১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ হয়, যাকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা যেতে পারে। ভারতবর্ষ জুড়ে শুধু সৈনিক নয়, সাধারণ মানুষেরা অস্ত্র হাতে নেমে পড়লেন বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এটিকে এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দেখলে ভুল হবে। বহু পূর্বে এর বীজ বপন করা হয়েছিল; ১৮৫৭ সালের পর থেকে সেই ফসল উঠে আসে মাত্র। অতীতের প্রেক্ষাপট দেখলেই আমরা বুঝতে পারবো কীভাবে সনাতন সংস্কৃতি ধীরে ধীরে প্রায় একশো বৎসর ধরে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছিলো।
১৭৬৩ সাল থেকেই বাংলায় সন্ন্যাসী বিদ্রোহ শুরু হয়। সন্ন্যাসীদের ও কিছু মুসলমান ফকিরদের নেতৃত্বে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর অভ্যুত্থান ঘটে যা সামলাতে ইংরেজরা নাজেহাল হয়ে ওঠে। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ তো এঁদের নিয়েই লেখা। ১৮০৩ সালে অজয়গড়ের রাজা লক্ষ্মণ দব বিদ্রোহ করেন; তিনি যখন বন্দি হন পরাজিত হয়ে তখন তাঁর শ্বশুর নিজের কন্যা ও নাতিদের হত্যা করেন ও নিজেও আত্মহত্যা করেন, কারণ পরাধীনতার থেকে মৃত্যুকে সম্মানজনক মনে করেন। ১৮০৮ সালে থিরুভিথামকুরের (Travancore) দেওয়ান বিদ্রোহ করেন। কুড়ি হাজার সৈন্য নিয়ে তিনি ইংরেজদের আক্রমণ করেন ও বহু ইংরেজ সৈন্যকে নিহত করেন। কালিকটের রাজাকে তিনি জানান যে ধৰ্ম রক্ষার্থে খ্রিস্টান ধর্মের আগ্রাসী প্রচারকে রুখতে হবে ও তাকেও রুখে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন। দেওয়ান যখন পরাজিত হন তখন তিনি একটি মন্দিরে আশ্রয় নেন ও সেখানে আত্মহত্যা করেন: হয়তো জীবনের শেষ মুহূর্তে ভেবেছিলেন যে দেবতার কাছে নিজেকে বলিদান করে সংকল্প সিদ্ধ করবেন!
১৮০৬ সালে ভেলোরে সেপাইদের আদেশ দেওয়া হয় যে তাঁরা কপালে তিলক রাখতে পারবেন না ও চামড়ার দড়ি দিয়ে বাঁধা পাগড়ি পরতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই সেপাইরা এটাকে তাদের ধর্মীয় রীতির বিরুদ্ধাচরণ মনে করলেন; প্রথম সঙ্ঘবদ্ধ বিদ্রোহ সেখানে শুরু হয়। পরের বিদ্রোহ হয় ১৮২৪ সালে ব্যারাকপুরে। সেপাইরা চিঠি দিয়ে কমান্ডিং অফিসারদের জানায় যে তারা গঙ্গা ও তুলসীপাতা ছুঁয়ে শপথ করছে যে তারা জাহাজে উঠে কালাপানি পার হবে না। এই নিয়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। ইংরেজ কমান্ডার তখন কলকাতা থেকে একদল ইউরোপিয়ান সৈন্যদের নিয়ে আসে। প্যারেড মাঠে সেপাইরা যখন তাদের অস্ত্র নামাতে অস্বীকার করে তখন পিছন থেকে ইউরোপিয়ান সৈন্যরা তাদের গুলি করে। ৬০ জন সেপাইর সেখানেই মৃত্যু হয়; অন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বহুজন বন্দি হয় ও তাদের হয় মৃত্যুদণ্ড নয়তো সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের কথা অন্যান্য সেপাইরা ভোলেনি। স্বধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে তারা মৃত্যু বরণ করেছে এই ভেবে তাদেরকে মনে রাখা হয়েছিল। ১৮২৪ সালের বিদ্রোহের এক ব্রাহ্মণ নেতাকে একটি জলের ট্যাঙ্কের পাশে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। সেপাইরা সেই স্থানে এক বটগাছ রোপণ করে। সেই গাছকে নতুন সৈনিকদের দেখিয়ে তার বৃত্তান্ত বলা হতো, এইখানে এক মহাপাপ ঘটেছিলো, ব্রহ্মহত্যা হয়েছিল। সেই নেতার পূজার আসবাবপত্র সেপাইদের কাছেই থাকতো। এই সময়ের মধ্যে লক্ষ লক্ষ সেপাইরা সেই পবিত্র বস্তুগুলি সযত্নে রক্ষা করেছে ও পূজা করেছে। এইভাবে স্মৃতি জীবন্ত ছিল। স্বাভাবিকভাবে ইংরেজ অফিসাররা এর কথা জানতেন না। এত সৈনিক এসেছে ও চলে গেছে, কিন্তু সবাই গোপনীয়তা রক্ষা করেছে। ১৮৫৭ সনে স্তম্ভিত হয়ে ইংরেজরা জানলেন যে দীর্ঘ বত্রিশ বৎসর ধরে সুপ্ত ফল্গুধারার মত সেই কাহিনী বয়ে যাচ্ছিলো। এই একনিষ্ঠতা না থাকলে ১৮৫৭ সালের যে স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা আমরা পড়ি তা সম্ভব হতো না।
এর পর আমরা পাই সুপরিচিত কাহিনী। ১৮৫৭ সালে এলো সেই বন্দুকের গুলি — যে গোলাগুলিতে গরু ও শূকর চর্বি লাগানো আছে। বাংলায় মঙ্গল পাণ্ডে প্রথম সর্বসমক্ষে রুখে দাঁড়ান। একসঙ্গে একাধিক ইউরোপিয়ান অফিসারদের সঙ্গে তিনি হাতাহাতি লড়াই করেন ও মনে হলো তিনি বিজয়ী হবেন। অফিসাররা অন্য সেপাইদের গুলি করতে আদেশ দিলে তারা তা অস্বীকার করে। তখন শেখ পল্টু নামে এক সেপাই পাণ্ডেকে আক্রমণ করে ও সাহেবদের মুক্তি পেতে সাহায্য করে। যদিও কিছু সেপাইরা পাণ্ডেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে, সে শেষ অবধি ধরা পড়ে ও তার ফাঁসি হয়। সেখানে উপস্থিত সমস্ত ভারতীয় বাহিনী যদি তার সঙ্গে যোগ দিতো তাহলে অবশ্যি তার এই মৃত্যু হতো না। কিন্তু মনে রাগ থাকলেও সম্পূর্ণ বিদ্রোহ করার মতো চেতনাবোধ তখনও সকলের হয়নি। সেইজন্য তারা সবাই জেগে ওঠেনি। কিন্তু তার আত্মদান সকলকে আরেকবার সচেতন করলো, বৃহত্তর রণক্ষেত্রের জন্য সবাইকে প্রস্তুত করলো। সেই বছরেই আলীগড়ে যখন এক ব্রাহ্মণকে সর্বসমক্ষে ফাঁসি দেওয়া হলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য, তখন এক সেপাই বললো দেখো ধর্মের জন্য প্রাণ দিয়েছেন এই ব্যক্তি। তখন সমস্ত রেজিমেন্ট একসঙ্গে বিদ্রোহ করলো ও দিল্লির পথে রওনা দিলো। অবশেষে সিপাহী বিদ্রোহ বলতে আমরা যা বুঝি শুরু হলো।
ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ নাটক হয়তো এখান থেকে শুরু, কিন্তু প্রথম অঙ্ক শতাধিক বৎসর ধরে অভিনীত হয়েছে। প্রথম থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যবে থেকে রাজদণ্ড নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, তবে থেকে তাদের বিরুদ্ধে ভারতীয়রা সংগ্রাম ঘোষণা করেছে নিজেদের সনাতন সংস্কৃতি রক্ষা করার জন্যে। এবং এই সংগ্রাম সশস্ত্র সংগ্রাম, শান্তিপূর্ণ নয়। (এর উপর হিন্দু চিন্তাধারার প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। অবশ্য হিন্দুদের সঙ্গে বহু মুসলমান যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে ওহাবী মতাদর্শী মানুষেরা এই বিদ্রোহকে বর্জন করেছিলেন। কিছু ওহাবী মতালম্বী ব্যক্তিগতভাবে যোগ দিয়েছিলেন, ফতোয়া মুদ্রণ করেছিলেন যে দার-উল-ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ওহাবী দলগুলি এই বিদ্রোহের আগে এবং পরে ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন এবং তাদের বাহিনী শক্তিশালী ছিল। কিন্তু ১৮৫৭-১৮৫৮ এই গুরুত্বপূর্ণ সময় সেপাইদের কোনো সহায়তা করেনি, কারণ স্বাধীন দেশ হিসেবে ভারতকে তারা কল্পনা করেনি।) ১৮৫৭ ঘটনাবলীর পূর্বেই ধৰ্ম ও দেশমাতৃকা রক্ষার্থে বহুজনে প্রাণ দিয়েছিলেন। যেহেতু তারা সবাই এক হতে পারেননি, এবং ইংরেজ বাহিনী আরও পেশাদার ছিল সেহেতু পরাজয় ঘটেছে–ইংরেজরা বারংবার জয়ী হয়েছিল। কিন্তু যে বীরের সদ্গতি প্রাপ্ত হয়, তাকে কেউ ভোলে না। যদি মনোবল থাকে তাহলে কোনো পরাজয় শেষ কথা নয়, নানা ভাবে সেই সংগ্রাম এগিয়ে চলে ও অবশেষে লক্ষ্য পূরণ করে।
যথা ধৰ্ম, তথা জয়
পাপিয়া মিত্র, অধ্যাপিকা, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ