#প্রথমাংশ : #চিলারায়ের_কোট
হিমালয়ের অঙ্কাশ্রিত যতগুলি নগর প্রধান অঞ্চল উত্তর বঙ্গে আছে নিঃসন্দেহে কোচবিহার তারমধ্যে নয়নাভিরাম উত্তরে হিমালয়। সুপ্রাচীন কোচবিহার । রাজা ভগদত্তের কোচবিহার। প্রাগজ্যোতিষপুর কোচবিহার। রাজা ভগদত্তের আরাধ্যা গোসানমারীর দেবী কামতেশ্বরীর কোচবিহার। শুভ্রকিরীট , দক্ষিণে দুর্ধর্ষ নদী সংকোষ, রায়ডাক, তোর্ষার জলবিধৌত সমতলভূমি এবং বনাঞ্চল, তারই মাঝে অমূল্য সম্পদ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজকের কোচবিহার।
কোচবিহার শহরের পূর্ব নাম ছিল গুড়িয়াহাটি। কোচবিহার কথাটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ #বিহার থেকে। বিহার অর্থাৎ প্রমোদ্দ্দ্যান – কোচদের প্রমোদ্দ্যান । বিহার প্রদেশের ন্যায় নামকরণের এই ঐতিহাসিক সত্যতা থাকলেও থাকতে পারে । কিন্তু শক্তি মতে , তন্ত্র মতে এবং প্রাচীন পুরাণ মতে কোচবিহারের প্রাচীন নাম কামরূপ। পুরাণ ও তন্ত্রে কামরূপ চারটি পীঠ নিয়ে গঠিত – কামপীঠ, রত্নপীঠ, সুবর্ণপীঠ এবং সৌমারপীঠ। কোচবিহার হল এই শেষোক্ত পীঠের অন্তর্গত।
খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে নানা ফার্সী গ্রন্থ যেমন – আলমগীরনামা , তারিখ -ই – আমাম ইত্যাদি গ্রন্থে কোচ সাম্রাজ্যের পশ্চিমভাগকে কোচবিহার ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্বকোষ মাতে কোচবিহারের আদি নাম বিহার ছিল, রাজা লক্ষ্মীনারায়ণের সময় থেকে মুঘল শাসিত বিহার প্রদেশের সঙ্গে নাম বিভ্রান্তি হওয়ার জন্য পৃথকভাবে এর নামকরণ করা হয় কোচবিহার ।
কোচ এই শব্দের উত্থান কোথা হতে?
কামরূপ কোটিকোটিযুতং লিঙ্গং কোটি কোটি গনৈযুর্তম।
পঞ্চতীৰ্থং ভবেৎ পূৰ্ব্বে পশ্চিমে ধনদা নদী।।
পত্রাখ্যা দক্ষিণে চৈব উত্তরে কুরবকাবনম্।
এতন্মধ্যগতং দেবী শ্ৰীপীঠং নাম নামত: ।।
( যোগিনীতন্ত্র ২ । ১ )
প্রথম পীঠের নাম বারাহী, দ্বিতীয় কোলপীঠ । প্রথম ক্ষেত্রের নাম কুমারক্ষেত্র, দ্বিতীয়ের নাম নন্দন এবং তৃতীয়ের নাম শাশ্বতীক্ষেত্র। প্রথম বনের নাম মাতঙ্গ, দ্বিতীয়ের নাম সিদ্ধারণ্য, তৃতীয়ের নাম বিপুলবন । এই বন কোটি কোটি লিঙ্গযুক্ত এবং কোটি কোটি গণাধিষ্ঠিত। পূৰ্ব্বসীমায় পঞ্চতীর্থ, পশ্চিমে ধনদা নদী, দক্ষিণে পত্রা ও উত্তরে কুরুবকা বন, এরই মধ্যস্থলে শ্ৰীপীঠ অবস্থিত। সম্ভবতঃ কমতেশ্বরীদেী এই স্থানে অধিষ্ঠান করিতেন বলেই এই কোচবিহারকে শ্ৰী পীঠ বলা হয়েছে।
এই মা ভগবতী কামতেশ্বরীর ক্রোড় থেকেই কোচ শব্দের উৎপত্তি। সঙ্কোচ থেকে কোচ শব্দের উৎপত্তি বলে কয়েকজন মনে করেন। তবে সংকোষ নদী বিধৌত ভূমি কোচ বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। কুবচ থেকে কোচ বা কোচক এবং কমোচ থেকে কোচ শব্দের সৃষ্টি হয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন। কালিকা পুরাণে একই কোচদেশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
কোচ রাজবংশের অনেকেই যেমন – শিবের বরপুত্র মহারাজ বিশ্বসিংহ, নরনারায়ণ, প্রাণনারায়ণকে কামতেশ্বর উপাধি নিতে দেখা যায় । এ থেকে উপলব্ধি হয় যে, সেই সময় কোচরাজ্য কামতা নামে পরিচিত ছিল।
পাল বংশের রাজত্বের শেষে এই অঞ্চলে খেন বংশের রাজত্ব শুরু হয়। খেন বংশের পরাক্রম শালী তিন রাজা ছিলেন – নীলধ্বজ , চক্রধ্বজ ও নীলাম্বর । এনারা ১৪৪০ থেকে ১৪৯৮ খ্রি অবধি রাজত্ব করেন। কামতাপুর ছিল রাজধানী। কিন্তু সেই করাল গ্রাস এল…হুসেন শা খেন রাজ্য আক্রমন করে ও প্রবল যুদ্ধ করেও নীলাম্বর পরাজিত ও নিহত হন। সেই আক্রমণের পর সমগ্র এলাকায় মাৎসন্যায় সূচিত হয়। ভূঁইয়ারা যেমন স্বাধীন ভাবে প্রভুক্ত হল তেমনি একে অপরকে গ্রাস করল।বারো ভূঁইয়ার মধ্যে হাজো নামে এক কোচ বংশীয় এ অঞ্চলে প্রভুত্ব করতেন ।তাঁর নামেই কামরূপের একাংশের নাম হয় কোচ – হাজো। কোচ রাজ্য পশ্চিমে করতোয়া নদী থেকে পূর্বে গৌহাটি পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।এই সময় কোচ জাতি শক্তি শালী হয়ে উঠছিল।
ভারতবর্ষের বিখ্যাত নৃপতি ছিলেন বোদাজাতির প্রতিভূ কামরূপ নৃপতি ভাস্করবর্মন। ইনি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা , সুরমা উপত্যকা এবং বাংলার উত্তরাঞ্চল নিয়ে একটি বৃহৎ সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। পরের যে পট পরিবর্তন হয় সে ইতিহাস তো আমি অনেক বড় আমার বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছি।
কোচরাজ বংশের শ্রেষ্ঠ ও আদি পুরুষ মহারাজ বিশ্ব সিংহের মৃত্যু হলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মল্লদেব বা নরনারায়ণ রাজা হন। এই সময় নরনারায়ণের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ও সেনাপতি শুক্লধ্বজ বা চিলারায় কোচরাজ্য কে বহুদূর বিস্তার করেন।
এ হেন পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক কোচবিহারের মাঠ, ঘাট, জলাশয় , নদী ,নালা সবই পুরাকীর্তির আকরে পরিপূর্ণ। খেন থেকে শুরু করে কোচ বংশের অজস্র মূর্তি, মুদ্রা , পুরাবন্তু, পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ , মন্দির ও টাঁকশালের ঢিপি এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে। খেনরাজাদের রাজধানী কামতাপুর থেকে অনেক পাথরের মূর্তি , পুরাবস্তু ও অন্যান্য পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এগুলি পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগে নির্মিত বলে মনে হয়। খেন ও খেন পরবর্তী যুগে খেন এবং কোচ বংশীয় রাজারা এখানে বহু মাটির , ইঁটের এবং পাথরের দুর্গ বা গড় নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে সেসব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং অনেকগুলিই জলপাইগুড়ি জেলা, আসাম রাজ্য, ভুটান ও বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
কোচবিহারের যেসব দুর্গের কথা বলা হয়েছে তার বেশিরভাগই সম্ভবত খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে নির্মিত। এসব দুর্গ গুলির মধ্যে ফেঙ্গুয়াগড়, বৈদ্যের গড়, বিক্রমরাজার গড়, রওনাগড়, প্রতাপগড়, সাতপাড় গড়, পাঙ্গাগড়, রাজার গড়, কামতাপুর দুর্গ , কুমারীর কোট, গড় দলিপা, ময়নামতির কোট, পিঞ্জারির ঝাড় দুর্গ, আঠারকোঠা দুর্গ, বারো পাইকের গড়, বিশ্বসিংহের কেল্লা, মন্থনাকোট , হিঙ্গুলা কোট, চিলারায়ের কোট ও জালধোওয়া দুর্গ বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য।
এসব দুর্গগুলির অধিকাংশই খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ – ষোড়শ শতকে নির্মিত। উক্ত দুর্গ গুলির মধ্যে ফেঙ্গুয়াগড় নামে রাজা কামতেশ্বরের এক পৌত্র ( খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকে ?) , গড় দলিপা বা জরিপা দলিপ সামন্ত নামক জনৈক কোচ নায়ক ( খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতকে ? )কামতাপুর , মন্থনা কোট, কুমারীর কোট, সাতপাড় গড়, বারো পাইকের গড় , পিঞ্জারীর ঝাড় দুর্গ ( ছোট এবং বড়) আঠারো কোটা খেন রাজ নীলাম্বর ( খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগে নির্মিত ) , বিশ্ব সিংহ কেল্লা ও হিঙ্গুলা কোট কোচ রাজনবংশের আদিপুরুষ বিশ্বসিংহ এবং চিলারায়ের কোট ও জালধোয়া দুর্গ চিলারায় কর্তৃক নির্মিত হয়।
ময়নামতীর কোট আনুমানিক গোপীচান্দের মাতা ময়নামতীর সৃষ্টি এবং বৈদ্যগড় ও প্রতাপগড় রাজা আরিমত্তের তৈরি । যদিও এই রাজা অরিমত্ত বা আরিমত্ত সম্পর্কে বিশেষ জানা যায় না । বিক্রমরাজার গড় ঠিক কোন সময় নির্মিত হয়েছিল তা অজ্ঞাত হলেও মনে হয় এই রাজার সঙ্গে গর্দভিল্লবংশীয় রাজা বিক্রমাদিত্য বা গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের কোন সম্পর্ক ছিল না । তবে কোচরাজ মল্লদেব বা নরনারায়ণের এক বিরূধ বা উপাধি ছিল বিক্রমাদিত্য । তাই মনে করা হয় ইনিই বিক্রমগড়ের নির্মাতা।
বেশ কিছুকাল আগে পর্যন্ত কুমারীর কোট ও জলধাওয়া দুর্গের যেটুকু ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যেত এক বিধ্বংসী বন্যার ফলে তার শেষ চিহ্নটুকুও লোপ পেয়েছে । কোচবিহার জেলায় বর্তমানে কামতাদুর্গ এবং চিলারায়ের কোট ব্যতীত অন্য কোন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আর দেখতে পাওয়া যায় না ।
কুমারীর কোট সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে খেনবংশীয়া আয়ী নামে পরিচিত এক রাজকুমারী এই দুর্গে বাস করতেন । সম্ভবত তিনি খেনরাজ নীলাম্বরের ভগ্নী ছিলেন । দুর্গটি ইঁট এবং প্রাচীরবেষ্টিত ছিল।
চিলারায় কর্তৃক জলধাওয়া দুর্গটি স্থাপিত হয়েছিল গদাধর নদের পাশে জলধাওয়া গ্রামে। ছোট এবং আয়তাকার এই দুর্গ থেকে চিলারায় নির্মিত বেরবেরা বন্দরের দূরত্ব খুব অধিক ছিল না।
আজ এই পর্বে আমরা কোচবিহারের চিলরায়ের কোট এবং কামতাপুর দুর্গ সম্পর্কে আলোচনা করব-
মহকুমা শহর তুফানগঞ্জ, তার একটি গ্রাম ফুলবাড়ি । সেখান থেকে মাত্র দেড় মাইল দূরে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত অন্দরান ফুলবাড়ি ,জেলা সদরের সঙ্গে পিচ রাস্তা দ্বারা সংযুক্ত । এ পথে নিয়মিত বাস চলে। এখানেই #চিলারায়ের_কোট নামে একটি পুরাতন দুর্গ বা গড়ের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায় । মহারাজ নরনারায়ণের কণিষ্ঠ ভ্রাতা শুক্লধ্বজ বা চিলারায় যিনি পরে #বিজনী রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন , তিনি এই দুর্গটি নির্মাণ করেন ।
ঐতিহাসিক হরেন্দ্রনাথ চৌধুরীর মতে যুবরাজ চিলারায় বা শুক্লধ্বজ ফুলবাড়ি গ্রামের মাটির পাঁচিল ঘেরা একটি গড় বা দুর্গে কাঠ অথবা বাঁশের ঘরে বাস করতেন । দুর্গের ভিতর তাঁর অন্দরমহল থাকায় স্থানের নাম হয়েছিল #অন্দরানফুলবাড়ি। সম্ভবত আদিতে অন্দরানফুলবাড়ি গ্রামের এই দুর্গটি মেচাঘর রূপে ব্যবহৃত হতো । খ্রিস্টীয় ষোড়শ – সপ্তদশ শতকে কোচবিহার রাজ্যের যুদ্ধ পরিচালনার কাজে সুবিধার জন্য রাজপথে সাময়িকভাবে বাঁশ বা কাঠের ঘর নির্মাণ করা হতো । এগুলিকে #মেচাঘর বলা হয়।
যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার জন্য কোচবিহাররাজ নরনারায়ণের প্রধান সেনাপতি রূপে চিলারায় তৎকালীন কোচবিহার আসাম সড়কের পাশে, উপযুক্ত দূরত্বে , এমন আরো কিছু মেচাঘর নির্মাণ করেছিলেন।
অন্দরানফুলবাড়ির যে মেচাঘর , তা চিলারায়ের ভীষণ প্রিয় ছিল । এটি রায়ডাক নদীর ধারে অবস্থিত থাকায় সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জনশ্রুতি আছে অন্দরানফুলবারি এই মেচাঘর , যা পরবর্তীকালে রূপান্তরিত হয় গড় বা কোর্টে , সেখানে একসময় বিখ্যাত বৈষ্ণবসন্ন্যাসী ও গুরু শঙ্করদেবকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা নরনারায়ণের কোপানল থেকে রক্ষা করার মানসে লুকিয়ে রেখেছিলেন । কথিত আছে, চিলারায় পরিণত বয়সে বৈষ্ণব দীক্ষা গ্রহণ করেন । উক্ত ঘটনা থেকে এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, চিলারায় শঙ্করদেবের সান্নিধ্যে আসার ফলে বৈষ্ণব ভাবাপন্ন হয়ে পড়েন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে , কোচরাজবংশের কুল দেবতা নারায়ণ এবং সেই কারণে কোচরাজবংশকে নারায়ণ বংশ বলেও উল্লেখ করা হয়। তবে নরনারায়ণ তথা কোচরাজবংশ শাক্তমতে বিশ্বাস করতেন এবং শাক্ত দেবী কামতেশ্বরীর উপাসক ছিলেন ।
এই দুর্গের ঘরগুলি বাঁশ বা কাঠ দিয়ে তৈরি হয়েছিল বলে দুর্গটির আর কোন চিহ্ন সেভাবে দেখা যায়না । দুর্গের প্রাচীর সম্ভবত মাটির হলেও তার ভিত ইঁট বা চুনমেশানো ইঁটের খোয়া দিয়ে শক্ত করা হয়েছিল । কেননা প্রাচীরের নিচের দিকে কিছু কিছু স্থানে ইঁটের টুকরো পাওয়া গিয়েছে ।
দুর্গ প্রাকার স্থানে স্থানে ক্ষয়ে গেলেও এর বর্তমান মাপ সাত ফুট উঁচু এবং ৬ ফুট চওড়া। অতীতে এটি আরো উচ্চ ছিল বলে মনে করা হয়। এর উত্তর দক্ষিণে ২৭০ ফুট লম্বা ও পূর্ব পশ্চিম ২১০ ফুট চওড়া। দুর্গের ভিতরে জমির পরিমাণ প্রায় ৫৬৭০০ বর্গফুট। দুর্গের প্রবেশ পথ কোনদিকে ছিল তা সঠিকভাবে বলা যায় না । তবে মনে করা হয় তা পূর্ব দিকে ছিল । কেননা সেদিকে পাঁচিলের মাঝামাঝি স্থানে প্রায় ৫ ফুট পরিমিত জায়গা খোলা পড়ে আছে।
এই খোলা স্থানে আরো পশ্চিমে আরেকটি পাঁচিল দেখতে পাওয়া যায় । সেটি উত্তর-পশ্চিমের প্রাচীরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে । মনে হয় এই পাঁচিলের মাঝখানে আরেকটি পূর্বমুখী প্রবেশপথ ছিল । এটি ছিল সম্ভবত অন্দরমহলের প্রবেশ পথ । আয়তাকার দুর্গের কাছাকাছি জায়গা থেকে কিছু লোহার টুকরো পাওয়া যায়। সেগুলো লোহার গোলার বা বলের অংশ হতে পারে তবে। উপযুক্ত পরীক্ষা ব্যতীত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা সংগত নয় । দুর্গের সীমানার উত্তর-পূর্ব কোণে কয়েকটি সুন্দর ভাবে কাটা পাথরখণ্ড দেখা যায়। একটি পাথর খণ্ডের গায়ে গোঁজের সুস্পষ্ট দাগও আছে। সম্ভবত দুর্গের স্থাপত্য কর্মের সংযোজক ছিলনা । কোনো পাথরের প্রাসাদ থেকে বা কোনো পাথরের নির্মাণ থেকে এগুলি আনা হয়েছিল। কী কারণে কোথা থেকে এগুলো সংগ্রহ হয়েছিল বলা যায়না। এই দুর্গের সামান্য পূর্বে প্রবাহিত হচ্ছে সুখানি নদী এবং সাড়ে চারমাইল দূরে রায়ডাক নদী প্রবাহিত হচ্ছে।
চিলারায়ের গড়ের দেড় মাইল দূরে দক্ষিণ-পূর্ব ও রায়ডাক নদ থেকে আড়াই মাইল উত্তর-পশ্চিমে কামাত ফুলবাড়ি মৌজায় আরেকটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় । এটি সাধারণের কাছে পরিচিত #চিলারায়ের_বড়_কোট নামে।
এই চিলারায়ের বড়কোট নামক দুর্গটি প্রকাণ্ড এবং প্রথমটির মতো আয়তাকার। মাটির উঁচু-নিচু প্রাকার দিয়ে ঘেরা । প্রাচীরটি প্রায় ৮ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট চওড়া। পূর্ব পশ্চিম বরাবর পাঁচিলটি উত্তর ও দক্ষিণের পাঁচিলের থেকে লম্বায় বেশি হবে। পূর্বদিকের পাঁচিলের গায়ে প্রায় পাঁচ ফুট পরিমিত খোলা জায়গায় গড়ের প্রবেশ পথ ছিল বলে মনে করা হয়। প্রথম দুর্গের মতোই এ দুর্গের ভিত্তিও ইঁট এবং চুন দিয়ে শক্ত করা হয়েছিল। এই দুর্গটিরও বাহির ও অন্দর দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। দুর্গের বাহির মহলের দক্ষিণ পূর্ব কোনে স্তূপকার অনেক আস্ত ইঁট এবং টালি দেখা যায়।
নিকটেই এক সাধুর আশ্রমের মধ্যেও কিছু অভগ্ন ইঁট এবং টালি সঞ্চিত আছে । কয়েকটির আকৃতি দেখে মনে হয় যে সেগুলি দেওয়ালের বা ভিতের কোণে ব্যাবহৃত হয়েছিল। কিছু L আকৃতির ইঁট পাওয়া যায় , যা হয়তো দেওয়ালের বন্ধনীর জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল ।দ্বিতীয় দুর্গটির জমি পাশের জমি থেকে বেশ উঁচু । এর তিন দিক দিয়ে প্রবাহিত খড়খড়িয়া বা চকচকিয়া নদী দ্বারা সুরক্ষিত। কিছুকাল আগেও নাকি এই দুর্গের অনতি দূরে , রায়ডাকের তীরে চিলারায়ের নির্মিত বন্দর , শস্যাগার ও দীঘি দেখা যেত। এখন সব রায়ডাকের গর্ভে নিশ্চিহ্ন।
ইতিহাস অনুসারে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে দুর্গগুলির ইঁটের দেওয়াল পুরোপুরি ভেঙ্গে যায়। পরে এই এলাকাকে কেন প্রত্নক্ষেত্রে পরিণত করা হল সেটা একটা প্রশ্ন থেকে যায়। হয়ত আমরা ইতিহাসকে সংরক্ষণ করার স্বাভাবকে আয়ত্ত করতে পারিনি।
এখন এই গড় এলাকার বন কেটে বসত তৈরি হয়েছে। প্রাচীন কিছু চিন্হ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই গড়ে। এখানে অলঙ্কৃত পদ্মফুল, লতা, পাতা আঁকা পোড়া মাটির কিছু কাজ দেখা যায়। আকারে ছোট। টালির ন্যায় পাতলা। গৃহ অলঙ্করণে এগুলির ব্যবহার করা হতো।অনেকে এখন এসব ইঁট সংগ্রহ করে রাখেন এখানে এখন খেলার মাঠ, জলাশয়, শ্মশান , বসতবাড়ী তৈরি হয়েছে। সামাজিক বন সৃজন প্রকল্পের অধীনে বৃক্ষ রোপন হয়েছে। এখানে একটি স্থানীয় কালী মন্দির আছে। সেই মন্দিরের পাশেই তিনটি বড় মাপের পাথর রয়েছে ,যাতে গোঁজের চিন্হ দেখা যায়।
#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১ . পশ্চিমবঙ্গের পুরাকীর্তি২. কোচবিহারের পুরাকীর্তি৩. ইতিকথায় কোচবিহার