শরশয্যাগত ভীষ্ম; ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে যোগধর্ম বিষয়ে জানাচ্ছেন নানান কাহিনী, শোনাচ্ছেন নীতি কথন। কখনও মৃত্যুর উৎপত্তি বর্ণনা করছেন, কখনও ধর্মাধর্ম প্রস্তাবে হরিনামের মাহাত্ম্য বলছেন, শোনাচ্ছেন ভদ্রশীল ও ধনুর্ধ্বজের উপাখ্যান, পাপ বিশেষে নরক গমনের কথা, ধর্মফল, একাদশী মাহাত্ম্য, একাদশী ব্রতোপলক্ষে যজ্ঞমালীর উপাখ্যান, বীরবাহু রাজার উপাখ্যান, হরিমন্দির মার্জনের ফল, দানধর্ম, প্রয়াগ মাহাত্ম্য ইত্যাদি। এসব বিষয়ের মধ্যেই ভীষ্ম শোনালেন পরশুরামের তীর্থপর্যটনের কথা।
কাশীরাম দাস প্রণীত মহাভারতের শান্তিপর্বে পরশুরাম বিষয়ে ভীষ্ম কী বিবৃত করেছেন, তা আলোচনা করবো। যুধিষ্ঠির পিতামহকে প্রশ্ন করছেন, ভৃগুবংশমণি মহা ধর্মশীল পরশুরাম কেন মাতৃবধ করলেন, যে মাতা সর্বগুরুর চাইতেও শ্রেষ্ঠ?
ভীষ্ম বলছেন সেই কাহিনী, বিখ্যাত তপস্বী জমদগ্নির রেণুকা নামে গুণবতী ভার্যা ছিলেন। পুত্রবাঞ্ছা করে স্বামীসেবা করলে তিনি পাঁচ পুত্রের জননী হলেন, কনিষ্ঠ পুত্রের নাম ভৃগুরাম বা পরশুরাম। পুত্রেরা বশিষ্ঠ মুনির কাছে ধনুর্বেদ শিখলেন এবং তার মধ্যে ত্রিভুবনের অন্যতম বীর হয়ে উঠলেন পরশুরাম। এদিকে পুত্রদের ছলনা করবার জন্য একবার সহধর্মিণী রেণুকাকে জল আনতে পাঠালেন জমদগ্নি। বিন্দু-সরোবর থেকে জল আনতে হবে। “শীঘ্রগতি জল আনি দেহ ত আমারে।/তর্পণ করিব আমি, জানাই তোমারে।।/শুনিয়া কলসী আনি অতি শীঘ্রতর।/জল আনিবারে যায় বিন্দু-সরোবর।।” জল আনার পথে ঘৃতাচী অপ্সরার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে নিরীক্ষণ করতে গিয়ে কিছুটা বিলম্ব হল তার। আর তাতেই ক্রোধিত হলেন মুনি। পুত্রদের ডেকে জননীর মাথা কাটতে আদেশ দিলেন তিনি। “জননীর মাথা কাটি আনহ ত্বরিত।/এত শুনি জ্যেষ্ঠ পুত্র হইল চিন্তিত।।/মাতৃবধ-পাপ চিন্তি না শুনিল বাণী।/আর তিন পুত্রে ডাকি বলে মহামুনি।। /কেহ না শুনিল বাক্য, ক্রোধে মুনিবর।/কনিষ্ঠ নন্দন রামে বলিল সত্বর।।/জননী সহিত কাটি চারি সহোদর।/আমার আজ্ঞায় তাত ফেলাহ সত্বর।।”
পরশুরাম দেরী না করে চার ভ্রাতার সঙ্গে নিজ জননীর মাথা কেটে ফেললেন। পিতৃআজ্ঞা পালিত হয়েছে দেখে তুষ্ট হয়ে জমদগ্নি ঋষি পুত্রকে চিরজীবী হবার বর দিলেন৷ আর ইচ্ছে মতো বর চাইবারও অনুমতি দিলেন। পরশুরাম তখন পিতার চরণে নিবেদন করলেন, “যদ্যপি আমারে পিতা তুমি দিবে বর।/জীউক আমার মাতা চারি সহোদর।।/ইহা শুনি সৌম্যদৃষ্টে চাহে তপোধন।/ভার্যা সহ জীয়াইল চারিটি নন্দন।।”
কিন্তু মাতৃবধ-জনিত পাপ তখন পরশুরামের দেহে সঞ্চারিত হয়েছে। “মাতৃবধ সঞ্চারিল রামের শরীরে।/না খসে হাতের টাঙ্গি, পড়িল ফাঁফরে।।….আয়ুধের ভরে আত্মা ধড়ফড় করে।/সংশয় জীবন তাত দেখহ আমারে।।” কীভাবে হাত থেকে টাঙ্গি খসবে তার উপায় দেখতে অনুরোধ করলেন পিতাকে। তখন পিতা ধ্যানযোগে উপায় জেনে পুত্রকে বললেন, “নিরাহার-ব্রতী হয়ে এক সম্বৎসর।/মান অহঙ্কার ত্যজি শিরে জটা ধর।।/পৃথিবীর যত তীর্থ করহ ভ্রমণ।/তবে ত তোমার পাপ হইবে মোচন।।” সব তীর্থ পরিভ্রমণ করে কোশল নগরে বিষ্ণুযশা নামে ব্রাহ্মণের বাড়ি গিয়ে তার কাছে জিজ্ঞাসা করার পরামর্শ দিলেন তিনি।
পিতার উপদেশে পরশুরাম তীর্থ পর্যটনে বেরোলেন, “গয়া গঙ্গা বারাণসী করিল ভ্রমণ।/তদন্তরে প্রভাসেতে করিল গমন।।/তার পরে হরিদ্বারে গেল মহামতি।/বদরিকাশ্রমে উত্তরিল শীঘ্রগতি।।” অতঃপর তিনি মান-সরে গেলেন, গেলেন বিন্দুক্ষেত্রে বিন্দুসরে, উত্তরের পথে সমস্ত তীর্থক্ষেত্রে, দ্বারকায়, ইন্দ্রদ্যুম্ন-সরোবর, সরযূ, কেদার, গোদাবরী, বৈতরণী, রেবা নদী। তারপর পৌঁছালেন বিষ্ণুযশার গৃহে। তিনি উপদেশ দিলেন, “ব্রহ্মহ্রদে গিয়া স্নান করহ ত্বরিত।/তবে ত হাতের টাঙ্গি হইবে স্খলিত।।” ব্রহ্মা-সৃজিত সেই হ্রদের জলে নামলে স্নানার্থীকে ডুবিয়ে মারে তার চক্রাকারে ঘুর্ণায়মান জলস্রোত। তার বর্ণনা আছে কাহিনীতে, “চক্রাকারে ঘুরে জল ঘূর্ণ্যমান বায়।/সেই হ্রদে যেই স্নান করিবারে যায়।।/দৃষ্টিমাত্রে জল তার উঠে উথলিয়া।/ডুবায়ে মারিতে বারি যায় খেদারিয়া।।” কেবলমাত্র পুণ্যাত্মার জীবনরক্ষা হয় ওই অবগাহনে, তাই ওই হ্রদে কেউই স্নান করতে সাহসী হন না।
এখন সেই হ্রদে ব্রহ্মর্ষি সুতপা শাপগ্রস্ত হয়ে কুমির রূপে অবস্থান করছিলেন, যার শাপমোচন হবে ভৃগুপতির আগমনে। ব্রহ্মা অভিশাপ দিয়েছিলেন তাকে। কীভাবে শাপমোচন হবে? “কতদিন পরে তবে হইবে মোচন।।/ভৃগুপতি যাবে মাতৃবধ খণ্ডিবারে।/তাবৎ থাকিবে সেই হ্রদের ভিতরে।।/টাঙ্গির প্রহারে হ্রদদ্বার করি চির।/স্নান করিবারে তথা যাবে ভৃগুবীর।।/সেইক্ষণে গ্রাহরূপ ত্যজি শীঘ্রগতি।/তদন্তরে জীব অংশে হইবে উৎপত্তি।।”
এখন পরশুরাম চললেন সেই ব্রহ্মহ্রদ-কূলে, তাঁকে দেখে জল উথলে ধেয়ে এলো যেন পর্বত-প্রমাণ নীর। শোষক মন্ত্রে ঘোর জলরাশি নিবারণ করলেন পরশুরাম, হ্রদদ্বার টাঙ্গির আঘাতে মুক্ত করলেন। “হ্রদে স্নান করি তবে করিল তর্পণ।/খসিল হাতের টাঙ্গি, আনন্দিত মন।।তখন সেই শাপগ্রস্ত ভয়ঙ্কর কুমীর পরশুরামের চরণে আসলো, তিনি কুমীরকে কূলে তুললেন।
” সহসা কুম্ভীর সেই অতি ভয়ঙ্কর।/রামের চরণে আসি ধরিল সত্বর।।/ধরিয়া কুম্ভীরে কূলে তোলে ভৃগুমণি।/শাপে মুক্ত হয়ে গ্রাহ ছাড়িলো পরাণী।।” শাপমুক্তি হয়ে গ্রাহ ছাড়লো সেই কুমীর। শাপমোচন হল পরশুরামেও।
১.
কাশীদাসী মহাভারতের আদিপর্বে বিষ্ণুর পরশুরাম অবতার গ্রহণ সম্পর্কে পর্বাধ্যায় রয়েছে। তা থেকে জানা যায়, পৃথিবীব্যাপী ক্ষত্রিয়গণ কদাচারে মহামত্ত হলে জনার্দন শ্রীবিষ্ণু লোকহিংসা সহ্য করতে পারলেন না।
“পৃথিবীর মধ্যে ক্ষত্র হইল অপার।
মহামত্ত হৈয়া সবে করে কদাচার।।”
সেই প্রেক্ষিতেই ভৃগুবংশে জমদগ্নি কুমাররূপে তাঁর আবির্ভাব হল, পরশুরাম; হাতে কুঠার, বারংবার তিনি পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রা করে তা সাধারণ মানুষের বাসযোগ্য করে তুললেন।
“করেতে কুঠার জমদগ্নির কুমার।
নিঃক্ষত্রা করিল ক্ষিতি তিন সপ্ত বার।।”
অত্যাচারী ক্ষত্রিয় নিধনে গিয়ে পৃথিবীতে কোনো ক্ষত্রিয়কেই বাদ রাখলেন না তিনি, এমনকি ক্ষত্রিয় বংশের দুধের শিশুটিকেও হত্যা করলেন। সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার জন্যই কদাচারী ক্ষত্রিয় শাসকদের একে একে সবংশে বিনাশ করতে লাগলেন।
“ক্ষত্র ব’লে ক্ষিতি মধ্যে না রাখিল রাম।
মারিল দুগ্ধের শিশু ক্ষত্র যার নাম।।”
এরপর ব্রাহ্মণের হাতে রাজ্যপাট সঁপে দিয়ে তপোবনে গেলেন পরশুরাম। এদিকে ব্রাহ্মণদের দিয়ে রাজকার্য হচ্ছিলো না। কাজেই বিপ্রগৃহে ক্ষত্রিয় স্ত্রীগণ গমন করলেন, ফলে সমুৎপন্ন হল ক্ষেত্রজ তনয়।
“রাজকর্ম বিপ্রগণে সম্ভব না হয়।
সে কারণে সমুৎপন্ন ক্ষেত্রজ তনয়।।
ক্ষত্র মাতা বিপ্র পিতা হইল কুমার।
পুনঃ ক্ষিতিমধ্যে হৈল ক্ষত্রিয় সঞ্চার।।”
এভাবে পৃথিবীর রাজারা নিষ্পাপ হলেন, তাদের মধ্যে পরম ধার্মিকতা প্রবেশ করল, বংশ বাড়লো এবং ধর্মভাবে প্রজাপালন চলতে লাগলো। রাজ্যে রাজ্যে অকাল মৃত্যু রোধ হল। সবাই নিজ নিজ বৃত্তি অনুযায়ী কর্মে মনোনিবেশ করলেন। রাজারা রাজ্যশাসনগুণে দ্বিতীয় দেবরাজ হয়ে উঠলেন।
“পাপের প্রসঙ্গ নাহি, ধর্মেতে তৎপর।
সাগর অবধি ক্ষিতি পূর্ণ হৈল নর।।
স্বর্গের বৈভব পূর্ণ হৈল ক্ষিতিমাঝ।
রাজগণ হইল দ্বিতীয় দেবরাজ।”
চিত্র: শীর্ষ আচার্য (Sirshya Acharya)
কল্যাণ চক্রবর্তী (Kalyan Chakraborty)