দ্বিতীয়াংশ: কামতাপুর দুর্গ (Kamatapur fort)

গত পর্বে গড় দুর্গের কোচবিহার (Kochbihar) নামক প্রবন্ধে আমি চিলারায়ের কোট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। আজ আমি কামতাপুর দুর্গ (Kamatapur fort) সম্পর্কে আলোচনা করব। 


খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের খেনরাজা নীলধ্বজ বা নীলাম্বর নির্মিত এই দুর্গের আয়তন এত বিরাট ছিল যে, কোচবিহার জেলার কয়টি থানার বেশ কিছু গ্রামকে এখন এর সীমানার অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা যেতে পারে। দুর্গের কেন্দ্রস্থলে রাজপ্রাসাদ ছিল । যার অংশবিশেষ এখন রাজপাট নামে অভিহিত হয়। এটি দিনহাটা থানার খালিসা – গোঁসানীমারি মৌজার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রাজপাটের উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশ ঘিরে প্রায় ১৪ মাইল ঘোড়ার খুরের আকৃতির উচ্চ প্রাচীর দেখা যায়, তা পূর্ব ভারতের দুর্গগুলির  মধ্যে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। কামতাপুর দুর্গ পূর্বে ধরলা নদী থেকে পশ্চিমে বড় গোদাইখোড়া নদী ও উত্তরে শীতলাবাস থেকে দক্ষিণের শিলদুয়ার – সোয়ারীগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । রাজপাটের পূর্ব দিকে ধরলা নদী প্রবাহিত থাকায় প্রায় ৫ মাইল বিস্তৃত কোনো প্রাচীরের প্রয়োজন হয়নি।


দুর্গটির বাহির পাঁচিলের ভিতর ও বাহিরে বেশ গভীর পরিখাও ছিল । দুর্গটি সম্পর্কে এ অঞ্চলে একটি কিংবদন্তী প্রচলিত আছে –
 রাজা কান্তেশ্বর বা কামতেশ্বর বা নীলাম্বর কামতাপুর দুর্গের সুষ্ঠ নির্মানের নিমিত্ত তাঁর উপাস্যা দেবী মা কামতেশ্বরীর কাছে মানত করেছিলেন যে, তিনি চারিটি দিন উপবাসী থাকবেন। কিন্তু কোনও বিশেষ কারণে নির্দিষ্ট দিনের আগেই তৃতীয় দিনে তাঁকে উপবাস ভঙ্গ করতে হয়। ফলে, চতুর্থদিকের প্রাকারটি  তিনি আর তৈরি করতে পারেননি ।

সম্ভবত হয়তো  চতুর্থ দিকে স্রোতস্বিনী ধরলা নদী প্রবাহিত হতো বলেই সেদিকে প্রাচীর তৈরির প্রয়োজন হয়নি । অথবা হোসেন শাহের সৈন্যবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের জন্য সেটি শেষ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে এই মাটির প্রাকার গড়ে প্রায় ৩০ ফুট এর মত উচ্চ। নির্মাণকাল এই প্রাচীরটি সম্ভবত ৪০ ফুটের অধিক উচ্চছিল। প্রাচীরটি বর্তমানে প্রায় ৩৫ ফুট চওড়া। উনবিংশ শতকের কোন কোন প্রত্যক্ষদর্শীর মতে এটি বেশ চওড়া ছিল এবং নিচের দিকে প্রায় ২০০ ফুট


দুর্গের সাতটি প্রবেশদ্বার বা দরজা ছিল। এর মধ্যে ছয়টির অস্তিত্বের নিদর্শন এখনও বর্তমান। দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে প্রবেশপথগুলো যথাক্রমে –  শিলদুয়ার ,বাঘদুয়ার, সন্ন্যাসীদুয়ার, জয়দুয়ার , নিমাইদুয়ার এবং হোকদুয়ার নামে পরিচিত । এদের মধ্যে কয়েকটি পাথরের , কটি কাঠের বা লোহার ছিল তা বলা সম্ভব নয় । তবে সাক্ষ্যপ্রমাণ দৃষ্টিতে মনে হয় প্রথমটি ছিল পাথরের। কারণ প্রথম দুয়ারের শিলদুয়ার নামকরণই এর সবথেকে বৃহত্তম প্রমাণ।  এই প্রবেশপথটির ধ্বংসাবশেষ নাকি কুড়ি বছর আগেও বিদ্যমান ছিল। পঞ্চাশের দশকের দিকে এক বিধ্বংসী বন্যায় তা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় । বাঘদুয়ারের মাথার উপর নাকি ছিল এক বাঘের মূর্তি বা বাঘের মাথা খোদিত ছিল।
সন্ন্যাসীদুয়ার নামকরণের কারণ সম্ভবত ওই দুয়ার দিয়ে সাধুসন্তেরা রাজার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। জয়দুয়ার দিয়ে রাজা বোধহয় যুদ্ধে জিতে এসে প্রবেশ করতেন ।  নিমাইদুয়ার শ্রীচৈতন্যদেবের কোচবিহারের বৈষ্ণব মতের আলোক নিয়ে এসেছিলেন সেই জন্য নির্মিত হয়।  

হোকদুয়ার আর এক নাম ছিল হেঁকোদুয়ার। বুকানন হ্যামিল্টনের মতে হেঁকো নামে একজন খেন বা কোচ  নায়কের নামানুসারে হেঁকোদুয়ারের নামকরণ হয়। 


গোঁসানীমঙ্গল পুঁথিতে  এই দুর্গের উত্তর দিকে অক্ষয় দুয়ার , দক্ষিণ দিকে বাঘদুয়ার ও শিলদুয়ার , পূর্বদিকে ধর্ম দুয়ার , পশ্চিম দিকে জয়দুয়ার অবস্থিতির কথা উল্লেখ রয়েছে। গোঁসানীমঙ্গলের প্রবেশপথগুলির  যে তালিকা দেওয়া হয়েছে , তা থেকে দেখা যায় পূর্বোক্ত তালিকার দুটি দুয়ারের উল্লেখ সেখানে করা হয়নি। আবার দুটি দুয়ারের নাম উল্লেখ নেই । পুঁথিতে উল্লিখিত অক্ষয় দুয়ার এবং ধর্ম দুয়ারের কথা পূর্বের তালিকায় নেই।
উভয় তালিকায় জয়দুয়ার, বাঘদুয়ার এবং শিলদুয়ারের কথা উল্লেখ আছে। গোঁসানীমঙ্গলে অক্ষয়দুয়ারের অবস্থান উত্তর দিকে দেখানো হয়েছে। হেঁকোদুয়ারও উত্তরদিকে অবস্থিত ছিল। তাই অক্ষয় দুয়ার এবং হেঁকোদুয়ারকে অভিন্ন মনে করা হয়। পূর্বে হয়তো এই দুয়ারটির নাম অক্ষয়দুয়ার ছিল পরবর্তীতে নাম হয়েছিল হেঁকোদুয়ার । ধর্ম দুয়ারের অবস্থান ঠিক কোথায় ছিল তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে মনে হয় এটির সঙ্গে পূর্বের তালিকার সন্ন্যাসীদুয়ার বা নিমাইদুয়ারের কোনো সম্পর্ক নেই । কারণ ধর্ম দুয়ারের অবস্থান ছিল পূর্ব দিকে এবং উক্ত দুই দুয়ারের অবস্থান ছিল পশ্চিমদিকে


 ধর্ম দুয়ার নামকরনের পিছনের সম্ভবত ধর্মঠাকুর ল সম্বন্ধীয় কোনো সংযোগ রয়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ভাগ ,পশ্চিমভাগ ,দক্ষিণভাগে নানাভাবে ধর্মঠাকুরের পূজা করা হয়। রাঢ়বঙ্গে ধর্মঠাকুর হলেন কুলদেবতা এবং ধর্মমঙ্গল হল জাতীয় কাব্যগ্রন্থ। কামতাপুর দুর্গের ওই ধর্ম দুয়ারের নিকট  সম্ভবত কোনো ধর্ম ঠাকুরের থান ছিল। তাই ওই দুয়ারের নামকরণ করা হয়েছিল ধর্মদুয়ার।
বর্তমানে রাজপাটের নিকট কোনো দুয়ার দেখা না গেলেও এস্থানেপূর্বে একটি প্রবেশপথ ছিল। এই প্রবেশ পথের নাম কি ছিল তা বলা যায় না । তবে , অনুমান জয়দুয়ার থেকে এটি পৃথক ছিল । জয়দুয়ারের অবস্থান রাজপাটের নিকট হওয়াই সংগত ছিল , কিন্তু  এটির বর্তমান অবস্থান রাজপাট থেকে অনেক দূরে ।  


বর্তমানে সপ্তদুয়ারের কোন নির্দিষ্ট চিহ্ন দেখা যায় না ।তবে স্থানে স্থানে প্রাচীরের মাঝে মাঝে যে প্রশস্ত ফাঁক দেখা যায় তা থেকে মনে হয় প্রবেশপথগুলো সেইসব স্থানেই অবস্থিত ছিল । শিলদুয়ার ব্যতীত আর সবকটি দুয়ার প্রবেশপথের দরজা সম্ভবত লোহা অথবা কাঠের তৈরি ছিল । শিলদুয়ারের পাথরের তৈরি দুয়ার কয়েক বছর আগে বন্যাপ্লাবিত সিংগীমারী নদীতে ভেসে যায় ।

বাঘদুয়ারে দুই পাশে ইঁটের গাঁথুনি থেকে মনে হয়, শিলদুয়ার ছাড়া বাকি ছটি দুয়ারের দুপাশেই ঐরূপ ইঁটের  গাঁথুনির গায়ে দরজা লাগানো ছিল । সমস্ত বাহির প্রাকারটি মাটির হলেও এর উপরে স্থানে স্থানে এখনো ইঁটের টুকরো থেকে উপলব্ধি করা হয় যে, প্রাচীরের উপবিভাগ ইঁট দিয়ে মজবুত করা হয়েছিল । দুর্গ  বেষ্টনকারী পরিখাটি প্রায় ২৫০ ফুট চওড়া ছিল ….কিন্তু এটির গভীরত্ব সম্বন্ধে এখন কিছু বলা যায়না । কত ৫০০ বছর ধরে এটি নাব্যতা প্রায় হ্রাস পেয়ে  গিয়ে অনেক স্থানে চাষের জমিতে পরিণত হয়েছে। পরিখাটিতে সব সময় জল সরবরাহ করার জন্য জল উবার নামের একটি জলাধার নির্মাণ করা হয়েছিল। তার উত্তর দিকে সাড়ে তিন মাইল দীর্ঘ এক শাখা প্রাচীর দেখা যায় ।

 ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে হ্যামিল্টন কামতাপুর দুর্গটি পরিদর্শন করেছিলেন ও নানা খুঁটিনাটি তথ্য সমেত একটি বিবরণী লিখে গিয়েছিলেন। তিনি আটিঁঁয়াবাড়ীর নেপ্রা গ্রামের নিকট একটি চওড়া রাজপথ ও সেতুর ভগ্নাবশেষ দেখেছিলেন। সেই সেতুর আজ আর কোন অস্তিত্ব নেই ।তবে রাস্তার ভগ্নাংশ এখনও দেখা যায়। স্থানীয় লোকের কাছে যার নাম মাল্লিভাঙ্গা । মাল্লি অর্থ পথ । এরকম আরেকটি পথ যদুর দীঘির কাছে দেখতে পাওয়া যায়।  এটি দর্পারমাল্লি নামে পরিচিত অর্থাৎ দর্পনারায়ন বা দর্পার পথ।  ওই দীঘির দক্ষিণ দিক দিয়ে আরেকটি সড়ক ঘোড়াঘাটের দিকে চলে গেছে তার নাম নীলাম্বরী সড়ক। খেনরাজা নীলাম্বর এটি তৈরি করেছিলেন।


বাঘদুয়ার থেকে অন্য একটি রাজপথরাজপাট অবধি বিস্তৃত। হ্যামিল্টন সেই পথের দুপাশে অধুনালুপ্ত লাল ইঁটের ছোট বড় নানা প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ দেখেছিলেন।  এর নিকটবর্তী আয়তাকার একটি দীঘি দেখা যায়। এর নাম ভোলানাথের দীঘি। কিংবদন্তি আছে যে এই দীঘি রাজা প্রাণনারায়ণের এক মন্ত্রী ভোলানাথ কার্যী দ্বারা খোদিত হয়। লৌকিক কিংবদন্তি অনুসারে এই দীঘির উত্তর পাড়ে একটি লাল রঙের ইঁটের প্রাসাদ ছিল। সেটি নাকি সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত নর্তকী লাল বাঈয়ের প্রাসাদ ছিল।

ভোলানাথের দীঘির সিঁড়ির ধাপ গুলি পাথর নির্মিত ছিল। এধরনের পাথর সাধারণত প্রাসাদ ইত্যাদি স্থাপত্যের কাজে ব্যবহার হতো। হরেন্দ্রনাথ চৌধুরীর মতে এই দীঘির পাড়ে একটি প্রাচীন পাথরের শিবমন্দির ছিল। ম্লেচ্ছরা আক্রমণ করে সেই মন্দির ধ্বংস করে। মন্দির নষ্ট করে সেখানে ম্লেচ্ছ সেনাপতিদের আবাস স্থলে পরিণত করা হয়। তাছাড়া ম্লেচ্ছরা যে কোচবিহারের পবিত্রতা নষ্ট করেছিল তার সব থেকে বৃহৎ প্রমাণ , ভোলানাথের দীঘির কিয়দ্ দূরে শাহ গরীব কামাল নামে এক গাজী দরগার ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। ভোলানাথের দিঘীর খুব কাছেই একটি ক্ষয়িত বেলে পাথরের মূর্তি আছে । এটি অল্টো – রিলিভো রীতিতে গভীরভাবে খোদিত। স্থানীয় মানুষজন এটিকে সুবচনী দেবী হিসেবে পূজা করে থাকেন । হ্যামিল্টন তাঁর বিবরণীতে এটি ও অপর একটি মূর্তির কথা উল্লেখ করেছেন । মিস্টার মার্টিনের #ইস্টার্ন_ইন্ডিয়া গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে মূর্তি দুটির ছবি রয়েছে। অনুমান অন্যমূর্তিটি কোনো বালকের।  দেবী সুবচনীর মূর্তিটি ভালোভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যায় সেটি হাঁটু গেড়ে বসা বীণাবাদনরত এক নারীমূর্তি। মনে হয় মূর্তির গাত্রে নানাপ্রকার অলংকার ছিল । মূর্তিটি হয় দেবী স্বরস্বতীর অথবা কোন বীণা বাদনরতা রাজমহিষীর।


প্রায় দেড়শ থেকে দুইশ বছর আগেও এখানে আরও বেশ কয়েকটি বেলেপাথরের মূর্তি ছিল বলে জনশ্রুতি আছে। রাজপাটের উপর এখন যেসব বেলেপাথরের মূর্তি দেখতে পাওয়া যায় তাদের সঙ্গে উল্লিখিত মূর্তিটির বিশেষ সাদৃশ্য আছে । মনে হয় , এইসব গভীরভাবে খোদিত বেলে পাথরের মূর্তিযুক্ত পাথরের খন্ডগুলি কোনো পাথরের মন্দির বা ভিত্তির গায়ে লাগানো ছিল। 

কিংবদন্তি আছে, দুর্গের ভেতর থেকে কিছু স্থাপত্য নিদর্শন , যেমন – থাম , তোরণ প্রভৃতি কোচবিহার রাজ প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। দুর্গের ভিতরে রাজপাটের ঢিবি , টাঁকশালের ধ্বংসাবশেষ, রাজাদের  স্নান করার জন্য গ্রানাইট পাথরের বিশাল চৌবাচ্চা,  ভুলকাভুলকি নামে একটি আজব প্রাসাদ,  রাস্তার চিহ্ন,বড় বড় মজা দীঘি আর পাথরের কিছু মূর্তি ও থামের ভাঙ্গা অংশ দেখা যেত।  অবশ্য এখন টাঁকশালে কারুকার্যখচিত কয়েকটি থাম, পাথরের খণ্ড,  কীর্তিমুখ ছাড়া অন্য কিছুই অবশিষ্ট নেই । 
জায়গাটির নাম হল কেন টাঁকশাল হল তা বলা কঠিন…! কেননা এই পাথরের খণ্ড গুলি কোন রাজপ্রাসাদ বা মন্দিরের বলে উপলব্ধ হয়। জনশ্রুতি ,এখানে খেন রাজাদের একটি টাঁকশাল ছিল । কিন্তু তাঁদের কোন টাকা এখনো যায়নি । তবে পাওয়া যাবেনা একথাও বলা ঠিক নয় …মাটির তলায় কি আছে তা বলা  কঠিন ! রাজপাট থেকে টাঁকশালের দূরত্ব আধ মাইলের বেশী হবে না।


#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী (Durgeshanandini)


তথ্যঃ ১ . পশ্চিমবঙ্গের পুরাকীর্তি

২. কোচবিহারের পুরাকীর্তি

৩. ইতিকথায় কোচবিহার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.