১৯০৬-০৭ সাল । বাংলার গভর্নর তখন অ্যান্ড্রু ফ্রেজার । অত্যাচারী শাসক ফ্রেজার হয়ে উঠলেন বাংলার বিপ্লবীদের চক্ষুশূল । পরিকল্পনা হল তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার । এই হত্যাকান্ড পরিচালনার জন্য দায়িত্ব নেন বারীন্দ্র কুমার ঘোষ । বিপ্লবীদের কাছে খবর ছিল ফ্রেজার ট্রেনে করে ফিরছেন । পরিকল্পনা হয় চন্দননগর ও মানকুণ্ডু স্টেশনের রেললাইনের পাশে বোমা পুঁতে রেখে আসার । বারীন ঘোষ দায়িত্ব দিলেন রংপুর থেকে কলকাতা আসা এক যুবককে । তিনি বোমা পুঁতে রেখে আসলেন কিন্তু ভুলবশত সেই বোমাটি একটু বেশি গভীরে পুঁতে রেখেছিলেন । তাই কার্যকরী হয়নি সেই পরিকল্পনা । বেঁচে যান ফ্রেজার । কিছুদিনের মধ্যেই আবার খবর পাওয়া গেল ফ্রেজারের ট্রেনযাত্রার । নারায়ণগড় স্টেশনের কাছে রেললাইনে বোমা রেখে আসলেন সেই যুবক । তার সঙ্গে ছিলেন বিভূতি সরকার । সেই বোমা ফাটল । কিন্তু যে কম্পার্টমেন্টে বোমার আঘাত এল তার ঠিক আগের কম্পার্টমেন্টে ছিলেন ফ্রেজার । বেঁচে যান ফ্রেজার । এদিকে সেদিনকার ঘটনার পর বন জঙ্গল, ধানক্ষেত অতিক্রম করে দৌড়ে এক রাতে নারায়ণগড় থেকে মেদিনীপুরে এসেছিলেন সেই যুবক এবং বিভূতি সরকার । ঘন্টায় ৫ মাইল দৌড়োনোর ক্ষমতা রাখতেন সেই যুবক । মেদিনীপুরে যখন পৌঁছালেন তখন সেই যুবকের পায়ে বিঁধেছিল ৩২ টি কাঁটা । এদিকে ব্রিটিশরা তখনও বুঝে উঠতে পারেননি এই ঘটনা বাংলার বিপ্লবীদের কাজ । তারা স্টেশনের কিছু কুলিকে আটক করে । কিন্তু আসল ঘটনা সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিল না ।
সেই যুবক ছিলেন প্রফুল্ল চাকী।
চাকী তার আসল পদবি নয় । ওটা ছিল তাদের উপাধি । তাদের পদবি ছিল বসু । প্রফুল্ল চাকীর পরিবারের আদি নিবাস ছিল পাবনার চাচাকিয়া গ্রামে । পাবনার চাচাকিয়া গ্রামের সকল পরিবারের উপাধি ছিল চাকী । তাই তারাও বসু ছেড়ে চাকী পদবি ব্যবহার করেন । ১৮৮৮ সালের ১০ ডিসেম্বর বর্তমান বাংলাদেশের বগুড়া জেলার বিহার গ্রামে জন্ম নেন প্রফুল্ল চাকী। পাশেই নাগর নদী । পিতার নাম রাজ নারায়ণ চাকী। তিনি বগুড়ার নবাব এ্যষ্টেটে কর্মরত ছিলেন। মাতার নাম স্বর্ণময়ী দেবী। প্রফুল্ল চাকী ৪ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে ছিলেন কনিষ্ঠ সন্তান। মাত্র ২ বছর বয়সে প্রফুল্ল চাকীর পিতা মারা যান।প্রফুল্ল চাকীর পড়াশুনার হাতেখড়ি হয় মায়ের কাছে। প্রাথমিক পড়াশুনা শেষে বগুড়ার নামুজা জ্ঞানদা প্রসাদ ইংরেজী বিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি করা হয়।গ্রামেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন লাইব্রেরী, কুস্তির আঁখড়া । খুব দক্ষ ছিলেন লাঠিখেলায় । দু হাতে দুটি লাঠি নিয়ে লাঠি চালাতে চালাতে অতিক্রম করতে পারতেন দুই তিন মাইল । আর খুব ভালোবাসতেন ঘোড়ায় চড়তে । ডুবসাঁতারে তিনি ছিলেন পারদর্শী । এরপর তিনি চলে আসেন রংপুর । ১৯০২ সাল থেকে প্রায় ১৯০৫ সাল পর্যন্ত রংপুর জেলাস্কুলে পড়াশুনা করেন। ১৯০৫ সালে শুরু হল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন । প্রফুল্ল চাকী এবং তার স্কুলের বেশ কিছু ছাত্র অংশ নিলেন এই আন্দোলনে । ব্রিটিশরা তাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল । রংপুর জেলাস্কুলের যে সমস্ত ছাত্র বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে ৫ টাকা জরিমানা ধার্য হল । প্রফুল্ল চাকি এর প্রতিবাদ করেন । তিনি এবং ওই স্কুলের অনেক ছাত্র বহিস্কৃত হন স্কুল থেকে । ব্রজকিশোর রায় এক রাতেই তৈরী করলেন রংপুর জাতীয় স্কুল । প্রফুল্ল চাকী সহ বহিষ্কৃত ছাত্ররা সেই স্কুলে ভর্তি হন । বিপ্লব তখন মিশে গেছে প্রফুল্ল চাকীর রক্তে । রংপুরে ঈশানচন্দ্র চক্রবর্তী ও তার ছেলে প্রফুল্ল চক্রবর্তী , সুরেশ চক্রবর্তী ও প্রফুল্ল চাকীর চেষ্ঠায় একটি কুস্তির আখড়া গড়ে উঠেছিল। প্রফুল্ল চাকী রংপুরের কুস্তির আখড়ার পরিচালক ছিলেন। এর পাশাপাশি চলত বিপ্লবী কার্যকলাপ । প্রফুল্ল চাকী রিভলভার চালানোয় ছিলেন প্রচন্ড দক্ষ । প্রফুল্ল চাকীর সহযোদ্ধা শ্রীযুক্ত সুরেশ চক্রবর্তী লিখেছিলেন, “রংপুরে আমাদের একটি বৈপ্লবিক দল ছিল। আমরা তিনজনেই (প্রফুল্ল চক্রবর্তী, সুরেশ চক্রবর্তী ও প্রফুল্ল চাকী) অন্তর্ভূক্ত ছিলাম। এই দলে প্রবেশের অনুষ্ঠান ছিল বুক কেটে সেই রক্ত দিয়ে কয়েকটি প্রতিজ্ঞা সম্বলিত একখানি কাগজে স্বাক্ষর করা। এই প্রতিজ্ঞা গুলোর একটি ছিল প্রয়োজন হলে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করবে।”
এইসময় বারীন ঘোষ রংপুরে আসেন। প্রফুল্ল চাকীকে দেখে মুগ্ধ হন । তিনি তাকে কলকাতা আসার অনুরোধ করেন । প্রতিষ্ঠানিক পড়াশুনার ইতি ঘটিয়ে বৈপ্লবিক কর্মকান্ডে নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য কলকাতায় চলে যান প্রফুল্ল চাকী। সেখানে তিনি ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে উঠেন। প্রফুল্ল চাকী সেখানে অন্যান্যদের বলতেন, “আমার নাম প্রফুল্ল চাকী । ব্রিটিশদের ক্ষমতা নেই আমার গায়ে হাত দেওয়ার ।” বারীন ঘোষ লিখেছেন, “প্রফুল্ল বড় জেদী ছেলে। খালি বলত আমাকে এ কাজে পাঠানো হয় না? ও কাজের ভার কেন আমাকে দেওয়া হল না, আমি কি মরতে পারি না? আমার কি সাহস নাই? আর কাজ না দিলে মুখ ভার করে থাকত। তাই ওকে আমরা কঠিন কাজের ভার দেওয়া শুরু করলাম।”
১৯০৭ সালে আবার বারীন ঘোষ ছোটলাট ফুলারকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। প্রয়োজনীয় টাকা সংগ্রহের জন্য তিনি রংপুরের বিপ্লবী দলকে রংপুরের এক জমিদার বাড়ীতে ডাকাতি করতে পাঠান। এই দলে ছিলেন নরেন বক্সী, হেমচন্দ্র দাস, মহেন্দ্র লাহিড়ী, পরেশ মৌলিক ও প্রফুল্ল চাকী। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন প্রফুল্ল চাকী । কিন্তু পূর্বেই কোনো রকম ভাবে সংবাদ পেয়ে জমিদার বাড়ীতে পুলিশ এসে যায়। এই খবর শুনে ডাকাতির পরিকল্পনা থেকে সরে আসা হয়, সাথে সাথে রামফিল্ড ফুলারকে হত্যা করার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এরপর আবার ফুলারকে হত্যার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ফুলার ধুবড়ী হতে যখন স্পেশাল ট্রেনে রংপুর আসবেন আর তখন রংপুর স্টেশনের একমাইল দুরে রেললাইনের নিচে ব্যাটারী সংযোগে একটি বোমা রাখা হবে। আর যদি বোমা না ফাটে তাহলে পরেশ মৌলিক ও প্রফুল্ল চাকী লাল লন্ঠন দেখিয়ে বিপদ সঙ্কেত বুঝিয়ে গাড়ি থামাবেন। তারপর প্রফুল্ল চাকী রিভলভার দিয়ে ফুলারকে হত্যা করবেন। কিন্তু এ যাত্রায়ও ফুলার হত্যা পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় কারণ ওই দিন ফুলার ষ্টীমার দিয়ে চলে যান।
এবার আসা যাক মুজফরপুরের ঘটনায় । আমরা সবাই জানি ক্ষুদিরাম বসুকে সঙ্গ দিয়েছিলেন প্রফুল্ল চাকী । আসলে প্রফুল্ল চাকির সঙ্গ দিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম বসু | প্রফুল্ল চাকীর যাওয়া ছিল একদম নিশ্চিত । প্রথমে তার সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল সুশীল সেনের । কিন্তু তার বয়স খুব কম থাকায় তিনি যাননি । এরপর কানাইলাল দত্তকে চন্দননগর থেকে কলকাতা নিয়ে আসা হয় প্রফুল্ল চাকীর সঙ্গী হিসেবে যাওয়ার জন্যে । কিন্তু যাওয়ার কিছুদিন আগে তার হল খুব জ্বর । শেষমেশ হেমচন্দ্র কানুনগো এবং সত্যেন বসু ক্ষুদিরাম বসুর নাম দিলে কোন উপায় না দেখে ক্ষুদিরাম বসুকেই প্রফুল্ল চাকীর সঙ্গী করা হয় । উল্লাসকর দত্তের বানানো বোমা নিয়ে দুজনে যান মুজফরপুরে । বোমাটি ছুড়েছিলেন প্রফুল্ল চাকী নিজে কারণ সেই প্রত্যাঘাত সহ্য করার ক্ষমতা তার ছিল ।
আরেকটা ভুল তথ্য জানানো হয় প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেছেন । বলা হয় মোকামা স্টেশনে নন্দলাল ব্যানার্জী ও তিন চারজন পুলিশ তাকে ধরে ফেলে এবং পালানোর পথ না দেখে তিনি আত্মহত্যা করেন । প্রফুল্ল চাকী এতটাই বলবান ছিলেন ওই তিন চারজন পুলিশের মোকাবিলা করা তাঁর কাছে কোন ব্যাপার ছিল না । বলা হয় তিনি পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিলেন কিন্তু সেটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় । পরে দেখা যায় প্রফুল্লর পিস্তলের ম্যাগাজিনে ৭টি কার্তুজ ভরার ব্যবস্থা ছিল এবং সম্ভবত প্রফুল্ল ৭টি কার্তুজ ভরেছিলেন৷ পিস্তলটি বাজেয়াপ্ত করে দেখা যায়, সেখানে ৪টি কার্তুজ রয়েছে, অর্থাত্ ৩টি খরচ হয়েছিল । তাঁর কাঁধে এক কনস্টেবল সজোরে লাঠির আঘাত করেছিল৷ শুধু একটিই? তা হলে নীচের ঠোঁটের গভীর ক্ষতের কারণ কী? কান-মুখ দিয়ে রক্ত বেরুনোর অস্পষ্ট দাগ? এসব অত্যধিক দৈহিক পীড়নের ফল নয় কী? দু’টি গুলির ক্ষতের স্থান নির্দেশ করে একজন বাঁ-হাতির পক্ষেই এই স্থানে গুলি করে আত্মহত্যা করা সম্ভব৷ প্রফুল্ল স্বাভাবিক ডান-হাতি ছিলেন৷ vital organ-এ একাধিক গুলিতে আত্মহত্যার ঘটনা বিরল, কেননা প্রথমটির পরে শারীরিক ক্ষমতা তেমন আর থাকে না । কোনও competent authority কেন, কোনও ডাক্তারের দেওয়া মৃত্যুর সার্টিফিকেটও নেই৷ হয়নি কোনো পোস্টমর্টেম । ব্রিটিশরা তাকে লাঠি দিয়ে এবং বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারে, তারপর আহত চাকীকে তার নিজের পিস্তল দিয়ে গুলি করে হত্যা করে ।
এখানেই শেষ নয় । এরপর ব্রিটিশরা তার দেহ থেকে মাথা কেটে স্পিরিটে চুবিয়ে তার মাথা পাঠিয়ে দেয় সনাক্তকরণের জন্যে । ক্ষুদিরাম বসু তাকে সনাক্ত করেন ।প্রফুল্ল চাকীর দেহ ফেলে দেওয়া হয় কোথাও, তার হদিশ মেলেনি । সেই মাথা পাঠানো হয় প্রফুল্ল চাকীর মায়ের কাছে । তিনি দেখে বলেন,”এই মাথা আমার ফুলুর(প্রফুল্ল চাকীর ডাকনাম)”।
প্রফুল্ল চাকী ছিলেন বিরাট বিপ্লবী । যিনি তাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন সেই পুলিশ অফিসার নন্দলাল ব্যানার্জীকে কিছুদিনের মধ্যেই লালবাজারের কাছে সার্পেনটাইন লেনে হত্যা করেন শ্রীশ পাল ও রণেন গাঙ্গুলী । ব্রিটিশরা হাজার চেষ্টাতেও জানতেও পারেনি কে করেছিল সেই খুন । স্বাধীনতার পরে জানা যায় শ্রীশ পাল ও রণেন গাঙ্গুলী হত্যা করেছিলেন নন্দলাল ব্যানার্জীকে । গুলি চালিয়েছিলেন রণেন গাঙ্গুলী । সে ইতিহাস অন্য কোনওদিন ।
আজ ২ রা মে । চাপেকার ভাইদের কর্মকান্ডের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যিনি সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন সেই বীর বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীর আত্মবলিদান দিবস । আমাদের শ্রদ্ধা।
(বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীর পরিবারের লোকেদের থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে লেখা)