‘এজ অব ইনফরমেশন’-এর যুগে বসে এসব ভাবাই যায় না। আমেরিকা ইরাকের ওপর পেট্রিয়ট মিশাইল বর্ষণ করছে, আর ঘরে বসে ছোট পর্দায় তা সরাসরি যখন দেখছি, তখন বাসুদেব অগ্রজ বলরাম সামান্য দূরে থেকেও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের খবরাখবর পাননি—এসব কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। যুবক দেবতারা দময়ন্তীর স্বয়ংবর সভার সামান্যতম সংবাদও পাননি। কপিলমুনির অভিশাপে তার বংশধরেরা যে ভস্মীভূত হয়েছেন, এ সংবাদ সগররাজা পেয়েছেন অনেক পরে। এসব তো বাহ্য। খোদ শিবেরই কাছে অমৃত মন্থনের কোনও খবর ছিল না। অথচ এমন কিছু সংবাদ রয়েছে, যা যথাসময়ে সংশ্লিষ্টজনের কাছে না পোঁছলে এই ভূলোক যে কীভাবে বিপর্যস্ত হোত তা ভাবলেও ভয় হয়। শুধু অমৃত মন্থনের খবরটাই ধরা যাক না কেন। শিব যদি শেষ পর্যন্ত না পৌছতেন, তাহলে মহুনজাত গরল কে ধারণ করত? কার এত হিম্মত ছিল ? কিন্তু ভাগ্যি ভাল, সেযুগেও এসব খবর যথাযোগ্য স্থানে পৌঁছেছে। ভূলোক আসন্ন সব ভয়াবহ সংকট থেকে ত্রাণ পেয়েছে। আর এসবের জন্য যদি কাউকে ক্রেডিট দিতে হয়, তবে তা প্রাপ্য দেবর্ষি নারদের।
বাঙালির ভাবনায় দেবর্ষির এই দিকটি কিন্তু অনাদৃতই রয়ে গিয়েছে। তিনি চত্রিত হয়েছেন একজন কলহ সংঘটনকারী রূপে। কোনও কলহ থেকে মজা লুঠতে হলে বাংলায় নারদ নারদ’ বলে তা উস্কে দেওয়ার চেষ্টা হয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণেই দেখুন, হরগৌরীর বিবাহ উপলক্ষ্যে নারদের বর্ণনা–
‘সর্বাগ্রে নারদ যান কলহ লইয়া।
কন্দলি খোকড়ি সাত কাঁখেতে করিয়া’।১
এর পর নারদের শিবনিন্দা এবং তার পরিণাম–
‘এত শুনি মেনকা স্বামীকে পাড়ে গালি।
কোপে গিরিরাজ ধরে মেনকার চুলি।’২
অথচ মূল রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদিতে নারদ সর্বজন শ্রদ্ধেয় দেবর্ষি। মহাভারতে সভাপর্বে যুধিষ্ঠিরের নবনির্মিত রাজ্যসভার দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হবে।
মহারাজা যুধিষ্ঠির নবনির্মিত রাজ্যসভায় ত্রিদশাধিপতি ইন্দ্রের মতো সপারিষদ বসে রয়েছেন। মহাসুর ময়ের চৌদ্দ মাসের চেষ্টায় কৈলাসের উত্তরাংশে মৈনাক পর্বতের কাছে এই রমণীয় সভা নির্মিত হয়েছে। বিভিন্ন বৃক্ষশ্রেণীতে সুশোভিত এই মহামণ্ডপের চারদিক পাঁচ হাজার হাত পর্যন্ত বিস্তৃত। সভাস্থলে এক অপূর্ব সরোবর। বিন্দু সরোবরের মতোই তার জল অতি স্বচ্ছ। এমন বিশাল, বিপুল, বহু চিত্র ও অত্যুত্তম দ্রব্যসম্ভারে শোভিত, রত্নপ্রাকার মণ্ডিত সুরক্ষিত রমণীর সভা ভূলোকে আর নেই। সভাগৃহে প্রবেশ উপলক্ষে দেবপূজা ও ব্রাহ্মণাদির সকার-পর্ব ইতিমধ্যেই সম্পন্ন। অসিত, দেবল, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, শুক, সুমন্ত, জৈমিনি, পৈল, তৈত্তিরি, যাজ্ঞবল্ক্য, অনীমাব্য, মার্কণ্ডেয়, গালব, ভৃগু, গৌতম প্রমুখ বেদবেদাঙ্গ পারঙ্গম, ধৰ্মৰ্ভজ্ঞ, জিতেন্দ্রিয়, বহু মহর্ষি সেখানে সমবেত হয়েছেন। বীর্যবান উগ্রসেন, ক্ষিতিপতি, কক্ষসেন, মহাবল, কম্পন, যবনাধিপতি চাণুর, কিরাতরাজ পুলিন্দ, পুণ্ড্রক, অঙ্গ, বঙ্গ, অন্ধক, পাণ্ডা, ভোজ, কলিঙ্গ, মগধ, বৈদেহ, মহাবল শ্রুতায়ু, শিশুপাল প্রমুখ রাজ্যন্য ও মহারাজ যুধিষ্ঠিরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। গীতবাদ্য বিশারদ তান-লয়-কুশল চিত্রসেন এবং গন্ধর্ব, অপ্সরা ও কিন্নরগণের সঙ্গীত লহরীতে সভায় সৃষ্ট হয়েছে এক স্বর্গীয় আবেশ। স্বর্গে দেবতারা যেমন ব্রহ্মাকে আরাধনা করেন, সেইরকম এই মহতী সভায় সকলে সমবেত হয়ে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের গুণকীর্তন করছেন।
আর এই সময়েই পারিজাত, রৈবত, সুমুখ, ধৌম্য প্রমুখ কয়েকজন তপস্বীকে সঙ্গে নিয়ে দেবর্ষি নারদ সেই সভাস্থলে এসে উপস্থিত হলেন। অগ্নিসম, তেজস্বী, প্রভাত সূর্যের মতো তার স্নিগ্ধ দৃষ্টি—‘জুলিতাগ্নিপ্রতীকাশো বালকসদৃশেক্ষণ’।২ক মস্তকে পিঙ্গল জটা। ললাটে পিঙ্গল ফোঁটা। পরনে স্বর্ণচীর, হাতে হেমদণ্ড, কমণ্ডলু আর অতি বিচিত্র কচ্ছপী বীণা। মহাভারতের শল্যপর্বে নারদের বর্ণনা
‘জটামণ্ডলসংবীতঃ স্বর্ণচীরো মহাতপাঃ।
হেমদণ্ডধরো রাজন্ কমণ্ডলুধরস্তথা।
কচ্ছপীং সুখশব্দাং তাং গৃহাঃ বীণাং মনোরমাম।’৩
সহসা দেবর্ষিকে দেখে সভার সকলেই সসম্রমে উঠে দাঁড়ালেন। কাশীরাম দাসের বর্ণনায়—দেখিয়া নারদ ঋষি / যে ছিল সভায় বসি/ সম্ভ্রমে উঠিল ততক্ষণে।’ সমাজের ওপর এই যে ‘কম্যান্ড’ বা প্রভাব স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেবও উগ্রসেনের এক প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে স্বীকার করেছেন। দেবর্ষি নারদকে পূজনীয় বলে বর্ণনা করে বাসুদেব বলেছেন, শাস্ত্রজ্ঞ এবং দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী হয়েও তার কোনও স্বাভিমান ছিল না। ‘অভিন্নতচারিত্রস্তস্মাৎ সর্বত্র পুজিতঃ।’৪ তিনি ‘সর্বগুণসংসপন্নং দক্ষং শুচিমনাময়ং’৫–সর্বগুণসম্পন্ন, কার্যকুশল, পবিত্র সময়সচেতন ঋষি।
পাণ্ডব অগ্রজ যুধিষ্ঠির অনুজদের নিয়ে অতি বিনীতভাবে দেবর্ষিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। আসন গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে গো, সুবর্ণ, মধুপর্ক ইত্যাদি সামগ্রী দিয়ে যথাবিধি অভ্যর্থনা জানালেন।
পঞ্চপাণ্ডব দেবর্ষির অতি প্রিয় পাত্র। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের জন্মলগ্নে তিনি। স্বয়ং সেখানে উপস্থিত থেকে নবজাতকের কল্যাণ প্রার্থনা করেছেন। কিছুদিন আগেও তিনি খাণ্ডবপ্রস্থে পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। পিতামহ ভীষ্ম ও জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রের নির্দেশে পাণ্ডবেরা নববধু দ্রৌপদীসহ সেইসময় খাণ্ডবপ্রস্থে বসবাস করছিলেন।
সমকালীন ভারতবর্ষে ধর্মরাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যাস-বাসুদেবের সঙ্গে। দেবর্ষি নারদও সম্মিলিত হয়েছিলেন। পাণ্ডবদের মাধ্যমে সেই লক্ষ্য সাধিত হবে বুঝে দেবর্ষি নিরন্তর সম্পর্ক রেখে চলতেন। অনুমাত্র অমঙ্গলের আশঙ্কা থাকলে তিনি পাণ্ডবদের সচেতন করে দিয়েছেন। পথনির্দেশ করেছেন। দ্রৌপদীকে কেন্দ্র করে যাতে ভ্রাতৃবিচ্ছেদ না হয়, তারই উপায় নির্দেশের জন্যই তার খাণ্ডবপ্রস্থে আগমন। এই প্রসঙ্গেই পাণ্ডবদের কাছে সুন্দ-উপসুন্দের কাহিনি বর্ণনা। মহাসুর হিরণ্যকশিপুর বংশজাত দৈত্যরাজ নিকুম্ভের পুত্র এই দুই সহোদরের মধ্যে এতটাই সৌহার্দ্য ছিল যে তারা একত্র শয়ন, ভোজন, উপবেশন ও রাজ্যশাসন করত। দেখে মনে হত, একজনই যেন দুভাগে বিভক্ত হয়ে দুই শরীর ধারণ করেছে। ব্রহ্মার বরে তারা ছিল অন্যের অবধ্য। একমাত্র একে অপরের বধ্য। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাই ঘটেও ছিল। উপলক্ষ্য-ললনা তিলোত্তমা।
এই কাহিনির মাধ্যমে দেবর্ষি ভবিষ্যৎ বিপদ আশঙ্কা থেকে মুক্তির যে পথনির্দেশ দিয়েছিলেন ধীমান পাণ্ডবদের বুঝতে তা অসুবিধা হয়নি। তারা স্থির করেছিলেন, তাঁদের পাঁচজনের মধ্যে একজন যখন দ্রৌপদীর গৃহে থাকবেন তখন অন্যজন সেখানে যাবেন না। আর এই নিয়ম যে অগ্রাহ্য করবে তাঁকে বারো বছর ব্রহ্মচারী হয়ে বনে বাস করতে হবে।
প্রিয় পাণ্ডবদের সভাগৃহ প্রবেশ অনুষ্ঠানে দূরদর্শী দেবর্ষির উপস্থিতি স্বাভাবিক। অদূর ভবিষ্যতে ভারত সম্রাটরূপে যুধিষ্ঠিরকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষে তার এই আগমন। আর একারণে তিনি এমন কিছু প্রশ্নের অবতারণা করেছেন যা যুধিষ্ঠিরের জানা একান্ত প্রয়োজন। জিজ্ঞাসাচ্ছলে দেবর্ষি রাজনীতির পা যুধিষ্ঠিরকে পড়িয়েছেন। যুধিষ্ঠিরকে নারদের জিজ্ঞাসা–
ধর্ম পথে থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন তো? সময়মতো ধর্ম, অর্থ ও কামের। সেবা? চতুর্দশ প্রকারে রাজদোষের পরীক্ষা? নিজেকে দুর্বল ও প্রতিপক্ষকে বলবান মনে করে সাম ও দান নীতি অনুসারে তাদের সঙ্গে সন্ধি করে কষি। বাণিজ্য-সহ আটটি কার্য? কৃষি, বাণিজ্য, পশুপালন ও সুদ গ্রহণ—এই কাজগুলি ভালো লোক দ্বারা হয় তো? অন্যান্য দেশ থেকে আগত বণিকদের কাছ থেকে শুল্ক আদায় করেন তো? দুর্গরক্ষক, সৈন্যাধ্যক্ষ, বিচারক, প্রধান সেনাপতি, পুরোহিত, বৈদ্য এবং দৈবজ্ঞ—এই সাতজন আপনার বিশ্বস্ত তো? লোভী নয়তো? দূত বা মন্ত্রীরা নিজেদের কথা আপনাকে ছাড়া অন্য কারো কাছে প্রকাশ করেন কি? বন্ধু, শত্রু ও উদাসীন পক্ষের কথা গুপ্তচর মাধ্যমে জেনে থাকেন নিশ্চয়? হিতৈষী, চরিত্রবান, বুদ্ধিমান, সদবংশজাত ও অনুরক্ত লোকদেরই মন্ত্রীপদে নিযুক্ত করেছেন তো? শত্রুদের কাছে তারা ক্রয়েযোগ্য নয় তো? আপনি একাকীই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না বহু লোকের সঙ্গে মন্ত্রণা করেন? সব কাজেরই শেষটা আপনার জানা থাকে তো? ধার্মিক ও শাস্ত্রজ্ঞ লোকেরাই বোধ করি রাজকুমারদের শিক্ষা দেন? আপনার দুর্গগুলি ধন, ধান্য, অস্ত্র, জল, যন্ত্র, শিল্পী ও যোদ্ধা দ্বারা সুরক্ষিত নিশ্চয়? সৈন্যদের যথোচিত খাদ্য ও বেতন? যাঁরা রাজকার্যের কারণে নিহত বা আহত হন, তাদের পরিবারদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা? ভয়ঙ্কর দণ্ড দিয়ে প্রজাদের উদ্বিগ্ন করেন না তো? গুণীদের পুরস্কৃত করেন তো? শরণাগতকে রক্ষা? কারো কথায় বিভ্রান্ত হয়ে আশ্রিতজনের বৃত্তি বন্ধ করেন না তো? প্রজাদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছেন তো? সর্বপ্রধান রাজা আপনার অনুরক্ত তো ? শত্রুর দুর্বল মুহূর্তেই আপনি শত্রুকে আঘাত করেন নিশ্চয়? জয় করা রাজ্যের ধনরত্নাদি যোগ্যতানুযায়ী প্রধান প্রধান যোদ্ধাকে দিয়ে। থাকেন তো? আয়ের চারভাগের এক ভাগ মাত্র আপনি নিজের জন্য বোধ করি ব্যয় করেন? নাস্তিকতা, প্রবঞ্চকতা, ক্রোধ, অসাবধানতা, দীর্ঘসূত্রিতা হত্যা চৌদ্দটি দোষ সম্বন্ধে আপনি সদা সচেতন নিশ্চয়? মহাভারতের সভাপবের কচ্চিৎ প্রশ্ন অধ্যায়ে পঁচানব্বইটি শ্লোকের ইতিবাচক এই প্রশ্নগুলির প্রাসঙ্গিকতা আজও কি অস্বীকার করা যায়? রামরাজ্য বা জনকল্যাণমূলক রাজ্যের শাসকবর্গের পক্ষে রাজনীতির এই সূত্রগুলিকে যুগোচিত। সংস্কারের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নয় কি? নারদ একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ শুধু। নয়, রাষ্ট্রহিতের আকাঙ্ক্ষায় সদা সক্রিয়ও। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরও স্বীকার করেছেন, দেবর্ষির রাজধর্ম সংক্রান্ত উপদেশ ন্যায়ানুগত এবং তিনি সাধ্যানুসারে তা। পালনও করে থাকেন। দেবর্ষিকে প্রণাম জানিয়ে যুধিষ্ঠিরের ‘রাজ’ বলে সম্বোধন—“রাজাব্রবীন্নরদং দেবরূপম্’৬—তাই যথোচিতই বলতে হবে।
যুধিষ্ঠিরের জিজ্ঞাসা এখানেই তৃপ্ত হয়নি। তিনি জানেন নারদ বহুদর্শী। ব্রহ্মা একবার নারদকে শাপ দিয়ে বলেছিলেন, ‘ভস্মাল্লোকে তে মুঢ় ন ভবে ভ্ৰমতঃ পদ’—অর্থাৎ নারদ সবসময় পায়ের ওপর থাকবেন। শাপে বর হল নারদের। ‘অ্যাক্রেডিয়েশন কার্ড’ নারদের হাতে সহজেই এসে গিয়েছিল। তিনি স্বর্গমর্ত্য সর্বত্র সহজেই ঘুরে বেড়াতে পারতেন। মনের ন্যায় দ্রুতগামী তার গতি। নারদ ‘মনোজব’। তাই যুধিষ্ঠির সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। নবনির্মিত এই সভা নিয়ে তার মনে যে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল না তা নয়। সেটাই তিনি একবার। যাচাই করে দেখতে চাইলেন। আর এক্ষেত্রে নারদের থেকে উপযুক্ত আর কে-ই বা হতে পারেন।
যুধিষ্ঠির বললেন—দেবর্ষি, আপনি বহুদর্শী—‘ভবাংশ্চরতি বৈ লোকান্ সদা নানাবিধান বহুন্’৭–সর্বদাই আপনি নানা লোকে বিচরণ করে থাকেন। এই সভার মতো উৎকৃষ্ট বা এর এর থেকেও উত্তম কোনও সভা দেখে থাকলে আপনি তা বলুন।
যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নে নারদ স্মিত হাসলেন। বললেন, রাজন, আপনার এই মণিময়ী সভার মতো কোনও সভা মনুষ্যলোকে এর আগে আমি কখনও দেখিনি। ‘সভেয়ং মানুষে লোকে সর্বশ্রেষ্ঠতমা তব’৮। তবে আমি ইন্দ্র, যম, বরুণ এবং কুবেরের সভার কথা বলব। আর এই সব সভার কথা শোনার পরও যদি আপনাদের ধৈর্য থাকে তবে স্বর্গীয় ব্রহ্মসভার কথাও বর্ণনা করব।
দেবর্ষি এবার এক এক করে পাঁচটি সভার বিশদ বর্ণনা অর্থাৎ রিপোর্টিং করেছেন–
দেবরাজ ইন্দ্রের সভা অতি উৎকৃষ্ট। বিস্তারে একশো যোজন, দৈর্ঘ্যে দেড়শো যোজন ও উচ্চতায় পাঁচ যোজন। এই সভা ইচ্ছামতো আকাশ পথে বিচরণ করতে পারে। জরা, শোক, শ্রান্তি ও ভয় এখানে নেই। পরিবর্তে রয়েছে শান্তি, মঙ্গল, উত্তম গৃহ, স্বর্গীয় বৃক্ষশ্রেণী। দেবরাজ মহিষী শচীদেবী শ্ৰী, লক্ষ্মী, স্ত্রী, কীর্তি ও দ্যুতিদেবীর সঙ্গে সেই সভায় বসে পরস্পর আলাপ করছেন। সিদ্ধগণ, দেবর্ষিগণ, সাধ্যগণ, দেবগণও সেই সভায় উপস্থিত। অঙ্গরা ও গন্ধর্বগণ নৃত্য, গীত, বাদ্য, নানাবিধ হাস্য, স্তব, মাঙ্গলিক সঙ্গীতাদি দ্বারা দেবরাজকে আনন্দ দিয়ে থাকেন। পরাশর, দুর্বাসা, দীর্ঘতম, যাজ্ঞবল্ক্য, উদ্দালক, শ্বেতকেতু, অগ্নিদেব, বিশ্বকর্মা, রাজা হরিশ্চন্দ্র, বিশ্বামিত্র, দেবগুরু বৃহস্পতি, দৈত্যাচার্য শুক্র—সমসাময়িক স্বনামধন্যরা প্রায় সকলেই সেই সভায় যাতায়াত করে থাকেন।
দেবর্ষি একই ভাবে যম, বরুণ ও কুবেরের সভার আকার-আয়তন, বিশেষ বৈশিষ্ট্য উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের পরিচয়াদি বর্ণনা করেছেন। যেমন, যম সভায় পবিত্র শব্দ শোনা যায়, পাওয়া যায় দিব্য গন্ধ। বরুণের সভা নির্মিত হয়েছে জলের তলায়। নাগ, দৈত্য, সমুদ্র ও নদ-নদী সেই সভার পরিষদ। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা এই দুই সভার নির্মাতা। কুবেরের সভা কৈলাস শৃঙ্গের মতো উঁচু। শত শত যক্ষ, রাক্ষস, গন্ধর্ব, অঙ্গরা পরিবৃত হয়ে যক্ষরাজ কুবের এই সভায় অবস্থান। করেন। প্রতিটি সভাই দেবর্ষি পর্যটন করে এসেছেন। অপরের মুখের ঝাল খাননি। একেবারে ‘স্পট রিপোর্টিং’।
ব্রহ্মার সভা দর্শনের ছাড়পত্র অবশ্য তিনি সহজে সংগ্রহ করতে পারেননি। এজন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। দেব দিবাকর বৈবস্বতের কাছ থেকে তিনি ব্রহ্মার সভার কথা প্রথম শুনছিলেন। সেই সভা দর্শনের জন্য সূর্যদেবের নির্দেশে তাঁকে পালন করতে হয়েছিল ব্রহ্মব্রত অনুষ্ঠান। ব্রত শেষে বৈবস্বতের সঙ্গেই তিনি ব্রহ্মর সভায় গিয়েছিলেন।
সভার বর্ণনা করতে গিয়ে দেবর্ষি ভূমিকাতে মানে আজকের জার্নালিজমের পরিভাষায় যা ইন্ট্রো’ তাতে বলেছেন, সেই সভাটি এমন—এরকম বলা যায় না। কেননা, ব্রহ্মার ইচ্ছানুসারেই ক্ষণে ক্ষণেই সভাটি বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। এরপর অন্য সভাগুলির মতো এই সভারও বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। এই সভার পরিমাপ। নির্ণয়ের অসামর্থ্যের কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, এর আগে এমন সভা কখনও দেখেননি তিনি। সকল লোকের পিতামহ ব্রহ্মা স্বয়ং সেই সভায় বিরাজ করছেন। প্রজাপতিরা ব্রহ্মর স্তবগানে রত। সকল মহর্ষি, দেবতা, গন্ধর্ব, অপ্সরা, দিকপাল ও ঋতুগণ, অদিতি, দিতি, শ্রী, স্বাহা, লজ্জা প্রমুখ দেবীও সেখানে রয়েছেন। স্বভাবসুখদায়িনী এই ব্রহ্মসভা দেবগণের উপস্থিতিতে যেমন কর্মচঞ্চল, অনুপস্থিতিতেও তেমনই কর্মচঞ্চল। এককথায়, ত্রিভুবনে ব্রহ্মার সভা তুলনাহীন।
দেবর্ষি যে উদ্দেশ্য নিয়ে যুধিষ্ঠিরের সভায় এসেছিলেন, বিভিন্ন সভার বিশদ বর্ণনার পেছনেও তা ছিল। দেবরাজ ইন্দ্রের রাজসভায় একমাত্র রাজা হরিশ্চন্দ্রের উপস্থিতির উল্লেখ করে তিনি সুকৌশলে যুধিষ্ঠিরের মনের উচ্চাশার—কীর্তি। প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা জাতের চেষ্টা করেছিলেন। যুধিষ্ঠিরের জিজ্ঞাসা ছিল—কোন্ গণ্য কর্মের কারণে একমাত্র রাজর্ষি হরিশ্চন্দ্র দেবরাজ ইন্দ্রের অমরাবতী সভায়। অবস্থান করছেন? কোন্ কীর্তি বলে তিনি দেরাজের সমকক্ষ?
দেবর্ষি এই ধরনের প্রশ্নই যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে প্রত্যাশা করেছিলেন। স্মিত হেসে বললেন, মহারাজ, রাজা হরিশ্চন্দ্র সসাগরা স্বদীপা বসুন্ধরার সম্রাট ছিলেন। পৃথিবীর সকল রাজারাই তার শাসনাধীন। সপ্ত-দ্বীপ জয় করে তিনি। রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন। আর এই যজ্ঞ শেষেই তিনি সম্রাট রূপে অভিষিক্ত হন। মহারাজ, যে মহীপালেরা রাজসূয় যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, তারাই ইন্দ্রলোকে গিয়ে পরমসুখে কালযাপনের অধিকারী হন।
দেবর্ষি এটুকু বলেই থামলেন না। রাজসূয় যজ্ঞের প্রতি যুধিষ্ঠিরের সুপ্ত। ইচ্ছাকে সংকল্পে পরিণত করার জন্য তার প্রয়াত পিতা পাণ্ডুর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সংবাদটিও জানালেন। বললেন, আপনার পিতা পাণ্ডু রাজা হরিশ্চন্দ্রের এমন সৌভাগ্য দেখে রাজসূয় যজ্ঞ সম্পন্ন করার কথা আপনাকে জানানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কেন না, তাহলে তিনিও রাজা হরিশ্চন্দ্রের মতো অবিচ্ছিন্ন সুখ সম্ভোগ করে দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে কালযাপন করতে পারবেন। ভূলোকে। গেলে অবশ্যই তার অনুরোধ রক্ষা করব বলে তখন তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।
নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষার পর যখন দেখলেন আপন উদ্দেশ্য সাধনের। প্রাথমিক পর্বটুকু তিনি সম্পন্ন করতে সার্থক হয়েছেন, তখন দেবর্ষি ধীরে ধীরে রাজসূয় যজ্ঞের বৈশিষ্ট্য খুবই সংক্ষেপে যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন। মহারাজ, রাজসূয়। যজ্ঞের মধ্যে প্রধান বটে, কিন্তু এতে বিঘ্ন অনেক। যজ্ঞহন্তা ব্রহ্মরাক্ষসেরা সততই এর ত্রুটি খুঁজতে থাকে। এই যজ্ঞে ক্ষত্রিয়নাশ তথা মানুষের হত্যার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থাৎ কোনো না কোনো অনিষ্ট ঘটনার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাই সব দিক ভেবেই যাতে শ্ৰেয়োলাভ হয়, সেই কাজ করুন। দেবর্ষি নারদ এরপর যুধিষ্ঠিরের রাজ্যসভা থেকে বিদায় নিয়েছেন।
২
দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। এক, দেবর্ষি নারদ বহুদর্শী। বহু জায়গায় গিয়েছেন, বহু কিছু দেখেছেন। আর এজন্য যে আয়াসের প্রয়োজন তাও তিনি স্বীকার করেছেন। ব্রহ্মার সভা দর্শনের তার প্রস্তুতি এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। আর দুই, বহুজনের সঙ্গে দেবর্ষির সম্পর্ক। বহুজন তাকে চিনতেন, জানতেন এবং শ্রদ্ধাও করতেন। লক্ষণীয়, যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় তার উপস্থিতি সকলেই সশ্রদ্ধ চিত্তে স্বীকার করে নিয়েছেন। তার এই পরিচিতির তালিকায় ব্যাস-বাল্মীকি-মার্কণ্ডেয় প্রমুখ ঋষি-শ্রেষ্ঠ যেমন ছিলেন, তেমনি কুরুকুলের বা। যদুবংশের রাজপুরুষেরাও ছিলেন। শিবি, সৃঞ্জয়, অকম্পন প্রমুখ নৃপতি থেকে ইন্দ্রের সারথি মাতলি পর্যন্ত—এক ব্যাপক জনসম্পর্ক, আজকের পরিভাষায় যা ‘পাবলিক রিলেশন’ তা তিনি গড়ে তুলেছিলেন।
ইদানীংকালের সঙ্গে পার্থক্যটা শুধু এই—অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সম্পর্কটা প্রয়োজন ভিত্তিক—ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। দেবর্ষির ক্ষেত্রে তা ছিল অন্তরের আকর্ষণ। লোক কল্যাণের স্বার্থেই তিনি নিজেই সকলের দরজায় গিয়ে হাজির হয়েছেন। তুলসীদাসের ‘রামচরিত মানস’-এ একটি দোঁহা আছে যার অর্থ মদের দোকানে না ডাকলেও লোকে ভিড় করে আর দুধ অমৃত হলেও গোয়ালাকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তা বিক্রি করতে হয়। জগতের এটাই রীতি। এই রীতি দেবর্ষির অজানা ছিল এটা ভাবা বাতুলতা মাত্র। তাই তিনি নিজেই গিয়েছেন। ধীরে ধীরে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। আপন করে নিয়েছেন। প্রয়োজনে পথনির্দেশ দিয়েছেন।
মাতলির প্রসঙ্গটাই ধরা যাক না কেন। ইন্দ্রের সারথি মাতলি। মেয়ে বিবাহযোগ্য হলে সব বাবা-মায়েরই যা হয়, মাতলিরও হয়েছে তাই। মেয়ে গুণকেশীর পাত্রের সন্ধানে তিনি বেরিয়ে পড়েছেন। এদিক-ওদিক ঘুরে মাতলি। যখন নাগলোকের দিকে যাচ্ছেন, পথে দেবর্ষির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হলো। শুভেচ্ছা, সৌজন্য বিনিময়ের পর মাতলি তার নাগলোকে যাওয়ার উদ্দেশ্যটার কথাটাও জানালেন। নিজের ছেলেমেয়ে না থাকলে কী হবে, বাপ-মা’র ব্যথা দেবর্ষি বোঝেন। সুতরাং তিনিও মাতলির সঙ্গী হলেন। নাগলোকে পৌঁছতে হলে বরুণলোকে, পাতাল লোক আর রসাতল হয়ে যেতে হয়। মহাভারত’-এ এইসব লোকের বিস্তৃত বর্ণনা আছে। নারদ ও মাতলি সেইসব লোক ঘুরে শেষ পর্যন্ত নাগলোকে পৌঁছলেন।
দেবর্ষি নাগরাজ আর্যকের নাতি সুমুখের সঙ্গে মাতলির কন্যা গুণকেশীর বিবাহের প্রস্তাবটা রাখলেন। প্রস্তাব শুনে নাগরাজ আর্যক খুশিই হলেন। কিন্তু সে অনেকটা পদ্মপাতার জলের মতো। বললেন, প্রস্তাবটা ভাল হলেও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, সুমুখের আয়ু আর মাত্র কয়েকদিন। পক্ষীরাজ গরুড় পূর্বশর্ত মতো। সুমুখকে ভক্ষণ করবেন। এ সংবাদ শুনে নারদ ও মাতলি দুজনেই খুব ব্যথিত হলেন। কিন্তু একজন তরতাজা তরুণ এভাবে শেষ হয়ে যাবে—দেবর্ষির মন তা। যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। শেষপর্যন্ত দেবর্ষির সঙ্গেই মাতলি ও সুখ দেবরাজ ইলর সভায় উপস্থিত হয়ে সকল বৃত্তান্ত জানালেন। সেইসময় ভগবান বিষ্ণুও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। শ্রীবিষ্ণুরই পরামর্শে দেবরাজ ইন্দ্র। সমুখকে উত্তম আয়ু প্রদান করলেন। সুমুখ আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকেই শুধু রক্ষা। পেলেন না, গুণকেশীকেও বধূ হিসাবে লাভ করলেন। এভাবেই এই পর্বের সমাপ্তি ঘটেছিল।
নাগ যুবক সুমুখের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ইন্দ্রের রাজসভা পর্যন্ত দেবর্যি। ছুটে গিয়েছিলেন। অথচ পুত্রশোকে কাতর রাজা সৃঞ্জয়কে বৃথা অনুতাপ করতে বারণ করছেন। যদিও সৃঞ্জয় পুত্র সুবর্ণষ্ঠীবী বাঘের আক্রমণে অকালেই নিহত হয়েছিল। দেবর্ষির চরিত্রের এই আপাতবিরোধী আচরণের মূলে রয়েছে মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবিতা সম্বন্ধে রাজা সৃঞ্জয়কে বোঝানোর প্রয়াস। সৃঞ্জয়ের থেকেও ধর্মশীল, জ্ঞানবান, নিস্পৃহ ও ঐশ্বর্যশালী মহীপালদের মৃত্যু হয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় হল, এই প্রসঙ্গে তিনি অতিথীর পুত্র মহারাজ সুহোত্র, উশীনরতনয় মহাত্ম শিবি, দুষ্মন্তপুত্র রাজ চক্রবর্তী ভরত, দশরথতনয় রঘুকুলশিরোমণি শ্রীরামচন্দ্র, রাজা। ভগীরথ, মহাত্মা দিলীপ, যুবনাশ্বতনয় মান্ধাতা, নহুযাত্মজ মহারাজ যযাতি, মহারাজ নাগভাগতনয় অম্বরীষ, মহারাজ শশবিন্দু, অমূর্তরার পুত্র মহারাজ গয়, সৃষ্কৃতিনন্দন রন্তিদেব, ইক্ষবাকু বংশীয় পরাক্রমশালী সগর, বেণপুত্র পৃথু প্রমুখের বৃতান্ত শুনিয়েছেন। দেবর্ষির পরিচয়ের পরিধির ব্যাপকতা ও দৃষ্টির গভীরতা বিস্ময় সৃষ্টি করে।
শুধু রাজা সৃঞ্জয় কেন, পুত্ৰবিনাশে বিষাদগ্রস্ত ভূপতি অকম্পন অথবা অকাল। পুত্র বিয়োগে কাতর নৃপতি চিত্রকেতুকেও দেবর্ষি বিগতশোক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে দেবর্ষি যে উপাখ্যানটি শুনিয়েছেন, তা যেমন হৃদয়স্পর্শী, তেমনি তার আড়ালে যে ভাবনাটি রয়েছে তা আরও আমাদের ভাবাচ্ছে।
উপাখ্যানটি এরকম : পৃথিবীতে প্রজার সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ায় প্রজাপতি ব্রহ্মা খুবই উদ্বেগের মধ্যে পড়লেন। অসংখ্য জীবের কারণে পৃথিবীতে এক অরাজক অবস্থা দেখা গিয়েছে। আনন্দ চলে গিয়েছে। তখন ব্রহ্মা ক্রোধানলে নিজেরই সৃষ্টি ধ্বংস করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু দেবাদিদেব মহাদেবের অনুরোধে ব্রহ্মাকে শেষ পর্যন্ত সংযত হতে হল। প্রজাপতি ব্রহ্মা তখন লোকসংহারের জন্য পিঙ্গলবসনা, কৃষ্ণনয়না, দিব্যকুণ্ডলধারিণী ও দিব্যাভরণভূষিতা এক নারীকে সৃষ্টি করলেন। তার নাম মৃত্যু। ব্রহ্মা তাঁকে প্রজাদের পর্যায়ক্রমে বিনাশ করতে নির্দেশ দিলেন।
মৃত্যু কিন্তু এবার নিজের স্রষ্টাকেই অস্বীকার করে বসলেন। নিরপরাধ জীবের বিনাশ করে তিনি অধর্মের ভাগী হতে রাজি নন। প্রিয়জনের চোখের জলের অভিশাপ তিনি সইবেন কেমন করে? জীবাত্মার জন্য এই বেদনবোধ, ন্যায় ধর্মের প্রতি তার এই শ্রদ্ধায় মৃত্যু হয়ে উঠলেন অনন্যা।
ব্রহ্মা তখনও আপন আদেশে অবিচল। মৃত্যু আননেত্র। মৌনী নীরব। শুধু। দু’চোখের কোণে জল। ব্রহ্মার নির্দেশ অস্বীকারের অর্থ মৃত্যু জানেন। প্রিয়জনের। অভিশাপের থেকেও ঢের বেশি তা নির্মম। তবু, তবু নিরপরাধ জীবকে তিনি স্পর্শ করতে পারবেন না। মৃত্যুর সমস্ত হৃদয় এক অনির্বচনীয় বেদনায় হাহাকার করে উঠল।
ব্রহ্মশাপভীতা মৃত্যু এরপর বহুভাবে প্রজাপতি ব্রহ্মাকে প্রসন্ন করার প্রয়াস করেছেন। শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছেন—প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে ব্রহ্মার নির্দেশ স্বীকার করে নিতে হয়েছে তাঁকে। জীবের বিয়োগান্তক পরিণতির তিনি নিজেই প্রথম শিকার ‘ট্র্যাজেডি অব ফেট।
এরপরও কি রাজা সৃঞ্জয়, অকম্পন বা চিত্রকেতুর ‘বিগতশোক’-এ উত্তরণ হওয়াটা খুব অবিশ্বাস্য? মৃত্যু যেন জীবন নাট্য প্রবাহের গ্রিনরুম। মাঝে মাঝে যেখানে পোশাক পাল্টাতে যেতে হয়। স্থান-কাল-পাত্র অনুসারে বিষয়বস্তুর পরিবেশনে দেবর্ষি অদ্বিতীয়।
আর মৃত্যুর বেদনাবোধকে স্বীকার করে নিয়েও প্রজাপতি ব্রহ্মাকে যা ভাবিয়েছিল এবং আজও যা ভাবাচ্ছে, তা বিশ্বের জনভার। সমাজকল্যাণে ব্ৰতবদ্ধ দেবর্ষির দৃষ্টিতে এই সমস্যা এড়িয়ে যায়নি। দেবর্ষি তাই মানুষের কল্যাণেই প্রকৃতির নিয়মকে মেনে নিতে বলেছেন।
॥ ৩ ৷৷
বিদ্বজ্জন সমাজে নারদ সমাদৃত। ব্যাস, বাল্মীকি থেকে শুরু করে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেব পর্যন্ত তাঁর গুণগ্রাহী। উগ্রসেনের কাছে নারদের প্রশংসা করতে গিয়ে বাসুদেব বলেছেন—তিনি সচ্চরিত্রের অধিকারী হয়েও নিরহংকারন চরিত্রনিমিত্তোস্যাহংকারী৯। তিনি কার্যকুশল, পবিত্র, নীরোগ, কালসচেতন ও আত্মতত্ত্বজ। এককথায় তিনি সর্বগুণসংপন্নং’।১° শ্ৰেয়োলাভার্থী গালব দেবর্ষিরই শরণ নিয়েছেন, কেননা, যেসব গুণের কারণে মানুষ লোকসমাজে সমাদৃত হয়, নারদ তার অধিকারী। ভবতানপ্রোণ সর্বাস্তাৎ গুণাল্লংক্ষয়ামহে।১ ঋষিকুলের কাছে তিনি ধর্মের সূক্ষ্ম বিচারক। প্রয়াগে এক ঋষি সমাবেশে মার্কণ্ডেয় মুনি জানতে চেয়েছিলেন, প্রত্যেক যুগের ধর্মের স্বরূপ কী? ঋষিরা তত্ত্বজ্ঞ নারদকেই মার্কণ্ডেয়র প্রশ্নের উত্তর দিতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন- ‘ঋষিভির্নারতঃ প্রোক্তো ব্ৰহি যত্ৰাস্য সংশয়ঃ ।১২
শুধু মুনি মার্কণ্ডেয় কেন, আদি কবি ঋষি বাল্মীকিরও তিনি সংশয় দূর করেছেন। নিজের রচিত শ্লোকের অর্থ না বুঝতে পেরে ভরদ্বাজের আশ্রমে উপস্থিত হয়েছিলেন ঋষি বাল্মীকি। সেইসময় দেবর্ষিও সেখানে ছিলেন। দেবর্ষিকে। সসম্রমে প্রণাম জানিয়ে আপন সংশয়ের কথা জানিয়েছিলেন। তখনই তিনি তিনি। বাল্মীকিকে রামায়ণ রচনার পরামর্শ দেন। রঘুকুলতিলক শ্রীরামচন্দ্রের ইতিবৃত্তও শোনান। সংশয়মুক্ত ঋষি কবির হাতে রচিত হয় রামায়ণ।
ঋষিকুলের মতো রাজন্যবর্গের কাছেও তিনি সমানভাবে সমাদৃত। মহারাজ যুধিষ্ঠিরের জিজ্ঞাসার জবাবে কুরু পিতামহ ভীষ্ম দেবর্ষি নারদের প্রসঙ্গই স্মরণ করেছেন। আবার যুধিষ্ঠিরের মতো পুণ্ডরীক নামে ব্রাহ্মণও নারদের কাছে শ্রেষ্ঠ কর্তব্যের কথা জানতে চেয়েছিলেন। সেই প্রশ্নেরও প্রত্যুত্তর নারদ দিয়েছিলেন। ‘নারদাশ্চব্রতীদেনং ব্ৰহ্মণোক্তং মহাত্মনা।১৩।
ঋষি সমাবেশে মার্কণ্ডেয় মুনির প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব। আর হস্তিনাপুর নরেশের অভিভাবক ভীষ্মের কাছে বর্ণনা করেছেন অন্নের মাহাত্ম। জীবনের বাস্তব চাহিদার কথা তিনি বিস্মৃত হননি। পার্থিব জীবনের সমৃদ্ধিও সত্যানুসন্ধানের সহায়ক—এই বাস্তববোধের ভিত্তিতেই দেবর্ষি অন্নের অর্থাৎ পার্থিব জীবনের বৈভবের গুণকীর্তন করেছেন–
‘লোকতন্ত্রং হি সংজ্ঞাশ্চ সৰ্বৰ্মন্নে প্রতিষ্ঠিত।১৪ অর্থাৎ অন্নের দ্বারাই লোকযাত্রানির্বাহ হয়ে থাকে। নারদ শুধুই তত্ত্বজ্ঞ—একালের ভাষায় ‘থিংক ট্যাঙ্ক’ নন, সাধারণ মানুষের ভাবনাও ভাবেন।
লোককল্যাণে মগ্ন বলেই তিনি দুর্যোধনের আত্মাভিমানের রাশ টেনে ধরতে। বিশ্বামিত্র-গালবের কাহিনি শোনান। কোনো বিষয়েই ‘অতি’ জিনিসটা ভাল নয়। বিশ্বামিত্র শিষ্য গালব গুরুদক্ষিণা প্রদানে সমর্থ হলেও এজন্য যে মূল্য তাকে দিতে হয়েছিল তা অবশ্য অন্য আর এক কাহিনি। কিন্তু দুর্যোধনের প্রতি দেবর্ষির এই উপদেশ ধৃতরাষ্ট্রও সমর্থন জানিয়েছিলেন—“ভগবল্লেবমেবৈতদ যথা বদসি নারদ। ৫।
শুধু আত্মাভিমানী দুর্যোধন কেন, রাজা সুহোত্রেরও স্বভাবের মোড় তিনি ঘুরিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কুরুবংশীয় রাজা সুহোত্র ফিরছিলেন। পথে উশীনরপুত্র শিবির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হল। দুজনে দুজনকে অভিনন্দন জানালেন বটে, কিন্তু কেউ কাউকে পথ ছেড়ে দিতে রাজি হলেন না। পরস্পরে এই গতিরোধের সময় নারদ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সমস্যার মীমাংসায় তিনি দুজনেরই উদারতার কাছে আহ্বান জানালেন। বললেন, নীচকে দানের দ্বারা জয়ের কথা শাস্ত্রে রয়েছে। যে অধিক উদার তিনি অন্যজনের পথ পরিষ্কার করে দিন।
উশীনর-পুত্র শিবিকে প্রদক্ষিণ ও তার শুভকর্মের প্রশংসা করে পথ ছেড়ে দিলেন। সূক্ষ্মদর্শী দেবর্ষি এভাবে ইঙ্গিতে রাজ্য শিবির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন।
অবিবেচকের মতো কেউ কাজ করতে উদ্যত হলে তিনি তাঁকে সরে করারও চেষ্টা করেছেন। যে অর্জুনকে সংবর্ধনার জন্য অন্যান্যদের সঙ্গে তিনি। দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় উপস্থিত ছিলেন, সেই দিব্যাস্ত্রধারী হানকেও হয়ে সেই অস্ত্র প্রদর্শন করতে নিষেধ করেছেন। আর কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষার্ধেনে অর্জুন ও অশ্বথামা যখন পরস্পরের প্রতি ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করেছেন তখন ব্যাসদেব সহ নারদ সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের অস্ত্র প্রত্যাহার হতে বলেছেন। সমকালীন বীরদের অনেকেই এই অস্ত্রবিদ্যা জানতেন, কিন্তু লোককল্যাণের স্বার্থে এই বিদ্যা প্রয়োগ করা ছিল ধর্মবিরুদ্ধ। পাবলিক ইন্টারেস্ট অর্থাৎ সমাজের স্বার্থ রক্ষাই ছিল নারদের ব্রত। নারদ সমছে সর্বভূতহিতৈষনৌ। ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি কৃপুত্র প্রকেও শাল্ববধ থেকে নিরস্ত করেছেন।
গালবের কাহিনি প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় লক্ষ্য রা বার। নারদ হজ লক্ষণ দেখে লোকচরিত্র পাঠেও অভিজ্ঞ ছিলেন। গুরুদক্ষিণা সংহে জন গলৰ যযাতি কন্যা মাধবীকে নিয়ে রাজা হাশ্বের রাজসভায় উপস্থিত হয়েছেন। তার প্রস্তাব, রাজা হর্য যদি মাধবীকে বিবাহ ব্রতে ইচ্ছুক হন, তাহলে ১ মতো শুভ্র অথচ এক কান কৃষ্ণবর্ণ এমন দুশো অশ্ব তাকে দিতে হবে। রাজা হ্যায় তখনই বিবাহে সম্মতি জানিয়েছিলেন। কারণ, শুধু শর্তপূরণে তিনি সমর্থ হলে নয়, মাধবীকে সুলক্ষণা বলে তার মনে হয়েছিল। হব বলেছেন, এই ম্যার করপৃষ্ঠ, পাদপৃষ্ঠ, পয়োধর, নিতম্ব, গণ্ড ও নয়ন—এই ছয় অঙ্গ উন্নত, উন্নতন্নতা টুসু সুক্ষ্মী সূক্ষ্মেয়ী!…. অঙ্গুলিসমূহের পর্ব, কেশ, রোম, নখ ও চর্ম—এই পঞ্চ অঙ্গ সূক্ষ্ম, স্বর, অন্তঃকরণ ও নাভি—এই তিনটি গভীর আর হস্ততল, পদতল, দক্ষিণ নেত্র প্রান্ত, বাম নেত্র প্রান্ত ও নখ—এই পঞ্চ অঙ্গ রক্তবর্ণ ইনি ‘চক্রবর্তিলক্ষণেপেত-পুত্ৰ প্ৰসবসমৰ্থা।
নারদ এখানেই থেমে থাকেননি। যে নারীচরিত্র দেবতাদেরও দুর্জেয়, সেই বিষয়েও অনুসন্ধান করেছেন। অপ্সরা পঞ্চচূড়ার কাছ থেকে তিনি নারীর স্বভাব বৈশিষ্ট্যের কথা জানতে চেয়েছেন। পঞ্চচূড়া নারদের জিজ্ঞাসার জবাব দিতে অস্বীকার করেও যা জানিয়েছেন তা যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ। পঞ্চচূড়া বলেছেন, তিনি নারী হয়ে নারী নিন্দা করতে পারবেন না—‘প্রত্যুবাচ ন শক্ষ্যামি স্ত্রী সতী নিন্দিতুং খ্রিয়ঃ ।১৭।
আবার যুধিষ্ঠির যখন পূজ্য পুরুষের লক্ষণের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন তখন পিতামহ ভীষ্ম স্মরণ করেছেন নারদ-শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেবের প্রসঙ্গ। একদা নারদ। উত্তম ব্রাহ্মণগণের পূজা করছিলেন। সেই সময় সেখানে শ্রীকৃষ্ণ উপস্থিত হয়ে নারদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—আপনি কাদের নমস্কার করেন। দেবর্ষি তখন। লজা পুরুষদের লক্ষণ বর্ণনা করে বলেছেন, যিনি বেদ্রাশ্রয়ী, ক্ষমাশীল ও। জিতেন্দ্রিয় তিনিই পূজ্য, তিনি নমস্য।
আর এই নমস্য হওয়ার মূলে চরিত্রই যে নির্ণায়ক শক্তি, ইন্দ্রপ্রহ্লাদ সন্তের বর্ণনা প্রসঙ্গে নারদ তা জানিয়েছেন। দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর পুত্র। প্রহাদ আপন চরিত্রবলে স্বর্গরাজ্য-সহ ত্রিলোক বশে এনেছিলেন। সুররাজ ইন্দ্র তাতে ভীত হয়ে পড়েন। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের পরামর্শে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে খোদ প্রহাদের কাছেই উপস্থিত হয়ে তিনি শ্রেয়ঃ সাধনের উপায় জানতে চেয়েছিলেন। ব্রাহ্মণের নিষ্ঠায় প্রসন্ন প্রহ্লাদ বর দিতে চাইলে ছদ্মবেশী ইন্দ্র প্রহাদের চরিত্র প্রার্থনা করে বসলেন। ব্রাহ্মণের অভিলাষে প্রহ্লাদ প্রীত হলেন। বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে এক অজানা আশঙ্কায় শঙ্কিতও। তবুও সত্যবদ্ধ প্রহ্লাদ সেই মূহুর্তেই ইন্দ্রের অভিলাষ পূর্ণ করতে দ্বিধা করেননি। চরিত্রকে দান করার পরিণামে ধর্ম, সত্য, সকাৰ্য, বল ও লক্ষ্মী—একে একে সবাই