর : গত 53 বছর এই রাজ্যে কোন নতুন বন্দর তৈরি হয়নি l 2016 তে নীতিন গাতকারী40000 কোটি টাকার গঙ্গাসাগরে গভীর সমুদ্র বন্দর ঘোষণা করলে, মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে তা তৎক্ষণাৎ নাকচ করে দেন lউড়িষ্যায় চারটি বড় বন্দর, বাংলাদেশে তিনটি lবাংলাদেশ আমাদের উত্তরপূবাঞ্চলের রাজ্যগুলির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ তৈরি করছেl এছাড়া আগামী দিনে রেঙ্গুন বন্দর আধুনিকীকরণ হতে চলেছে, যা আরও কিছু উত্তর পূবাঞ্চলের রাজ্যকে যুক্ত করবে l পূর্ব-উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড তাঁদের রাজ্যকে উড়িষ্যার বিভিন্ন বন্দরের সঙ্গে যুক্ত করছে, যাতে তারা বাংলার হাত থেকে বাঁচতে পারে l এবার কোন রপ্তানিমূলক শিল্প পশ্চিমবঙ্গে আসবে?
6. সড়ক : সড়ক যোগাযোগ অর্থনীতির অন্যতম প্রাথমিক শর্ত l নূন্যতম চার লেন l আজকের দিনে রাস্তার অবস্থা এতো খারাপ যে শিলিগুড়িতে থেকে কোন দ্রব্য হলদিয়া পাঠাতে পুরো একদিন লাগবে l কে উত্তরবঙ্গে শিল্প বানাবে?
7. বিদ্যুৎ ও জল : তৃণমূল সরকার বলছে জমিতে বিদ্যুৎ ও জল নিয়ে যাবার দ্বায়িত্ব বিনিয়োগকারীর l জমির দাম বিনিয়োগকারীকে দিতে হবে l কোন বহুজাতিক সংস্থা এখানে আসবে?
8 বিমানবন্দর : কলকাতা ও শিলিগুড়ি বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ বহুদিন আটকে আছে জমিজটে l দুর্গাপুর বিমাননগরী রাজ্য সরকারের SEZ নীতির ফলে ব্যর্থ l
- ডেডিকেটেড ফ্রেইট করিডোর: অর্থাৎ এমন রেল পথ যা শুধুমাত্র মালগাড়ি বহন করবে l কেন্দ্র তিনটি এধারণের প্রকল্প বাংলাকে দেয়া l এক )লুধিয়ানা থেকে দিল্লি হয়ে ডানকুনি, দুই ) মুম্বাই থেকে কলকাতা, তিন )বিজয়ওয়ারা থেকে খড়্গপুর l যথারীতি, পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে এসে এদের সবার রাস্তা বন্ধ জমিজটে l বাকিরাজ্যের মাথায় হাত পরতে বসেছে l এরা চাইছি ওড়িষ্যার কোন বন্দরের দিকে যাত্রাপথ ঘুরিয়ে নিতে l একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর জন্য এতগুলো রাজ্য ভুগবে কেন?
1991 পর্যন্ত জ্যোতিবাবুরা দাবী করতেন,লাইসেন্স রাজ, মাসুল সমীকরণ, কোটা রাজ ফেরা ইত্যাদি আইন বাংলার উন্নতির পথে অন্তরায় l কিন্তু 1991 তে নরসিমা রাও উদার অর্থনীতি প্রবর্তন করলে সারা ভারতে সফটওয়্যার শিল্পের বন্যা বয়ে গেলেও,পশ্চিমবঙ্গে 1% এরও কম বিনিয়োগ হয়,শুধুমাত্র সিপিম সরকারের কম্পিউটার সম্পর্কের নেতিবাচক মনোভাবের জন্য l 1998 এ অটলজি ব্যাঙ্কিং, পরিকাঠামো শিল্পে সংস্কার আনলে সারাদেশে সড়ক, বন্দর, মেট্রোরেল,বিমানবন্দর, সেচ, বিদ্যুৎ ও আবাসন শিল্পে জোয়ার আসে l শুধু একটা রাজ্য বাদে lপশ্চিমবঙ্গ l একটা ছোট্ট উদাহরণ l বাজপেয়ীজি দিল্লি মেট্রোর সূচনা ও টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া মেট্রোর সূচনা একই সপ্তাহে করেন l গত 20 বছরে দিল্লিমেট্রো কর্পোরেশন 285 টি মেট্রো স্টেশনকে যুক্ত করে l আর কলকাতা? মাত্র 12 l
2011 তে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিবর্তন হলেও রাজনীতি ও আর্থিকনীতির কোন পরিবর্তন হয় নি l তাই, শিল্পের আশা আমরা যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাই আমরা , ততই আমাদের জন্য মঙ্গল l শিল্প আনা তো দূরের কথা, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকার গত নয় বছরে ন্যূনতম কোন সংকেত দেয়া নি, যে তারা শিল্পস্থাপনে আগ্রহী l চারবার রাজ্য সরকার শিল্প সম্মেলন করেছেন, কিন্তু একটা কাকও বসে নি l 1991 ও 1998 এর মত এবারও আমরা খালি হাতেই ফিরবো l কারণ মার্ক্সিয় অর্থনীতিতে জ্যোতিবাবুর সেরা ছাত্রী তথা আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর অগাধ আস্থা l