ভারতীয় অর্থনীতির পুনঃগঠন : সমস্যা ও সম্ভাবনা

ভারতীয় অর্থনীতির প্রাণশক্তি মূলত স্বদেশী কেন্দ্রিক হলেও দেখা যায় অফিসিয়াল প্রোটোটাইপ, কার্যক্ষেত্রে আলাদা পথে চলে। বর্তমান কোভিড বিশ্বমারীর প্রেক্ষিতে সমগ্র বিশ্ব তথা আমাদের দেশেও সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন আসতে চলেছে বা পরিলক্ষিত হচ্ছে।

প্রথমতঃ আন্তর্জাতিক ওয়ান সাইজ ফিটস্ অল মডেল ব্রাত্য হওয়া শুরু হয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ কোভিড বিশ্বমারী আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, কোনো অর্থনৈতিক তত্ত্ব বা মডেলই চিরস্থায়ী নয় এবং প্রতিটি মডেলেরই আয়ুষ্কাল ক্রমশ কমছে। কঋণিয়ালিজম্ বা ঔপনিবেশিকবাদ ২০০ বছরে সমাপ্ত হয়, মার্কেন্টাইল ক্যাপিটালিজম্ ১০০ বছর চলে, মার্ক্সিজম্ ৫০ বছরেই শেষ। প্রকৃত অর্থে, বিশ্বায়নের অর্থনীতিতেও মাত্র ২৫ বছরে নাভিশ্বাস উঠেছে। মূলত সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলি পরিবর্তিত হতে থাকে।

তৃতীয়তঃ অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন একটি সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত ধারণা। দ্বন্দ্বমুক্ত পৃথিবী বাস্তবিক ভাবেই অসম্ভব হওয়ার কারণে বিশ্বায়নকে সামগ্রিক ফলশ্রুতিতেই ব্যর্থ করেছে।

চতুর্থতঃ চীন তার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন এবং চূড়ান্ত শ্রমিক শোষণের মাধ্যমে সারা বিশ্বের সাপ্লাই চেন মডেলের সিংহভাগ দখলে রেখেছিল। কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতি তারও বদলের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সমগ্র বিশ্ব আজ অনুধাবন করতে পারছে, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মধ্যে কোনো বাণিজ্যিক চুক্তিরই সার্থক রূপায়ণ সম্ভব নয়, তা শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মাধ্যমে চালিত দেশগুলির মধ্যেই সম্ভব।

পঞ্চমতঃ মাল্টি ল্যাটারালিজমের যে তত্ত্ব আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে এতদিন চলে এসেছে, বস্তুতঃ তারও দিন শেষ। মাল্টি ল্যাটারালিজমের পরিবর্তে পারস্পরিক সহমতের ভিত্তিতে উপযুক্ত বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কই বিশ্ব অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হতে চলেছে।

অর্থাৎ কোভিড পরিস্থিতি, চলতি বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে নতুন করে সাজিয়ে নিতে চলেছে।

মূলত নৃতত্ত্ববিদ্যার পশ্চিমি সংস্করণ ‘one size fits all model’ ১৯৫১ সালে অর্থনীতির আঙ্গিনায় বলপূর্বক ঢোকানো হয়েছিল যার প্রধান ও প্রাথমিক শর্তই ছিল সমস্ত দেশগুলিকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, দর্শন এবং অনন্যতা পরিহার করে অর্থনৈতিক বিশ্বায়নে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ করতে হবে। ২০০৫ সালে জি২০ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলি এই নীতির অসারতা সামনে তুলে ধরে এর স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং ঘোষণা করে প্রতিটি দেশের তাদের নিজস্বতা অনুযায়ী উপযুক্ত আর্থিক নীতি থাকা উচিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে, এতদিন ধরে চলে আসা বাধ্যতামূলক অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন মডেলের উপর প্রশ্নাতীত আনুগত্যে চিড় ধরে। দুর্ভাগ্যবশত ভারতীয় অর্থনীতির পরিসরে এই বিষয়ে সামান্য আলোচনা হলেও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তার কণামাত্র প্রতিফলিত হয়নি। যদিও ২০১৪ পরবর্তী সময়ে ওয়ান সাইজ ফিটস অল তত্ত্বের পরিবর্তে ভারতে নীতি আয়োগের শুভ সূচনা হয়, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এই ভ্রান্ত নীতিকে তাত্ত্বিকভাবে পরিত্যাগ করেও আমরা এখনো কার্যক্ষেত্রে তার অনুসরণ করে চলেছি এবং এটাই দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক অস্থিরতার মূল কারণ।

প্রথম বিশ্বের উন্নত দেশগুলি এই ওয়ান সাইজ ফিটস অল তত্ত্বের প্রবক্তা হয়েও নিজেরাই বারে বারে এর মূল তাত্ত্বিক কাঠামো থেকে বিচ্যুত হয়েছে। এর মৌলিক নীতিই হল সরকার দেশের জাতীয় ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার করবে না। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখলাম আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান প্রভৃতি বিশ্বের উন্নত অর্থনৈতিক শক্তিগুলি বারংবার এই নিয়ম উল্লঙ্ঘন করেছে। ফলতঃ এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে ক্রমাগত ক্ষতিকারক হয়ে উঠছে। প্রকৃতপক্ষে একে কোনোভাবেই ডায়নামিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব বলা যায় না, বরং ভারতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে একে অনাকাঙ্ক্ষিত ওয়াল স্ট্রিট প্রভাব বলা যেতে পারে কারন অদ্ভুতভাবে আমরা ততক্ষণ টাকা ছাপাতে পারি না যতক্ষণ না ডলার আমাদের দেশে আসছে। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার কমে তখন বেশি রিটার্নের আশায় আমাদের দেশে ইনভেস্টমেন্ট বাড়ে। আর এভাবেই দিনের পর দিন তা চলে আসছে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর আমাদের এর থেকে বেরিয়ে আসা উচিত ছিল, যদিও সেটা সম্ভব হয়নি। ২০১৫ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার না করার তত্ত্বকে সামনে রেখে ভারত সরকার এফআরবিএম বিধি সংশোধনের সিন্ধান্ত নেয় কিন্তু ম্যাক্রো ইকোনমিক্সের তত্ত্বের প্রয়োগের তাগিদে, উন্নয়নশীল দেশে তিন শতাংশ ফিসকাল ডেফিসিট বজায় রাখার খাতিরে এই সিদ্ধান্ত থেকে বাধ্যতামূলক সরে আসতে হয়। সত্যি কথা বলতে কি, উন্নয়নশীল অর্থনীতির উপর এই চাপিয়ে দেওয়া মাত্র তিন শতাংশ ফিসকাল ডেফিসিটের বাঁধন অর্থনীতির মূল ভিত্তিকেই অস্বীকার করে। উন্নত আর উন্নয়নশীল দেশের জন্য একই রেটে ফিসকাল ডেফিসিট সত্যিই হাস্যকর। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে আমাদের অনেক বেশি মূলধন প্রয়োজন এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে তা উৎপাদন করতে না পেরে, আমরা যদি শুধুমাত্র বিদেশ থেকে আসা মূলধনের উপর নির্ভর করি, সেক্ষেত্রে দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হতে বাধ্য।

শ্রী এস গুরুমূর্তি, অর্থনীতিবিদ, তুঘলক-এর সম্পাদক

বাস্তবিকই, সমগ্র বিশ্ব জুড়ে বারেবারেই দেখা গেছে, অর্থনীতির মারাত্মক সমস্যার ক্ষেত্রে ক্লাসিকাল অর্থনীতিবিদেরা সমস্যার সমাধান করতে পারেন না, পারে নতুন বিশেষজ্ঞ। ১৯৩০ এর অর্থনৈতিক মন্দায় কেইনসের সমাধান, পরবর্তীকালে যখন কেইনসের তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগ মারাত্মকভাবে মুদ্রাস্ফীতি ও কর্ম সঙ্কোচন সৃষ্টি করতে শুরু করে, তখন মিল্টন ফ্রীডম্যানের তত্ত্বকে সামনে রেখে সমস্যার সমাধান করা হয়। ১৯৯৭ সালে আমেরিকাতে মিল্টনের তত্ত্বও বাতিল করা হয়। যদিও অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপিয়ে অর্থনৈতিক মন্দা কাটানো অর্থনীতির কোনো তত্ত্বের মধ্যে পড়ে না, তথাপি ২০০৮ সালের মন্দায় বিপদ কাটানোর সাময়িক উপায় হিসাবেই এই পথ অবলম্বন করা হয়েছিল।

ভারতীয় অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্যই হল যে আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি বাজার নয় বরং তা ব্যাঙ্ক নির্ভর। দেশে স্টক মার্কেট লিস্টেড সংস্থাগুলির অবদান জিডিপির মাত্র পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ যেখানে অনথিভুক্ত কর্পোরেট বা এমএসএমই সেক্টরের অবদান জিডিপির ৫০ শতাংশ এবং মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশ। এরা কিন্তু বাজার থেকে টাকা ধার করে না, করে ব্যাঙ্কগুলো থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেসাল নর্মসকে সামনে রেখে আমাদের দেশে সমস্ত উন্নয়ন ব্যাঙ্কগুলোকে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলতঃ উন্নয়ন ব্যাঙ্কগুলোকেও বাধ্যতামূলক ভাবে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের সমস্ত নিয়ম নীতি মেনে চলতে হয়। ১৯৯৫ সালে যেখানে সমস্ত ব্যাঙ্ক ঋণের মাত্র ৮ শতাংশ টার্ম ঋণ ছিল, এখন তা প্রায় ৫৮ শতাংশ, কারন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি উন্নয়ন খাতে ঋণ দিচ্ছে এবং তা বেসাল নর্মসের নীতিকে সামনে রেখেই, আর এখানেই সর্বনাশের রূপরেখা তৈরী হচ্ছে। উন্নয়ন ঋণের ক্ষেত্রেও এই বেসাল নর্মস্ প্রযোজ্য হওয়ায়, কোনো শিল্প উদ্যোগ, তা যতই আকর্ষণীয় সম্ভাবনাময় হোক না কেন, ৯০ দিন পরবর্তী সময় থেকে ঋণ শোধ করা শুরু করতে না পারলে, ব্যাঙ্ক তাকে দেউলিয়া ঘোষণার পথে এগোয়। ব্যাঙ্ক নির্ভর অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই নিয়ম আবশ্যিক ভাবেই ব্যর্থ প্রমাণিত হচ্ছে। প্রায় ৮০ শতাংশ ঋণগ্রহীতা-উদ্যোগ এই নিয়মের ফলে পরবর্তীতে নতুন করে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে অযোগ্য বিবেচিত হয়েছে। ব্যাঙ্কগুলি নিয়মের জালে ঋণ দিতে পারেনি। অথচ ব্যাঙ্কগুলিতে জমা হওয়া প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকার মধ্যে ৬ লাখ কোটি রিজার্ভ ব্যাঙ্কে জমা দিতে হয়েছে। ২০০৪ থেকে ২০০৯-এর মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত অবিবেচক ঋণ দেওয়ার ফলে একদিকে যেমন ব্যাঙ্কগুলির সমস্যা তৈরি হয়েছিল, তা পরবর্তীতে আরো বাড়তে থাকে নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনাগ্রহ সৃষ্টি হওয়ায়, যদিও এইসময় দেশের অর্থনীতির অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন এবং ব্যাঙ্কগুলির হাতেও নোটবন্দীর পরবর্তী সময়ে প্রচুর অর্থ রয়ে গেছে, তথাপি ভ্রান্ত প্রুডেনশিয়াল নীতির কারণে আশানুরূপ সাফল্য আসেনি। এই প্রুডেনশিয়াল নীতির অতি দ্রুত সংস্করণের জন্য অবিলম্বে সরকার ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ফলপ্রসূ নীতি নির্ধারণের কারণে আলাপ আলোচনার দরকার যাতে এনপিএ ঘোষিত সংস্থাগুলিকে কোভিড পরবর্তী সময়ে একবারের জন্য হলেও টেকসই পরিকল্পনা পুনর্গঠনের মাধ্যমে ক্ষেত্রবিশেষে সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বিগত কয়েক বছর ধরে আমেরিকার নেতৃত্বে এক নতুন বাস্তুতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে, যা কোভিড১৯ পরবর্তী সময়ের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের পক্ষে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক হতে চলেছে। বিশ্ব অর্থনীতির এই নতুন বাস্তুতন্ত্র অত্যন্ত সফল ভাবে বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে তাদের ভ্রান্ত নীতির কারণে চীন কে অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষতিকারক দিক চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে এবং সমগ্র বিশ্বে ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়া এই চীন-বিরোধী বাস্তুতন্ত্রের ফলে মোট প্রায় ৫০০০০ কোটি ডলার অর্থমূল্যের বিভিন্ন শিল্প চীন ত্যাগ করেছে এবং অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ভাবে এরমধ্যে ৩৩ শতাংশ ক্যাপিটাল গুডস্ ও ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, ১৪ শতাংশ ভোগ্যপণ্য উৎপাদন শিল্প এবং ১৮ শতাংশ টেকনিক্যাল হার্ডওয়্যারস্ আমাদের দেশে আসতে চলেছে। কোভিড১৯-এর মারণ ধাক্কা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের মেক ইন ইন্ডিয়া ও স্বদেশী অর্থনীতির সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন দিশার দিকে এগিয়ে যেতেই হবে। যে দর্শনের উপর ভিত্তি করে নীতি আয়োগ স্থাপিত হয়েছিল, তার উপযুক্ত ও সঠিক বাস্তবায়ন হওয়া এই মুহূর্তে বিশেষ প্রয়োজন। সারা বিশ্বই এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের মারণ আঘাতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নকে পাশে সরিয়ে রেখে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য হচ্ছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সঠিক অর্থে অর্থনীতির ভারতীয়করণের মাধ্যমে আমাদের এগিয়ে চলতে হবে। ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পারস্পরিক বিশ্বাস, সামাজিক সুসংহতি ও সমস্ত বিপদে পরিবারের পাশে থাকার মানসিকতাকে পাথেয় করে স্বদেশী নির্ভর বিকল্প ম্যানুফ্যাকচারিং মডেল আমাদেরকে এই কোভিড আক্রান্ত দিনগুলিতে নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে।

অনুবাদক : ড. তরুণ মজুমদার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.