গোড়ায় নাম ছিল মাতৃ-অভিযেক’। পরে রবীন্দ্রনাথ নিজেই পরিবর্তন করে কবিতাটির নাম দিলেন ‘ভারততীর্থ’ ‘হে মোর চিত্ত পুণ্যতীর্থে জাগোরে ধীরে { এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে। ভারতভূমি বরাবরই যে ছিল তাঁর কাছে পুণ্যভূমি, ‘পুণ্যতীর্থ। কেননা তাঁর নিজের কথাতেই দেশ বলতে কেবল তো মাটির দেশ নয়। সে যে মানবচরিত্রের দেশ। দেহের বাহ্যপ্রকৃতি আমাদের দেহটা গড়ে বটে, কিন্তু আমাদের মানবচরিত্রের দেশ থেকেই প্রেরণা পেয়ে আমাদের চরিত্র গড়ে ওঠে (কালান্তর, বৃহত্তর ভারত’)। কিন্তু এই দেশটাকে তাঁর মহামানবের সাগরতীর’ মনে হল কেন? উত্তর হিসাবে রবীন্দ্রনাথের অন্য একটি প্রবন্ধের কয়েকটি ছত্রের উল্লেখ করা যায়—‘কবীর নিজেকে বলেছিলেন ভারতপথিক। ভারতকে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন মহাপথরূপে। এই পথে ইতিহাসের আদিকাল থেকে চলমান মানবের ধারা প্রবাহিত। এই পথে স্মরণাতীতকালে এসেছিল যারা, তাদের চিহ্ন ভূগর্ভে। এই পথে এসেছিল হোমাগ্নিবহণকরে আর্যজাতি। এই পথে একদা এসেছিল মুক্তিতত্ত্বের আশায় চীনদেশ থেকে তীর্থযাত্রী। আবার কেউ এসেছে সাম্রাজ্যের লোভে, কেউ এল অর্থকামনায়। সবাই পেয়েছে আতিথ্য। এ ভারতের পথের সাধনা, পৃথিবীর সকল দেশের সঙ্গে যাওয়া-আসার, নেওয়া-দেওয়ার সম্বন্ধ, এখানে সকলের সঙ্গে মেলবার সমস্যা সমাধান করতে হবে। এই সমস্যার সমাধান যতক্ষণ না হয়েছে, ততক্ষণ আমাদের দুঃখের অন্ত নেই। এই মিলনের সত্য সমস্ত মানুষের চরম সত্য, এই সত্যকে আমাদের ইতিহাসের অঙ্গীভূত করতে হবে (ভারতপথিক রামমোহন)। সেই তাগিদেই ভারততীর্থ’কবিতাটির শেষ অংশে রবীন্দ্রনাথের উদাত্ত আহ্বান–
এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান—
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার।
এসো হে পতিত, হোক অপনীত সব অপমানভার।
মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা,
মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা
সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থনীরে
আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।
কবিগুরুর চিত্তার চেতনায় এই যে ভারতবোধ, তা এল কোথা থেকে, কেমন করে ? এ তো কোনও তাৎক্ষণিক ভাবাবেগ নয়, প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট কোনও চিন্তনের বহিঃপ্রকাশ নয়, যা কিনা স্বভাবতই স্বল্পায়ু, যাতে ভাটার টান পড়ে সহজেই। বরং এ ছিল তাঁর আজন্ম লালিত, যার বীজ অঙ্কুরোদ্গমের সুযোগ পেয়েছিল তেরো বছর বয়সে ‘হিন্দু মেলা’র প্রেরণাময় পরিমণ্ডলে, কৈশোর-যৌবনের স্বভাবজাত আবেগের মতো তা পরে স্তিমিত হয়ে যায়নি, নানা ঘটনাধারায় পুষ্ট হয়ে ক্রমে তা পরিণত হয়েছিল এক জীবনবোধে যার শিকড় দৃঢ়ভাবে প্রোথিত ছিল ভারতের মাটিতে, যার রসদ জুগিয়েছে ভারতে সংস্কৃতির প্রাচীন শাশ্বত ধারা, ভারত-ইতিহাসের ‘ভাবাত্মক ঐক্যের’ উপলব্ধিতে যা থাকত সদা-সঞ্জীবিত। রবীন্দ্রনাথের এই ভারতবোধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশ ও কালের পটভূমি, অতীত ভারতের ইতিহাস আর পারিবারিক ঐতিহ্য। যে পরিবারে তাঁর জন্ম, তার প্রত্যেকেই নিয়োজিত ছিলেন এমন সব বিবিধ কমে যা স্বাদেশিকতা ও ভারতপ্রীতি প্রেরণা সঞ্জাত। বাবা ব্রহ্মসাধনায় মগ্ন, ভাইদের সকলেই সংস্কৃতি চচায় রত, কেউ সংস্কৃত সাহিত্যের গভীরে ডুব দেন তো কারও তানুরাগ বুদ্ধের জীবন, সাধনপথ ও বৌদ্ধ সাহিত্যের প্রতি, কারও মুগ্ধতার কেন্দ্রবিন্দু মহাকবি কালিদাস। ঠাকুরবাড়ির উদ্যোগেই ১৮৬৭ সালের ১২ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘হিন্দুমেলা’। শিক্ষিত বাঙালিদের মনে জাতীয়তাবোধের বিকাশের জন্য রাজনারায়ণ বসুর পরিকল্পনা আর নবগোপাল মিত্রের যিনি ন্যাশনাল নবগোপাল’বলে সাধারণের কাছে পরিচিত—সক্রিয় প্রচেষ্টায় রূপ পেল এই মেলা। রবীন্দ্রনাথের নিজের কথায়, “ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলিয়া ভক্তির সহিত উপলব্ধির চেষ্টা সেই প্রথম। হিন্দুমেলায় দেশের স্তবগান, দেশানুরাগের কবিতা, দেশীয় শিল্প ও ব্যায়াম প্রদর্শিত ও গুণীজন সমাদৃত হইতেন। ”দ্বিতীয় বছর মেলার উদ্বোধন হয় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মিলে সব ভারতসন্তান’গানটি দিয়ে। বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, “এইমহাগীত ভারতের সর্বত্র গীত হউক। হিমালয় কন্দরে প্রতিধ্বনিত হউক। গঙ্গা-যমুনা-সিন্ধু নর্মদা-গোদাবরী তটে বৃক্ষে বৃক্ষে মর্মরিত হউক। পূর্ব-পশ্চিম সাগরের গম্ভীর গর্জনে মন্দ্রীভূত হউক। এই বিংশতি কোটি ভারতবাসীর হৃদয়যন্ত্র ইহার সঙ্গে বাজিতে থাকুক। ” গানটির কথাগুলি একবার দেখে নেওয়া যাক :
মিলে সব ভারতসত্তান একতান মনপ্রাণ গাও ভারতের যশোগান। ভারতভূমির তুল্য আছে কোন্ স্থান? কোন অদ্রি হিমাদ্রি সমান? ফুলবর্তী বসুমতী স্রোতস্বতী পুণ্যবতী শত খনি রত্নের নিধান। হোক ভারতের জয়, জয় ভারতের জয়, গাও ভারতের জয়, কি ভয় কি ভয় গাও ভারতের জয়। কেন ডর, ভীরু, কর সাহস আশ্রয় যতোধস্তিতো জয়। ছিন্ন ভিন্ন হীনবল ঐক্যেতে পাইবে বল মায়ের মুখ উজ্জ্বল হইবে নিশ্চয় হোক ভারতের জয়, জয় ভারতের জয়।
গোড়া থেকেই হিন্দুমেলায় যোগদান ছিল কিশোর রবীন্দ্রনাথের। স্বরচিত কবিতা পড়তেন, গান গাইতেন। হিন্দুমেলার উপহার’, ‘হোক ভারতের জয়’শীর্ষক ওই সব কবিতার ছত্রে ছত্রে ভারতের জয়গান। ১৮৭৭ সালে হিন্দুমেলার একাদশ অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ যে কবিতাটি পড়েছিলেন, সেটি লর্ড লিটনের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত তখনকার দিল্লি দরবার নিয়ে। কবিতাটির অংশবিশেষ ;
হা রে হতভাগ্য ভারতভূমি, কণ্ঠে এই ঘোর কলঙ্কের হার পরিবারে আজি করি অলঙ্কার গৌরবে মাতিয়া উঠেছে সবে? তাই কাঁপিতেছে তোর বক্ষ আজি ব্রিটিশ-রাজের বিজয়রবে? ব্রিটিশ-রাজে করিয়া ঘোষণা যে গায় গাক, আমরা গব না, আমরা গাব না হরষ গান, এস গো আমরা যে ক’জন আছি, আমরা ধরিব আরেক তান।
কত অল্প বয়সেই রবীন্দ্রনাথের মনে কী পরিমাণ ভারতবোধের উন্মেষ ঘটেছিল, এইরকম আরও অনেক রচনা তা সাক্ষ্য বহন করে।
শুধু হিন্দুমেলা নয়, রাজনারায়ণ বসুরা একটি গুপ্তসভাও প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেওয়া হয়েছিল সঞ্জীবনী সভা’। জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ :‘জ্যোতিদাদার উদ্যোগে একটি সভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নাম স্বাদেশিকতা সভা। ঠনঠনিয়া অঞ্চলের একটা পোড়ো বাড়ির একটা অন্ধকার ঘরে সভা বসতো। সেই ঘরের কোণে একটা টেবিলের ওপর একটা মড়ার মাথা রাখা থাকতো। তার দুটো চোখের দুটে গর্তেদুটো মোমবাতি জ্বলতো। ঋত্বিকরাজনারায়ণ বসু একখানি লাল চেলি পরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আর তাঁর সামনে একটা শপথ বাক্যের নীচে সভ্যপদ প্রার্থীদের নাম স্বাক্ষর করতে হতো বুক-চেরা রক্ত দিয়ে। হিন্দুমেলার মতো এই গুপ্তসভার সঙ্গেও ঠাকুরবাড়ি কাঁচা-মিঠে আঁব’ রবিঠাকুরের’নিবিড় যোগাযোগ ছিল।
দেশের প্রতি, দেশের বন্ধনমুক্তির জন্য যা কিছু উদ্যোগ তার প্রতি, এই মমত্ববোধই যুবক রবীন্দ্রনাথকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন অঙ্গনেও। বোম্বাইয়ে প্রথম অধিবেশন থেকেই শুরু, তারপর বহুবার অধিবেশনের জন্য কত গান, কবিতা লিখে দিয়েছেন। ১৮৮৬-তে কলকাতায় দ্বিতীয় অধিবেশনে স্বকণ্ঠে গেয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম্’ সঙ্গীতটি। নিজে ব্রাহ্ম হয়েও তথাকথিত পৌত্তলিকতার দোষে দুষ্ট এই সঙ্গীত, যাতে দেশকে দশপ্রহরণধারিণী দেবী দুর্গার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যা গাইতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয়নি তাঁর। ভারতবর্ষ, তার সনাতন হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতি এবং সম্প্রদায়গত অস্তিত্ব সম্পর্কে নিজের যে দৃষ্টিভঙ্গি পরিণত বয়সে তিনি ব্যক্ত করেছেন তাঁর আত্মপরিচয়’প্রবন্ধে, তার মধ্যেই যৌবনের এই দ্বিধাহীনতার ব্যাখ্যা মেলে। উপাসনা পদ্ধতি যার যাই হোক না কেন, এদেশে বসবাসকারী সকলেরই পরিচয় হিন্দু বলে মানতেন তিনি। কেননা, হিন্দু কোনও ধর্ম নয়, একটা জীবনদর্শন। ওই প্রবন্ধে তাঁর নিজের কথাতেই ‘হিন্দু কোনও বিশেষ ধর্ম নহে, হিন্দু ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি জাতিগত পরিণাম। ইহা মানুষের শরীর মন হৃদয়ের নানা বিচিত্র ব্যাপারকে বহু সুদুর শতাব্দী হইতে এক আকাশ, এক আলোক, এক ভৌগোলিক নদনদী অরণ্য পর্বতের মধ্য দিয়া, অন্তর ও বাহিরের বহুবিধ ঘাত-প্রতিঘাত-পরম্পরার একই ইতিহাসের ধারা দিয়া আজ আমাদের মধ্যে আসিয়া উত্তীর্ণ হইয়াছে। কালীচরণ বাঁড়ুজ্যে, জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় খৃস্টান হইয়াছিলেন বলিয়াই এই সুগভীর ধারা হইতে বিচ্ছিন্ন হইবেন কী করিয়া? জাতি জিনিসটা মতের চেয়ে অনেক বড়ো এবং অনেক অন্তরতর, মত পরিবর্তন হলে জাতির পরিবর্তন হয় না। এখানে জাতি’ অর্থেজাতনয়, ‘নেশন’এবং মত অর্থেসম্প্রদায় বোঝাতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আরও লিখেছেন, “আমি হিন্দুসমাজেজন্মিয়াছি এবং ব্রাহ্ম সম্প্রদায়কে গ্রহণ করিয়াছি—ইচ্ছা করিলে আমি অন্য সম্প্রদায়ে যাইতে পারি, কিন্তু অন্য সমাজে যাইব কী করিয়া? সে সমাজের ইতিহাস তো আমার নহে। গাছের ফল এক ঝাঁকা হইতে অন্য বকায় যাইতে পারে, কিন্তু এক শাখা হইতে অন্য শাখায় ফলিবে কী করিয়া ? …তবেকি মুসলমান অথবা খৃস্টান সম্প্রদায়ে যোগ দিলেও তুমি হিন্দু থাকিতে পার ?নিশ্চয়ই পারি। ইহারমধ্যে পারাপারির তর্কমাত্রই নাই। হিন্দু সমাজের লোকেরা কী বলে সেকথায় কান দিতে আমরা বাধ্য নই। কিন্তু ইহা সত্য যে কালীচরণ বাঁড়ুজ্যে মশায় হিন্দু খৃস্টান ছিলেন, তাঁহার পূর্বে জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর হিন্দু খৃস্টান ছিলেন। অর্থাৎ তাঁহারা জাতিতে হিন্দু ধর্মে খৃস্টান। খৃস্টান তাঁহাদেরং, হিন্দুই তাঁহাদেবস্তু। হিন্দুর স্বাভাবিক উদারনৈতিকতার উপলব্ধি রবীন্দ্রনাথের মনে গোড়া থেকেই ছিল বলে তাঁর ভারতবোধ কোনও কালেই কোনও আবিলতা দেখা যায়নি।
তাই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে অন্তরের তাগিদেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এ শুধু বঙ্গবিভাগ নয়, তাঁর আজন্ম লালিত ভারতবোধের উপরই আঘাত। যে ভারতের সকল মানুষকে তিনি একই পরিচয়ের অধিকারী বলে ভেবেছেন, প্রশাসনিক সুবিধার দোহাই দিয়ে তাঁরই মধ্যে বিভাজন আনার কার্জনী দুরভিসন্ধি তাঁকে বিচলিত করে তুলেছিল। আন্দোলনের পুরোভাগে কবিগুরুর মতো বিশিষ্টজনেরা ছিলেন বলেই তা কেবল বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, সারা ভারত উত্তাল হয়ে উঠেছিল—একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আর ১৮৭৫ সালে এক সত্যদ্রষ্টা ঋষি এই জাগরণের ‘বন্দেমাতরম্’মন্ত্র সৃষ্টি করে ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন, আগামী বিশ-ত্রিশ বছরে মধ্যে ‘বন্দেমাতরম্’-কে কণ্ঠে নিয়ে দেশ উত্তাল হয়ে উঠবে। সেই যুবা বয়স থেকেই এই বঙ্কিম-রচনাটির স্থায়ী আসন রবীন্দ্রনাথের অন্তরে পাতা হয়ে গিয়েছিল বলেই সে গান গাইতে, তার সুর করতে, দেশাত্মবোধক সঙ্গীত রচনায় ‘বন্দেমাতরম্’শব্দ দুটি জুড়ে দিতে (একসূত্রে বাঁধিয়াছিসহস্রটি মন) তাঁর কখনও সংকোচবোধ। হয়নি।
এই ভারতবোধের জন্যই জালিয়ানওয়ালাবাগের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কবিমনকে অত অশান্ত করে তুলেছিল। ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের বিধিনিষেধ জারি হওয়ায় কবির কানে খবরটা পৌঁছতে দেড় মাস লেগে যায় (২৭ মে)। শোনামাত্র অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি, কোনও কিছুতে মনস্থির করতে পারেন না, রাতে ঘুমোতে পারেন না। ছুটলেন নেতাদের কাছে, প্রতিবাদে কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু তেমন সাড়া মিলল না কারও কাছ থেকেই। অতএব ৩০ মে রাত জেগে চিঠি লিখলেন বড়োলাট লর্ড চেমসফোর্ডকে, জানিয়ে দিলেন, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যালীলার প্রতিবাদে ঘৃণাভরে। নাইটহুড’বা স্যার উপাধি প্রত্যাখান করছেন তিনি। জীবনভর কত গান, কবিতা তিনি লিখেছেন যে-সবের মধ্যে তাঁর দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ, ভারত-ভাবনা মূর্ত হয়ে উঠেছে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের কালেই তিনি সবচেয়ে বেশি স্বদেশী সঙ্গীত রচনা করেন। তার আগে-পরেও অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান তিনি লিখেছেন। এইসব গানে বঙ্গবোধ, ভারতবোধের স্পষ্ট প্রকাশ ঘটলেও কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা বিশ্ববোধ, বিশ্বমৈত্রীরও বার্তাবহ হয়ে উঠেছে। দু দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত তাঁরই দান। শুধু গানেই নয়, অসংখ্য কবিতায়ও তাঁর ভারতবোধের অনন্য প্রকাশ ঘটেছে। আমাদের পুরাণে, ইতিহাসে যেখানেই অনুপম মনুষ্যত্ববোধের সন্ধান পেয়েছেন, তাকেই তিনি কাব্যরূপ দিয়েছেন। যেমন, কর্ণকুন্তীসংবাদ’, ‘গান্ধারীর আবেদন’-এর মতো নাট্য-কবিতা, ‘পূজারিণী’, অভিসার’, -এর মতো বৌদ্ধযুগীয় কাহিনীর কাব্যরূপ, বন্দিবীর’, ‘হোহারিখেলা’, ‘গুরুগোবিন্দ’-এর মতো রাজপুত-মারাঠা-শিখ ইতিহাসভিত্তিক কবিতা। ‘শিবাজী-উৎসব’কবিতায় তো ফুটে উঠেছে। কবিগুরুর অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন।
গুরুকুল শিক্ষাব্যবস্থার স্বল্পতাঁকে একদিন টেনে নিয়ে গিয়েছিল বোলপুরের নির্জন আশ্রম শান্তিনিকেতনে। সেখানে বেদ-উপনিষদের মন্ত্রপাঠকে নিত্যকর্মের অন্তর্ভুক্ত করে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলেছিলেন, তাঁর নাম দিয়েছিলেন বিশ্বভারতী। বার্তা দিতে চেয়েছিলেন—নিজেকে জানলে, নিজের দেশ, দর্শনের কথা বুঝলে বিশ্বকে জানার, বোঝার দুয়ার খুলে যায়। সম্যক ভারতবোধই প্রশস্ত করে বিশ্বমৈত্রীর পথ। বোঝাতে চেয়েছিলেন, ভারতকে জানার, বোঝার এটাই সারস্বত বিশ্ব-অঙ্গন। আত্ম পরিচয়ের গৌরব থেকে জন্ম যে আত্মবিশ্বাসের, আত্মশক্তির, আত্মমর্যাদার, তাই সঠিক পথে মানুষকে পরিচালিত করতে পারে, সহায়ক হয় সংকল্পের সার্থক রূপায়ণে। রবীন্দ্রনাথের জীবন তার জ্বাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। সার্ধ জন্মশতবর্ষে সেই মহামানবকে প্রণাম।
রথীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়
(লেখক একজন সাংবাদিক ও প্রবন্ধকার)