শুক্রবার সন্ধ্যায় অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্য সচিব অনিল চন্দ্রকে নির্বাচন কমিশন রাতারাতি সরিয়ে দিতেই বাংলায় শাসক দলের অন্দরেও আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছিল, কমিশনের নজরে কি এ বার বাংলা?
হলোও তাই। বাংলায় সাত দফায় লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট গ্রহণ শুরু হবে ১১ এপ্রিল। তার আগে কলকাতা ও রাজ্য পুলিশে বড় ধরনের বদলির নির্দেশ দিল নির্বাচন কমিশন। কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদ থেকে অনুজ শর্মাকে সরিয়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল তথা সিনিয়ার আইপিএস অফিসার রাজেশ কুমারকে সেই পদে বসানোর নির্দেশ দিল কমিশন। সেই সঙ্গে বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার পদ থেকে রাতারাতি সরিয়ে দেওয়া হল জ্ঞানবন্ত সিংহকে। তাঁর পরিবর্তে বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের নতুন কমিশনার হলেন নটরাজন রমেশ বাবু। তিনি এডিজি এবং আইজিপি অপারেশন পদে ছিলেন। এ ছাড়াও তাৎপর্যপূর্ণ ভাবেই বদলে দেওয়া হল, ডায়মণ্ডহারবার ও বীরভূমের পুলিশ সুপারকে।
ডায়মণ্ডহারবারের পুলিশ সুপার ছিলেন এস সেলভামুরুগান। তাঁকে সরিয়ে ওই পদে কলকাতা আর্মড পুলিশের ডেপুটি কমিশনার শ্রীধর পাণ্ডেকে বসিয়েছে কমিশন। অন্যদিকে বীরভূমের পুলিশ সুপার পদ থেকে শ্রীশ্যাম সিংহকে সরিয়ে সেখানে বসানো হয়েছে বিমানবন্দর এলাকার ডেপুটি কমিশনার আভান্নু রবীন্দ্রনাথকে।
পঞ্চায়েত ভোটের সময় ডায়মণ্ডহারবার ও বীরভূমেই সব থেকে বেশি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে নিয়েছিল তৃণমূল। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের কাছে আগেই সবিস্তার রিপোর্ট পেশ করে অভিযোগ জানিয়েছিল বিরোধীরা।
এ ব্যাপারে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল অবশ্য এখনও দলীয় তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তবে ঘরোয়া আলোচনায় দলের নেতারা স্বীকার করছেন, কমিশনের তরফে এমন পদক্ষেপের আশঙ্কা তাঁদের ছিলই। গোটা ঘটনায় মুকুল রায়ের বড় ভূমিকা রয়েছে বলেও মনে করছেন তৃণমূলের অনেকে। কারণ, কলকাতা ও রাজ্য পুলিশের এই অফিসারদের বিরুদ্ধে লাগাতার কমিশনের কাছে গিয়ে অভিযোগ জানিয়েছিলেন মুকুলবাবু। তাঁর স্পষ্ট অভিযোগ ছিল, এঁদের তত্ত্বাবধানে ভোট হওয়ার চেয়ে, না হওয়া ভাল। সেক্ষেত্রে কমিশন বরং ভোট না করিয়েই তৃণমূলের প্রার্থীদের সার্টিফিকেট দিয়ে দিক।
বাংলায় ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু করানোর জন্য নির্বাচন কমিশন যে এ বার ত্রুটি রাখবে না সেই বার্তা মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরা এ বার গোড়া থেকেই দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে নিরপেক্ষতার বার্তাও দিচ্ছে কমিশন। বাংলায় বিশেষ পুলিশ পর্যবেক্ষক হিসাবে প্রথমে বিএসএফের প্রাক্তন ডিজি কে কে শর্মাকে নিয়োগ করেছিল কমিশন। কিন্তু কমিশন তা ঘোষণা করতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি ছবি দেখিয়ে অভিযোগ করেন, কে কে শর্মা আরএসএস ঘনিষ্ঠ। তিনি ভোটে পক্ষপাত করতে পারেন। তৃণমূলের ওই অভিযোগ পেয়ে কে কে শর্মাকে বিশেষ পুলিশ পর্যবেক্ষক পদ থেকে সরিয়ে দেয় কমিশন। পরিবর্তে ওই পদে বসানো হয় অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার বিবেক দুবেকে।
তার পর পরই মুকুল রায় সহ বিজেপি নেতারা দাবি করেন, একটি ছবি দেখিয়ে যদি প্রমাণ করা যায় কে কে শর্মা আরএসএস ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তা হলে বাংলায় সেই উদাহরণ ভুরি ভুরি। এই বলে পরদিনই তিনি বিবেক দুবের সঙ্গে দেখা করে একগুচ্ছ ছবি তুলে দেন তাঁর হাতে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল সম্প্রতি মমতার ধর্মতলার ধর্না মঞ্চের ছবি। যেখানে অনুজ শর্মা ও জ্ঞানবন্ত ছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার জ্ঞানবন্ত সিংহ বা তৎকালীন আইজি আইন শৃঙ্খলা অনুজ শর্মার ধর্না মঞ্চে কোনও ভূমিকা ছিল না। মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য ওখানে দায়িত্ব ছিল কলকাতা পুলিশের। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হিসাবে তাঁরা তাবেদারি করতে গিয়েছিলেন বলে মুকুল অভিযোগ করেন।
শুধু মুকুলবাবু নন, অনুজ শর্মা ও জ্ঞানবন্তের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে বাকি বিরোধী দলেরও। সেই সঙ্গে বিরোধী দলের এও অভিযোগ ছিল বীরভূম ও ডায়মণ্ডহারবারের পুলিশ সুপার তৃণমূলের জেলা সভাপতির মতো কাজ করছেন। ওঁরাই জেলায় তৃণমূল চালান।
পর্যবেক্ষকদের মতে, কমিশন এখানেই থামবে বলে মনে হয় না। ভোট চলাকালীন পুলিশ ও প্রশাসনের উচ্চ ও মাঝারি পদে আরও বদলের সম্ভাবনা থেকেই গেল।