মহারাষ্ট্রের সাথে রবীন্দ্রনাথের একটা পরম শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। তাই শ্রদ্ধাবনত চিত্তেই তিনি মহারাষ্ট্রের ইতিহাসকে অনুধাবন করেছেন। অতীত মহারাষ্ট্রের গৌরবময় ইতিহাস নিয়ে তিনি বেশকিছু কবিতা রচনা করেছেন। অতীত ইতিহাসকে তিনি নতুন রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। মহারাষ্ট্রের অতীত গৌরবগাঁথার স্মরণ প্রসঙ্গে তাই শিবাজীও এসেছেন তাঁর “শিবাজী উৎসব” কবিতা ছাড়াও অন্য কবিতায়।
শিবাজীর চরিত্র তার গুরুমন্ত্রে দীক্ষা প্রসঙ্গে আর একটি কবিতারও উল্লেখ করা যেতে পারে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ তার গুরুদেব মন্ত্রে ধর্মদীক্ষার কথাও লিখেছেন। কবিতাটির শুরু এইভাবে,
“একদা প্রভাত কালে সিতারার দুর্গভালে।
শিবাজী হেরিলা একদিন,
রামদাস গুরু তার ভিক্ষামাগী দ্বারদ্বার।
ফিরিছেন যেন অন্নহীন।”
শিবাজী তার গুরুদেবকে ভিক্ষা করতে দেখে বিস্মিত হন। তিনি তক্ষুনি গুরুদেবকে তার সমস্ত রাজ্যপাট অর্পণ করেন। কিন্তু গুরু রামদাস সেই দান শিবাজীকেই প্রত্যর্পণ করে বললেন, “আমার হয়ে তুমিই এই রাজ্যপাট পরিচালনা করবে। তিনি বলেন,
“পালিবে যে রাজধর্ম জেনো তাহা মোর কর্ম,
রাজ্যলয়ে রবে রাজ্যহীন।”
মহারাজ শিবাজীও গুরুর এই আদেশ বর্ণে বর্ণে পালন করেছেন। শিবাজী উৎসব কবিতার এই পটভূমিকা থেকে অনুধাবন করলে শিবাজীর রাজ্যশাসনের সম্পর্কে কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। গুরুর আদেশে সন্ন্যাসীর গেরুয়াকে মর্যাদা দিয়ে তিনি রাজপতাকায় স্থান দিয়েছিলেন। তার কর্ম চিন্তাধারায় প্রকাশিত হয়েছিল যে শপথ –
“একধর্মরাজ্যপাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত
বেঁধে দিব আমি।”
এই ছিন্ন ভিন্ন খণ্ড বিখণ্ড ভারতকে এক সূত্রে মহান রাষ্ট্রে তিনি গড়ে তুলবেন। ভারতবর্ষকে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে নতুন প্রাণের সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। তার জন্য সেদিনের বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী শাসকদের সঙ্গে তাকে কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছিল। কিন্তু তারা ছিল সেদিনের রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী। সেই রাজশক্তি ছাড়া তাদের হাতে ছিল ইতিহাস লেখার ক্ষমতা। শিবাজীর সেই ভারতের নবমুক্তির আঁচ দিল্লির মসনদকে বিব্রত করে তুলেছিল। তাদের ইতিহাসে শিবাজীর এই মুক্তিসংগ্রামকে পার্বত্য মুষিকের উপদ্রব বলেই বর্ণনা করেছেন। কোনো ইতিহাসে তাকে বর্গীর হাঙ্গামা বলে বিবৃত করা হয়েছে।
ইতিহাসে সেদিন প্রকৃত সত্য দেখানো হয়নি। রবীন্দ্রনাথ সত্যান্বেষী কবি। আজ আমরা অখণ্ড ভারত রাষ্ট্র গড়তে পেরেছি। আমাদের ভাষা আলাদা। সংস্কৃতিও ভিন্ন। ভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন। কিন্তু সব স্বতন্ত্র ভুলে গিয়ে আমরা আজ নিজেদের ভারতীয় বলে ভাবি। একসূত্রে বাঁধা পড়ে গেছি সব বিভেদ ভুলে গিয়ে। এক মহান ঐক্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছি বিশ্ববাসীর সামনে। কবিগুরুর মনে শিবাজীই ছিলেন এই ভারততীর্থের অন্যতম রূপকার। স্বার্থান্ধদের ইতিহাস তাকে মর্যাদা দেয়নি। রবীন্দ্রনাথ তাকে সেই মর্যাদায় ভূষিত করে তার বন্দনা গেয়েছেন। তাঁর ভাষাতেই আমরাও সেই মহান পুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানাই–
“মৃত্যু সিংহাসনে আজি বসিয়াছ অমরমুরতি–
সমুন্নত ভালে
যে রাজকিরীট শোভে লুকাবে না তার দিব্যজ্যোতি
কভু কোনোকালে।তোমারে চিনেছি, আজি চিনেছি চিনেছি হে রাজন্,
তুমি মহারাজ।
তব রাজকর লয়ে আট কোটি বঙ্গের নন্দন
দাঁড়াইবে আজ॥’
শ্রী শক্তিপদ রাজগুরু
(লেখক প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও চিত্র নাট্যকার)