আজ আমরা ঘোর সঙ্কটে পতিত, সুতরাং অদ্য আমি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করিব। বিশেষতঃ এই জরাজীর্ণ দেহে সুদীর্ঘ বক্তৃতা করিবার ক্ষমতাও আমার নাই।
আমি যে রাজনীতি বুঝি না, তা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। এই সভার উদ্দেশ্য সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার প্রতিবাদ। ইহা প্রধানত রাজনৈতিক বিষয়। বহুকাল পর আজ আমি রাজনৈতিক সভায় যোগদান করিলাম। প্রথমে এই সভায় যোগ দিতে আমি ইতস্ততঃ করিয়াছিলাম। কিন্তু স্বদেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করিয়া আমি আপনাদের আহ্বান উপেক্ষা করিতে পারিলাম না। যে প্রাণবান সহজ বিক্ষুদ্ধবন্ধন আমাদের বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একজাতীয়তায় আবদ্ধ করিতে পারে, সেই বন্ধন ছেদনের উদ্দেশ্যে যে অস্ত্রে শান দেওয়া হইতেছে, উহার লেলিহান ফলকের ভীতি আমি উপেক্ষা করিতে পারি নাই।
আজ ইউরোপ তামস যুগের ঘনান্ধকারে সমাচ্ছন্ন। যে নবীন আদর্শের আলোক জ্বালিয়া ইউরোপ নব যুগ আনয়ন করিয়াছিল, আজ স্বয়ং ইউরোপই সেই আলোক নির্বাপিত করিবার জন্য ব্যগ্র, ডিক্টেটরগণ তাহাদের বিরুদ্ধবাদীদিগকে বিরত পঙ্গু করিয়া রাখিবার জন্য বা রাজনীতিক্ষেত্র হইতে তাহাদিগকে চিরতরে অপসারিত করিবার জন্য যে যথেচ্ছাচার অবলম্বন করিয়াছেন, ইউরোপের সংবাদপত্রগুলির পৃষ্ঠা উহার বিবরণে পূর্ণ। আমাদের দেশের জন্য রচিত যে নূতন শাসনতন্ত্রে আমাদের ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদের মূল সূত্রটি পর্যন্ত উপড়াইয়া ফেলিতে কাহারও মনে কোনো দ্বিধা হইবে না, উহাকে ইউরোপের ডিক্টেটরগণের ওই সকল স্বেচ্ছাচারের সহিত তুলনা করিতেও আমি শিহরিয়া উঠিতেছি। বৃহত্তর জগৎ এই ব্যাপারটিকে তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া ঔদাসীন্য ভাবে উপেক্ষা করিবে। কারণ যে সকল অক্ষম ইহা দ্বারা পীড়িত তাহারা নিষ্ঠুরতম অপমানে অর্থাৎ উপেক্ষার অপমানে অপমানিত। যাহা হউক, আমাদের পক্ষে ইহার অপমান এমন দুর্বিসহ যে, বার্ধক্য ও স্বাস্থ্যহীনতার অজুহাত দেখাইতে আমি লজ্জাবোধ করিলাম এবং আমার চিরপ্রিয় নির্জনতা পরিত্যাগ করিয়া সাবধানবাণী উচ্চারণ করিতে আসিলাম। হয়তো ইহা অরণ্যরোদনে পর্যবসিত হইবে। কিন্তু এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করা আমি আমার কর্তব্য জ্ঞান করি।
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা দেশের রাজনৈতিক জীবনকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করিবার জন্য একটি অভিশাপ। যে সকল দল ও সম্প্রদায় বাঁটোয়ারা চাহে নাই, তাহাদের উপরও এই অভিশাপ বর্ষিত হইয়াছে। ভারতবাসীদিগকে রাজনীতি হিসাবে আঠারটি পৃথক ভাগে বিভক্ত করিবার আয়োজন হইয়াছে। মহাত্মা গান্ধী ইহাকে ভারতবর্ষের জীবন্ত ব্যবচ্ছেদ নামে অভিহিত করিয়াছেন। এই ব্যবচ্ছেদের ফলে ভারতবর্ষ প্রাণহীন শবমাত্রে পর্যবসিত হইবে।
কোনো কোনো সম্প্রদায়কে তাহাদের প্রাপ্যাতিরিক্ত অধিকার দানের ব্যবস্থায় এই সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার অনর্থ আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে। স্বকীয় উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য গভর্নমেন্ট বিভিন্ন তুলাদণ্ডে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে পরিমাপ করিয়াছেন। আসন্ন শাসনতন্ত্রে নিগূঢ় কারণে হিন্দুদের উপরই সর্বাধিক অবিচার করা হইয়াছে, সেই কারণ এস্থলে বর্ণনা করা নিরর্থক। বাংলার হিন্দুরা সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়; সুতরাং তাহাদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই বিশেষ ব্যবস্থা করা আবশ্যক। কিন্তু তৎপরিবর্তে তাহাদিগকে তাহাদের প্রাপ্য অপেক্ষাও কম সদস্যপদ দিয়া অপর সম্প্রদায়কে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হইয়াছে। ইহাতে প্রকারান্তরে হিন্দুদিগকে হয়তো প্রশংসাই করা হইয়াছে, কিন্তু অদ্ভুত রাজনৈতিক গণিত শাস্ত্রানুযায়ী যে ব্যবস্থায় এক সম্প্রদায়কে চিরতরে অপর সম্প্রদায়ের সহযোগিতা নিরপেক্ষ করিয়া তুলিয়া উহাকে অপর সম্প্রদায়ের উপর পীড়নের অধিকার দিয়াছে, তাহা হিন্দুদের উপর প্রকাশ্য আক্রমণ ব্যতীত আর কিছু নহে। আমরা যে মুসলমান ভ্রাতৃবর্গকে তাঁহাদের সংখ্যালঘিষ্ঠতার সুযোগ সুবিধা দিতে চাই না এমন নহে, তাঁহাদের কোনো দুরভিসন্ধি আছে বলিয়াও আমরা সন্দেহ করি না। যে ব্যবস্থায় ভবিষ্যৎ সহযোগিতার সমস্ত সম্ভাবনা নির্মূল হইয়া পড়িতেছে, আমরা শুধু সেই ব্যবস্থা মানিয়া লইতে চাহি না, যে ব্যবস্থায় জাতীয় স্বার্থ বিপন্ন করিয়া সাম্প্রদায়িকতাকে পুরস্কৃত করা হইয়াছে, সাম্প্রদায়িকতা রোধে উন্মত্তদিগকে সাম্প্রদায়িকতা প্রচার-পূর্বক রাজনৈতিক সুবিধা হস্তগত করিবার সুযোগ দানে উভয় সম্প্রদায়ে দুর্নীতি প্রচারের পথ প্রশস্ত করা হইয়াছে এবং যে ব্যবস্থায় পারস্পরিক বিশ্বাসের পরিবর্তে সন্দেহ সৃষ্টি করিবে, আমরা তাহা মানিয়া লইতে অক্ষম। আমাদের শাসকবর্গকে আমি স্মরণ করাইয়া দিতে চাই যে, আমাদের জাতীয় শোণিতে রাজনৈতিক বিষ প্রয়োগ করা আর্থিক শোষণ অপেক্ষাও ক্ষতিকর। প্রজাকে সন্দেহবশে বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া অপেক্ষাও ক্ষতিকর। কারণ জাতীয় শোণিতে রাজনৈতিক বিষ সঞ্চার করিলে সমগ্র ভবিষ্যৎকে শাস্তি দেওয়া হয়—ইহা প্রকৃত অথবা কাল্পনিক, প্রমাণিত অথবা প্রমাণবিহীন সর্ববিধ অবাধ্যতার জন্য চিরস্থায়ী শাস্তির বিধান।
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার প্রস্তাব যেদিন উত্থাপিত হয়, সেইদিন হইতেই আমাদের প্রদেশ বিক্ষুব্ধ হইয়া পড়িয়াছে—ঔদার্য্য এবং সহযোগিতার উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছে। ইতিমধ্যেই আমাদের সাহিত্যেও ধ্বংসোন্মত্ততা আত্মপ্রকাশ করিয়া আমাদের ভাষাকে আক্রমণে উদ্যত হইয়াছে। ইংরেজী ভাষার সহিত স্কচ জাতির কথ্য ভাষার সাদৃশ্য নাই বলিয়া যদি স্কচ জাতি অকস্মাৎ ইংরেজী ভাষার বিরুদ্ধে ক্যালভিনের মতবাদ অনুসরণপূর্বক ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিত এবং দেশের অন্যান্য সকলের সহিত তাহাদের সংস্কৃতি ঐক্যবন্ধন ছিন্ন করিতে চাহিত, তাহা হইলে যে অবস্থা হইত, আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রের ধ্বংসোন্মত্ততার ফলেও সেই অবস্থা দাঁড়াইয়াছে। এক অখণ্ড জাতীয়তা সূত্রে আবদ্ধ হওয়াই যে সকল সম্প্রদায়ের কর্তব্য, অদূর ভবিষ্যতে যে ওই সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটিবে, ইহা সেই ভবিষ্যৎ বিপদেরই সূচনা। যদি সাম্প্রদায়িক একগুঁয়েমির ফলে জাতীয় ঐক্যবোধ বিদূরিত হয়, তবে শুধু আমাদের রাজনৈতিক শক্তি নহে, আমাদের আর্থিক সম্পদও ধ্বংস হইবে। শাসনকার্য পরিচালনায় যোগ্যতার অপহ্নব করিয়াও গভর্ণমেন্ট যে সরকারী চাকুরীতে কর্মচারী নিয়োগে ক্রমাগত বৈষম্য করিয়া চলিয়াছেন, আমরা তাহা নির্বাকভাবে প্রত্যক্ষ করিতেছি। নানা কারণে আমাদের মুসলমান ভ্রাতৃবর্গের বহুকাল যাবৎ নানা বিষয়ে অসুবিধা ভোগ করিতে হইতেছে। কিন্তু তজ্জন্য হিন্দুরা দায়ী নহে। ইহার প্রতিকার হউক, তাঁহারাও হিন্দুদের অবস্থায় উপনীত হউন—ইহা আমার আন্তরিক কামনা। কিন্তু স্পষ্টই বুঝা যায়, প্রতিকার ব্যবস্থার পশ্চাতে এমন একটি মনোবৃত্তি রহিয়াছে, সমস্যা মীমাংসার সহিত প্রকৃতপক্ষে যাহার কোনো সম্পর্ক নাই, এই ব্যবস্থায় আমাদের সকলের কল্যাণ ক্রমাগত বিপন্ন হইয়া পড়িতেছে। প্রভুর খানার টেবিলের নীচে নিক্ষিপ্ত খাদ্যটুকরোর জন্য যে কোলাহল উত্থিত হইয়াছে, ইহা সমর্থন করায় শুধু যে নীচতা আছে তাহা নয়, উহা চারিত্রিক দৌর্বল্যেরও পরিচায়ক।
মুসলমানদের চরিত্রে যে স্বাভাবিক সরলতা আছে, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। তাঁহাদের গণতান্ত্রিক মনোবৃত্তি যে তাঁহাদিগকে জীবনযুদ্ধে বিজয় লাভের ক্ষমতা দিয়াছে, তাহাও নিঃসন্দেহ। যে সকল মুসলমানের সহিত ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসিবার সুযোগ আমার হইয়াছে, তাঁহাদের সকলকেই আমি ভালোবাসি ও শ্রদ্ধা করি। তাঁহাদের সংখ্যা কম নহে। আমার চিরদিনের বিশ্বাস এই যে, প্রধানত মূর্খতা ও প্রাচীনযুগীয় যুক্তিহীনতাবশতই আমরা পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছি এবং ঘনিষ্ঠতর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব দ্বারা সেই ভেদ বিভেদ দূর করা সম্ভব। কিন্তু এই দেশের জন্য যে বৈদেশিকবর্গের স্বাভাবিক সহানুভূতি ও নিঃস্বার্থ হিতৈষণা নাই, সেই বৈদেশিকগণ যদি একটি বিশেষ উদ্দেশ্য লইয়া এই সাম্প্রদায়িক বৈষম্য দূর করিতে অগ্রসর হয়, তবে তাহার ফল মারাত্মক না হইয়া পারে না। আসুন, আমরা দূরদর্শিতা অবলম্বনপূর্বক বুঝিবার চেষ্টা করি যে, সাবধানীর পৃষ্ঠপোষকতায় যে সুবিধা লাভ হয়, তাহা ভাগ্যবান, অনুগৃহীত এবং দুর্ভাগ্য বিমুখ—উভয়ের পক্ষেই সমান ক্ষতিকর। তাহার ফলে যে সকল জটিলতার সৃষ্টি হইবে, তাহা পরস্পরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে উস্কাইয়া দিবে এবং যাহারা পৃষ্ঠপোষকতা লাভে সস্তায় কিস্তিমাৎ করে, পরিণামে তাহাদেরও কোনো মঙ্গল হইবে না। আমরা, যাহারা এক জন্মভূমির সন্তান, সভ্য জাতিস্বরূপ অস্তিত্ব বজায় রাখিবার জন্য, এমনকি আত্মরক্ষার জন্য তাহাদের উচিত পরস্পরের সহিত বন্ধুত্ব করা, উভয় সম্প্রদায়েরই ক্ষোভের কারণ ও প্রলোভন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া দেশ ও বিদেশের তাহাদিগকেই অবিশ্বাস করা উচিত, যাহারা তাহাদের বন্ধুত্বের পথে কণ্টক স্থাপন করে। আমাদের অদৃষ্টের সহিত যাহাদের অদৃষ্ট এক সূত্রে গ্রথিত, তাহাদের প্রতি যতদিন সম্ভব অতিরিক্ত অনুগ্রহ বর্ষিত হইতে থাকুক তাহাতে হিন্দুদের ক্রুদ্ধ হওয়া উচিত নহে। এই অন্যায় অনুগ্রহের যে একটা নিশ্চিত প্রতিক্রিয়া আছে, তাহাই চিন্তার বিষয়। কারণ একদিন আসিবে, যেদিন আর এইরূপ অনুগ্রহ করা সম্ভব হইবে না, যেদিন একতরফা আবদার পালনে স্বেচ্ছাচারীরও চক্ষুলজ্জা হইবে। অথচ সেই দিনও অন্যায় অনুগ্রহ লাভের আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত হইবে না। বর্তমান সমস্যার যে বিপদকে আমরা সর্বাধিক ভয় করি তাহা এই যে, আমাদের শাসকবর্গ পার্লিয়ামেন্টারি প্রথায় বহুদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হইলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা যে উহার উদ্দেশ্যের পক্ষে মারাত্মক, তাহা তাঁহারা আমাদের অপেক্ষা ভালো জানিলেও তাঁহারা উহার সমর্থনে যুক্তি দেখাইতে পশ্চাদ্পদ হন না।
এই ব্যাপারে যে মুসলমানদের উপরে ক্রোধ প্রকাশ করা হয়, তাহা বিশেষ শোচনীয়। কারণ, আমাদের ন্যায় তাঁহারাও একটি বিধ্বংসী নীতির কবলগ্রস্ত। তাঁহাদিগকে যে মাদক উপহার দেওয়া হইয়াছে, উহা তাঁহাদের পক্ষে মঙ্গলকর হইতে পারে না। এই দান অবশ্যই আমাদের শান্তিকেও ক্রমাগত নিষ্ঠুর আঘাত করিবে, একদিন অন্য অন্য দলের উৎসাহও মন্দীভূত হইবে— সেইদিন তাঁহারা বুঝিতে পারিবেন, তাঁহাদের অনেক মূল্যবান সম্পদ ও সুযোগ বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে— আর তাহা পুনরুদ্ধারের বিশেষ সম্ভাবনা নাই। যাহা হউক, হিন্দুদের নিকট আমার অনুরোধ তাঁহারা ধৈর্য হারাইবেন না, তাঁহাদের উপর যে অবিচার করা হইয়াছে, উহাকে যেন তাঁহারা আত্মহত্যার কারণ বলিয়া গ্রহণ না করেন। যাঁহারা নানারূপ আপাতশ্রুতিসুখকর ধুয়া তুলিয়া সেই নীতিই অবলম্বন করিয়াছেন, তাঁহাদের বিপথ-পরিচালিত নীতির বিরুদ্ধে তাঁহাদিগকে সাবধান করিতে যাওয়া আমাদের পক্ষে ধৃষ্টতা মাত্র।
যাঁহারা ইউরোপের বর্তমান পরিস্থিতি লক্ষ্য করিয়াছেন, তাঁহারাই জানেন, কোনো দেশের অধিবাসীদিগকে সাময়িক কালের জন্য নিস্তেজ করিয়া ফেলিয়া অপমানের বোঝা শিরে বহিতে বাধ্য করা যায় বটে, কিন্তু তাঁহাদিগকে চিরতরে তাহা মানিয়া লইতে বাধ্য করা যায় না। শীঘ্রই হউক আর বিলম্বেই হউক, ওই অপমান প্রতিনিক্ষিপ্ত হয় এবং উহার বিষ চতুর্দিকে বিস্তৃত হয়। যে শাসকবর্গ আমাদের অদৃষ্ট গঠন করিবার জন্য বা উহা নষ্ট করিবার জন্য আর এই দেশে বর্তমান, আপাততঃ আমাদের তাঁহাদের কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইয়া আমাদের সেই সকল স্বদেশবাসীর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করা উচিত, যাহারা চিরস্থায়ী সৌভাগ্যের মোহমুগ্ধ হইয়া মানসিক স্থৈর্য্য হারাইয়া ফেলিয়াছেন তাঁহাদিগকে আমাদের স্মরণ করাইয়া দেওয়া উচিত যে, জাতির এই সন্ধিক্ষণে বিপথ অবলম্বন করিলে উহার অনিবার্য ফল চিরন্তন অপমান এবং ঘোর দুর্বিপাক। পক্ষপাতিত্বের যে নীতি, ইহা মারাত্মক তদপেক্ষা মারাত্মক এই নীতি হইতে উদ্ভূত মনোবৃত্তি। ইহার ফলে দেশের উপর দিয়া একদিকে বহে উল্লাসের বন্যা, আর একদিকে ধূমায়িত হয় অসন্তোষের দাবানল; ফলে উভয় পক্ষই এমন সমস্ত কার্য করিয়া বসে, যাহাতে পরস্পরের মধ্যে বিভেদ বিদ্বেষ মজ্জাগত হইয়া দাঁড়ায় এবং প্রতিবেশীসুলভ ঘনিষ্ঠতা ও সৌহার্দ্যের মূলোচ্ছেদ হয়।
মহাযুদ্ধের পরবর্তী এই অস্বস্তিকর আবহাওয়ার মধ্যে আমার জন্ম নহে, ভিক্টোরিয়া যুগের শিক্ষা সংস্কৃতি ও মানবতার প্রতি প্রগাঢ় নিষ্ঠা আবহাওয়ার মধ্যে আমার শিক্ষা সংস্কৃতি অর্জন। আজ আমরা পাশ্চাত্যের সর্বত্র অত্যাচার উৎপীড়ন ও নিপীড়নের তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করিতেছি— বিশ্বমানবের দুঃখ-কষ্টের প্রতি, অন্যায়-অবিচারের প্রতি পাশ্চাত্যের নিদারুণ উপেক্ষা প্রত্যক্ষ করিতেছি। তথাপি এখনও মানবতার আদর্শের প্রতি পাশ্চাত্যের মজ্জাগত আকর্ষণ বিষয়ে আমার মনে দৃঢ় আস্থা বিদ্যমান। এই জন্যই আমাদিগকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিয়া ফেলিবার জন্য ভবিষ্যৎ প্রগতিপথে আমাদের গতিকে চিরতরে পঙ্গু করিয়া ফেলিবার জন্য সুকৌশলী রাজনীতিকের দৃঢ় ফাঁদের বেষ্টন নিজেদের আশেপাশে যদিও অনুভব করিতে পারিতেছি, তথাপি আমি পাশ্চাত্য জগতের শ্রেষ্ঠ চিন্তাধারার ধারক ও পোষক ইংরেজদের বীরসুলভ মানবতার দোহাই না দিয়া পারিতেছি না। পাশ্চাত্যের এই মহান আদর্শের অধোমুখীন গতিকে যদি পরিবর্তিত করা যায়, অন্ততঃ ভারতীয় রাজনীতির উপর যদি উহার প্রভাব বিস্তার করা যায়, আমাদের দেশের অদৃষ্টনিয়ন্ত্রণকারীরা যদি দেশের লোকের উপর আস্থা ও শ্রদ্ধার আসন প্রতিষ্ঠা করিতে পারেন—তাহা হইলে তাহাতে তাঁহাদের শিক্ষা সভ্যতারই যে শুধু কৃতিত্ব ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাইবে তাহা নহে, ঐহিক স্বার্থের দিক হইতেও উহাতে তাঁহারা লাভবান হইবেন। এই সভা যাঁহারা আহ্বান করিয়াছেন, তাঁহাদের মনে যদি এইরূপ কোনো আস্থা বা প্রতীতি না থাকে, তাহা হইলে বলিতে হইবে, এই সভা আহ্বান নিরর্থক হইয়াছে। এবং ইহা নির্বুদ্ধিতারই পরিচায়ক। উন্নতমানের ইংরেজসমাজ কেবলমাত্র ভূতপূৰ্ব্ব প্রধানমন্ত্রীর মত লোকদিগকে লইয়াই গঠিত নহে, —ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী যেমন ভারতের বেলায় নিজ মুখে ঘোষিত আদর্শের অমর্যাদা করিলেন, বা কোনো কোনো বড়লাট যেমন হোয়াইট পেপার সম্পর্কে এক অচল অবস্থার সৃষ্টি করিয়া তুলিয়াছিলেন এবং তলে তলে আমাদের দোষত্রুটি, অযোগ্যতা, অক্ষমতা দর্শনে আত্মসন্তোষ লাভ করিতেছিলেন—উন্নত ইংরেজ সমাজ কেবলমাত্র সেই শ্রেণীর লোকদিগকে লইয়া গঠিত নহে। আমাদের অন্তরের এই আস্থা যদি আমাদের মনের ভ্রান্তি বা ভ্রান্ত ধারণায় পর্যবসিত হয়, তাহা হইলে এই সকল সভা, সমিতি, এইসকল সম্মেলনাদি নিছক ছেলেখেলা ছাড়া আর কিছুই হইবে না। তাহা হইলে আমাদিগকে এই সকল ত্যাগ করিয়া এই সকল হইতে দূরে থাকিয়া নিজেদের মনে সম্পূর্ণ নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করিয়াই নিজেদের ইতিহাস রচনায় মনোনিবেশ করিতে হইবে, অথবা এই সমস্তের প্রতি প্রাচ্য মনোসুলভ কঠোর ঔদাসিন্যের আশ্রয় গ্রহণ করিতেই হইবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কলকাতা টাউন হলে সাম্প্রদায়িক বিরোধী সভার সভাপতির অভিভাষণ।