সংবাদ জগতের আলোকবর্তিকা আদি সাংবাদিক দেবর্ষি নারদ

স্বামী বিবেকানন্দ বলছিলেন আপাত দৃষ্টিতে অলৌকিকতা ও অবিশ্বাস্য ঘটনাবলির মোড়কে আবৃত্ত থাকলেও পুরাণের চরিত্রগুলি সত্য, ন্যায়, নীতি, দানব থেকে দেবতা হয়ে ওঠার মতো শ্রেষ্ঠত্বের সাধনা ও মূল্যবোধের মতো আদর্শের মণিমুক্তো খচিত। শাশ্বত সনাতন এই সমস্ত আদর্শ যুগে যুগে মানব সভ্যতাকে পথ প্রদর্শন করে এসেছে। দেবর্ষি নারদ বাস্তবে ছিলেন কি ছিলেন না, এই চরিত্রের সাথে বর্ণিত অলৌকিক ঘটনাবলি সত্য কি মিথ্যা, তা প্রতিপন্ন করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম সংবাদদাতা হিসেবে দেবর্ষি নারদের জীবন দর্শন এক কালোত্তীর্ণ আদর্শ। শুধু আধুনিক সংবাদজগৎ নয় দেবর্ষি নারদের জীবনাদর্শ ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছেও এক অনুকরণ, অনুসরণ যোগ্য আদর্শ হয়ে উঠতে পারে। দেবর্ষি নারদের চরিত্রের সাথে জড়িয়ে থাকা কালোত্তীর্ণ এই আদর্শের উপর আলোকপাত করাই এই লেখার উদ্দেশ্য।

মনে হতে পারে হঠাৎ করে ‘বিদূষক’, ‘কলহ প্রিয়’ হিসেবে চিহ্নিত দেবর্ষি নারদের মতো একটি পৌরাণিক চরিত্রকে তুলে ধরার প্রয়াস কেন? কিছু সিনেমা সিরিয়ালে নারদ চরিত্রকে বিকৃত করে হাস্যরসের উপাদান হিসেবে তুলে ধরে জনমানসে দেবর্ষি সম্পর্কে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরী করা হয়েছে। ভারতের যে সমস্ত মানবিন্দু আছে সেগুলিকে কলঙ্কিত করার কাজ মেকলে সাহেবের হাত ধরে সেই ইংরেজ আমল থেকেই শুরু হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মেকলে সাহেবের ভাবশিষ্যরা সেই কাজটি পরম যত্নের সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে করে গেছেন। এদের হাত ধরেই সেই পৌরাণিক যুগের ভগবান রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ থেকে শুরু করে আধুনিক কালের রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দদের মতো মনীষীদেরও চরিত্র হনন করার প্রয়াস হয়েছে। দেবর্ষি নারদ সেই তালিকায় একটি সংযোজন মাত্র। পৌরাণিক তথ্য বলছে নারদের মতো আদর্শ চরিত্র কমই দেখা যায়। স্কন্দপুরাণে উল্লেখ আছে অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রশ্ন করে ছিলেন, আপনি কেন প্রতিদিন নারদের নাম জপ করেন। উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন এই ত্রিলোকে দেবর্ষি নারদের থেকে শ্রেষ্ঠ কেউ নেই। নিজের জন্য নয় নারদ সর্বদাই ত্রিলোকের মঙ্গলের কাজই করেন। সে জন্যই তিনি প্রতিদিন নারদের নাম জপ করেন।

ইতিহাস বলছে ভারতীয় পরম্পরাকে সামনে রেখে ১৮২৬ সালের ৩০মে নারদ জয়ন্তীর দিন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রথম সাংবাদিক দেবর্ষি নারদকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে কলকাতায় ভারতের প্রথম হিন্দি সাপ্তাহিক ‘উদন্ত মার্তণ্ড’ আত্মপ্রকাশ করে।

দেবর্ষি নারদের সময় আজকের দিনের মতো প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক বা সামাজিক মাধ্যম ছিল না। সে সময় সংবাদ আদান প্রদান হতো মৌখিকভাবে। এক সাথে অনেক মানুষের কাছে সংবাদ পৌছানোর জন্য মেলা, তীর্থস্থান, হাট বাজার, ধর্মীয় জমায়েতগুলি কাজে লাগানো হতো। একজন আদর্শ সাংবাদিক হিসেবে দেবর্ষি নারদের দেব, মানব ও দানব এই তিন লোকেই অবাধ বিচরণ ও সমান বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল। যুদ্ধের মতো সঙ্কটময় মূহূর্তেও দেবর্ষি নারদ অবাধে যাতায়ত করতেন এবং নিরপেক্ষ ভাবে সঠিক সংবাদ পরিবেশন করতেন। নারদের দেওয়া তথ্য কোন পক্ষই হালকা ভাবে নিতেন না।

সাংবাদিকতা কাজের জন্য যে সমস্ত গুণের বিকাশ হওয়া আবশ্যক দেবর্ষি নারদের চরিত্রে সেই সমস্ত গুণ পূর্ণরূপে বিকশিত হয়েছিল। ব্রহ্মজ্ঞানী এই ঋষির জীবন দর্শনের মূল কথা ছিল ‘লোককল্যাণ’। পুরাণ অনুসারে তিনি ছিলেন ৬৪টি বিদ্যায় পারদর্শী এক চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। যে কোন ধারণা ও পরিস্থিতিকে তিনি যথাযথ ভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষন করতে পারতেন। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমেই উঠে আসতো ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে তার অনুমান। এক মাত্র দেবর্ষি নারদকেই ‘দেবতাদের মন’ বলা হতো। কারণ কিছুক্ষণ কথা বলেই তিনি শুধু দানব ও মানব নয় দেবতাদেরও পড়ে ফেলতে পারতেন।

জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নৈপুণ্য অর্জনের জন্য দেবর্ষি নারদ যে ভাবে প্রয়াসী হয়েছেন মানব সমাজের কাছে চিরকালই তা প্রেরণার উৎস হিসেবে গণ্য হতে পারে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নিজের অসম্পূর্ণতা নজরে আসতেই তিনি কঠোর তপস্যার মাধ্যমে নিজেকে উচ্চমানের সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তপস্যা করে ভগবান বিষ্ণুর কাছে বর লাভ করেন। নারদ সংহিতা নামক সংগীতশাস্ত্র প্রণয়ন করেন। বীণা নামক বাদ্য যন্ত্রটি দেবর্ষি নারদেরই সৃষ্টি।

তিনি নারদ ভক্তিসূত্র নামক গ্রন্থের রচয়িতা। নারদ ভক্তিসূত্রে আত্মা পরমাত্মা সম্পর্কিত ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্ট তিনি উচ্চ মানের দার্শনিক ছিলেন। অন্যান্য ঋষিদের মতো দেবর্ষি নারদের কোন আশ্রম ছিল না। লোককল্যাণের জন্য তিনি সর্বদাই বার্তাবাহক হিসেবে ভ্রমণ করতেন। দেবর্ষি নারদের প্রত্যেকটি বার্তা, বাক্য ও উপস্থাপিত বিষয়সমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে নিজের হিতের জন্য নয় তিনি যা করেছেন সবই লোকহিতের জন্য।

শুধু মাত্র আত্মতত্ত্ব নয় নারদ ভক্তিসূত্রের ব্যাপক ব্যাবহারিক তাৎপর্য়ও আছে। যেমন, ভক্তিসূত্রের ৪৩ নম্বর সূত্রে বলা হয়েছে পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন অবাঞ্ছনীয়কে পরিত্যাগ করতে হবে। যা কিছু অবাঞ্ছনীয় তার প্রচার, প্রসার, প্রতিপালন হওয়া বাঞ্চনীয় নয়। অর্থাৎ নেতিবাচক সাংবাদিকতা এই সমাজের জন্য বিষতুল্য।

৬৩ নম্বর শ্লোকের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করলে দেখা য়াবে দেবর্ষি নারদ সংবাদ হিসেবে পরিবেশনের ক্ষেত্রে কিছু বিধি নিষেধ আরোপ করেছেন। যেমন এক, স্ত্রী বা পুরুষের শরীর বা তার মোহের বর্ণনা করা যাবে না। দুই, নাস্তিকতার বর্ণনা করা যাবে না, তিন শত্রুর চর্চা করা যাবে না। ৭৮ নং শ্লোকে বলা হয়েছে যে কোন মানুষের মধ্যেই অহিংসা, সত্য, শুদ্ধতা, সংবেদনশীলতা এই সমস্ত গুণাবলির সমাবেশ আবশ্যক। সংবাদদাতাদের মধ্যেও এই সমস্ত গুণের সমাবেশ ঘটবে এটাই প্রত্যাশিত।

বাল্মীকি দস্যুবৃত্তি করে পরিবার চালাতেন। একদিন দেবর্ষি নারদকে অর্থ লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে আক্রমন করলে দেবর্ষি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তাঁর পরিবার তাঁর পাপের ভাগী হতে চায় কি না! নারদের মন্ত্রণায় তিনি তাঁর পরিবারের প্রত্যেককে এ প্রশ্ন করলে সকলেই জানায় যে তাঁর পাপের ভাগী তাঁরা হতে চায় না। ঐ দস্যু জীবনের সত্যতা উপলব্ধি করে নারদের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চায়। নারদ তাঁকে রাম নাম জপ করতে শেখান।

ঐ দস্যু বহু বছর সাধনা করে ব্রহ্মার নিকট বরলাভ করে কবিত্ব শক্তি প্রাপ্ত হন। তপস্যারত অবস্থায় তাঁর দেহ বল্মীকের স্তূপে ঢেকে গিয়েছিল বলে তাঁর নামকরণ হয় বাল্মীকি। দেবর্ষি নারদের জন্যই রামায়ণ রচিত হয়েছিল। ঋষি বাল্মীকি ১৬টি গুণ সম্পন্ন একজন আদর্শ মানুষের খোঁজে ছিলেন। দেবর্ষি নারদ ৫৭টি গুণ সম্পন্ন পুরুষোত্তম রামের খোঁজ দেন। সুবক্তা ও অসাধারণ বিশ্লেষক দেবর্ষি নারদের মুখে শ্রীরামচন্দ্রের কাহিনী শুনে ঋষি বাল্মীকির মনে রামায়ণ রচনার ভাবনা আসে।

তিনি ধ্রুবকে তপস্যা ও ঈশ্বর প্রাপ্তির পথ দেখিয়েছেন। প্রহ্লাদকে আধ্যাত্মিক উপদেশ দিয়ে অশুভ শক্তির বিনাশের পথ প্রশস্ত করেছিলেন। কৃষ্ণ পৌত্র অনিরুদ্ধ বাণরাজপুরে অবরুদ্ধ হলে তিনি দ্বারকায় ঐ সংবাদ প্রদান করে দৈত্যবিনাশে সহায়তা করেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় অনেক অসুরের জীবন নাশ হয়। পাণ্ডবরা ইন্দ্রপ্রস্থে রাজধানী স্থাপন করলে দেবর্ষি নারদ সেখানে উপস্থিত হয়ে দ্রৌপদীর জন্য পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে যাতে বিরোধ না হয়, তার নিয়ম নির্ধারণ করতে উপদেশ দেন। ফলত লোককল্যাণের জন্য সকল স্থানেই দেবর্ষি নারদকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও স্বেচ্ছায় উপস্থিত দেখা যায়।

আদি সাংবাদিক নারদ সাংবাদিক হিসেবে যে আদর্শ তুলে ধরেছেন সেগুলি নিয়ে আরো ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন আছে। মানব সভ্যতার সামনে বড় বড় বিপদ দেবর্ষি নারদের প্রচেষ্টায় কেটে গেছে। অর্জুন একবার দিব্যাস্ত্র (হয়তো আজকের দিনের পরমাণু অস্ত্রের সমতুল) পরীক্ষা করতে চাইলে দেবর্ষি নারদ তাঁকে নিরস্ত করে বলেন দিব্যাস্ত্রের ব্যবহার শুধুমাত্র চরম পরিস্থতিতে অশুভ শক্তির বিনাশের জন্যই করা প্রয়োজন। শুধু মাত্র সংবাদ আদান প্রদান নয় দিগ্‌ভ্রান্ত মানুষ ও সমাজকে সঠিক দিশা দেওয়াও যে এক জন সাংবাদিকের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে আদি সাংবাদিক দেবর্ষি নারদ সে আদর্শও প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

সাধন কুমার পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.