প্রথম পর্ব
১৩৪৭ বঙ্গাব্দ , কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পী কার্তিক পাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি মূর্তি প্রস্তুত করলেন। রবি ঠাকুর তখন দার্জিলিঙের কালিম্পং – এর গৌরীপুর ভবনে ছিলেন। কার্তিক পালের গড়া নিজ মূর্তিখানি প্রত্যক্ষ করে খুশি হয়ে ঠাকুর তাঁর Letter Head Pad -এ ১ লা জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭ বঙ্গাব্দে কার্তিক পালকে একটি শংসাপত্র দিয়েছিলেন। সমকালে এই শংসাপত্রটি কার্তিক পালের প্রচারে বা বিজ্ঞাপনে কাজ করেছিল। ১৩৯৯ বঙ্গাব্দের বৈশাখ – জ্যৈষ্ঠ মাসের #দ্বৈমাসিক_অন্যপত্র পত্রিকায় এই শংসাপত্রটির সন্ধান পাওয়া যায়। “অন্যপত্র” পত্রিকায় শংসাপত্রটি “রবীন্দ্রসন্নিধান/ কার্তিক পাল” শিরোনামে প্রকাশিত হয়। কয়েক বছর পরে , ” রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ আনন্দবাজার তৃতীয় খণ্ডে” এই বিজ্ঞাপনমূলক সংবাদটি স্থান পায়।
সেই শংসাপত্রে রবি ঠাকুর লিখেছিলেন :
কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পী শ্ৰীযুক্ত কার্তিকচন্দ্র পাল আমার যে মূর্তি গঠন করিয়াছেন তাহাতে বিশেষ সন্তুষ্ট হয়েছি। তাঁর দ্রুত হস্তের নৈপুণ্য প্রশংসনীয়। য়ুরোপ আমেরিকায় যে শিল্পীরা আমার মূর্তি গড়িয়াছেন তাঁহারা আমাকে ক্লান্তিতে পীড়িত করিয়াছিলেন। ইঁহার হাতে সে দুঃখ পাই নাই । ইতি -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৩৪৬ বঙ্গাব্দ, ২ রা ভাদ্র অর্থাৎ ১৯৩৯ সাল ১৯ আগাস্ট, কংগ্রেস থেকে পদত্যাগের পর সুভাষচন্দ্র বসু সহ বেশ কয়েকজন সর্বভারতীয় নেতাদের উপস্থিতিতে স্থাপিত হল মহাজাতি সদনের ভিত্তি প্রস্তর। স্থাপন করলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ । রবীন্দ্রনাথ নিজে ওই ভবনের নাম প্রদান করেন #মহাজাতি। ২ রা ভাদ্র ১৩৪৬ বঙ্গাব্দের এই ভিত্তি স্থাপন অনুষ্ঠানে সুভাষচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন –
” গুরুদেব ! আজকার এই জাতীয় যজ্ঞে আমরা আপনাকে পৌরহিত্যের পদে বরণ করে ধন্য হচ্ছি। আপনার পবিত্র করকমলের দ্বারা ” মহাজাতি সদনের ভিত্তিস্থাপনা করুন। “
রবীন্দ্রনাথ কতৃর্ক মহাজাতি সদনের ভিত্তি স্থাপনা অনুষ্ঠানের প্রচার দীর্ঘদিন ধরে করা হয়েছিল। বিভিন্ন সংবাদ পত্রে বিষয়টি প্রচারিত হয়ে। এই সব সংবাদগুলিকে আমরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মহাজাতি সদন এর ভিত্তি স্থাপন অনুষ্ঠানের প্রচার বা বিজ্ঞাপন বলতে পারি। উনিশে আগস্ট ১৯৩৯ এই মর্মে আনন্দবাজার পত্রিকায় যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল সেটিও ভিত্তি স্থাপন অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপনই ছিল। সেই অংশের কিয়দ্ উল্লেখ করা হল –
মহাজাতি সদনের ভিত্তি স্থাপন /রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক অনুষ্ঠান –
অদ্য শনিবার অপরাহ্ণ ৫ টার সময় ১৬৬ নং চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে রবীন্দ্রনাথ মহাজাতি সদনের ভিত্তিস্থাপন করিবেন । প্রবেশপত্র দেখাইয়া উৎসব ক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে হইবে ।”
এই ভিত্তিস্থাপন অনুষ্ঠান উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেই ভাষণ #মহাজাতিসদন নামে #কালান্তর গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অনেক ফিল্ম কোম্পানি এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই এই অনুষ্ঠান ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন । #অরোরা_স্ক্রিন_নিউজ নামে একটি সংস্থা সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান রেকর্ড করেছিলেন। এই অনুষ্ঠান তাঁরা বিভিন্ন চিত্রগৃহে সবাক চিত্রগুলির সঙ্গে করতেন । তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই সবাক অনুষ্ঠানের কথা বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করতেন। ১৯৩৯ সালে ২৯ আগস্ট অরোরা স্ক্রিন নিউজের পক্ষ থেকে আনন্দবাজার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা হয়েছিল :
” বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক মহাজাতি সদনের ভিত্তিস্থাপন , ঋষি কবির জাতীয় নির্দেশবাণী কথাচিত্রে এই প্রথম । তৎসহ দেশ গৌরব সুভাষচন্দ্রের অভিভাষণ।”
হ্যাঁ , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ । সংসারের ঊনকোটি সত্তর কাজ, অবসর, বিনোদন ,দুঃখ, সুখ, প্রেম , প্রকৃতি এমন কি বিজ্ঞাপনেও। রবীন্দ্রনাথের নামটি একটি বিজ্ঞাপনের জন্য একসময় যথেষ্ট ছিল। পণ্যের বাজারের মান বাড়ানোর থেকে স্বদেশী আন্দোলনের সময় সর্বত্র ছিল সেসব বিজ্ঞাপনের চাহিদা। কবিও মহাখুশিতে ছোট ছোট কবিতা, পংক্তি ইত্যাদি লিখে দিতেন যে যেমনটি ভাবে চাইতেন। সেই লেখাই অনেক সময় আশীর্বাদ , প্রেরণা হয়ে উঠেছে বহু মানুষের জীবনে।
স্বদেশী যুগের প্রথম সময় থেকে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের পরিবার থেকে জাহাজের ব্যবসা করে কিরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন সেই কথা তিনি “সরোজিনী প্রয়াণ” প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন । নোবেল প্রাইজ সাম্মানিক দক্ষিনা তিনি যা পেয়েছিলেন তার সিংহভাগ তিনি পাতিসর কৃষকদের ঋণ দেবার জন্য গচ্ছিত রেখেছিলেন। স্বল্প সুদের হারে কৃষকদের কৃষকদের ঋণ দেওয়া বহু অসৎ সুদখোরদের সইল না। তারা চক্রান্ত করে ওই ব্যাংকের অসৎ কর্মচারীদের সঙ্গে মিলে দরিদ্র কৃষকদের ঋণ পেতে এবং পরিশোধ করতে বাঁধা সৃষ্টি করে। পরিণতিতে ব্যাংক ঠিক মতো চলতে না পেরে একদিন ফেল করল। ফলে, দরিদ্র কৃষকদের আরো কপাল পুড়লো , সুদখোরদের পোয়া বারো হল । কবিপ্রদত্ত অর্থও আর ফেরৎ পাওয়া হল না। প্রথম জীবনে কৃষকদের আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে তাঁদের ভালো করতে গিয়ে নোবেল প্রাইজের প্রদত্ত টাকা খুইয়ে সর্বশান্ত হলেন। জীবনের পর্বে তিনি একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংগে যুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু দরিদ্রের স্বার্থ রক্ষার মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা তখন আর সম্ভব ছিল না।
যা হোক, তো স্বদেশী আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন রবি ঠাকুর বহু স্বদেশী ব্যবসা এবং পণ্যের জন্য বহু বিজ্ঞাপন লিখেছিলেন , নিজের গরজে এবং দায়িত্বে ব্র্যান্ড এম্বাসটারও হয়েছিলেন।
১৯৮৯ এর ২৫ মার্চ দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল দ্বারকানাথ ঘোষ প্রতিষ্ঠিত ডোয়ার্কিন এন্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড ৮/২ , এস্প্ল্যানেড ইস্ট , কলকাতা – ৬৯ এর একটি বিজ্ঞাপন । এই বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের অভিমত সম্বলিত একটি চিঠি ব্যবহার করা হয়। অনুমান বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত এটিই রবীন্দ্রনাথের প্রাচীনতম অভিমত। সেই পত্রে লেখা হয়েছিল –
ওঁ /১০ উড স্ট্রিট / ৭ ই আশ্বিন ১২৯৫ /
মহাশয়েষু,
আপনাদের ডোয়ার্কিন ফ্লুট পরীক্ষা করিয়া বিশেষ সন্তোষ লাভ করিয়াছি। ইহার হাপর অতি সহজেই চালানো যায় -ইহার স্বর প্রবল ও সুমিষ্ট । ইহাতে অল্পের মধ্যে সকল প্রকার সুবিধা আছে। দেশীয় সঙ্গীতের পক্ষে আপনাদের এই যন্ত্র যে বিশেষ উপযোগী তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি এই যন্ত্র ক্রয় করিতে ইচ্ছা করি। আমাকে ইহার মূল্য লিখিয়া পাঠাইবেন। শ্ৰীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাদ্যযন্ত্র প্রস্তুতকারক কোম্পানি ডোয়ার্কিন এন্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেডের নিকট এই পত্র খানি অমূল্য সম্পদ।
১৯৩৭ সালে ১৭ ই জানুয়ারি The Advance পত্রিকায় প্রকাশিত হয় স্বদেশী #Godrej সাবানের বিজ্ঞাপন। স্বদেশীয়দের দ্বারা প্রস্তুত এই সাবানকে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞাপন করে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাবানের মর্যাদা দিয়েছিলেন। তিনি বিজ্ঞাপনে লেখেন –
” Godrej’s is Toilet Soaps / High class Swadeshi Soaps/
‘The best in the World ‘ Poet Rabindranath Tagore speaks ‘highly of our soaps.”
পরে রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ আনন্দবাজারের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হলে জানা যায় ১৯২৯ সালে ১৬ ই সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকায় গডরেজ সাবানের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল। সেটি ” গডরেজের ভেজিটেবিল টয়লেট সোপ ” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল –
” কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন , ‘ গডরেজ সাবানের অপেক্ষা ভালো কোনো সাবান আমার জানা নাই। আমি ভবিষ্যতে শুধু এই সাবানই ব্যবহার করিব স্থির করিয়াছি। “
১৯৩০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর #কাজলকালী বিজ্ঞাপন লেখেন। সেটি অনেক পরে ১৯৬০ সালের দেশ সাহিত্য সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সেই বিজ্ঞাপনে লিখিত ছিল –
” কাজলকালী ব্যবহার করে সন্তোষ লাভ করেছি , এর কালিমা বিদেশী কালীর চেয়ে কোনো অংশ কম নয় – ইতি ২৭ ফেব্রুয়ারি , ১৯৩০ শ্ৰীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। “
#কুন্তলীন তেল , একসময় বিখ্যাত কেশতৈল এবং রূপচর্চা , প্রসাধনের অংশ ছিল। এই তেলের প্রস্তুত কারক ছিলেন ৫২ নং আমহার্স্ট স্ট্রিটের এইচ বোস পারফিউমারি । বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সেসময় এই তেলের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতো। প্রতিটি বিজ্ঞাপনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৩ সালের ৬ ই আগস্ট The Advance পত্রিকায় সেই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হল –
” Dr. Tagore says : We have been trying your KUNTALIN for about two months . A relation of mine was suffering from falling off of the hair. But new hair began to grow on the head within a month’s use of KUNTALIN . It is a perfumed oil and its fragrance does not deteriorate after.
Rabindranath Tagore
Sweet , Lily , Rose, Jusmin, Violet etc. H. Bose Perfume 52 , Amherst street , Calcutta.
১৩৫২ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হল কুন্তলীন তেলের বিজ্ঞাপন #নারীর_রূপ_লাবণ্য শিরোনাম নিয়ে। সে বিজ্ঞাপনটিতে উদ্ধৃত করা হয়েছিল –
নারীর রূপলাবণ্য / কবি বলেন যে, ” নারীর রূপ লাবণ্যে স্বর্গের ছবি ফুটিয়া ওঠে। সুতরাং আপনাপন রূপ ও লাবণ্য ফুটাইয়া তুলিতে সকলের আগ্রহ হয়। কিন্তু কেশের অভাবে নরনারীর রূপ কখনো সম্পূর্ণভাবে পরিস্ফুট হয় না। কেশের প্রাচুর্যে মহিলাগণের সৌন্দর্য সহস্র গুনে বর্ধিত হয়। কেশের শোভায় পুরুষকে সুপুরুষ দেখায়। যদি কেশ রক্ষা ও তাহার উন্নতি সাধন করি তে চান তবে আপনি যত্নের সহিত ভিটামিন ও হরমোনযুক্ত কেশতৈল কুন্তলীন ব্যবহার করুন। কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন : কুন্তলীন ব্যবহার করিলে এক মাসের মধ্যেই নতুন কেশ হইয়াছে।
কুন্তলীনের গুনে মুগ্দ্ধ হইয়াই গাহিয়াছেন :
কেশে মাখো কুন্তলীন / রুমালেতে ‘দেলখোস ‘/পানে খাও তাম্বুলীন / ধন্য হোক এইচ বোস।প্রবাসী পত্রিকার অন্যান্য সংখ্যাতেও ওই বিজ্ঞাপনটি প্রভিচারিত হতো।
১৯৩২ সালের ১০ জানুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকাযা ‘কুন্তলীন’ শিরোনামে কুন্তলীনের যে বিজ্ঞাপনটি প্রচারিত হয়েছিল তাতে তারিখহীন একটি শংসাপত্র প্রকাশিত হয়। তাতে রবি ঠাকুর লিখেছিলেন -” কুন্তলীন তৈল আমরা দুই মাস কাল পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। আমার কোনো আত্মীয়ের বহুদিন হইতে চুল উঠিয়া যাইতেছিল কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া তাঁহার একমাসের মধ্যে নতুন কোদোদ্গম হইয়াছে। এই তৈল সুবাসিত এবং ব্যবহার করিলে ইহার গন্ধ ক্রমে দুর্গন্ধে পরিণত হয় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”
রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মের যে বিষয়গুলো কখনোই আলোচনায় আসেনি তেমনই একটি বিষয় সম্প্রতি আলোচনায় এনেছেন কলকাতার একজন সম্পাদক। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি অত্যন্ত সাধারণ হলেও তা রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ-চেতনায় লাগিয়েছে নতুন রঙ। বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নোবেলজয়ী এই কবির জীবনের সেই অপরিচিত দিকটি হলো, জীবদ্দশায় তিনি পণ্যের বিজ্ঞাপনের অত্যন্ত জনপ্রিয় তারকা ছিলেন। আজকালকার দিনে বিজ্ঞাপন জগতে সিনেমার নায়ক-নায়িকা আর ক্রিকেটারদের জনপ্রিয়তা যেমন আকাশছোঁয়া, ঠিক তেমনি। আর রবীন্দ্রনাথ যে পণ্যের বিজ্ঞাপন করতেন তার কাটতিও বেড়ে যেত হু হু করে। অনেকেই হয়তো কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু বিষয়টি একেবারেই গুল নয়। কারণ গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, অন্তত একশটি পণ্যের বিজ্ঞাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তবে তা অবশ্যই টেলিভিশনে নয়, পত্রিকা আর ম্যাগাজিনের পাতায়। কারণ ভারতবর্ষে টেলিভিশনের যাত্রা তখনও শুরু হয়নি।
কুন্তলীনের বিজ্ঞাপনের ন্যায় রেডিয়াম ল্যাবরেটরির যে বিজ্ঞাপন মতই রেডিয়াম ল্যাবরেটরির যে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছে তাতেও রবীন্দ্রনাথের তারিখবিহীন স্বাক্ষর আছে। ১৯৪১ সালে ১৮ ই মে The Amrita Bazar Patrika – তে রেডিয়াম ল্যাবরেটরি যে বিজ্ঞাপন আমরা দেখেছি তাতে রবীন্দ্রনাথের ছবি সহ বিজ্ঞাপন শিরোনাম ছিল ” Your Duty ” .
Your DutyThose who are in habit using cosmetics like snow and cream and scent Eau- De- Cologne will find the poducts of the Radium Laboratory is no way different from those of product the foreign make. Under the circumstances I consider it their duty to encourage Swadeshi enterprise on the behalf .
Rabindranath Tagore
Snow, Cream, Til oil, Castor oil, Radium oil , Coconut oil, Cantheridin oil, Lime Juice, Glycerin, Dental cream, Rose Water etc.etc. Radium Laboratory , Calcutta.”
১৯৪১ সালের ২৭ মেয আনন্দবাজার পত্রিকায় রেডিয়াম ল্যাবরেটরির বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের যে অভিমত প্রচারিত হয়েছিল তাতে শুধুমাত্র স্নোর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল । সেটি ছিল নিম্ন রূপ –
” রেডিয়াম স্নো। কৃতজ্ঞতার সহিত জানাইতেছি যে, কলিকাতায় আমাদের একটি গীতিনাত্যা অভিনয়ের সময় এক প্যাকেট বসাক ফ্যাক্টরির রেডিয়াম স্নো উপহার পাইয়াছি ।আনন্দের সহিত বলিতেছি যে, আমাদের অভিনেতা ও অভিনেত্রীবর্গ ইহার উপকারিতা ও মনোহারীত্বে প্রীতিলাভ করিয়াছেন।
অমৃতবাজারে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে যা প্রচারিত হয়েছিল তা থেকে আমরা জানতে পারিনি কবি ঐসমস্ত বস্তু নিজে ব্যবহার করেছেন কিনা ? আনন্দবাজারের বিজ্ঞাপনে তিনি বলেছিলেন , নাটক দলের কুশলীবেরা স্নো ব্যবহার করে আনন্দ পেয়েছেন।
এই নিয়ে রবি ঠাকুরের জীবনে একটি কৌতুকপূর্ন ঘটনা আছে , এখানে বললে তা অসমীচীন হবে না।
“জয়শ্রী ” পত্রিকার লেখার জন্য শকুন্তলা রায় সহ তিনজন মহিলা কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। শকুন্তলা রায়ের জীবনস্মৃতিতে এসব কথা উদ্ধৃত হয়েছে-
” আমাদের দেখে উনি খুব আনন্দিত হয়ে বল্লেন – । তোমরা তো জয়শ্রী। ঢাকা থেকে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছো? তারপর কিছুক্ষণ নানা বিষয়ে কথা বলার পর আমাদের উদ্দেশ্যে জানাতে উনি বল্লেন , ‘সেতো তোমাদের দেখেই বুঝতে পেরেছি ।’ কিন্তু তখন উনি খুব ক্লান্ত আর লেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন । কাজেই লেখা দিতে পারলেন না ।শেষকালে আমাদের হতাশ মুখের ভাব দেখে কি মনে হলো বল্লেন – একেবারে খালি হাতে ফিরে যাবে ।এইটা নিয়ে যাও । এই বলে এক বাক্স রেডিয়াম স্নো- গোটা কতক শিশি হবে – হাতে দিয়ে বল্লেন। এটা মেখো সবাই মিলে । আমিতো ও সব ব্যবহার করিনা।আমি বল্লাম , ‘কিন্তু আমরা তো দেখেছি আপনি ওদের বিজ্ঞাপনে লিখে দিয়েছেন যে, ” রেডিয়াম স্নো ব্যবহার করিয়া দেখিয়াছি এটি বিশেষ ভালো।” ব্যবহার না করলে লিখলেন কি করে ? ‘ উনি একটু হেসে বল্লেন , ,’দুটো লাইন লিখে দিলে আমার ভিক্ষার ঝুলিতে কিছু টাকা পাওয়া যাবে যে।’
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ আনন্দবাজার প্রথম খন্ড
২. বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ