১৯০৬এ ভারতে (India) প্রথম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ (Muslim League) তৈরী হয় আর তার বছর কুড়ি পর ১৯২৫/১৯২৭ নাগাদ মোহাম্মদ ইলিয়াস আল-কান্ডলাউই (Mohammed Elias Al-Kandlawi) , এখন যেখানে হরিয়ানা রাজ্য তারই এক এলাকা, মেওয়াতে (Mewa) , তাবলিগী জামাত সংগঠনের জন্ম দেন। তাবলিগ জামাত এক ইসলাম প্রচারকারি সংগঠন। যদিও এতে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সদস্য পদ নেই, তবে দাবী করা হয় ১৮০ থেকে ২০০ টা দেশ জুড়ে তাবলিগী জামাতে (Tabligh Jamaat) সক্রিয় সদস্য আছে পনেরো থেকে পঁচিশ কোটি মুসলমান। পৃথিবীর কোন সংগঠনে এত সদস্য আছে বলে মনে হয় না। অত্যন্ত রক্ষণশীল ও ইসলামী মৌলবাদী এই সংগঠন প্রায় একশো বছর ধরে ইসলামকে কোন রকম আধুনিক সংস্কারের প্রচেষ্টা থেকে বাঁচিয়ে ১৪০০ বছর আগে তাদের বিশ্বনবী মহাম্মদের সময়কার ইসলামী জীবন শৈলীতে বেঁধে রাখার জন্য প্রচার ও প্রসার চালিয়ে আসছে। প্রায় নারী বর্জিত এই সংগঠনের নানা বয়সের পুরুষ সদস্যরা ছোট ছোট দলে ‘চিল্লা’ করতে চল্লিশ দিনের জন্য বেরিয়ে পড়ে। তাদের পরিবারের সদস্যরা জিজ্ঞাসা করতে পারেনা চিল্লার গন্তব্য। তাবলিগীরা এক এলাকায় গিয়ে প্রথমে সেখানকার এক বা একাধিক মসজিদে ওঠে এবং সেখানে স্থানীয় মুসলমানদের ইসলামের মূল শিক্ষায় ও জীবন শৈলীতে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রচার শুরু করে। পরিবারে মহিলাদের মধ্যে কঠোর পর্দা প্রথা, গান বাজনা, ফটো, ছবি আঁকা বা তার ব্যবহার বর্জন, বাড়ী থেকে রেডিও/ টিভি বহিষ্কার, খাদ্যভ্যাসে কঠোর ভাবে হালালের নিয়ম মানা, কাজের মধ্যেও নিয়মিত পাঁচবার নামাজ পড়া এবং কঠোর ভাবে রোজা রাখার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। কোরাণ ও বিভিন্ন হাদিসের আলোকে সমস্ত শিক্ষা চলে। এর পর তাবলিগীরা বিভিন্ন মুসলমানদের বাড়ীতে গিয়ে সেখানে পরিবারের নারী, পুরুষ ও শিশুরা ইসলামী জীবন ধারায় চলে কিনা তা দেখে এবং সঠিক ও কঠোর ভাবে পালন করার শিক্ষা দেয়। সমস্ত পরিবার যেন সঠিক এবং মৌলবাদী ইসলামী পদ্ধতিতে জীবন অতিবাহিত করে সে ভাবে সবাইকে অভ্যাস করায়। তাবলিগী জামাতের আর একটি বড় কাজ অন্য ধর্মের মানুষদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করা। বলা বাহুল্য ক্রমাগত এই প্রচারের মাধ্যমে তাবলিগ সদস্য সংখ্যা বহুগুন বেড়েই চলে। একশো বছরের কম সময় উত্তর ভারতের একটা ছোট্ট আঞ্চলিক ধর্ম সংগঠন এখন পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ ইসলামী মৌলবাদী সংগঠনে পরিনত হয়েছে। মুসলিমদের মধ্যে তাবলিগের প্রতি আকর্ষন এতটাই যে ১৯৪১এ তাবলিগের সন্মেলনে ২৫০০০ মুসলমান জমায়েত হয়েছিলো। বলা বাহুল্য, কংগ্রেস নেতা গান্ধীর বহু ত্যাগ স্বীকার, আবেদন, নিবেদন ও চেষ্টা সত্বেও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের অংশগ্রহন প্রায় ছিলোই না। অথচ ১৯৪৬ সালে যখন ভারত জুড়ে পাকিস্তানের পক্ষে, মুসলিমদের ইসলামী আন্দোলন তুঙ্গে, তখনই তাবলিগী জামাতের প্রসার হঠাৎ বৃদ্ধি পায়। এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পরে সেই দেশের তাবলিগ শাখা ফুলে ফেঁপে ওঠে। এরপর ‘৭১ এ পাকিস্তান ভেঙে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বাংলাদেশ সৃষ্টির কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের সদস্য সংখ্যা পৃথিবীর মধ্যে সর্ব বৃহৎ হয়ে দাঁড়ায়। দিল্লীর নিজামুদ্দিন (Nizamuddin) এলাকায় তাবলিগ মার্কাজ তাবলিগি জামাত বিশ্ব সংগঠনের কেন্দ্র। যদিও দাবী করা হয় তাবলিগ, সক্রিয় রাজনীতি বা হিংস্র জিহাদে অংশগ্রহন করবে না, কিন্তু স্পষ্টতই তারা মৌলবাদী ইসলামের প্রচারের মাধ্যমে জিহাদের জন্য জমি প্রস্তুত করে। বিভিন্ন দেশের পুলিস ও গোয়েন্দা রিপোর্ট পরিস্কার ভাবে বলে যে সারা পৃথিবী জুড়ে তাবলিগ থেকে বিপুল সংখ্যক হিংস্র জিহাদী তৈরী হয় এবং সন্ত্রাসে অংশ গ্রহন করে। FBI এর তথ্য অনুযায়ী আমেরিকার তাবলিগ সদস্য ৫০০০০ এরও বেশী, বৃটেনে ৬০০ র বেশী মসজিদ তাবলিগ সদস্যরা নিয়ন্ত্রণ করে। ফ্রান্সে তাবলিগ জামাতের সদস্য সংখ্যা ২০০৬ এই ছিলো লক্ষাধিক। যখন চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের সংক্রামনে ২০২০ র ফেব্রুয়ারী পর থেকে সারা বিশ্বে নির্মম ভাবে বহু মানুষ রোজ মারা যাচ্ছে তখন মার্চ মাসে দিল্লীর তাবলিগ মার্কাজে হাজার হাজার তবলিগী জামাত সদস্যরা জমায়েত হয়। তাদের মধ্যে অন্তত ১৩০০ জন ছিলো বিদেশী। তারা আমেরিকা, বৃটেন, ইটালী, ফ্রান্স, বেলজিয়াম সহ বহু এশিয়া ও আফ্রিকার মুসলমান এবং তাবলিগ জামাতের সক্রিয় সদস্য। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, কিরঘিজস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েৎনাম, সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া , আলজিরিয়া, কঙ্গো, আইভরিকোস্ট, মিশর, ইথিওপিয়া, ফিজি, গাম্বিয়া, ইরান, জর্ডান, কাজাখস্থান, কেনিয়া, মাদাগাস্কার, মালি, ফিলিপিন্স, কাতার, রাশিয়া, সেনেগাল, সিয়েরালিওন, দক্ষিন আফ্রিকা, সুদান, সুইডেন, তানজানিয়া, টোগো, ত্রিনিদাদ, টোবাগো, ◦ টিউনিশিয়া, ইউক্রেন এবং আরও ছয়টি দেশ থেকে নিজামুদ্দিনে আসে। তাদের মধ্যে বহু মুসলমান করোনা ভাইরাস (Corona virus) বহন করছিলো। জমায়েত কালিন খুব কাছাকাছি গোষ্ঠীবদ্ধ কয়েক দিন কাটানোর সময় করোনা রোগের সংক্রমণ হয়। এবং যখন নহাজার ভারতীয় তাবলিগী জামাতের সদস্য যারা ঐ সম্মেলনে এসেছিলো অচিরেই তারা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। এবং তাদের সঙ্গে ছড়িয়ে পরে মারণ ভাইরাস

তাবলিগী জামাত আগেই গ্রামে পৌঁছে গেছে।
বছর পঞ্চাশের সাকিলা বিবির (Shakila Bibi) বাড়ী, মুর্শিদাবাদে সালারের কাছে একটা ছোট গ্রামে। স্বামী অনেক আগেই মারা গেছেন। বাড়ীতে ছেলে, বৌ আর ছোট নাতনী। পারুল বিবি কলকাতায় এক বাড়ীতে বৃদ্ধার দেখাশোনা করেন। কর্মঠ, পরিস্কার আর দয়ালু সাকিলা বিবি কলকাতার এক এজেন্সীর মারফত ভারতের প্রায় সব বড় শহরে বৃদ্ধ, শিশু বা সদ্য মা হওয়া মহিলাদের সেবা করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। নানা সমাজ, নানা ভাষা ভাষী পরিবারে থেকেছেন, খেয়েছেন। তাদের অনেক উপহার, আশির্বাদ, শুভেচ্ছা পেয়েছেন। সাকিলা বিবি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর সর্বভারতীয় অভিজ্ঞতার কথা বলেন।
২০২০র ৮/৯ এপ্রিল শবেবরাত। মুসলমানরা বিশ্বাস করে শবেবরাতের রাতে তাদের পরের বছরের জন্য বরাত বা ভাগ্য নির্ধারিত হয় এবং তাদের আল্লা তাদের পাপ মাফ করে দেন। মৃত পুর্বপুরুষদের পাপস্খালনের জন্য প্রথাগত ভাবে বিশেষ ভাবে রোজা (উপোষ)রাখা হয়, নামাজ পড়া হয়, কোরান পড়া হয়, তাদের কবরে প্রদীপ বা মোমবাতি জ্বালানো হয়। বাড়ীতে বিভিন্ন প্রকার হালুয়া তৈরী করে খাওয়া এবং বিতরন করা হয।
কলকাতার বাড়ীর গৃহকর্ত্রী মুসলমান। সাকিলা বিবি গৃহকর্ত্রী কে জিজ্ঞাসা করেন শবেবরাতে তিনি একদিনের জন্য, কাছে থাকা তার মাসির (খালার) বাড়ী একদিনের জন্য যেতে পারেন কি না। সেখানে নামাজ রোজা ইত্যাদি করবেন। কলকাতার গৃহকর্ত্রী করোনা ভাইরাসের কারনে সাকিলা বিবিকে ছাড়তে রাজী নন। তিনি বলেন এই বাড়ীতেই রোজা, নামাজ, হালুয়া, মোমবাতি জ্বালানো সব করতে। সাকিনা বিবি খুশি। তবে বলে, যে মোমবাতি জ্বালানো যাবেনা। ওটা শেরেক!! ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের মধ্যে মোমবাতি বা ধুপ জ্বালানো, দরগায় উপাসনা, ইত্যাদি অত্যন্ত প্রচলিত প্রথা। মৌলবাদীরা এইসব প্রথাকে মূর্তি পুজোর সমান বা শেরেক (শির্ক) বলছে। এবং কোটি কোটি ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে মৌলবাদী প্রথা কয়েমের মাধ্যমে তাদের সাচ্চা মুসলমান তৈরী হওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে ও ভয় দেখাচ্ছে। এই কাজ হচ্ছে বাড়ীর পুরুষদের মাধ্যমে, যাদের মসজিদে শিক্ষা দিচ্ছে প্রধানত তাবলিগ জামাত সদস্যরা। সারা পৃথিবীর মুসলমানরা যেন সহি বা সাচ্চা মুসলমান হয়ে মৌলবাদী ও কঠোর ইসলামী জীবন শৈলী মেনে চলে, তা কায়েম করার জন্য বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামেও ইসলামের দূতরা পৌঁছে গেছে। এই দূতরা তাবলিগী জামাত। গ্রামের সাকিলা বিবিরা, যারা বছর কয়েক আগেও মাথায় ঘোমটা দিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে নামাজ পড়তো। বাড়ীর শিশুদের, প্রতিবেশীদের হালুয়া দিয়ে শবেবরাত পালন করতো। তারা এখন ঐ সব ‘অনৈস্লামিক’ প্রথা বাদ দিয়ে নিজেদের আরবের মুসলমানদের সঙ্গে এক লাইনে নিয়ে আসছে। দাবানল লেগে গেছে। এবং প্রায় ২০০ টা দেশে কুড়ি পঁচিশ কোটি তাবলিগ জামাতের সদস্যরা ইসলামের যোদ্ধাতারা সারা পৃথিবী জুড়ে ১৪০০ বছর পুরোনো আরবী এবং ইসলামী ঝড় তুলছে

গৌতম বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.