চীনের বােধোদয় কবে হবে?

শুকনাে খুক খুক কাশি আর জ্বর! একরকম প্রত্যেক বছরই হয়ে থাকে আমার আপনার সবার। কিন্তু এই সামান্য কাশি আর জ্বরই এবার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে একশাে পঁচিশটা দেশের। ২১ জানুয়ারি থেকে প্রত্যেকদিন সিচুয়েশন রিপাের্ট বার করে চলেছে ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন। প্রত্যেকদিনই আক্রান্ত দেশের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে একের পর এক দেশ। ২ মে হু-র সিচুয়েশন রিপাের্ট অনুযায়ী গােটা বিশ্বে এখনাে পর্যন্ত ৩৪,০২,১৬০ জন আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গিয়েছেন। ২,৩৯,৬২৩ জন। করােনাভাইরাস… কোভিড-১৯! থরথর করে কাপছে সবাই আজ এই ভাইরাসের নাম শুনে।

আজ থেকে সতেরাে বছর আগে, ২০০৩ সালে, ঠিক একইরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, মনে আছে নিশ্চয়? Severe Acute Respiratory (SARS) 7697 মারাত্মক রােগের প্রকোপে ১৭টি দেশে ৭৭৪ জন মানুষ মারা গিয়েছিল। তার পিছনেও ছিল সেই একই দানব— করােনাসুর— করােনা ভাইরাস! এই দুই মারণ রােগেরই উৎপত্তিস্থল হিসাবে একটা নাম ওতপ্রােতভাবে জড়িয়ে আছে চীন। বা চায়না!

কিন্তু কেন? সেটাই আজকের প্রতিপাদ্য বিষয়। হুয়ানান ফুড মার্কেট। উহান, হুবেই, সেন্ট্রাল চায়না। নতুন বছরের প্রথম দিনেই চাইনিজ গভর্নমেন্ট এই ফুড মার্কেট তড়িঘড়ি বন্ধ করে দিয়েছিল। কেন? কী রহস্য? কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত প্রথম ৪১ জনের মধ্যে ২৭ জনই এই ফুড মার্কেটে বাজার করতে এসেছিলেন। চমকে দেওয়ার মতাে সাদৃশ্য- ২০০২ সালে সাউথ চায়নার গুয়াংজুর এক ফুড মার্কেট থেকেই প্রথম ছড়িয়েছিল মারণ রােগ SARS !

কী আছে এই ফুড মার্কেটগুলােতে যে একের পর এক অজানা মারণ ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটছে?

করােনাভাইরাসের এত পছন্দের জায়গা কেন চায়না? সেই গল্পই বলি। ভাইরাস এক অদ্ভুত জিনিস। সে একাধারে জড় আবার জীব। এমনিতে মৃত, নিঃসাড় কিন্তু কোনাে জীবের জীবন্ত কোষের সংস্পর্শে এলেই এক অদ্ভুত মায়াবী শক্তিতে সজীব হয়ে অস্বাভাবিক ভাবে বংশবিস্তার করতে থাকে। উদ্ভিদ, প্রাণী থেকে শুরু করে ব্যাক্টেরিয়া ও তার আক্রমণ থেকে রেহাই পায় না। ভাইরাস। বহনকারী এই জীবনের বলে ক্যারিয়ার।

মারাত্মক কিছু ভাইরাসের ক্যারিয়ার হলাে আমাদের চেনা পরিচিত কিছু প্রাণী। যেমন, ইনফ্লুয়েঞ্জা এসেছে মুরগি ও শুয়ােরের মতাে farm animals থেকে, HIV নিয়ে এসেছে শিম্পাঞ্জি, ইবােলা এসেছিল বাদুড় থেকে। কোভিড-১৯ সবকিছুর রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। কারণ এই ভাইরাস বাদুড়, সাপ, প্যাঙ্গোলিন ইত্যাদি বেশ কয়েকরকম ক্যারিয়ার চেঞ্জ করে তারপর আক্রমণ করেছে মানুষকে। কিন্তু এটা কী করে হলাে?

করােনা ভাইরাসকে এতগুলাে ক্যারিয়ার চেজ করার জন্য একটা মিলনায়তন দরকার ছিল, আর উহানের হুয়ানান ফুডমার্কেট সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছে। মানে? হুয়ানান ফুড মার্কেটে রয়েছে প্রায় ১২৫ রকমের জীবন্ত প্রাণীর লাইভ ওয়েট মার্কেট! খাঁচার উপরে খাঁচার উপরে খাঁচার উপরে খাঁচা। সাপ, ব্যাঙ, গিরগিটি, বাদুড়, শেয়াল, ভালুক, ভেড়া, ছাগল, ময়ুর, উটপাখি গােরু, খরগােশ, বনবেড়াল, কুমির, কচ্ছপ, কুকুর কিচ্ছু বাকি নেই। যেটি আপনার পছন্দ মতাে খাঁচা থেকে বের করে গলা কেটে দেওয়া। তারপর ছাল ছাড়িয়ে টাটকা মাংস পলিথিন প্যাকেটে করে আপনার হাতে! প্রত্যেক রকম প্রাণী বিভিন্ন রকমের ভাইরাসের ক্যারিয়ার! এ যেন ভাইরাসদের ব্রিগেড বা প্রগতি ময়দান! ধরুন, আপনি আজ মিক্সড সুউপ খাবেন– চিকেন, মটন, প্রনের বদলে কিনলেন বাদুড়, পাইথন আর প্যাঙ্গোলিন। খাওয়ার বা রন্ধন পদ্ধতিও বলিহারি! সেদ্ধ বা ফ্রাই করার দিকেও যান না তার। ধোঁয়া ওঠা গরম জলে ধনে পাতা আর পেঁয়াজকলির সঙ্গে বাদুড়ের ডানা, প্যাঙ্গোলিনের নখ আর পাইথনের নরম মাংস কাঁচাই ফেলে দিলেন, তারপর পরম তৃপ্তিতে সাবাড়!

করােনা ভাইরাস মিক্সড সুউপের মিক্সিং থেকে তার জৈব-রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটিয়ে যখন end user-এর শরীরে প্রবেশ করছে, তাকে বাধা দেওয়ার শক্তি আমাদের শরীরের ইমিউনিটির আর নেই। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে যায়, চাইনিজদের এমন অদ্ভুত ফুড হ্যাবিটসের কারণটা কী? বাদুড়, প্যাঙ্গোলিন, পাইথন তাে ফার্মের পশু নয়! এই প্রশ্নের উত্তর পেথে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৭০-এর দশকে। চায়নায় তখন মহাদুর্ভিক্ষ। খাবারের জন্য হাহাকার! ৩৬ মিলিয়ন লােক না খেতে পেয়ে মারা গেছে। চীনের তৎকালীন কমিউনিস্ট সরকার সাধারণ খাদ্য যেমন ধান, গম শস্যাদি বা গবাদি পশুপাখি যেমন গােরু, শুয়াের, মুরগির জোগান দিতে ব্যর্থ হচ্ছিল বেঁচে থাকা ৯০০ মিলিয়ন দেশবাসীকে। তখন খিদের জ্বালায় প্রথম কৃষক শ্রেণীর কিছু মানুষ, কচ্ছপ, কাছিম, মেঠো ইদুর, বনবিড়াল ধরে মেরে খেতে শুরু করলাে।

কমিউনিস্ট সরকার এটাকে বাধা দিতে পারতাে, কিন্তু দেয়নি। উল্টে তারা বন্য প্রাণীকে খাদ্য বানানাের এই প্রবণতাকে পুরােপুরি সমর্থন করলাে। শুরু হলাে চীনের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের এক আমূল পরিবর্তন। দুর্ভিক্ষের প্রকোপ থেকে মুক্তি পেলেও ১৯৮৮ সালে চীনা সরকারের বােধােদয় হলাে না। তারা এক অদ্ভুত Law of the Protection of Wildlife নিয়ে এলাে, যাতে T6436011, “Wiledlife resources shall be owned by the state. The state proects the lawful rights and intersts of units and individuals engaged in the development or utilization of wildlife resources according to law.”হায় ভগবান! | চাইনিজ গভর্নমেন্ট বনের পশুপাখিকে চিহ্নিত করলাে wildlife natural resources হিসাবে, অর্থাৎ পাতি কথায় খাদ্যদ্রব্য হিসাবে! সৃষ্টি হলাে একটা নতুন ইন্ডাস্ট্রির ! Wildlife Farming Indistry ! সাপ, ব্যাং, কচ্ছপ, ইঁদুর, বনবিড়াল, ভালুক প্রতিপালনের ফার্ম শুরু হলাে এবং লােকাল ওয়েট মার্কেটে তাদের পাঠানাে হতে শুরু করলাে মাংস হিসেবে বিক্রি হওয়ার জন্য। ভাবুন, আপনি মুরগি বা মাটনের দোকানে গেছেন, আপনার সামনেই চিকেন মাটন কাটা হচ্ছে, ছাল ছাড়ানাে হচ্ছে, মাংস আলাদা করা হচ্ছে, ছাল ছাড়িয়ে সেটা পাশেই ফেলে রাখা হচ্ছে। আপনি শুধু পরিষ্কার মাংস পলিথিনের কালাে প্যাকেটে ভরে বাড়িতে আনছেন। কিন্তু চীনের এই ওয়েট মার্কেট গুলােতে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকরভাবে আপনার সামনেই কাটা হচ্ছে। গিরগিটি, সাপ, বনবেড়াল, কুকুর। গিরগিটির চামড়া, সাপের খােলস বনবেড়ালের পা, কুকুরের অন্ত্র সব একসঙ্গে পড়ে রয়েছে, হয়তাে পচন ধরছে। এক মৃত শরীর থেকে এক প্রজাতির ভাইরাসের দল আরেক। মৃত শরীরে যাচ্ছে। যারা এগুলাে দিনের শেষে পরিষ্কার করছে, তাদের শরীরে প্রবেশ করছে সেই মারাত্মক ভাইরাসগুলাে। এভাবেই ছড়িয়ে। পড়ছে মারণ ভাইরাস। এরপরে শুরু হলাে আরেক অদ্ভুত প্রবণতা! সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক মুনাফার জন্য একশ্রেণীর ব্যবসায়ী রটিয়ে দিল— শতায়ু হতে চাও তাে গণ্ডারের মাংস খাও। প্রচণ্ড বলশালী হতে চাও তাে বাঘের মাংস খাও। বিছানায় হিউ হেফনার হতে চাও তাে শিম্পাঞ্জির ইয়ে খাও ইত্যাদি।।

এখানেই শেষ নয়, এটাও রটিয়ে দেওয়া হলাে যে মাংসের যথাযথ গুণাগুণ পাওয়ার জন্য তাকে সুসেদ্ধ বা সুপক্ক করা যাবে না। কাঁচা খেলেই সেই মাংসের প্রকৃত গুণ আত্তীকরণ করা যাবে। চোরাকারবারিরা সক্রিয় হলাে, শুরু হলাে আনা endangered species-দের চোরাপথে খাবার প্লেটে ! ২০০৩ সালে যখন SARS-এর প্রকোপ শুরু হয়েছিল, বিজ্ঞানীরা বলে দিয়েছিলেন এর ক্যারিয়ার চাইনিজ সিভিক ক্যাট! তড়িঘড়ি ওয়েট মার্কেট বন্ধ করে দিয়েছিল চাইনিজ সরকার। ওয়াইল্ড লাইফ ফার্মিংকে পুরােপুরি ব্যান করে দিয়েছিল। | কিন্তু বিপদ কেটে যাওয়ার পর আবার যে সেই চাইনিজদের খাদ্যাভ্যাসই ততদিনে বদলে গিয়েছে। তাছাড়া, এতাে সােনার খনি, ২০১৮-তেই ওয়াইল্ড লাইফ ফার্মিং ২৪৮ বিলিয়ন ডলারের এক প্রভূত লাভজনক ব্যবসা হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। | কোভিড-১৯ এসে আবার সব উলট-পালট করে দিয়েছে। কিন্তু বােধােদয় কবে হবে? দেখা যাক, কার জয় হয়, লােভ না ভয়?

পবন চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.