এই মহামারীর সময় নিজের জীবন বিপন্ন করে মানবতার সেবায় কর্তব্যরত ডাক্তার, নার্স, পুলিশ কর্মীদের উপর প্রাণঘাতী হামলা চালাচ্ছে এক দল মানুষ। কাশ্মীরের পাথরবাজদের অনুকরণে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে পাথর ছুঁড়ছে, করোনা সংক্রমিত করতে থুতু ছেটাচ্ছে, মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্দেশ্যে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছে, পোশাক ছিঁড়ে দিচ্ছে। এসবই নাকি বিচ্ছিন্ন ঘটনা!
গত ৪ মে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া একটি বক্তব্য দিয়ে লেখাটি শুরু করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “গোটা বিশ্ব যেখানে করোনার (কোভিড-১৯) বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সেখানে কিছু মানুষ প্রাণঘাতী ভাইরাসের মতোই সন্ত্রাসবাদ, ভুয়ো খবর এবং বিকৃত ভিডিয়ো ছড়িয়ে সমাজ ও দেশেবিভাজন তৈরি করছে”। অর্থাৎ ভারতকে যুগপৎ করোনার চেয়েও ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদ, ভুয়ো খবর, বিকৃত ভিডিয়ো নামক ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। দেশের ভেতরে আক্রান্ত হচ্ছেন ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত করোনা যোদ্ধারা, সীমান্তে আক্রান্ত হচ্ছেন সীমান্তরক্ষীরা। দেশ জুড়ে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করার চেষ্টা চলছে। দেশের ঐক্য, সম্প্রীতি, লড়াই করার দৃঢ় সংকল্প আক্রান্ত হচ্ছে। ভুয়ো খবর, বিকৃত বিডিয়ো নামক ভাইরাস দ্বারা।
সমস্ত দেশ করোনা যোদ্ধাদের সম্মান জানাচ্ছে। হিন্দু সমাজ তো করোনা যোদ্ধাদের মধ্যে ঈশ্বরের রূপ দেখতে পাচ্ছে। অনেককে বলতে শোনা যাচ্ছে মন্দির বন্ধ তো কী হয়েছে। ভগবান তো এখন সাদা পোশাক পরে হাসপাতালে ডিউটি করছেন। পাশাপাশি এর বিপরীতে দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে দেশের সর্বত্রই।
গত ১ এপ্রিল বুধবার মধ্যপ্রদেশেরইন্দোরে স্বাস্থ্য আধিকারিকদের একটি পাঁচ সদস্যের দল করোনা স্ক্রিনিংয়ে গেলে স্থানীয় বাসিন্দাদের হেনস্থার মুখে পড়তে হয়। লাঠি, কাঁচের বোতল, পাথর নিয়ে হামলা চালানো হয়েছে তাঁদের ওপর। বাদ যায়নি মহিলা চিকিৎসকরাও। বিশ, সম্প্রদায়ের দলবদ্ধ মানুষ ডাক্তারদের ইট, পাথর নিয়ে তেড়ে আসে। প্রাণ হাতে করে ডাক্তারা দৌড়াচ্ছেন, এই দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে সমস্ত বিশ্ব দেখেছে।
২ এপ্রিল। দিল্লির নিজামুদ্দিন মরকজে যোগদানের পরে তবলিগি জামাতের কিছু মানুষ যারা কর্ণাটকে ফিরে এসেছিলেন তাদের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার জন্য স্বাস্থ্য আধিকারিকদের সঙ্গে আশা কর্মীরা একটি বিশেষ সম্প্রদায় অধ্যুষিত অঞ্চলে ঘরে ঘরে জরিপ চালাচ্ছিলেন। কর্ণাটকের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বি শ্রীরামালু নিজের টুইটার হ্যান্ডেলে একটি ভিডিয়ো শেয়ার করেছিলেন। যাতে দেখা গেছে এই জরিপ দলের সদস্য দৃশ্যত বিচলিত আশাকর্মী কৃষ্ণাবেণী ভিডিয়ো বার্তায় অভিযোগ করেছেন যে, তারা আমাদের ব্যাগ এবং মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়েছিল। তারা আমাদের একটি ফোন কলও করতে দেয়নি। আমি বিগত পাঁচ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছি কিন্তু কখনও কখনও এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি।’আরও অভিযোগ, সেদিন স্থানীয় মসজিদের মাইক থেকে থেকে ভিড় করার জন্য আহ্বান করা হচ্ছিল।
গত ১৫ এপ্রিল উত্তর প্রদেশের মোরাদাবাদের মুসলমান অধ্যুষিত নবাবগঞ্জ এলাকায় করোনা সংক্রামিতদের খোঁজ করতে গেলে একদল উন্মত্ত জনতা কর্তব্যরত ডাক্তার, নার্স ও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর পাথর ছুঁড়তে শুরু করে। এই চিকিৎসক দলকে উদ্ধার করতে যাওয়া পুলিশ দলের ওপরও চড়াও হয় দুষ্কৃতীরা। এই ঘটনায় একজন ডাক্তার ও ফার্মাসিস্ট-সহ তিন জন গুরুতর আহত হন।
গত ২১ এপ্রিল ইন্ডিয়া টিভির রিপোর্টার মণীশ প্রসাদ দিল্লির লোকনায়ক জয় প্রকাশ হাসপালের কাছে গেলে আশা নামে একজন মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী এগিয়ে এসে তার ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন। আশা দেবীর বক্তব্য ছিল, নিজামুদ্দিন মরকজ থেকে আসা আইসোলেশনে থাকা তবলিগিদের খাবার দিতে গেলে ওরা তাকে ঘাড়ে ধরে ওই খাবার টেস্ট করাতে বাধ্য করে, ওর পরনে থাকা পিপিই কিট টেনে ছিড়ে দেয় এবং হুমকি দেয়। তিনি কোনো রকমে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে আসেন। তিনি আরও বলেন, এতদিন টিভিতে তবলিগিদের তাণ্ডবের কথা শুনে বিশ্বাস হতো না। কিন্তু তার নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর সেই ভাবনা পালটে গেছে। আবার ২৩ এপ্রিল ২০২০ দিল্লির ওই লোকনায়ক জয়প্রকাশ হাসপাতালের চিকিৎসকরাও অভিযোগ করেন আইসোলেশনে থাকা করোনা আক্রান্ত তবলিগিরা তাদের মাস্ক খুলে নিচ্ছে, ভাইরাস সংক্রামিত করার হুমকি দিচ্ছে। এ ব্যাপারে ডাক্তারবাবুরা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কাছে অভিযোগও করেন।
দিল্লির দ্বারকা এলাকায় কোয়ারেন্টাইনে থাকা তবলিগিদের বিরুদ্ধে বোতলে করে প্রস্রাব ছুড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠে। ঘটনাটি ৮ এপ্রিলের। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌলতে সবাই ঘটনাটি দেখেছে।
১৪ এপ্রিল হায়দরাবাদের ওসমানিয়া জেনারেল হাসপাতালের একজন ডাক্তারকে সন্দেহভাজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর ছেলের দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়। হায়দরাবাদের গান্ধী হাসপাতালে একজনের করোনা ধরা পড়ায় আক্রান্ত হন চিকিৎসকরা। গুজরাটের সুরাট থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর হামলার খবর আসে। বিহারের মুঙ্গের শহরে করোনা সংক্রমিতদের লালারসের নমুনা সংগ্রহ করে গেলে পলিশ, ডাক্তার -সহ স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি দলকে স্থানীয়দের হাতে আক্রান্ত হতে হয়।
গত ২৮ এপ্রিল বিকেলে কনটেনমেন্ট এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হাওড়ার টিকিয়াপাড়ায় বেলিলিয়াস রোডে টহল দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয় পুলিশ। পিছু ধাওয়া করে পুলিশকে মারধর করা হয়। পুলিশের দিকে ধেয়ে আসে এলোপাথাড়ি ইট, পাথর। পুলিশের দুটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োর জেরে এই ঘটনার সাক্ষী সাধারণ মানুষ। দেশের বিভিন্ন জায়গাতেই নিরন্তর ঘটে যাচ্ছে এরকম আক্রমণের ঘটনা।
একাজ যারা করছে তাদের সন্ত্রাসবাদী বলা হবে কিনা তা অবশ্যই আলোচ্য বিষয় হতে পারে। কারণ ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এখন পুরো ভারত ভগবানের চোখে দেখছে। অন্যদিকে এই উন্মাদীরা নার্স ও ডাক্তারদের। ডওপর থুতু মিক্ষেপ করছে, আক্রমণ করছে। শুধু এই নয়, যে ডাক্তারদের টিম তবলিগি জামাতের এলাকায় যাচ্ছে সেখানে চিকিৎসক, পুলিশ সকলকেই আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। জামাতিদের বিরুদ্ধে বলার জন্য নিউজ পোর্টাল –সহ বাকি সংবাদমাধ্যমগুলিকেও হুমকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যার জন্য অনেক সংবাদমাধ্যম জামাতিদের উপদ্রব সম্প্রচার করা বন্ধ করে দিয়েছে। তবে সত্য এই যে, এখনও অবধি উন্মাদী জামাতিরা তাদের উপদ্রব বজায় রেখেছে। এক হাসপাতালে জামাতিরা নগ্ন হয়ে। নার্সদের সামনে নাচানাচি করেছে, অশ্লীল ইঙ্গিত করছে।
ভারতে করোনা ভাইরাস নিয়ে একাধিক ভুয়ো তথ্য পরিবেশিত হচ্ছে। আর তার জেরে হোয়াটসঅ্যাপ একসঙ্গে একের অধিক ব্যক্তিকে কোনো ম্যাসেজ ফরোয়ার্ড না করার মতো বড়োসড়ো পদক্ষেপ নিয়েছে। করোনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভ্রান্তিকর পোস্ট ছড়ালে। শাস্তি, হুঁশিয়ারি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ। তিনি জানান করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এই কঠিন সময়ে ফেসবুক, টুইটার বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া ভুল পোস্ট মানুষকে বিভ্রান্ত করছে ও করোনার বিরুদ্ধে লড়াইকে দুর্বল করছে। তাই এ বিষয়ে কড়া পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের।
গত এক মাসে জম্মু ও কাশ্মীরে ১২টিরও বেশি গুলির লড়াই হয়েছে, যেখানে ২৭ জন নিরাপত্তাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। ৩ মে , জম্মু ও কাশ্মীরের হান্দোয়ারায় সেনা-জঙ্গি গুলির লড়াইয়ে ২ লস্কর কম্যান্ডার -সহ ৫ জন নিরাপত্তাকর্মীর মৃত্যু হয় তাদের মধ্যে রয়েছেন দুজন পদস্থ আধিকারিক, একজন কর্নেল, একজন মেজর। ৪ মে, একই জায়গায় গুলির লড়াই হয়, সেখানে অন্তত ৩ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু হয় এবং ৭ জন আহত হন। সিআরপি এফের টহল দেওয়ার সময় হামলা চালায়। জঙ্গিরা।
এই মহামারীর সময় নিজের জীবন বিপন্ন করে মানবতার সেবায় কর্তব্যরত ডাক্তার, নার্স, পুলিশ কর্মীদের উপর প্রাণঘাতী হামলা চালাচ্ছে। এক দল মানুষ। কাশ্মীরের পাথরবাজদের অনুকরণে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে পাথর ছুড়ছে, করোনা সংক্রমিত করতে থুতু ছেটাচ্ছে, মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্দেশ্যে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছে, পোশাক ছিড়ে দিচ্ছে। জামাতের ‘ধর্মনিরপেক্ষ মুখগুলি মিডিয়ায় বসে নিরন্তর বলে যাচ্ছে এগুলি সমস্ত বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সে সমস্ত মিডিয়া এই সমস্ত ঘটনা নিয়ে সরব হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও মুসলমান বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হলেই সেকুলার ব্রিগেড মাঠে নেমে ভিক্টিম কার্ড খেলছে। বলা হচ্ছে ভারতেমুসলমানদের টার্গেট করা হচ্ছে। করোনা মোকাবিলার নামে শুধু বেছে বেছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। এক শ্রেণীর মিডিয়া প্যানেল ডিকাসশনের আয়োজন করছে, কলাম লেখা হচ্ছে, ব্লগ লেখা হচ্ছে, একই সঙ্গে বিদেশি মিডিয়া সরব হচ্ছে ভারতে মুসলমান বিদ্বেষের অভিযোগ নিয়ে। পালঘরের নির্মম সন্ন্যাসী হত্যার ঘটনা নিয়ে কিংবা করোনা যোদ্ধাদের ওপর বর্বর আক্রমণ নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষ তকমাধারী একদল প্রাক্তন হয়ে যাওয়া আমলা মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ তুলে চিঠি দিচ্ছেন দেশের মুখ্যমন্ত্রীদের। ‘জামাতিরা হিরো’ হ্যাস ট্যাগ টুইটারে ট্রেন্ড করছে। ইয়াকুব মেননের ফাঁসি রদ করানোর জন্য রাত তিনটের সময় যে আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্ট খুলিয়ে ছিলেন সেই সমস্ত জাদরেলরাও জামাতিদের আইনি সুরক্ষা দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ছেন। খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে দেশের ভিতরে-বাইরে এক বিরাট ভারত-বিরোধী ইকোসিস্টেম কাজ করছে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতকে হারিয়ে দিয়ে এই দেশকে ইউরোপ আমেরিকার মতো মৃত্যুপুরীতে পরিণত করতে।
সামনে কঠিন লড়াই। এই মহামারীর জন্য প্রচুর মানুষ কর্মচ্যুত হবে, অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হবে। এই সংকটের সময় মানুষকে বিভ্রান্ত করা, ভড়কে দেওয়া, সরকার বিরোধী করে তোলা, বিশৃঙ্খলা তৈরি করা খুবই সহজ। বিগত সত্তর বছর ধরে এই সংকট কেন্দ্রিক’ নেতিবাচক রাজনীতির ফলে সম্পদে পূর্ণ ভারত এখনো দরিদ্র দেশের তকমা বহন করে চলেছে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে দেশে একটি সাকারাত্মক রাজনীতির বাতাবরণ তৈরি হলেও এই মহামারীর জেরে দেশজুড়ে আবার একবার সেই নেতিবাচক রাজনীতির উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
এই কঠিন পরিস্থিতিতে ক্ষমতালোভী, তোষণকারী, স্বার্থান্বেষী রাজনীতির কারবারিদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে দেশের প্রত্যেকটি মানুষকে সচেতন নাগরিক ও লড়াকু সৈনিকের ভূমিকা পালন করতে হবে।
সাধন কুমার পাল