দেড়শততম রবীন্দ্র জন্মোৎসব আমাদের জীবনে এক পরম মুহূর্ত। সারা ভারতে আজ গান, নাচ, নাটক, নৃত্যনাট্য, কবিতা আর তার আঁকা চিত্রাঙ্কনে ভরপুর নতুন নতুন ধর্ম দর্শন শিল্প সাহিত্য নতুন চিন্তাভাবনা ও যে-কোনো শুভ আন্দোলনের প্রাণস্বরূপ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালিন অনুভব করি যে তার চিত্রাঙ্কন সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের কোনো ধারণা নেই। এ সম্পর্কে তাদের যথাযথ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন সেই অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করেছি মাত্র।
রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার কোনো পরম্পরা তৈরি হয়নি। তাঁর ছবি বুঝতে হলে, এই পরম্পরার ভিতর দিয়েই তা বুঝতে হবে। দৃশ্যকলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে, তিন বছর ধরে এক নতুন পরিকল্পনা রূপায়ণের চেষ্টা করা হয়েছিল।
তাঁর চিত্রার্পিত চেতনার যে দৃঢ় সম্ভাবনা আছে, তা উদঘাটন করা প্রয়োজন।
সেই চিত্রচেতনা ও ভাবনার উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হলো। তাঁর ছবি বুঝতে হলে, জানতে হলে, তার ছবির সঙ্গে সব দিক থেকেই নিজেদের পরিচিত হতে হবে।
রবীন্দ্রচিত্রকলা, তার শিল্প জীবনে একই সঙ্গে আকস্মিক, একই সঙ্গে বহু বিচিত্র। নানা দিকে রেখা টেনে গোটা ছবিতে একটা সামঞ্জস্য এনেছেন এক-একটি ছছাটোখাটো কবিতার মতো। যেমনটি মনে হয়েছে, তেমনটি করেছেন। তার এই যে মনে হওয়া এবং করে তোলা, এর সবটাই তিনি নিজের থেকে অর্জন করেছেন। সাধারণ শিল্পী তা পারে না। সৌন্দর্য নিজে এসে ধরা দিলে, কে রুখতে পারে।
কাটাকুটি খেলা দিয়ে তার ছবি রচনার শুরু; কিন্তু সেখানেই তিনি থেমে থাকেননি। কোনোরকম বাইরের প্রয়োজন বা তাগিদ থেকে শুরু করেননি, ছবি আঁকা শুরু হয়েছিল আপনা থেকেই। পরে, অনুভব করেছিলেন ছবি আঁকার দুর্দমনীয় তাগিদ।
ছবি আঁকা শেখেননি বলে, তার রচনায় আড়ষ্টতা নেই। শিশুসুলভ সারল্য ছিল, এই সরলতা তার ছবিতে প্রিমিটিভ কোয়ালিটি এনে দিয়েছে। সরলতা কোনো শিক্ষার ভিত্তিতে হয়নি। শিশু প্রতিভা স্বতঃস্ফুর্ত, তা শিশুর বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মরে যায়। শিল্পীর প্রতিভা, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার ঠিকানা বদল ঘটে। শিশুকে প্রতিভা চালায় শিল্পী প্রতিভাকে চালান। শিল্পীর অর্জিত ও সঞ্চিত ধন তার শিল্প শিক্ষায়।
রবীন্দ্রনাথের সে শিক্ষা ছিল না, ছিল তুলনাহীন শিল্প-সতর্কতা, যা তাকে পাকা শিল্পী করে তুলেছিল। অচিরেই নিজস্ব শৈলী-ঈক্ষণ প্রকাশ পেল। তিনি অনুভব করেছিলেন পৃথিবীর শিল্পকলা, আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলায় প্রাণের স্পন্দন নেই সেই মেজাজে ও নেই’, এ চিন্তা তাকে মর্মাহত করেছিল।
ছবিতে সার্বিক আবেদন আছে। পাশ্চাত্ত্য চিত্র, রবীন্দ্রনাথের চিত্রের পাশে রেখে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে, ছবিতে কোথাও আলো ছায়া নেই। ডাইমেনশন নেই। আছে রেখা, ‘রেখার অভাবে রেখা’ (anti lines), ব্যঞ্জনার অভিনবত্ব নেই, জটিল কোনো সমস্যাও নেই। বাস্তব থেকে গ্রহণ করে, নতুন বাস্তব চেতনা রেখেছেন। তার শিল্পী সুলভ মেজাজ ও মানসিকতা অপূর্ব। তা অত্যন্ত দুর্লভ বস্তু। তাঁর জন্মসঙ্গী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু পছন্দ করার ক্ষমতা অভাবনীয়। ছবি চিরন্তন ও জীবন্ত। ছবি আপনাতে আপনি বিকশিত, প্রত্যহ সে বাঁচে।
প্রথম দিনের অকস্মাৎ ছবিটি থেকে শেষ দিনের পরিণত ছবিটি, এক মহাসূত্র-আত্মায় বাঁধা। খণ্ড খণ্ড ছবি মিলিয়েই তার বিশাল পটভূমি প্রতিটি ছবিতেই তিনি আছেন। তাঁর প্রতিভা ও পৃথিবীর চাপ, তাকে শিল্পীর সূক্ষতা দিয়েছিল।
এমনি করে দিনের পর দিন, রবীন্দ্র-চিত্রভাবনায় নতুন রস উপলব্ধি ও অনুভব করে, সদা-সর্বদা তাকে চোখের সামনে রেখে, তার যথেষ্ট বিশ্লেষণ করে, ছাত্রছাত্রীরা মিলিতভাবে কাজ করে চলেছে। প্রত্যেকটি ক্যানভাসই একটি যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব অথবা সমস্যার ক্ষেত্র, রং রেখা, চেতনা ও ঈক্ষণের।
রবীন্দ্রনাথের ছবির মূল্যায়ন করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য জেনেও, আমাদের এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে, তার ছবির রূপায়ণ পৌঁছে দেওয়াই আমাদের কর্তব্য। কোনো একক উদ্যোগ কিংবা কোনো একক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এরকম একটি কঠিন পরিকল্পনার বহুল প্রচার সম্ভব নয়।
রবীন্দ্রনাথ কেন ছবি আঁকতে চাইলেন। ছবি বা ভাস্কর্য, যে-কোনো শিল্পকলা বুঝতে আলাদা ভাষার প্রয়োজন হয় না। দেখে ভালো লাগলেই হল, গান, নাচও তাই। পৃথিবীর সব লোকই ছবি বা ভাস্কর্য দেখেই কিছুটা বুঝতে পারেন বা ভালো লাগে। তারপর দেখতে দেখতে ও তার সঙ্গে যদি একটু পড়াশোনা করা যায় তবে আস্তে আস্তে আরও ভালো বুঝাতে পারেন। সেইসময় ভারতের শিল্প মহারথীরা থাকা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ তীব্রভাবে অন্য পথ নিয়েছিলেন। তার ছবি দ্বিমাত্রিক (টু-ডাইমেনশনাল), আলো ছায়ার কোনো খবর নেই—বহু ছবি রেখাধর্মী হলেও মাঝে মাঝে নিজের ইচ্ছে মতো ব্রাশ ওয়ার্ক আছে। জীবনের শেষ বয়সে প্রায় আড়াই হাজারের উপর স্কেচ ও ছবি এঁকে নাটকীয় একাকিত্বের ভারতীয় চিত্র চেতনার নতুন যুগের প্রবর্তন করলেন।
তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পর যখন চেষ্টা চলছিল তার ছবি বোঝার ও উপলব্ধি করার, তখন তা অনেকেই বোঝেননি।
ছবি আঁকার মধ্যে আনন্দ আর সৃষ্টির প্রেরণা কবিকে মাতোয়ারা করেছিল। তিনি সৃষ্টি করেছেন শিশু সুলভ উত্তেজনা নিয়ে, কাজ করেছেন সরলতা নিয়ে। যা আমাকে সব থেকে বেশি অবাক করেছে তা হল কবি প্রতিভা। কী অপূর্ব উপলব্ধি দিয়ে তিনি তা প্রয়োগ করেছেন। এক চুলও এদিক-ওদিক হতে দেননি। তবে অনেক ছবি হয়তো তার মনের মতো হয়নি। এ তো সর্বত্র শ্রেষ্ঠ আর্টিস্টদেরও ঘটেছে বহুবার।
রানী মহলানবিশকে কবি চিঠিতে বলেছিলেন, আমার ছবি রেখার ছবি রঙের ছবি-ভাবের ছবি না।’
এই সহজ বুঝতে শিল্পীদের কত সময় কেটে যায়।
ড. শিবনারায়ণ রায় বলেন, ‘ছবির ক্ষেত্রে তিনি প্রায় সম্পূর্ণ ভাবেই অভারতীয় অবাঙালি অহিন্দু…এদেশের প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস থেকে তিনি কিছুই গ্রহণ করেননি।
তার ছবি বড় করে দেখলে মনে হবে না এ অভারতীয় বা অহিন্দু। তিনি প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে না নিলেও, ভারতীয় ভাস্কর্যের মতো দাঁড়ানো বা বসা তাঁর ছবিতে নেই, কিন্তু ভারতীয় ভাবটা থেকে গিয়েছে। সেই দ্বিমাত্রিক।
যে কয়েকটি প্রতিকৃতি তিনি করেছেন নিজের বা অন্য কারও, সবগুলোই তার অমর চিন্তাধারার স্বাক্ষর। সম্রাট শাজাহানের পুত্র দারা কিছু ছবি দেখে বলেছিলেন—মুসলমানদের আঁকা প্রতিকৃতিগুলো প্রতিকৃতিই থেকে যায় কিন্তু হিন্দুদের প্রতিকৃতি কী করে ছবি হয়ে যায়। কতশত বছর আগে একজন দর্শকের (দার্শনিক) এ কথা মনে হতে পারে—কী চোখ ! অবাক হতে হয় কোনটা ছবি আর কোনটা ছবি নয় বুঝতেন। কবি ভারতীয় চার দেওয়ালের মধ্যে থাকতে চাইলেন না বা থাকতে পারলেন না। কতকগুলো আঁচড়ের টানে রেখা দিয়ে মিসটিক ভাবধারা এনে তাকে বিশ্বের দরবারে এনে দিলেন।
যে কয়েকটি মহিলা প্রতিকৃতি এঁকেছেন তার মধ্যে ছ-সাতটি অতি উচ্চ মানের। আসলে উনি ছোট ছবি করতেন বলে তাঁর নিজের কাছে তো তা অধরা রয়ে গেছে। যদি বড় করে দেখানো হত অথবা উনি করতেন তা হলে আমরা বড় বড় ছবি পেতাম। অবাক হতাম।
রবীন্দ্রনাথ নিজের রচিত কবিতার ঠিকমতো শব্দ অথবা শব্দের জায়গা বদলে কি ছত্রে আরও মাধুর্য আনতে গিয়ে এ-ধরনের গোটা লাইনের অদলবদল করেছেন বা করতে হয়েছে। এটুকু কাটাকুটি করতেই হয়, যেমন চিত্রশিল্পীর চিত্রপটে নকশা বা অবয়ব ভঙ্গিমা নিয়ে নানান ধরনের হেরফের করেন। কবিও তেমনই, শব্দ স্থাপনের উপর—এই ধরনের স্থান পরিবর্তনের সময় কলমের কালি দিয়ে পরিষ্কার। করে বা অন্য রকম করে কাটার একটা নিজস্ব ধারা গড়ে তুললেন। এই কাটাকুটি করার সময় তিনি নিশ্চয়ই দেখতে পেতেন তার মণিকোঠায় কী অলংকারের জাল বোনা আছে। তারই প্রতিচ্ছবি করেছেন, কাটাকুটির প্রতি লাইন নিয়ে। এ এক অভিনব আবিষ্কার। এই নব নব আবিষ্কৃত নকশা আঁকে বাধ্য করেছিল আরও নতুনের দিকে এগিয়ে যেতে।
সর্বত্রই প্রেমের খেলা—প্রকৃত ভালো না বাসলে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। অব্যক্তকে অনুভব করাই তো অনন্তের অনুভব, সৃষ্টির মধ্যে সীমাহীন ঐশ্বর্যকে অনুভব করা। এ ঐশ্বর্য অনুভব স্বর্গীয় আনন্দ, হৃদয়ের গভীরতম দেশে সঞ্চিত ধন। এর বহিঃপ্রকাশ হয় ছবিতে গানে নাচে কবিতায়। শিল্পী (বিজ্ঞানে দর্শনে) নিজেকে বোঝেন না সব সময়, বহুদিন বাদে হয়তো বুঝতে পারেন। সর্বদাই অস্বস্তিতে কাটে তাই নিজের ভালোটার প্রতি নজর পড়ে না, সর্বদাই কী পাইনি পাইনি ভাব। এই উপলব্ধি তিনি করেছিলেন সৃষ্টি শক্তির দৃষ্টি, সৃষ্টির পথই উপলব্ধির পথ। আসলে তার পথই ছিল প্রশস্ত। কল্পনা শক্তিই ছিল তাঁর আলো। তাই তিনি কবিতা এঁকেছেন আর যা লিখেছেন তা ছবি হয়েছে। এমন করেই তার ছবি বোঝার চেষ্টা করেছি।
ডঃ শানু লাহিড়ী
(লেখিকা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা ও চিত্রশিল্পী)